Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি সাহিত্য পত্রিকার গল্প সম্মাননা

#বিষয়_সামাজিক গল্প#শিরোনাম_পণের দাবী#অয়ন্তিকা সেন
"তা বউমা,তোমার বাপের বাড়ির লোকেরা কি আর ঘর খুঁজে পেলেন না তোমার জন‍্য?এই বাড়ীতেই গছিয়ে দিলেন তোমায়"?বিয়ের কনেকে দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে রেখে,বরণডালা হাতে নিয়ে আটপৌরে শাশুড়ি মায়…

 


#বিষয়_সামাজিক গল্প

#শিরোনাম_পণের দাবী

#অয়ন্তিকা সেন


"তা বউমা,তোমার বাপের বাড়ির লোকেরা কি আর ঘর খুঁজে পেলেন না তোমার জন‍্য?এই বাড়ীতেই গছিয়ে দিলেন তোমায়"?

বিয়ের কনেকে দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে রেখে,বরণডালা হাতে নিয়ে আটপৌরে শাশুড়ি মায়ের পান চিবানোর মতো, চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কথাগুলো সাথীর বুকে এসে লাগল।

"কী গো নতুন বউ?চোখে অন্ধ নাকি?বরণ করা যে হয়ে গেছে দেখতে পাওনি?বললুম তো ঘরে এসো।জগাটা যে কোথায় গেল?পই পই করে বললুম,বরণের সময় বউয়ের পাশে থাকিস,কিন্তু শুনলে তো?বউকে দরজায় এনেই পালিয়েছে।আর একে দেখ,এখনও সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছে।ওরে কে কোথায় আছিস,নতুন বউকে আমার ঘরে নিয়ে যা।জগার ঘরে আবার নিয়ে যাস না বাপু"।

কথাগুলো বলেই এ বাড়ির গিন্নি নিজের কাজে চলে গেলেন।সাথীকে এ বাড়িরই কোনো এক আত্মীয় তার শাশুড়ি মায়ের ঘরে গিয়ে পৌঁছেদিল।

"নতুন বউ,তুমি স্নান করে তৈরী থেকো, ঘর থেকে বেরিও না।একটু পরে তোমার শাশুড়ি মা এসে তোমাকে বলে দেবেন কী করতে হবে"।

ভদ্রমহিলাটি চলে যাওয়ার পর সাথী তাড়াতাড়ি দরজার ছিটকিনিটা দিয়ে দেয়।তার মনের ভিতরটা তোলপাড় করছে।মা কে খুব মনে পড়ছে সাথীর।মনে হচ্ছে দৌড়ে গিয়ে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ুক সে।ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড়।একবার ভাবল ব‍্যাগ থেকে ফোনটা বের করে মা কে একটা ফোন করুক।কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল,মা বারবার বলে দিয়েছিলেন যে,"যতই বুক ফাটুক তোর, শ্বশুরবাড়িতে গিয়েই আমাকে ফোন করবি না,শ্বশুরবাড়ির লোক খারাপ ভাবতে পারেন।পরে ধীরে সুস্থে করিস"।

"বউমা,ও বউমা দরজাটা খোলো।ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?এখনও অনেক আচার অনুষ্ঠান বাকী যে,দরজা খোলো বউমা.."


শাশুড়ি মায়ের ডাকে সাথীর ভাবনায় ছেদ পড়ল।তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজাটা খুলতেই শাশুড়ি মা হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলেন...

" একি তুমি এখনও স্নানে যাওনি?বেলা যে গড়িয়ে গেল..ওদিকে কত্তা আর জগা যদি জানতে পারে তুমি এখনও তৈরী হওনি,তবে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে"!

সাথী একটু অবাক হয়ে শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল,কিন্তু সেই মুহূর্তে সাথীর শ্বশুরমশাই আর স্বামী ঘরে ঢুকলেন।

"কী ব‍্যাপার?নীচে সকলে অপেক্ষা করছে আর তোমরা এখানে ন‍্যাকামি করছ"?

