Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সাহিত্য আলোচনা - বিষ পাড়ার হাঁড়িকথা

বিষ পাড়ার হাঁড়িকথা----------------------হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
               শব্দরঙ হাউস থেকে প্রকাশিত হলো "বিষ পাড়ার হাঁড়িকথা" কবিতা সংকলন ২০২০। সম্পাদনা করেছেন অঞ্জন দাস ও বিপ্লব ভূঞ্যা। একটি অসাধারণ কবিতা সংকলন। কব…

 


বিষ পাড়ার হাঁড়িকথা

----------------------

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়


               শব্দরঙ হাউস থেকে প্রকাশিত হলো "বিষ পাড়ার হাঁড়িকথা" কবিতা সংকলন ২০২০। সম্পাদনা করেছেন অঞ্জন দাস ও বিপ্লব ভূঞ্যা। একটি অসাধারণ কবিতা সংকলন। কবিতার আলোচনায় যাওয়ার আগে সংকলনটির নামকরণ নিয়ে দু'চার কথা বলতে ইচ্ছা করছে। আমার মা বলতেন, কবি মানেই তো তিনি নীলকন্ঠ। সমগ্র পৃথিবীকেই তো তিনি আত্মার আত্মীয় করে রেখেছেন। তাঁর তো নিজের দেশ বলে কিছু নেই। তাঁর কাছে সীমান্ত বলেও কিছু হয় না। পৃথিবীর যে প্রান্তে যা কিছুই হোক না কেন কবির কাছে তা তাঁর ঘরের মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা। তাই সব দুঃখই কবিকে ছুঁয়ে যায়। পৃথিবীর সব বিষ তিনি আপন কন্ঠে ধারণ করেন। তাই কবি যথার্থ অর্থেই নীলকন্ঠ। তাই তাঁর পাড়া বিষপাড়া তো বটেই। কবি মানুষ তো বটেই তবে এটুকু বললেই কবির বর্ণনা শেষ হয়ে যায় না। সাধারণ মানুষের যাত্রা যেখানে শেষ হয় কবির যাত্রা শুরু হয় ঠিক তার পর থেকেই। তাই মানুষ হয়েও তিনি অন্য মানুষ। তাই কবির সঙ্গে পথচলা, কবির সঙ্গে একছাদের নিচে থাকা সে তো সাধারণ কাজ নয়। উচিত নয় কবিকে দুঃখ দেওয়াও। মনে পড়ে যায় কবি শামসুর রাহমানের সেই বিখ্যাত কবিতা ----- "কবিকে দিও না দুঃখ, দুঃখ দিলে সে-ও জলে স্থলে / হাওয়ায় হাওয়ায় নীলিমায় গেঁথে দেবে দুঃখের অক্ষর।" 


               কোনো কবিতা সংকলনের নাম এমন হতে পারে আমরা সত্যিই তা কখনও ভেবে দেখি নি। কবির পাড়া বিষপাড়া। আর সেই বিষপাড়ার হাঁড়িকথা মানে তাঁর সৃষ্টি ---- কবিতা। আমি মনে করি এমন নামের সত্যিই কোনো তুলনা হয় না। ৯৪ জন কবির ৯৪ টি কবিতা নিয়ে এই সংকলন। সম্পাদনায় আছেন যে দুজন আছেন তাঁরা দুজনেই তরুণ কবি। তাই তাঁরা যে চিরাচরিত ও গতানুগতিক পথের বাইরে দিয়ে হেঁটে এইরকম একটা সংকলন কবিতাপ্রেমী পাঠকদের উপহার দেবেন তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কি আছে। তরুণ কবিদের কাছ থেকে এটা পাওয়ার জন্যেই তো আমরা অপেক্ষায় থাকি। 


               ফেসবুকের "শাপলা পর্ব'-এর প্রথম ঘোষণাতেই আমার মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা কৌতূহল জাগে। তখন তো "শব্দরঙ" কে চিনতাম না। জানতাম না শব্দরঙ-এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষজনদের কথা। তাই এই ঘোষণা শব্দরঙ-এর প্রতি আমাকে আগ্রহান্বিত করে তোলে। একের পর এক পর্ব প্রকাশিত হতে থাকে। আমি নিজেও একটি পর্বে অংশগ্রহণ করি। তখনই মনে হয়েছিল এই কবিতাগুলি যদি একটি বইয়ের মধ্যে ধরে রাখা যেত তাহলে খুব ভালো একটা কাজ হতো। পরে যখন শব্দরঙ থেকে বইয়ের ঘোষণা শুনলাম তখন যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম।


               এবার আসা যাক কবিতার আলোচনায়। প্রভাত মিশ্রের কবিতায় চোখ আটকে যায়। "জায়গাবদল" কবিতাটি শুরু হয়েছে এইভাবে -----

