Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন#বিভাগ_গল্প#বরণ #মৃন্ময়_সমাদ্দার#তারিখ_১৭/০১/২০২১
রমেন বাবুর বাড়িতে খুব হইচই। সব আত্মীয়স্বজনরা আসছেন এক এক করে।রমেনবাবুর দিদি বোন বা শ্বশুরালয়ের লোকজন সবাই একে একে আসছে। সবাইকেই সমানভাবে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে র…

 


#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন

#বিভাগ_গল্প

#বরণ 

#মৃন্ময়_সমাদ্দার

#তারিখ_১৭/০১/২০২১


রমেন বাবুর বাড়িতে খুব হইচই। সব আত্মীয়স্বজনরা আসছেন এক এক করে।রমেনবাবুর দিদি বোন বা শ্বশুরালয়ের লোকজন সবাই একে একে আসছে। সবাইকেই সমানভাবে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে রমেনবাবুর ছেলে রমিত। রমিত দুদিন হল বাড়িতে এসেছে। ও আমেরিকায় থাকে চাকরির সূত্রে। গত দুবছর হলো ওদেশে গেছে। গত বছর আসতে পারেনি। এ বছর প্রায় এক মাসের ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। এখানে একটাদিনের একটা আলাদা মাহাত্ম্য আছে। বাড়িতে একমাস আগে থেকেই সাজো সাজো রব পড়ে যায়। রমেন বাবুর বাড়ি বর্ধমান জেলায়। পৈতৃক সূত্রে জমিদার। জমিদারি আর নেই তবে জমিদারি চালটা বজায় রেখে গেছেন এত বছর পরেও। রমেন বাবুর স্ত্রী মালতি দেবীও খুবই ব্যস্ত অতিথিদের আপ্যায়নে। রমেন বাবুও বারেবারেই বাইরে এসে তদারকি করে যাচ্ছেন সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে হচ্ছে কিনা।যেখানটায় ওনার পছন্দ হচ্ছেনা সেখানেই নির্দেশ দিয়ে ঠিক করে নিচ্ছেন।গ্রামের লোকজন একটাদিন রমেন বাবুর বাড়িতেই কাজ করে এবং খাওয়াদাওয়া করে। মালতি দেবীও এত ব্যস্ত যে কারুর সাথে দু'দণ্ড বসে যে একটু কথা বলবেন তার জো নেই। এই একজন বড়মা বলে ডাকে তো আরেকজন কাকিমা বলে জিজ্ঞাসা করে এটা কোথায় এটা কোথায়? উনিও হাসিমুখে সবাইকে সব বলে দেন। একটাদিন রমেন বাবুর বাড়ি সবার জন্যে অবারিত দ্বার। গ্রামের সবাই রমেন বাবুদের খুবই শ্রদ্ধা করে এবং বাড়িটাকে নিজেদের বাড়ি বলেই মনে করে। এতদিন ধরে এ বাড়িতে আছেন কোনদিনই একটা জিনিসও হারায়নি বা চুরি যায়নি। 

রমেনবাবুর বাড়িটা প্রায় দেড় বিঘা জমির ওপর। বিরাট দোতলা বাড়ি। সব মিলিয়ে প্রায় খান পঞ্চাশ ঘর রয়েছে বাড়িটাতে। বছরের অন্যান্য সময় ঘরগুলি বন্ধই থাকে তবে এই সময়ে ঘরগুলি খুলে দেওয়া হয়। প্রতিটা ঘরই ঝকঝকে করে পরিষ্কার করে নেন মালতি দেবী। অতিথিরা সব এই ঘরগুলিতে থাকবে বলে কথা। রমেনবাবুকে যেন কোন দিক থেকে লজ্জায় না পড়তে হয় সেই দিকে লক্ষ্য রাখেন মালতি দেবী। উনিও ওনার স্বামীকে খুবই শ্রদ্ধা করেন। জমিদার বংশের ছেলে অথচ ওনার মত অতি সাধারণ ঘরের মেয়েকে বিয়ে করে এনেছিলেন বলে রমেনবাবুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেন না দাম্পত্য জীবনের ত্রিশ বছর পরেও। মালতি দেবী রান্নার কাজে নিযুক্ত লোকেদের নির্দেশ দিচ্ছেন দুপুরে কি রান্না হবে। ক্ষণে ক্ষণে চা করার নির্দেশ দিচ্ছেন যখনই কোন অতিথি এসে পৌঁছাচ্ছেন। 

