Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

অণুগল্প19/12/2020
নিতাই
শিবাজী সান্যাল
           চারদিকে গ্রাম , মাঝখানে এই বাজার। সপ্তাহে দুদিন বাজার লাগে , বাকি দিনগুলোতে দোকানপাট অবশ্য খোলাই থাকে। এমনই একটি দোকান শিবেনের। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসই পাওয়া যায়। বউ সীতা আর…

 


অণুগল্প

19/12/2020


নিতাই


শিবাজী সান্যাল


           চারদিকে গ্রাম , মাঝখানে এই বাজার। সপ্তাহে দুদিন বাজার লাগে , বাকি দিনগুলোতে দোকানপাট অবশ্য খোলাই থাকে। এমনই একটি দোকান শিবেনের। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসই পাওয়া যায়। বউ সীতা আর ছেলে নিয়ে ছোট্ট সংসার , সুন্দর নির্বিবাদ জীবন । কিন্তু কপালে টিকল না , অসুস্থ হল সীতা , কাছের শহরে নিয়ে গিয়ে যথাসম্ভব চিকিৎসা করালো শিবেন , তবুও শেষে সবাইকে ছেড়ে সীতা স্বর্গবাসী হল। নিতাই তখন মাত্র চার বছরের , মা হারিয়ে ছেলেটা উদাস হয়ে ঘুরে বেড়াতো , ওর খাওয়া দাওয়া , পড়াশোনা বা দেখাশোনা , শিবেনের দোকান সামলে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। তাই কয়েকবছর পরে বড়দের উপদেশে ও আবার একটি বিয়ে করল। কিন্তু মূলতঃ যে উদ্দেশে বিয়ে করা , মানে নিতাইয়ের দেখাশোনা তা হল না। প্রথম থেকেই অনিমা নিতাইকে পছন্দ করেনি আর নিতাইও ওকে মায়ের জায়গায় মেনে নিতে পারে নি। বরং অনিমা আসার পর থেকে ও যেন আরও উশৃঙ্খল হয়ে উঠতে লাগল। পাড়া প্রতিবেশীদের ওকে নিয়ে নানা অভিযোগ , অনিমার নিত্যদিন কিচকিচ , স্কুল থেকে ওর দস্যিপনার কথা বাড়তে লাগল। শিবেন অনিমাকে অনেক বলেছে ওকে একটু ভালবেসে কাছে আনতে , ফল হয়নি , বরং শুনিয়েছে , “ তোমার অমন বখাটে ছেলে কারো কথা শোনে ? আমারই ফাটা কপাল , এই অল্প বয়সে এক ছেলের বাপ এক বুড়োকে বিয়ে করে এসে নাস্তানাবুদ হচ্ছি । ” নিতাইকেও কতবার বুঝিয়েছে , চুপ করে মাথা নামিয়ে সব শোনে , তারপর আবার যা তাই। কি করবে ভেবে শিবেন কোনো কূলকিনারা পায় না । 

              দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। বাড়ির এই নানা অশান্তির মধ্যে অনিমার কোলে একটি মেয়ে এসেছে , ফলে ও যেন নিতাইকে আরও দূরে ঠেলে দিতে চাইছে। নিতাই ছোট্ট বোনটিকে খুব ভালবাসে , কিন্তু অনিমা ওকে বিশেষ কাছে আসতে দিতে চায় না। ওর খাওয়া দাওয়া আগে যেটুকু খেয়াল রাখত এখন তাও করে না। নিতাইর এখন আঠারো বছর বয়েস , বেশ বড়সড় চেহারা আর তেমনই হিংস্র হয়ে উঠেছে। ওর বিরুদ্ধে প্রায়ই মারপিটের নানা অভিযোগ শুনে শিবেন ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে। ওকে

 নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছে , কিন্ত কোন পরিবর্তন হয় নি।একদিন অনিমার কোথাও কাছেই যাওয়ার ছিল , টুনিকে উঠোনের মাচায় শুইয়ে নিতাইকে বলল, “ টুনিকে একটু লক্ষ্য রেখো , আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি। ” নিতাই বোনকে পেয়ে ওর পাশে বসে আদর করতে লাগল , ওকে হাসাতে চেষ্টা করল।ও টুনির জন্য আনা খেলনাটা আনতে ঘরে গেল আর সেসময় টুনি মাচা থেকে পরে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। নিতাই ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিল আর তখনই অনিমা ফিরে রেগে টুনিকে ওর কোল থেকে টেনে নিয়ে একটা কড়া থাপ্পড় লাগিয়ে বলল , “ হতভাগা, বাচ্চাটাকে এটুকু সময়ের জন্যও সামলাতে পার না ? সবদিক থেকে অকর্মণ্য , এত বড় হয়ে বাপের একটা কাজে আসতে পার না , আর দুবেলা একগাদা করে গিলছো ? তোমার লজ্জা করে না - - - ? ” নিতাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে নানা জায়গায় অর্থহীন ভাবে ঘুরে বেড়ালো। নিজের ওপর ওর ধিক্কার আসছিল। মাকে ভীষণ মনে পড়ছিল। শিবেন রাতে বাড়িতে ফিরে সব শুনে নিতাইকে খুঁজতে বেরুল। অনেক জায়গা ঘুরে শেষে মন্দিরে এসে দেখল বটপাকুর ঘিরে বাঁধানো চত্বরে একরাশ শুকনো পাতার মাঝে নিতাই শুয়ে ঘুমোচ্ছে। ছেলেটার জন্য ওর খুব কষ্ট হল , ওকে ঘুম থেকে তুলে হাত ধরে ও বাড়ির দিকে রওনা হল। 

            এর তিনদিন পর শিবেন নিতাইকে নিয়ে নদীর ঘাটে এল , একটি সিঁড়িতে দুজনে পাশাপাশি বসল। নিরবতা ভেঙে নিতাই বলল , “ তোমার জন্য অনেক কিছু ভেবেছিলাম - - কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। ওপারে গিয়ে তোমার মাকে কি জবাব দেব জানি না। সবসময় তোমার কথা ভেবে অস্থির হই। তোমার কথা ভেবেই আবার বিয়ে করেছিলাম , ভেবেছিলাম তোমার দুঃখ লাঘব হবে , কিন্তু সব কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। ” শিবেনের গলা কাঁপছিল। ওরা দুজনে সামনে ঘাটে নৌকোতে লোকেদের ওঠা নামা দেখছিল। শিবেন বলল , “ তুমি এই বাড়িতে কিছুই পাবে না আর যেভাবে নিজেকে প্রতিদিন শাস্তি দিচ্ছ তাতেও এই সমস্যার কোন সমাধান হবে না। আমি কলকাতায় সুখেনের সঙ্গে কথা বলে কিছু ব্যবস্থা করেছি। ও ওখানে ওলা ট্যাক্সি চালায়। তোমার জন্য কিছু একটি কাজের ব্যবস্থা করে দেবে। এই নাও কলকাতার টিকিট , আর এই খামটা রাখো, এতে কিছু টাকা আছে। নিজের ভাগ্য , একবার চেষ্টা করে দেখ। তোমাকে ছেড়ে কি করে থাকব জানি না। সবসময় তোমার কথা মনে হবে , চিন্তা হবে , তবুও - - - , নিজের খেয়াল রেখো । ” শিবেন অনেক স্নেহে ওকে জড়িয়ে ধরল ,ওর পিঠে হাত বোলালো , চুলে বিলি কাটল , তারপর উঠে আস্তে আস্তে দোকানের দিকে হাঁটতে লাগল । নিতাই বাবার দিকে তাকিয়ে রইল ,হাতের খাম আর টিকিট দেখল তারপর ও এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা বুকের মধ্যে কষ্টটা অনুভব করল , ওর দুচোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এল।