Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#সৃষ্টি সাহিত্য যাপন# ইভেন্ট - জীবনের গল্প - ছোটগল্প # শিরোনাম - "শূন্যতায় পূর্ণতা"# নাম- কাকলি মুখার্জী ( কলি) # তারিখ - ১৬/ ১২/২০২০
        ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যতার মধ্যে দিয়ে বড়ো হচ্ছিলেন সমীরবাবু।এমনিতে খুবই আদরের…

 


#সৃষ্টি সাহিত্য যাপন

# ইভেন্ট - জীবনের গল্প - ছোটগল্প 

# শিরোনাম - "শূন্যতায় পূর্ণতা"

# নাম- কাকলি মুখার্জী ( কলি) 

# তারিখ - ১৬/ ১২/২০২০


        ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যতার মধ্যে দিয়ে বড়ো হচ্ছিলেন সমীরবাবু।এমনিতে খুবই আদরের ছিলেন। দুই দিদির পরে তিনি,  বাবা-মা দিদিদের তুলনায় তাকে একটু বেশিই ভালবাসতেন। তার সব আব্দার পূরণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন তাঁরা। অর্থাভাবের কারণে দিদিদের পড়াশোনা বেশিদূর এগোতে পারেনি, বড়দি মাধ্যমিক পাশ আর ছোড়দির উচ্চমাধ্যমিকের পর  কলেজের প্রবেশদ্বারে পা রাখা আর হয়ে ওঠেনি । সমীরবাবু পড়াশোনায় বরাবর ভালো ছিলেন তার ওপর পুত্র সন্তান তাই, বাবা নিজের হাজারো কষ্ট উপেক্ষা করে ছেলে যাতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে সেদিকে নজর রাখতেন সবসময়। 


           সমীরবাবু যখন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন তখন  তার বাবা হঠাৎ করে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেনন। সেই  বয়সে বাবাকে হারিয়ে  বড্ড অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। তার চারপাশে এমন  এক শূন্যতার সৃষ্টি হয় যা কোনদিনও পূরণ হওয়ার নয়, তবুও  সংসারের সব দায়িত্ব তাকেই কাঁধে তুলে নিতে হয়। নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর সাথে সাথে সংসারের সব খরচ জোগাড় করতেন টিউশনি করে।অতি কষ্টে দিন কাটছিল তাদের। তারপর  কলেজের পড়াশোনা শেষ করে  চাকরির বিভিন্ন পরীক্ষা দিতে দিতে মোটামুটি ভালো একটা চাকরি পেয়ে যান।  ক্রমে ক্রমে দুই দিদিরই বিয়ে দেন তিনি। 


         সমীরবাবুর মাকে নিয়ে দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিল । এমন সময় একদিন তার মা বললেন.... "বাবা  এবার তুই একটা বিয়ে কর।আমার বয়স হয়েছে, আজকাল প্রায়ই শরীরে নানারকম উপদ্রব দেখা দিচ্ছে,  কাজ করতে বড্ড কষ্ট  হয় তাছাড়া আমি চোখ বোঁজানোর আগে তোর বৌ এর মুখ দেখে যেতে চাই। " মায়ের কথা শুনে সমীরবাবু ঘোরতর আপত্তি জানান, তিনি বলেন "  বিয়ে করার কি দরকার মা? এইতো, মা - ছেলে মিলে দিব্যি কেমন সুখে আছি....?  তোমার কাজ করতে কষ্ট হচ্ছে তার জন্য আমি লোক রেখে দিচ্ছি তাহলে তো আর কোন অসুবিধা নেই?" ছেলের মুখে এই কথাগুলো শুনে পরণের কাপড়ের আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে মা বললেন " না বাবা শুধুমাত্র কাজের জন্যই নয়, তোর বাবা দিদিদের বিয়ে দিয়ে যেতে পারেননি।তুই তোর দিদিদের বিয়ে দিয়েছিস, আমার ঘরে পুত্রসম দুই জামাই এসেছে এতে আমি ভীষণ খুশী । এবার শুধু আমার একমাত্র পুত্রবধূকে ঘরে এনে তার সংসার তাকে বুঝিয়ে দিতে পারলেই আমি নিশ্চিন্ত হই".। এরপর সমীরবাবু আর কথা বাড়ায়নি। 


 এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়ে মেয়ে দেখে পছন্দ হয়ে যায়। তারপর  শ্রাবণের এক শুভদিনে ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরের লক্ষীকে ঘরে নিয়ে আসেন তার মা।


         বিয়ের দু বছরের মাথায় সমীরবাবু আর তার স্ত্রী, সোমা র একটা ফুটফুটে পুত্র সন্তান হয়।নাতিকে পেয়ে ঠাকুমা খুব খুশী হন। কিন্তু বাচ্চার বয়স যখন ছ'মাস, তার মুখেভাতের অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে তখন একদিন ডাক্তারবাবুর কাছে চেকআপে গিয়ে ধরা পড়লো, সে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। প্রথম অবস্থায় তাদের মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়, পরে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নেয় তারা। সমীরবাবু ছেলেকে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে যথাযথ চিকিৎসা চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু, ঠাকুমা একমাত্র নাতির এই অবস্থা কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। তিনি অসুস্থ হয়ে সেই যে বিছানা নিলেন, আর উঠলেন না। টানা আড়াই বছর শয্যাশায়ী থেকে তারপর একদিন ইহলোকের মায়া কাটিয়ে পরলোকে গমন করলেন। সেদিন মায়ের অভাব বড্ড কষ্ট দিয়েছিল  সমীরবাবুকে,তার  বুকে আরো এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। তবুও, অসুস্থ সন্তান আর স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলিয়ে নেন তিনি। 


         দেখতে দেখতে তাদের ছেলে যখন পাঁচ বছরে পা দেবে তখন ছেলের মা, সোমা দেবী বলেন....  "পাপানের অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানটা ঠিক মতো হয়নি, তাই পাঁচ বছরের জন্মদিন টা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালন করতে চাই "। সমীরবাবুও স্ত্রীর ইচ্ছের সাথে ইচ্ছে মিলিয়ে অনুষ্ঠানের সব আয়োজন করে ফেললেন। 


       ওইদিন সকাল থেকেই আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবে বাড়ি একেবারে গমগম করছিল। ছেলের দুই পিসি পিসেমশাই দাদা দিদি সবাই এসেছে, খুব মজা হচ্ছে তার। বড়ো পিসি পাপানকে কোলে নিয়ে বলেন " আজকের পায়েস আমি রান্না করবো " সাথে সাথে ছোট পিসি  কুহেলী বলে উঠলো "তাহলে পাপানের ফেবারিট দইপোনা টা আমি করে দিই "। দুপুর হতে না হতেই স্নান করে বাবা-মা এর দেওয়া নতুন পায়জামা পাঞ্জাবি, গলায় সোনার চেন হাতে দুই পিসির দেওয়া আংটি পরে একেবারে রাজপুত্রের বেশে ঘরের মেঝেতে তার জন্য পাতা আসনে এসে বসে পড়লো সে। মা ও পিসিরা মিলে কাঁসারের সুদৃশ্য থালা বাটিতে করে ওর পছন্দের সব খাবার এনে সাজিয়ে দিল। এবার আশীর্বাদের পালা, একে একে সকলের আশীর্বাদ করা হয়ে গেলে সমীরবাবু হাতে ধানদূর্বা নিয়ে ছেলেকে আশীর্বাদ করতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন  পাপানকে যেন বড্ড ফ্যাকাশে লাগছে, ওর চোখমুখ কেমন যেন লাগছে...... কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই পাপান সামনের ভাতের থালার ওপর ঢলে পড়ে,  সাথে সাথে ছেলেকে কোলে তুলে কয়েকজন আত্মীয় কে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি করে  ডক্টর এর চেম্বারে যান, দুর্ভাগ্যবশত ডাক্তার বাবু তখন চেম্বারে ছিলেন না, কালবিলম্ব না করে পাপানকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে ডাক্তার বাবু চেক-আপ করে বলেন পাপান আর নেই। সমীরবাবুর চারপাশ টা যেন অন্ধকার হয়ে যায়, তিনি  পাগলের মতো করতে থাকেন,  ডাক্তার বাবুর দুটো পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন " আমার ছেলেকে আমার বুকে যে করেই হোক ফিরিয়ে দিন"। কিন্তু হায়!!!! সে ক্ষমতা ডাক্তারবাবুর যে নেই.....   অবশেষে ছেলের প্রাণহীন শরীরটা তার মা কে শেষবারের মতো দেখাতে নিয়ে এলেন । ছেলের নিশ্চল নিথর দেহ দেখে সোমাদেবী শোকে পাথর হয়ে গেলেন, অনেক চেষ্টা করেও একটুও কাঁদাতে পারলেন না কেউ। একমাত্র সন্তানকে হারানো সর্বশান্ত পিতা, শুষ্ক হাহাকারের সাথে ছেলের  শেষকৃত্য সম্পন্ন করে একবুক শূন্যতা নিয়ে বাড়ি  ফিরলেন।.... তাকে দেখে ঘর থেকে উন্মাদের মতো দৌড়ে এসে তার বুকে আছড়ে পড়লেন সদ্য  সন্তানহারা হতভাগী মা। বুকফাটা চিৎকারে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন তিনি।  তারপর থেকে  সোমাদেবী মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যান, গুমরে থাকেন, কথা বলেন না। সমীরবাবু বাড়িতে ডাক্তার এনে দেখিয়েছেন, তিনি দেখে বলেছেন গভীর শোকের কারণে এই অবস্থা। ডাক্তারবাবু আরো বলেন সোমাদেবী কে একা রাখতে না, তার সাথে সবসময় হাসিগল্প করে তাকে আনন্দ দিতে তাহলে তিনি  সুস্থ হয়ে যাবেন কিন্তু সময় লাগবে। 