"দাও না বাবা,কানের গোড়ায় এক থাপ্পড়,দেখবে সব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে"।

"উফ! জগা আমি তো কথা বলছি?তুমি এর মধ‍্যে এসো না।বউমা,এদিকে একটু এসোতো"।

সাথীর ততক্ষণে ভয়ে হাত পা কাঁপছে।এ কোন বাড়িতে আমার বাবা - দাদারা বিয়ে দিলেন?কী ভাষা এদের মুখের"?

সাথীর শাশুড়ি মা এগিয়ে সাথীকে ধরে গুটি গুটি পায়ে শ্বশুরের কাছে নিয়ে যান।

"জগা,দরজাটা বন্ধ কর"।

জগা বাপের আদেশ মানতে দৌড়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয়..

"শোনো বউমা,তোমার বাবার কাছ থেকে ভদ্রতার খাতিরে বিয়ের সময় কোনো পণ নেইনি বলে তোমার বাবা আর দাদা দেখছি তোমার সাথে কিছুই পাঠাননি?কী ভাবলেন ওঁরা,মেয়েকে এমনিই গছিয়ে দেবেন আমাদের ঘাড়ে?তা হবে না।এখনই ফোন করে বলো ওদের,যেন ৫০হাজার টাকা সাথে নিয়ে তবে কালকের অনুষ্ঠানে আসে।নয়তো ওদের সাথেই তোমাকে ফিরে যেতে হবে।

"কিন্তু বাবা ৫০ হাজার টাকায় আজকাল কী হয়?অন্তত আর ৫০ দিতে বলো।এর বাড়ির অবস্থা তো আর আগেরটার মতো ভিখারীর নয়"।

"না জগা,এখনই বেশী লোভ ভালো না।

পরে ধীরে ধীরে সব আদায় করা যাবে।

গিন্নি নতুন বউকে সব বুঝিয়ে দাও। আগেরজনের অবস্থা মনে আছে তো.."?

সাথী ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল।পুরো পৃথিবীই এখন অন্ধকারময় তার কাছে।

"ও মেয়ে তুমি বসে পড়লে কেন?তাড়াতাড়ি বাপকে ফোন করে বলে দাও কাল কিছু টাকা এনে তোমার শ্বশুরের হাতে দিতে।তবেই তিনি সন্তুষ্ট হবেন"।

" কিন্তু মা,আপনাদের যদি পণ নেওয়ারই ছিল,তবে বিয়ের আগে বলেননি কেন?এখন সব হয়ে যাওয়ার পর আপনারা পণের টাকা চাইছেন?এমনিতেই বিয়েতে অনেক খরচা হয়ে গেছে।আর তাছাড়া ওদের অতো ক্ষমতা নেই এতগুলো টাকা দেওয়ার।আত্মীয়দের সাহায‍্যে আর মায়ের জমানো কিছু গয়না দিয়ে আমায় বিয়ে দিয়েছেন।দাদারও তো সংসার আছে।বাবা রিটায়ার্ড হয়েছেন।এখন কী করে এতগুলো টাকা..."


"অতসব জানিনে বউমা।তোমার বাবা-দাদা কেন বিয়ের আগে এ বাড়ির খোঁজ-খবর নেননি?যেই শুনলেন ছেলে ভালো চাকরি করে,একটাই সন্তান তখনই বিয়ের জন‍্য রাজি হয়ে গেলেন?কোন বাড়িতে মেয়েকে পাঠাচ্ছেন সেটা দেখবেন না?জানবেন না?আগের বউটার কী হয়েছিল জানো?পণেরদাবী মেটাতে পারেনি বলে আত্মহত্যা করতে বাধ‍্য করেছিল আমার ওই রাক্ষস বর আর ছেলে।তোমারও যাতে একই হাল না হয়,তার ব‍্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে"..

