Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

বিভাগ -- ছোটগল্প শিরোনাম -- মাদার ✍️ শাশ্বতী মুন্সী ২৯. ১১. ২০২০
        " বিশ্বপিতা তুমি হে প্রভু          আমাদের প্রার্থনা এই শুধু         তোমারই করুনা হতে বঞ্চিত          না হই কভু........      ...........................…



 বিভাগ -- ছোটগল্প 

শিরোনাম -- মাদার 

✍️ শাশ্বতী মুন্সী

 ২৯. ১১. ২০২০


        " বিশ্বপিতা তুমি হে প্রভু

          আমাদের প্রার্থনা এই শুধু

         তোমারই করুনা হতে বঞ্চিত

          না হই কভু........

      ..............................................

     

        বিপদে আপদে সংশয়ে

        কখনো যেন না ডরি

        শত বাধা বিঘ্নেরও

         মুখোমুখি যেন পড়ি

        সত্যের দীপ চোখে জ্বালিয়ে

        আঁধারের রাত যাব পেরিয়ে 

        ভরিব ধরণী হাসিতে, প্রেমে

        আর গান দিয়ে....


       বিশ্বপিতা তুমি হে প্রভু....... "


           প্রত্যেকদিন প্রভাতে এই প্রার্থনা সংগীত দিয়ে শুরু হয় মালঞ্চ সেবাসংঘের প্রাত্যহিক জীবন | সহায়সম্বলহীন, নিরাশ্রয় শিশুদের ভবিষ্যৎ জীবনকে সুরক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করাই সংঘের একমাত্র উদ্দেশ্য | সারাদেশের নানা জায়গা থেকে আসা শিশুদের একছাতার তলায় রেখে প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে তোলার মহৎ কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করা ব্যক্তিটির নাম -- মিস এলিনা গোমস | জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটা শিশুকে মাতৃস্নেহে লালন পালন করার জন্যে নিজের জীবনকে হাসিমুখে উৎসর্গ করেছেন তিনি | "মালঞ্চ সেবাসংঘে"র পরিচালনার ভার স্বেচ্ছায় নিজহস্তে গ্রহণ করে বিগত ১৬ বছর ধরে এক বিশাল কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন!

            কিভাবে, কেমন করে মিস গোমস এই সংঘ গড়ে তুললেন, তা জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কিছু বছর আগে |


               খ্রীষ্টান পরিবারের ছেলে পিটার গোমস এবং হিন্দু বাঙালি পরিবারের মেয়ে সুনেত্রা ব্যানার্জীর একমাত্র সন্তান হলেন মিস এলিনা গোমস | বেথুন স্কুল ও কলেজ থেকে সফলতার সাথে পাস করা অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী এলিনা বাবা মায়ের খুব আদরের ছিল | লেখাপড়ার পাশাপাশি তার চরিত্রের একটি বিশেষ গুন হলো দীনদুঃখী মানুষের জন্য হৃদয়ের উদারতা | ছোটবেলায় এমন একটি ঘটনা ঘটিয়েছিল এলিনা যে.... তখনই সুনেত্রাদেবী এবং মিস্টার গোমস এর কাছে মেয়ের এই গুনের প্রকাশ হয়েছিল |

          সেবার সাত বছরের জন্মদিন ছিল এলিনার | প্রতিবারের মতো ধুমধাম করে জন্মদিনের আয়োজন করেছিলেন গোমস দম্পতি | সন্ধ্যে থেকে রাত অবধি আনন্দানুষ্ঠানের শেষে বাড়ির সবাই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে | এমন সময় বাড়তি হয়ে যাওয়া খাবারগুলো বাড়ির পরিচারক-পরিচারিকাদের সাহায্যে পাড়ার একধারে বসবাসকারী বস্তিবাসীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে এসেছিলো বালিকা বয়সী এলিনা গোমস | মেয়ের এই উদার মনের পরিচয় পেয়ে সেদিন তার বাবা মাসহ বাড়ির সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছিলেন! ছোট্ট মেয়ের এমন মনভাবকে নানা ক্ষেত্রে বিকশিত করার জন্যে ওনারা নিরন্তর উৎসাহ দিয়ে গেছেন |

