Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন#গল্প#হারানিধি#কলমে_সুপ্রিয়া_হালদার০৯/১২/২০২০
রাঘব বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে সন্ধ্যাবেলায় যেসময় বাড়িতে ফেরে , আজ তার অনেক আগেই চলে এসেছে । ওর চোখেমুখে উচ্ছ্বাস ফেটে পড়ছে । এসেই শমিতাকে স্মার্টফোন খুলে একটা স…

 


#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন

#গল্প

#হারানিধি

#কলমে_সুপ্রিয়া_হালদার

০৯/১২/২০২০


রাঘব বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে সন্ধ্যাবেলায় যেসময় বাড়িতে ফেরে , আজ তার অনেক আগেই চলে এসেছে । ওর চোখেমুখে উচ্ছ্বাস ফেটে পড়ছে । এসেই শমিতাকে স্মার্টফোন খুলে একটা সংবাদ দেখাল। আমেরিকাবাসিনী এক তেতাল্লিশ বছরের মহিলা--রীটা, তার শিকড়ের সন্ধানে ভারতে এসেছে তার আমেরিকান বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে । তেতাল্লিশ বছর আগে এই আমেরিকান দম্পতি একটি ভারতীয় শিশুকন্যাকে "মাদার হাউস" থেকে দত্তক নিয়েছিলেন , শিশুটি তখন মাত্রই কয়েক মাসের । সেই মেয়েটি স্কুলে নীচু ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই বুঝতে পারত, তার গাত্রবর্ণ ও মুখের গড়ন তার মা-বাবা ও সহপাঠীদের থেকে আলাদা। একটু বড় হতেই মা-বাবাকে এব্যাপারে প্রশ্ন করলে তাঁরা কিছু গোপন করেননি। তার জন্মবৃত্তান্ত , দেশ, সামাজিক অবস্থা---সব খুলে বলেন । ইন্ডিয়ার কলকাতা শহরের শান্তি বিশ্বাস নামের এক অবিবাহিতা মায়ের সন্তান সে। মেয়েটিও এরপরে ইন্ডিয়া সম্পর্কে অনেক পড়াশোনা করে এদেশে এসেছে। ইন্টারনেট ও সব সংবাদপত্রে সে তার জন্মদাত্রী মায়ের নাম ও নিজের ফোন নম্বর- ই-মেল আইডি জানিয়ে আবেদন করেছে---তার সেই মা যেন একটিবার তার সঙ্গে দেখা করেন , দরকার হলে যেন গোপনে যোগাযোগ করেন।


এই শান্তি বিশ্বাস আর কেউ নয় , সে যে শমিতা রায় , একথা রাঘব-শমিতার থেকে ভাল আর কে জানে ? ছলো ছলো চোখে দুজনে দুজনের হাতে হাত রেখে সোফায় বসে থাকে ।কত পুরনো কথা মনে পড়ে যায় দুজনের ।

____________________


একই পাড়ায় থাকা ও দুই পরিবারে ঘনিষ্ঠতার কারণে খুব ছোটবেলা থেকেই শমিতা আর রাঘবের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল , যা পরে প্রেমে পরিণত হয় । দুই পরিবারের সম্মতিও ছিল । শুধু সময়ের অপেক্ষা । দুজনে পড়াশোনা শেষ করে কিছু উপার্জন করতে শুরু করলেই ওদের বিয়েটা দিয়ে দেওয়া হবে ।