    এমনিতে এত বড় বাড়ি সারা বছর ধরে সেভাবে পরিচর্যা করা হয় না। এখন বাড়ির কোথাও একটুও ধুলো জমে নেই। এদিকে ঠাকুরদালানটা বাড়ির একটু বাইরে। সেখানে কলকাতা থেকে মৃৎশিল্পী এসেছেন। কাজ করে যাচ্ছেন। মালতি দেবী একটু পরপর ওনাকে চা জলখাবার দিয়ে আসছেন। ঠাকুর তৈরীর কাজ প্রায় শেষ। মহালয়ার দিন চক্ষুদান হবে। চক্ষুদানের দিন একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে গ্রামের লোকেরা তাদের লোকসংগীত পরিবেশন করবেন। 

      মহালয়ার দিন চক্ষুদান হলো গ্রামের সবাই লোকসংগীত পরিবেশন করলেন। এক কথায় এক জমজমাট অনুষ্ঠান। আমেরিকা প্রবাসী রমিত এই অনুষ্ঠান দেখে অভিভূত। ও নিজেই ক্যামেরায় ধরে রাখলো চক্ষুদান থেকে লোকসংগীত অনুষ্ঠান সবটাই। সাতদিন পরে পুজো শুরু হবে কিন্তু সাতদিন ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করবে গ্রামের লোকজনরাই । অতিথিরাও সবাই থাকবেন। সবাই খুব খুশী এই ধরনের অনুষ্ঠানের স্বাদ উপভোগ করতে পেরে। সন্ধ্যাবেলা থেকে শুরু করে রাত এগারোটা পর্যন্ত চলে এই অনুষ্ঠান। অতিথিদের মধ্যে থেকেও যারা যা পারে করে। সমস্ত বাড়ি আলোয় আলোয় সাজানো। রাত হয়ে গেলেও মনেই হয় না রাত হয়েছে। রাতের অন্ধকারকেও হার মানিয়ে দেয় এই আলোকমালা। ঠাকুর তৈরীর কাজ শেষ। রমেন বাবু মৃৎশিল্পী কে সমস্ত পাওনা গন্ডা বুঝিয়ে দিয়ে ওনাকে থাকবার অনুরোধ করলেন। উনিও রাজি হয়ে গেলেন এই ধরনের আনন্দ দেখে। আসলে কলকাতায় ফিরে তো সেই গতানুগতিক যান্ত্রিক জীবন। তার থেকে এই আনন্দটাকে একটু চেটে পুটে নেবার উদ্দেশ্যেই থেকে যাওয়া। 