                    বাবা পিটার গোমসের কাছে মাদার তেরেসার জীবনের নানাকথা গল্পাকারে শুনে বড়ো হয়েছিল এলিনা | মহিয়সী এক নারীর কর্মকাণ্ডের প্রভাব তার জীবনের গতিপথকে চরিত্রের বিশেষ গুনের সাথে গ্রন্থি বন্ধন করে সম্পূর্ণ ভিন্নখাতে বইয়ে দিয়েছিলো | যার পরিণতি হলো "মালঞ্চ সেবাসংঘ " স্থাপন |

              জন্মদিনের সেই ঘটনায় চরিত্রের যে বিশেষ গুনের অংকুরোদগম হয়েছিল, কিশোরী বয়সে ঘটা শরীরজনিত আকস্মিক একটি ঘটনা জীবনের স্বাভাবিক কাঠামো পরিবর্তিত হয়ে সেই গুনের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানোর দিশা দেখিয়েছিলো!

            এলিনা তখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী | সেইসময় হঠাৎ একদিন অসহ্য পেটের ব্যাথা শুরু হলে তার মা বাবা সত্ত্বর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান | জরুরি বিভাগে ভর্তি করিয়ে দ্রুত চিকিৎসার পর ডাক্তারবাবু ওনাদের জানান, "মিস্টার গোমস... আপনার মেয়ের ইউটেরাসে একটি বড়ো টিউমার হয়েছে যা এখুনি অপারেশন না করলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে! তাই এলিনাকে বাঁচাতে অপারেশন করে টিউমার বাদ দিতে হলে সাথে ইউটেরাসও শরীর থেকে বাদ দিতে হবে.... ফলে আপনাদের মেয়ে ভবিষ্যতে কোনোদিন মা হতে পারবে না ঠিকই কিন্তু তার প্রাণ বেঁচে যাবে.... "! এমন অভাবনীয় কথায় এলিনার মা বাবা প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেও একমাত্র মেয়ের শিয়রে মৃত্যুর করাল ছায়া দেখে শংকিত হৃদয়ে কম্পিত স্বরে অপারেশন করতে সম্মতি দিয়েছিলেন | তারা নিজেদের মনকে সান্ত্বনা দেন এই বলে যে, ".... তাদের মেয়ের শরীরের জননঅঙ্গ বাদ গিয়ে মাতৃত্বের সম্ভাবনা চিরতরে লুপ্ত হবার চেয়ে আদরের এলিনার সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা অনেক বেশি কাম্য... "!

             অপারেশনের পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসে এলিনা | কিন্তু তখনই সুনেত্রাদেবী মেয়ের শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ বাদ পড়ার কথা মেয়েকে বলেন নি | সঠিক সময়ের জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন! স্কুল পাস করে এলিনা যখন কলেজে যাওয়া শুরু করলো.... তেমন একদিনে সুনেত্রাদেবী মনের সব জোরকে একত্রিত করে বললেন, " লিনা(এলিনার ডাকনাম)... আজ তোর জীবনের এক চরম সত্য জানাবো তোকে যা শুনে তুই হয়তো আমাদের দোষ দিবি, নিষ্ঠুর ভাববি.... কিন্তু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে দেখবি সেই বিপদের সময়ে তোকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য বুকে পাথর চেপে মেয়ের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল আমাদের..!"