"কিন্তু মা,আপনি তো নিজের চোখে সব দেখেছেন।একজন মেয়ে হয়ে প্রতিবাদ করতে পারেননি"?

সাথীর শাশুড়িমা অন‍্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ধীর গলায় বলেন, "করেছিলাম বউমা,লাভ হয়নি।শুধু আমার একটা পা ভাঙা গিয়েছিল আর প্রাণের হুমকি এসেছিল।এই এতবড় পৃথিবীতে আমি সম্পূূর্ণ একা যে বউমা।তোমার শ্বশুরমশাই আমায় দয়া করে এই বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন।ছেলেটাকেও মানুষ করতে দেননি।আগের বউমাটা যখন মরলো,তখন আমি এখানে ছিলাম না।কয়েকদিনের জন‍্য জগন্নাথ দর্শনে গিয়েছিলাম।হয়ত এই সুযোগে বাপ-বেটার পণ আনার অত‍্যাচারটা বেড়েছিল,তাই কচি মেয়েটা নিজেকে শেষ করার পথটা বেছে নিয়েছিল।আমি অনেকবার মেয়েটাকে বুঝিয়েছিলাম তুই তোর বাড়ি চলে যা,ওখানেই থাক আর আসিস না।বাপের বাড়িতে নুন-ভাত খাবি তাও ভালো।কিন্তু মেয়ে শোনেনি।

বলত,মা বাড়ির লোক বলেছে আমি যেন কোনো প্রকারে মানিয়ে নেই শ্বশুরবাড়িতে। মেয়েদের একবার বাপের বাড়ি ছাড়লে আর ফেরৎ আসার উপায় নেই।এটাই নাকি নিয়ম।

ব‍্যাস,ভুগলো সেই মানিয়ে নেওয়ার ফল।জীবনটাই চলে গেল..

এখন তোর কপালে কী হয় দেখ.."

কথাগুলো বলে সাথীর শাশুড়ি মা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছলেন।

"তুমি তৈরী হয়ে নাও।আমি আধা ঘন্টা পর আসছি..."

শাশুড়ি মা চলে যাওয়ার পর সাথী মাথায় হাত দিয়ে বসে থেকে ভাবে তারও তো অবস্থা সেইরকমই।মধ‍্যবিত্ত পরিবারে বড়ো হওয়া সাথীকে মা সবসময় একটা কথাই বলে এসেছেন,'যে সয়,সে রয়'।বিয়ের আগে নিজের কাছে শুইয়ে মা বারবার একই কথা বলেছেন,"সাথী মেয়েদের শান্ত-নম্র-ভদ্র হতে হয়।ধৈর্য ধরতে হয়।হতেই পারে নতুন পরিবেশ আর নতুন লোকের মধ‍্যে গিয়ে তুই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলি না।ঘটি-বাটি পাশাপাশি থাকলে ঠুকোঠুকি লাগবেই।কিন্তু তোকে ধৈর্য ধরতে হবে।মানিয়ে নিতে হবে।শ্বশুরবাড়ির একেক জন একেকরকম কথা বলবে,কিন্তু তুই মানিয়ে নিবি।কিছু হলেই বাপের বাড়ি চলে আসবি না।এখন থেকে ওটাই তোর আসল বাড়ি"।


কথাগুলো সাথীর কানে বারবার বাজতে থাকল।কিন্তু চুপ করে থাকলেও তো সমস‍্যার সমাধান হবে না।আর মুখ খুললে হয়ত প্রাণটাই যাবে।

সাথী কোনোরকমে উঠে ব‍্যাগ থেকে নিজের ফোনটা বের করে।তারপর দাদাকে একটা ফোন করে এখানকার সমস্ত কথা জানায়।সাথীর কথা শোনার পর পরিবারের উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।কী করবে এখন তারা?শেষে মেয়ের প্রাণ আর সংসারটা বাঁচাতে কোনোরকমে টাকাটা জোগাড় করে সাথীর শ্বশুর আর বরের হাতে তুলে দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল।