কিন্তু দীর্ঘকাল প্রেম চলতে থাকলে কি আর অপেক্ষা করা যায়!! দুই অপরিণত বয়স্ক ছাত্র-ছাত্রী ক্রমে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করছিল , বাড়ির লোকেদের অগোচরে । শমিতা যখন একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী , মাত্র সতেরো বছর বয়স , সেসময় দেখা দিল এক মহা সমস্যা । কিছুদিন ধরে মেয়ের খাওয়া-দাওয়ায় রুচি নেই , এটা মায়ের নজরে এসেছিল । মেয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে মা অজানা আশঙ্কায় মেয়েকে চেপে ধরল। আসল সত্যটা জানতে পেরে শমিতার মা-বাবা চলে গেল রাঘবদের বাড়িতে । উদ্ভুত পরিস্থিতির কথা জানিয়ে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলল। রাঘবের মা-বাবারও অতটা আপত্তি না থাকলেও বাদ সাধলো দুজনের বয়স । রাঘব তখন কুড়ি, কলেজে সেকেন্ড ইয়ার । আইনের চোখেই রাঘব-শমিতার বিয়ে নাকচ হয়ে যাবে । পড়শীরাই বা কি বলবে? তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্থির হল , গর্ভের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখতে দেওয়া যাবে না ।

পরের দিনই শমিতাকে নিয়ে ওর মা আর রাঘবের মা একজন স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞর কাছে গেল । ডাক্তারের কাছে সব খুলে বলে সাহায্য চাইল। 

ডাক্তার প্রথমেই তাদের কথা নাকচ করে দিলেন---দুই পরিবার যখন বিয়ে দেবেনই ভবিষ্যতে , তখন এই প্রথম সন্তান আমি নষ্ট করতে পারব না । আমার ডাক্তারি এথিকস-এ বাধবে । আর এই বয়সে গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট করলে ভবিষ্যতে ওদের আর সন্তান নাও হতে পারে ।

শমিতাকে পরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন , সে চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা ।তাই কোনভাবেই তার গর্ভপাত সম্ভব নয় । তাতে শমিতার জীবন সংশয় হবে ।

এরপরে দুই পরিবারে চলল লম্বা লম্বা বৈঠক। অনেক আলোচনা শেষে ঠিক হল, শিশুর জন্ম না হওয়া পর্যন্ত শমিতা বাড়িতেই থাকবে । কিন্তু জন্মের পরে এ শিশুকে বাড়িতে আনা যাবে না, হাসপাতালেই পরিত্যাগ করে আসতে হবে ।

কাজটা যদিও খুব একটা সহজ ছিল না । প্রসবের সময় আসন্ন হলে শমিতাকে ওদের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সেখানকার সরকারি হাসপাতালে “শান্তি বিশ্বাস" নামের মিথ্যা পরিচয়ে ভর্তি করা হয়েছিল । একটি কন্যাসন্তান জন্মে ছিল। পরের দিন ভিজিটিং আওয়ার-এর ভিড়ের সুযোগে শমিতাকে হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল । শিশুসন্তান রয়ে গেছিল হাসপাতালের জিম্মায়।

শমিতা অনেক কান্নাকাটি করলেও মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল । ততদিনে ও বুঝেও গেছিল , ভুলটা ওর আর রাঘবের। ওর পড়াশোনারও অনেক ক্ষতি হয়েছিল । তাই প্রতিজ্ঞা করেছিল , আর ভুল করবে না । মন দিয়ে পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়ে তবেই বিয়ে করবে।

রাঘব ইকনমিক্সে এম.এ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে চাকরি, আর শমিতা বি.এ বি.এড করে স্কুল শিক্ষিকা হবার পরে খুব ধুমধাম করে ওদের বিয়ে হয়েছিল । কিন্তু সে কাঙ্খিত জিনিসটি আর কিছুতেই ঘটল না । ওদের কোন সন্তান হল না । দুজনকেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল । ডাক্তার জানালেন দুজনেরই কোন শারীরিক অসুবিধা নেই । তবুও দীর্ঘ কয়েক বছর কেটে গেলেও ওদের আর সন্তান আসেনি। 

রাঘব চুপিচুপি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার  সেই সরকারি হাসপাতালে ওদের সেই পরিত্যক্ত সন্তানের ভাগ্যে কি ঘটেছিল, জানার চেষ্টা করেছে । এক পুরনো নার্স জানিয়েছিল , শিশুটিকে মাদার টেরিজার কাছে দেওয়া হয়েছিল । শিশুটিকে ফেরৎ পাওয়ার ইচ্ছা জাগলেও উদ্ধারের কোনও উপায় ওরা খুঁজে পায়নি । একবার সন্তান দত্তক নেবার কথা ভেবেছিল , কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটাও ফলপ্রসূ হয়নি ।