         সোমাদেবী সুস্থ আর হলেন না।পাপানের মৃত্যুর ঠিক এগারো মাসের মাথায় তিনিও চলে গেলেন তার আদরের  পাপানের কাছে।  শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে সমীরবাবু একেবারে ভেঙে পড়লেন, নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলেননা তিনি। সেই কোন ছোটবেলায় বাবা,  তারপর মা, তারপর একমাত্র সন্তান এবং সবশেষে স্ত্রী কে হারিয়ে   যে অসীম অনন্ত শূন্যতার সৃষ্টি হলো, তা তাকে ক্রমশঃ গ্রাস করে নিল।তিনি গভীর অবসাদে চলে গেলেন। অফিসে যাননা, বাড়ির বাইরে বেরোননা কারোর সাথে কথা পর্যন্ত বলেননা। ওনার এই অবস্থায়,  কয়েকজন বন্ধু ওনাকে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করেন। 


          সমীরবাবু এখন অনেকটাই সুস্থ হয়েছেন, যদিও বেশ কিছু ওষুধ খেতে হয় তাকে তবুও আগের থেকে তিনি অনেক বেশি স্বাভাবিক।  একদিন  সংসারের দায়ভার কাঁধে তুলে নিতে গিয়ে তার সখের..... তার স্বপ্নের.... রং তুলি কে তিনি বাক্সবন্দী  করে  সযত্নে তুলে রেখেছিলেন, সেই রং তুলিই এখন তাকে নতুন করে বেঁচে থাকার রসদ জোগাচ্ছে। অসম্ভব ভালো আঁকতেন তিনি। একদিন এই আঁকা নিয়ে দুচোখে অনেক অনেক স্বপ্ন ছিল তার  । আজ যখন অফুরন্ত অবসর, তখন একাকীত্ব কাটাতে হাতে তুলে নেন সেই রং তুলি।   এখনো তার এক একটা তুলির টানে ক্যানভাসে ফুটে ওঠে কতো সুন্দর সুন্দর ছবি। তার ছবির কতো প্রশংসা হয়। দেশজুড়ে তার ছবির প্রদর্শনী হয়। তিনি এখন তার বাড়িতে একটা আঁকার স্কুল করেছেন। ছোট ছোট বাচ্চাদের নিজে হাতে ধরে আঁকা শেখান,  না, তার জন্য কোন পারিশ্রমিক তিনি নেননা বরং নিজের টাকা দিয়ে গরীব বাচ্চাদের আঁকার বই খাতা রং তুলি এসব কিনে দেন। এমনকি খাবার দাবারও কিনে দেন। তিনি বলেন, " এই শিশুগুলো আমার কাছে ঈশ্বরের মতো। ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুগুলো,  সহজ সরল মুখের হাসি দিয়ে  আমার বুকের শূন্যতা অনেকটাই পূরণ করে দিয়েছে। বাকি জীবনটা আমি ওদের সাথে এভাবেই  কাটিয়ে দিতে চাই "...............।


         (কলি)