সৃষ্টি সাহিত্য যাপনকাব্যকাহিনী , পর্ব--০৭শিরোনাম : চাঁদ আর উঠলো নাকলমে : শক্তিপদ ঘোষতারিখ : ২৩ , ১২ , ২০২০
সেই এক মুকুলিকা , যে ফোটার মুখে না ফুটেমুকুলেই গেছে ঝরে ,মগ্ন দু'চোখের তারায় ব্যর্থ স্বপ্নকে ধরে।সে জান…
সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
কাব্যকাহিনী , পর্ব--০৭
শিরোনাম : চাঁদ আর উঠলো না
কলমে : শক্তিপদ ঘোষ
তারিখ : ২৩ , ১২ , ২০২০
সেই এক মুকুলিকা , যে ফোটার মুখে না ফুটে
মুকুলেই গেছে ঝরে ,
মগ্ন দু'চোখের তারায় ব্যর্থ স্বপ্নকে ধরে।
সে জানে খুব ভালো করে ,
সেই তাদের মতো আর যারা , যাদের ঘরে
নুন আনতে গিয়ে পান্তা ফুরোয় ,
একবেলা একসন্ধ্যে খাওয়া ,
সেই তাদের দু'চোখে স্বপ্ন দেখা বারণ ।
সেই বাড়িতে লেখাপড়া শিখে বড়ো হওয়া ,
আকাশের চাঁদ চাওয়ার মতোই ,
সে জানে--খুব অসম্ভব একটা চাওয়া ।
তবুও মেয়েটি মনে মনে ভাবতো :
নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ,
তার একটা হাত বাবার হাতে বাড়িয়ে
অসুস্থ বাবাকে সে
তিলে তিলে ক্ষয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাবে ।
অন্য হাতে , ওষুধ ও পথ্যের অভাবে ,
বাবার মতো--যে মাও বড় ক্লান্ত , সেই মাকে ,
অন্ধকারের গভীরতম খাদ থেকে ,
তুলে আনতেই যে হবে সেই তাকেই ।
সে ছাড়া বাড়ীতে তৃতীয় কোন হাত নেই ;
আছে তার থেকে বয়সে অনেক ছোট
খুব দুষ্টু-মিষ্টি ছোট্ট একটা ভাই ,
ভাই তো ভাই , খুব আদরের সেই একটাই ।
তার ভবিষ্যতও আজ বিশবাঁও জলে ,
মনে মনে চলে চর্চা অবিরাম , কী হবে তাহলে ?
প্রশ্ন নিরুত্তর , তবু মনের ভিতরে ,
প্রশ্নটা নদীজলে পাক খাওয়া
সুগভীর ঘূর্ণির মতো অবিরত ঘোরে ।
তথাপি , কথা ছিল না মুখে ;
ঢের বেশি কাজ ছিল , বড় বেশি মায়া ছিল ,
অনেক কান্না চাপা ছিল তার বুকে ।
তবু মনে ছিল দৃঢ় অঙ্গীকার ;
দুর্গম পথ , পদে পদে বাধা , তবু দুর্বার ।
তবু দুর্জয় দুই হাতে , দাঁত চেপে দাঁতে ,
চেপে ধরে হাল ;
কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভাইটাকে পড়াতো
নিয়মিত সন্ধ্যা-সকাল ।
নিজের জন্যে দীর্ঘ বিনিদ্র রাত্রি ;
আঁধারে পথহাঁটা একা এক মরুযাত্রী ।
সমুখে চড়াই পথের অনেক দুর্ভঙ্গ সোপান ভেঙে ,
এক পা এক পা করে--পা ফেলে সাবধানে ,
স্কুল ফেলে--পৌঁছায় গিয়ে কলেজ অবধি ;
মরতে মরতে না মরে হাঁটে--মরানদী ।
কলেজ থেকে ফেরার পথে , কয়েকজনকে
একজায়গায় একসাথে পড়িয়ে ফেরাটা ,
ছিল তার নিত্যদিনের কাজেরই একটা ।
এইভাবেই কাটছিল দিন যেমন দিন কাটে ;
আস্ত একটা রথ একহাতে টানার ভাবনাতে ।
এরই মধ্যে হঠাৎ একসময় দেখতে পায় ,
আকাশের গায়--একটা রাঙামেঘের আনাগোনা ;
তার মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে ঘুরে ফিরে
একটা মুখের ছবি , কাছে আসা ধীরে ধীরে ,
খুব বেশি নয় জানাশোনা ।
তবু গলায় আজকাল গুনগুনিয়ে গান ওঠে ,
তার টবের আদুরে ফুলকলিগুলো
ধীরে ধীরে ফুল হয়ে ফোটে ।
কখনও বা স্বগত ভাবনার ঘোরে
আপন মনে তার পছন্দের কিছু কবিতা
সে আবৃত্তি করে ;
কখনও বা খুব ভালোলাগা কবিতার