             মায়ের কথার বিষয়বস্তু বিন্দুমাত্র আন্দাজ করতে না পেরে দু চোখে কৌতূহল নিয়ে এলিনা মাকে বললো, "আমি বিশ্বাস করি আমার ভালোর জন্যে তোমরা যে সিদ্ধান্ত সেদিন নিয়েছিলে তা আমার ভবিষ্যৎ জীবনকে ভালো কাজের পথেই চালিত করবে! সেই সিদ্ধান্ত যত কঠোর সত্যকেই আজ উন্মোচন করুক না কেন... তা গ্রহণ করার মনোবল তোমার মেয়ের আছে মা...!"  মা হতে না পারার কঠিন অথচ বাস্তব সত্যকে মেনে নেবার সময় মেয়ের মুখের কোনো ভাবান্তর সুনেত্রা দেবীর চোখে পড়লো না | স্বভাব সুলভ মিষ্টি হেসে এলিনা বলে উঠলো, "... কিশোরী বয়সে তোমাদের নেওয়া সিদ্ধান্ত আমার কোনো ক্ষতি করে নি বরং আগামীদিনের কর্মজীবনের পথকে প্রশস্ত করে দিল!" মায়ের অবাক চাহনির প্রত্যুত্তরে এলিনা বললো, "আমি মনস্থির করে ফেলেছি..... গতানুগতিক বিবাহিত জীবনপ্রবাহে নিজের জীবনকে বহমান না করে দুস্থ-আর্ত-দীন-দরিদ্রের সেবায় ঈশ্বরের দেওয়া জীবনের অমূল্য দিনগুলো অতিবাহিত করবো! তাছাড়া এই চরম সত্য জানার পর তো জেনে বুঝে কোনো ছেলেকে বাবা হবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বিবাহ নামক সম্পর্কের অমর্যাদা করতে পারি না! তাই নিজগর্ভে সন্তান ধারণ করতে না পারার দুঃখের চেয়ে অগণিত অসহায়,স্নেহ ভালোবাসার কাঙাল শিশুদের মা হতে পারার সুখ আমার কাছে অনেক বেশি সৌভাগ্যের হবে...!" মেয়ের এই সিদ্ধান্তের কথা সুনেত্রাদেবীর মুখে শুনে বাবা পিটারের বুক গর্বে ভোরে গেছিলো | ওনাদের আশীর্বাদকে পাথেয় করে এলিনার ভবিষ্যৎ জীবনের কর্মধারার পথ সুগম হয়েছিল |

                গ্র্যাজুয়েশন পাস করার পর বেথুন স্কুলের প্রাক্তন প্রিন্সিপল মিসেস মাথুরের কাছে গিয়ে নিজের মনোবাসনার কথা জানাল এলিনা | স্কুলে পড়াকালীন সে জানতো প্রিন্সিপল ম্যাডাম একটি সেবাসংঘের সাথে যুক্ত আছেন | স্কুলের দায়িত্বভার সামলানোর পাশাপাশি তিনি "মালঞ্চ সেবাসংঘে"র কর্মভারও সমান তালে সুষ্ঠুভাবে সামলে এসেছেন! তাঁকে দেখে এবং মাদার তেরেসার জীবন কাহিনীর অনুপ্রেরণায় এলিনা নিজের জীবনের লক্ষ্যে স্থির হবার চিত্তে অটল থাকতে পেরেছিলো | কলেজের পড়া শেষ করে তিনি ওই সেবাসংঘের কর্মযজ্ঞে সবটুকু উজাড়  করে নিজেকে সামিল করতে তৎপর হয়েছিলেন |

                 জন্মসূত্রে বিদেশিনী হয়েও ভারতীয়দের সেবায় নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পেরেছিলেন যে বিরাট হৃদয়ের নারী, সেই রমণীর জন্মদিন অর্থ্যাৎ ২৬ শে অগাষ্ট-ই মিস এলিনা গোমসের জন্ম তারিখ | কুড়ি বছর পূর্ণ করে একুশে পা দেবার এই বিশেষ দিনে বাবা মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে "মালঞ্চ সেবাসংঘে"র কর্মস্রোতের প্রবাহে নিজজীবনের স্রোতপ্রবাহকে মিলিয়ে দিয়েছিলো | জীবন থেকে সব রং মুছে ফেলে নীল পাড় সাদা খোলের শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ পরিধান করে সংঘের অন্যান্য কর্মীর মতো পোশাকে সজ্জিত হয়ে দীনদুঃস্থের সেবার ব্রতে নিজের অন্তরাত্মাকে ব্রতী করেন!


           ----------------------------------------------------


       বয়সজনিত কারণে মিসেস মাথুর স্কুলের এবং সেবাসংঘের দায়িত্বভার থেকে অবসর গ্রহণ করে যাবার আগে মিস এলিনা গোমসকে এই সংঘের পরিচালকের আসনে অধিষ্ঠিত করে সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করে যান | নত মস্তকে কৃতজ্ঞ চিত্তে তিনি ১৬ বছর ধরে সেই দায়িত্বভার বহন করে সংঘের যাবতীয় কর্তব্য একনিষ্ঠ ভাবে পালন করে চলেছেন | নিষ্পাপ, অবলা,আশ্রয়হীন, সরল মনের কচি কচি শিশুদের আধো আধো স্বরের "মা" ডাক মিস গোমসকে মাতৃত্বেরসুখে সিঞ্চিত করে অনাবিল আনন্দে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রেখেছে....!!


                  ~সমাপ্ত~