সেই মুহূর্ত থেকে সাথীর নিজের জীবনটাকেই বিষময় মনে হল।কোনো আচার অনুষ্ঠানেই তার মন নেই।কীভাবে কাটাবে সে পুরো জীবনটা এই বিষাক্ত মানুষ দুটির সাথে।যতটুকু পেটে বিদ‍্যে আছে ততটুকু দিয়ে নিজের পেটটুকু তো চলে যাবে।কিন্তু সেই সুযোগ তাকে দেবে কে?সেই তো বাড়ির লোক বলবে,"মানিয়ে নে মা,ওখানে থাকাটাই সম্মানের"..

মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে সাথীর।একবার মনেও হল,তাহলে কী আমাকেও আগের বউটার মতই মুক্তি পেতে হবে?না আর ভাবতে পারল না সে।জোর করে চোখ বুজে কালরাত্রির কালো রাতে নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করল।কিন্তু মুক্তি আছে কী তোর নারীর?

পরের দিন সন্ধ্যায় বউভাতের অনুষ্ঠানে সাথীর পরিবার আর কিছু আত্মীয়-স্বজন মেয়ের প্রাণরক্ষা করতে উপস্থিত হন।

সাথীর শ্বশুর তাদের দিকে এগিয়ে ধীর গলায় বলেন,

"বেয়ান,আপনার মেয়ের টাকাটা এনেছেন তো?ভাববেন না,টাকাটা কিন্তু আপনার মেয়েরই থাকবে"..

সাথীর অসহায় বাবা ব‍্যাগ থেকে একটা পুঁটুলি বার করে তার হাতের উপর রেখে বললেন, "এই নিন আপনার পণের টাকা"।

হঠাৎই বেশ কয়েকটা ক‍্যামেরার ফ্ল‍্যাশ লাইট এসে পড়ল সাথীর শ্বশুরের উপর। পাশ থেকে কে যেন লোকটার হাত থেকে পুঁটুলিটা কেড়ে নিয়ে বলল,

"খুব শখ না,মেয়ের বাপের থেকে পণের টাকা নেওয়ার?এবার চলুন জেলের ভিতরে সেই পণের টাকা গুণবেন"..

ভিড়ের মধ‍্যেই জগা আর জগার বাপকে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশের গাড়িতে তোলা হল।

সাথী আর তার শাশুড়িমা অবাক হয়ে শুধু দেখতে থাকে কান্ডকারখানা। হঠাৎ পাশ থেকে সাথীর দাদা বলে উঠল..


"চল বোন ঘরে চল।আর তোকে শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নিতে হবে না।আজ মানিয়ে নিতে নিতেই এই পশুগুলো এত বেড়েছে।আজ চারপাশে যে এত বধূহত‍্যা হয়,তারজন‍্য শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যতটা না দায়ী থাকে,তার থেকে বেশী দায়ী থাকে মেয়েগুলোর বাড়ির লোকেরা।তারা মেয়ের বিপদ জেনেও সেখানেই মানিয়ে নেওয়ার জন‍্য বাধ‍্য করে।তারপর একদিন যখন মেয়ের লাশ নিয়ে যাওয়ার খবর আসে তখন সেই লাশের বুকের উপর পড়ে হা-হুতাশ করে।কিন্তু আর এমন হবে না।যা হওয়ার হয়েছে।কিন্তু আমাদের কাছে পণের দাবীর থেকে নারীর জীবনের দাবী অনেক বেশী মূল‍্যবান।চল,মা তোর জন‍্য ঘরে অপেক্ষা করছেন।"...

সাথী চোখের জল মুছে দাদা আর বাবার সাথে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার শাশুড়ি মাকে প্রণাম করে।

শাশুড়ি মা সরস নয়নে সাথীর চিবুকে একটা স্নেহের চুম্বন এঁকে বলেন

 "ভালো থাকিস মা,বেঁচে থাকিস.."


সমাপ্ত।