খাপছাড়া কয়েকটা পঙক্তি ;
কখনও বা খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে
সাগ্রহে দেখে ফুলে ফুলে ওড়ে প্রজাপতি ।
মনে মনে সাধ হয়--একটু সাজে , সাধ্য নাই ;
সংকোচও দাঁড়ায় সম্মুখে পাহাড় হয়ে ।
কিছুটা হলেও ভাটার টান লাগে কাজে ,
একটা শান্ত মুখের মায়া তাকে ভাবাচ্ছে ;
বোঝার চেষ্টা করে , কানে কানে সে
কী যেন যায় ক'য়ে ।
আজকাল বেড়েছে রাত্রি জাগা ,
মন উন্মন , তবুও মগ্নতা বেড়েছে পড়াশোনায় ।
পড়া থামিয়ে কখনও বা একা একা
স্নান সারে মধুজ্যোৎস্নায় ।
ভাইয়ের ভাবনাটাও তাকে সমানে ভাবাচ্ছে ,
যার কোন সাধ , আহ্লাদ মেটেনি অভাবে ।
কোনদিনও মুখ ফুটে করে না আবদার ;
ভাবে , চাকরি পেলে সব না-চাওয়া তার ,
মেটাবে সে সবার আগে ;
বাবামাকেও কিছুতেই মরতে দেবে না অভাবে ।
কলেজের চূড়ান্ত পরীক্ষায়
সবাইকে চমকে দিয়ে--এলো অসামান্য সাফল্য ;
বাড়িতে বাবা , মা , ভাই ,
খুশির বন্যায় ভাসলো সব্বাই ।
সবাই তার চোখে স্বপ্ন মাখালো ,
পরিচিতরাও আশাতীত উৎসাহ জোগালো ,
আর সেই একটা শান্ত মুখের মায়া ,
যে তার দহনবেলায় মাথায় ফেলেছে
স্নিগ্ধ মেঘের ছায়া ,
যে তাকে ছুঁয়েও ছুঁতে পারেনি ,
সেই শুধু জানলো না--কার কাছে সে হারেনি ।
সে-ই নিজের অজান্তে তাকে দেখিয়েছে ,
কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় স্বর্ণচ্ছটা ;
অথচ , জানলো না--কার চোখে সে
নিঃশব্দে ঢেলেছে মুগ্ধতা ।
অথচ , কর্তব্যের পাহাড় তার মাথায় ,
এই দুর্বলতা তাকে জয় করতেই হবে ;
তাই , তাকে ঘিরে স্বপ্নটা তার শেষমেশ
স্বপ্নেই ঘুমিয়ে গেল খুব নীরবে ।
এদিকে কলেজ ছাড়ার বেশ কিছুদিন আগে
কলেজেরই একজন খুব বিরক্ত করছিল তাকে ;
তার প্রতি সে ক্ষুণ্ণ ছিল ভীষণ মনে মনে ,
ক্ষোভ একদিন ব্যক্ত হলো খুব রাগে ।
একদিন তার মুখের ওপর বলেছিল ,
তেমন দুসাহস ভবিষ্যতে যেন আর না দেখায় ,
যদি বাঁচতে চায় ।
তারপর , অনেকদিন কেটে গেছে ,
সব ছিল চুপচাপ ;
কোত্থাও ছিল না কোন ঝড়ের পূর্বাভাস ।
সে এখন ইউনিভার্সিটির প্রথমে বর্ষের ছাত্রী ,
ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরছিল একা একা ;
গ্রীষ্মের দুপুর , নির্জন পথ , সেই তার সঙ্গে দেখা ।
গাছের ছায়ায় মোটর সাইকেলটা রেখে সম্মুখে ,
দাঁড়িয়েছে পথ রুখে ;
আবারও সেই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাব ,
কিছুক্ষণ প্রবল কথাকাটাকাটি ,
তারই মধ্যে হঠাৎই
অ্যাসিড ছুঁড়ে মারলো তার মুখে ।
তারপরেও ছুরির আঘাত
সামনে-পিছনে , যেমন-তেমন ;
পথের ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে সেই মেয়ে ,
অকারণ ব্যর্থ চেঁচিয়ে ।
সশব্দে হাত পা ছুঁড়লো কিছুক্ষণ ;
তারপর সব শেষ ; চোখের পাতাদু'টো
সেই পড়লো , আর উঠলো না ;
যার তাড়া ছিল খুব--বাড়ি ফেরার ,
সে আর ফিরলো না ।
তার টবের সব ফুল ঝরে গেল ,
গান থামলো , দীপ নিভলো , রাত্রির
চুপ আঁধার নামলো , চাঁদ আর উঠলো না ।
--------------------------------------------------------------------