 আজ তেতাল্লিশ বছর পরে রাঘব-শমিতা তাদের অবসর জীবনে যখন আরও বেশি করে সেই শিশুকন্যার অভাব বোধ করছে , সেসময়ে এ কি আনন্দ সংবাদ এল ।________________

অনেকক্ষণ হাতে হাত রেখে বসে থাকার পরে শমিতা মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল---যোগাযোগ করবে না ?

রাঘব উচ্ছ্বসিত মুখে বলল-- নিশ্চয়ই ।

ল্যাপটপ খুলে বসে গেল মেল করতে ।রীটার সঙ্গে মেলে কথা হল। কি কি কথা হল , সব শমিতাকে জানাল রাঘব। স্থির হল , পরের দিনই রীটা তার আমেরিকান মা-বাবা সহ রাঘবদের বাড়িতে আসছে ।

শমিতার মধ্যে যেন সেই আগেকার শক্তি এসে জুটলো। ও ড্রয়িংরুম বেডরুম সব ছিমছাম গুছিয়ে ফেলল। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পায়েস আর পিঠে বানালো। রাঘবকে বলল, সকালে মিষ্টির দোকান খোলা মাত্র যেন রসগোল্লা আর মিষ্টি দই নিয়ে আসে ।

অপেক্ষার রাত যেন আর শেষ হয় না । ভোরে স্নান-পুজো সেরে নিল। ঠাকুরের কাছে অনেক কিছু প্রার্থনা করল। যথাসময়ে রীটা ও বৃদ্ধ আমেরিকান দম্পতি এলেন। আলাদা করে পরিচয় পর্বের দরকার পড়ল না। শমিতা ও রীটা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল। দুজনেরই চোখে জল । শমিতা বাকরুদ্ধ। রাঘবেরও খুব ইচ্ছা করছিল রীটাকে জড়িয়ে আদর করতে । কিন্তু তেষট্টি বছরের ভারতীয় সংস্কার তেতাল্লিশ বছরের অচেনা মহিলাকে জড়িয়ে ধরায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল । রীটা হাত বাড়িয়ে রাঘবের সঙ্গে করমর্দন করল ।


 কোন্ পরিস্থিতিতে এই কন্যাসন্তানকে ত্যাগ করতে হয়েছিল , রাঘব সেটা জানিয়ে দুঃখপ্রকাশ করল ।


 শমিতা ওরা আসার আগেই ওদের জন্য খাবার-দাবার সাজিয়ে রেখেছিল । ভারতীয় খাবার ওরা খুশি মনে খেল ঠিকই ,  কিন্তু অন্তরের সেই টান , সেই আগ্রহটা যেন দেখা গেল না রীটার মধ্যে । শমিতা মনে মনে অনেক কিছু আশা করেছিল । সব কেমন যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল । শুধু যেন নিজের জন্মদাত্রীকে একবার দেখতেই এসেছিল করুণা করে । যেন মনে করাতে এসেছে ওদের ভুলটাকে ।শমিতার  খুব ইচ্ছা করছিল রীটাকে বুকে জড়িয়ে বলে ---না , আর কোত্থাও যেতে দেব না তোকে ।

কিন্তু কিছুই বলতে পারল না বৃদ্ধ আমেরিকান দম্পতির দিকে তাকিয়ে । 

যাওয়ার আগে রীটা বলে গেল , সে চেষ্টা করবে বছরে একবার ইন্ডিয়ায় আসার ।

__________________

অনেকক্ষণ হল ওরা চলে গেছে । রাঘব আর শমিতা এখনও স্তব্ধ হয়ে বসে আছে । আজ ওরা টিভিটা চালাতেও ভুলে গেছে ।