"আলোর বসার জায়গা এইখানে, অন্ধকার ওখানে বসবে।

কিন্তু এরা জায়গা বদল করে নিয়েছে কখন

আমরা দেখি নি। আমরা দেখি নি 

যে পাতা রৌদ্রের দিকে মেঘ ঢাকে তার ক্লোরোফিল ।"

আস্ত একটা সমাজের ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর কবিতাটির শেষ কয়েকটি লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাই আমাদেরই মুখের ছবি-----

"এই তো সেদিন, আমরা যখন কথা বলছিলাম পথে

আমাদের আস্তিন নড়ে উঠেছিল। 

আস্তিনের ভিতরে পিস্তল

দেখছিল প্রসন্ন মুখ -----

আমরা দেখেছি, বলি নি কাউকে,

হেসেছিও কম - বেশি ...

সেই কথা বলা হবে আজ ?"

               দিশারী মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় সমাজের আরও এক রূপ। এ যেন একই বিষয় ভিন্ন ভিন্ন শিল্পীর ভিন্ন ভিন্ন রঙের তুলিতে ক্যানভাসের সাদা জমি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে -----

"চব্বিশ ঘণ্টা ব্যাপী খুঁজেছি দিনের আলোয় 

চব্বিশ ঘণ্টা ব্যাপী খুঁজেছি রাতের অন্ধকারে

দিনের অন্ধকারও দেখেছি

রাতের আলোও দেখেছি

ঠিক কোনখান থেকে শুরু হয়েছে এই জল

জল থেকে প্রবাহ আর প্রবাহ থেকে ঘুম"

               উত্তম দত্তের কবিতার সবুজ জমিতে দাঁড়িয়ে মন ছুঁয়ে যায় আকাশ আলো হাওয়া জল মাটি। ভালোবাসাময় জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় একটুকরো জমি আর পাখির গান আমাদের মনে এক অন্য পৃথিবীর ছবি এঁকে দেয় ------

"এতটা নিষ্ঠুরভাবে পুড়ে যেতে ইচ্ছে করে না বলে এক টুকরো জমি কিনেছিলাম শহরের সীমান্ত - পল্লীতে। একদিন ভোরের অন্ধকারে সেখানে রোপন করেছিলাম শমিবৃক্ষ। অগণন শ্রাবণের জল আর অঘ্রানের শিশির পান করে সেই বৃক্ষ আজ সবুজ শাড়ি পরা উদবাস্তু মায়ের মতো স্নেহময়ী।"

               "বংশপুরুষ" কবিতায় অরিন্দম প্রধান এমন এক চিরকালীন ঘরের ছবি আঁকেন যে ঘরের আলো আমাদের চোখের সামনে দিগন্তকে উন্মোচন করে। দু'দিকের দুই তালগাছের হাওয়ায় আমাদের শরীর মন জুড়িয়ে যায় -----

"একটা ঘর এগিয়ে এলো আমার দিকে

সর্বক্ষণ টর্চ দেখিয়ে গেল

ঘূর্ণি বাতাসে ফুলের পাপড়ি দুঃখ ভুলে

নৌকার পালে সাহস জোগায়

পাতা হাতে মা ভাতের অপেক্ষায়"

               সংকলনের সব কবিতা সম্পর্কেই কিছু না কিছু বলতে ইচ্ছে করে। এমন একটা কবিতার সংকলন যদি পাঠক হাতে তুলে নেন তাহলে আমার বিশ্বাস বাজারচলতি অনেক সংকলনের কথাই তিনি ভুলে যাবেন। প্রবীণ কবিদের পাশাপাশি নবীন কবিদের উপস্থিতি সত্যিই চোখে পড়ার মতো। শ্যামলকান্তি দাশ, সুধীর দত্ত, রাহুল পুরকায়স্থ, শঙ্কর চক্রবর্তীদের সঙ্গে যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দেন জগন্নাথদেব মণ্ডল, রাজীব মৌলিক, শৈলেন চৌনি, মেহবুব গায়েন প্রমুখ।

               পরিশেষে বলি, সংকলনটির প্রচ্ছদের কথা। সমস্ত কবির স্বাক্ষর নিয়ে এমন একটি অভিনব প্রচ্ছদের জন্য দুই সম্পাদককে অসংখ্য ধন্যবাদ। কবির পবিত্র হাতের স্পর্শ আমরা এই প্রচ্ছদের মধ্যে দিয়ে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি। এই সংকলন কবিতাপ্রেমীদের দীর্ঘদিন মনে থাকবে। "শব্দরঙ" আরও এগিয়ে চলুক। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম তাদের আরও নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার।