স্মৃতিচারণ :ভুলুর_অনুমতি।
কলমে রীনা মুখার্জী।
সতেরবছর তেরো দিন কাটিয়ে চলে গেল ভুলু।একনিমেষে ওর জীবনের শুরু থেকে শেষটা চোখের সামনে ভেসে উঠল।পাশের বাড়ির ভাড়াটেদের কয়লাঘরে চারটে চারপেয়ে জন্মনিল।কালো সাদা ছোপছোপ দুটো আর একটা পুরো কালো …
স্মৃতিচারণ :ভুলুর_অনুমতি।
কলমে রীনা মুখার্জী।
সতেরবছর তেরো দিন কাটিয়ে চলে গেল ভুলু।একনিমেষে ওর জীবনের শুরু থেকে শেষটা চোখের সামনে ভেসে উঠল।পাশের বাড়ির ভাড়াটেদের কয়লাঘরে চারটে চারপেয়ে জন্মনিল।কালো সাদা ছোপছোপ দুটো আর একটা পুরো কালো একটা ধবধবে সাদা খালি লেজের কাছে একটু কালো।
মায়ের দুধ ওদের বেশিদিন জুটলো না।একমাসের মাথায় বড় রাষ্তার মোড়ে লরিচাপা পড়ে চলে গেল মা।এবার আমাদের সকলের যৌথ চেষ্টায় ওদের বাঁচিয়ে রাখার দায়।দিদি আর আমি মায়ের চোখ বাঁচিয়ে দুধ চুরি করে ওদের একটা নারকেল মালায় ধরে দিতাম।দিন পনের আমি টুসি মিলি আর দিদি ওদের সামলে রেখেছিলাম।মা কোনদিন এই সব পশু পাখি পালন পচ্ছন্দ করে না আর ঠাকুরমা তো সারাক্ষণ সারাঘরে গঙ্গা ডেকে আনছেন।
দিদি একটা প্ল্যান বানাল।ওই চারটেকে এক এক জন দেখাশুনা করবে।তা হলে দুটো আমাদের ভাগে পড়ল।লালু, ভুলু,ছটু, ঘেটু -এই চার নাম দিদির দেওয়া।একদিন সকালে দেখি ভুলু ছাড়া বাকিরা কেউ ওই ঘরে নেই।কয়লার স্তুপের পিছনে খুব ভয়ে লুকিয়ে আছে ভুলু।।ওর কালো রঙটা কয়লার সাথে প্রায় মিশে আছে।আমাদের তো মাথায় বাজ।বাকিরা গেল কোথায়।এদিকে ওদিকে খোঁজ করেও পেলাম না।সকলে বলল কাল ওই একটা বস্তা করে প্লাসটিক কুড়তে লোক এসেছিল ও ওদের নিয়ে গেছে।খুব মন খারাপ নিয়ে ভুলুকে ওখান থেকে তুলে নিলাম।কিন্তু রাখব কোথায়?ভুলু দিদির ভাগে পড়েছিল।দিদি বাবা কে এসে ধরল।বাবা তো এককথায় নাকচ করে দিল।আপাতত বারান্দাতে একটা টিভির পিজবোটের বাক্স তে আমরা প্রায় লুকিয়ে রাখলাম।ঠাকুরমার সেই সময় বড় পিসির বাড়ি গিয়েছিল তাই কটা দিন হাতে সময় পেলাম। মা তেমন কিছু টের পেল না খালি বাবা কিছুটা অনুমান করেছিল।
এর ঠিক দিন সাতেক বাদে দিদির খুব জ্বর হয় আর দিদি কোনরকম চিকিৎসাতেই সাড়া দেয় না।কেমন যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছিল।ডাক্তার ও কিছু বুঝতে পারছিলেন না।সবার খুব মন খারাপ।ঠাকুরমা কে বাবা নিয়ে আসল।মা খুব কান্নাকাটি করছেন, দিদি খাটে শুয়ে আর ভুলু ওই বাক্স থেকে বেরিয়ে দিদির খাটের নীচে কেমন করে চলে এসেছে।হঠাৎ কেমন একটা গলা করে ভুলু কেঁদে উঠল।আমরা সবাই চমকে গেলাম।মা আর ঠাকুমা যখন আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে খুঁজতে শুরু করল তখন ভুলু কে দেখে ফেলল।
আমি তো আতঙ্কে ঘামছি।ঠাকুমা সারাক্ষণ ইষ্টনাম জপ করেন হাতে মালা নিয়ে,তিনি হঠাৎ ভুলুর সামনে হাটুগেড়ে বসে প্রণাম করে নারায়ণ নারায়ণ করতে লাগলেন।জানিনা এটা কাকতলীয় ঘটনা দিদি এরপর আস্তে আস্তে সুস্হ হয়ে গেল।
ঠাকুমার অনুমতি পেয়ে আমাদের সাহস বেড়ে গেল।ভুলু বাড়ির সদস্য হয়ে গেল।
ভুলুর আরো অনেকগুণের মধ্যে একটা গুণছিল যে ও ঠাকুমার সাথে একাদশী করত।কিছুতেই কিছু খেত না সারাদিন। আর ঠাকুমা ওকে যা প্রসাদ দিত তাই খেত।ভুলু মাংস খেতে ভালো বাসত।রবিবার মাংস রান্না হলে রান্না ঘরের বাইরে গ্যাট হয়ে বসে থাকত।আর মা আমাদের কষা মাংস টেস্ট করতে দিলে ওকেও দিতে হতো।ওকে যতক্ষণ মা না দিত ও একটা অদ্ভুত সুরে মুখটা তুলে ডেকেই যেত।
আমাদের পাড়াতে ছিচকে চোরের খুব উপদ্রব ছিল সেটা ভুলুর পাহারাদারিতে চলে গিয়েছিল।ভুলু আমাদের সব কথা বুঝতো এবং ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করতো।দিদির বিয়ের পরের দিন যখন শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে ও সকলের মতোই ঘরে চুপ করে বসে থাকল আর কিছু খেল না।মিষ্টি ওর খুব পচ্ছন্দের ছিল কিন্তু রাগ হলে খাটের নীচে মুখ লুকিয়ে শুয়ে থাকত।মা বা ঠাকুমা আমাদের বকাবকি করলে ভুলু সারাক্ষণ চেচিয়ে যেত।
একবার আমি অঙ্ক বারবার ভুল করছিলাম বলে বাড়ির গৃহ শিক্ষক আমাকে কানটা জোরে মুলে দেয়।ভুলু ওই ঘরেই ছিল,এমন ভাবে তেড়ে যায় যে ওই গৃহ শিক্ষক আমাকে পড়ান ছেড়ে দেন।
ঠাকুরমা কদিন ধরে অসুস্হ। আস্তে আস্তে বিছানা নিল।বয়সের কারণে নানান রোগ এক এক করে ধরে নিল।ঠাকুমা সাতদিন হল চলে গেছেন। উঠোনে ঠাকুরমা কে যেখানে শেষবারের মতো শোয়ান হয়েছিল তুলশীতলার সামনে আজ ঠিক ওই জায়গাতে ভুলু চির নিদ্রায় শুয়ে আছে।ঠাকুরমার অনমতিতে ওর গৃহপ্রবেশ হয়েছিল।ঠাকুরমার সাথেই ভুলু নিজে থেকেই চলে গেল।