     ষষ্ঠীর দিন ঠাকুরের বোধন হবে। মালতি দেবীর নির্দেশে এই দিন নিরামিষ খাওয়া হবে। সকালে কি হবে একপ্রস্থ বলে দিয়ে এলেন রান্নার লোকদের।দুপুরের রান্নার নির্দেশও দিয়ে এসেছেন। সবাই এই কদিন একেবারে পেটপুরে খান এবাড়িতে। পুরোহিতমশাই চলে এসেছেন সকাল বেলাতেই। নির্ঘণ্ট দেখে বোধন হলো। সবাই একজায়গায় গোল করে বসে গল্প করছেন অতিথিরা। গ্রামের লোকজনরাই সব দেখেশুনে ঠিক করে রাখছে। ওনারা সারারাত ধরে ঠাকুরদালানে জেগে থাকেন আর রমেন বাবুদের আশীর্বাদ করতে থাকেন এরকম একটা উৎসব উপহার দেবার জন্য। গত বছর ছোট বাবু মানে রমিত আসেনি বলে এত জাঁকজমক করে পুজোটা হয়নি।এবার ও আসাতে জাঁকজমকের কোন খামতি নেই। সপ্তমীর পুজো হলো অষ্টমীর পুজোও হলো। অষ্টমীর পুজোর শেষে অঞ্জলি দিতে এলো রমিত। ও এখনো পর্যন্ত কিছু খায়নি। নিয়ম মেনে উপোস করে অঞ্জলি দিতে গেল সবার সাথে। সেদিন পাশের গ্রামেরও কিছু লোক এসেছিল পুজো দেখতে। সবাই একরকম উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে লাগলো এরকম আন্তরিকতার সাথে পুজো দেখে। সেখানে ময়না বলে একটা বছর কুড়ির মেয়েও এসেছিল ওর বাবা-মায়ের সাথে। ময়নাকে দেখে রমিতের হৃদস্পন্দন শুরু হয়ে গেল। ওর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। কি সুন্দর দেখতে মেয়েটাকে।বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে এসেছে অঞ্জলি দিতে। অপূর্ব,অপরুপা। ওর মনের মধ্যে আলোড়ন তৈরি হলো। অথচ সেই আলোড়ন ময়না পর্যন্ত পৌঁছতে পারলো কিনা ও বলতে পারবে না। ও কোনো রকমে অঞ্জলিটা দিয়েই ঘরের ভেতরে চলে গেল ক্যামেরাটা আনতে। ক্যামেরাটা নিয়ে এসে ময়নার অগোচরেই বেশ কিছু ছবি তুলে নিল যদিও এটা জানত যে ও অন্যায় করছে। নবমীর পুজো শেষ। সেদিনও ময়না এসেছে। রমিত শুধু চোখ মেলে ওকে দেখে যাচ্ছে। ময়না ওর দিকে একবারের জন্যেও তাকাচ্ছে না। মনে মনে একটু রেগে গেল রমিত এত দেমাক মেয়েটার ওকে একবারের জন্যেও দেখছে না ।দশমী এলো সবাই মাকে বরণ করছে। রমিতের ক্যামেরা একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছে। মালতি দেবীও বরণ করলেন। অতিথিরাও একে একে সবাই মাকে বরণ করলেন। এবার ঠাকুর নিয়ে গ্রামের পাশের নদীতে ভাসানের উদ্দেশ্যে যাওয়া হবে। সেইমতো নিখুঁত আয়োজনে ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হল। ভাসানে যাবার সময় ময়না রমিতের কাছাকাছি এলো।রাস্তায় ওদের কথা শুরু হল। রমিতকে বললো আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকেন কেন আমার লজ্জা করেনা বুঝি?রমিত আকাশ থেকে পড়লো যে একবারও ওর দিকে তাকায় নি সে জানল কিভাবে? কথায় কথায় ওরা ঘাটে চলে এলো ঠাকুর বিসর্জনও হয়ে গেল। সবাই বাড়ি গিয়ে মিষ্টিমুখ করে যে যার বাড়ি চলে গেল। এতদিন যে হইচই ছিল হঠাৎ যেন সব শান্ত হয়ে গেল। ও সুযোগ বুঝে ওর মাকে ময়না সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল, ছবিও দেখালো। ওর মা হাসিমুখে সব কথা শুনলেন। রাতে রমেন বাবুকে বললেন তোমার ছেলের মনে ময়না বাসা বেধেছে। সেই কথা শুনে রমেনবাবু উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন।পরেরদিনই ওনারা দুজনে চলে গেলেন ময়নাদের বাড়ি। ময়নার বাবা-মাকে সব কথা বললেন এবং ময়নাকে ওনারা বৌমা হিসেবে চান সেটাও জানিয়ে দিয়ে এলেন। এদিকে ময়না আড়িপেতে সব শুনে খুবই খুশিই হলো।পরেরদিন ময়নার বাবা-মা রমিতের বাড়ি এসে পৌঁছলো এবং সব কথাবার্তা পাকা করে ফেলল। রমিতের আমেরিকা ফিরে যাবার আগে ময়নার সাথে রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়ে গেল। পরের বার এসে সামাজিকভাবে ময়নাকে বিয়ে করে আমেরিকা নিয়ে যাবে। তার আগে ময়নার সব কাগজপত্র করে নিতে হবে। জয় মা দুর্গা,দুর্গতিনাশিনী।