Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন
আনন্দনিকেতন
কলমে -আকাশ দত্ত
***************************আমরা জীবনের চলার পথে কত গল্পই না শুনি , কখনো মন ভালো করে দেবার গল্প আবার কখনো মন খারাপের গল্প । জীবনের চলার এই পথটায় সময়ের স্রোতে দুই ধরনের গল্পই এক সূত্রে …

 


#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন


আনন্দনিকেতন


কলমে -আকাশ দত্ত


***************************

আমরা জীবনের চলার পথে কত গল্পই না শুনি , কখনো মন ভালো করে দেবার গল্প আবার কখনো মন খারাপের গল্প । জীবনের চলার এই পথটায় সময়ের স্রোতে দুই ধরনের গল্পই এক সূত্রে বাঁধা । এরই নাম যে জীবন । আজ এই জীবনের একটা গল্প নাহয় বলি  যে গল্প জীবনের চলার পথে তিনটে মানুষের গল্প । হ্যাঁ সময়ের স্রোতে চলতে চলতে এরাও এসে পৌঁছেছিল একে অপরের সামনে আর শুরু হয়েছিল জীবনে চলার গল্প ।


নীলিমার সঙ্গে আজ প্রথম আলাপ হলো ঋকের । কেমন যেন ভালোলাগা রয়েছে নীলিমার দুই চোখে , ঋক ওই দুটো চোখের পানে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো, সত্যি এত সুন্দর কেউ হয় ঋকের জানা ছিল না । রূপকথার গল্পের রাজকন্যার মতন ঠিক , ছোটবেলায় যখন ঠাকুমা গল্প বলতো তখন ঠাকুমার মুখে শুনতো রূপকথার গল্পগুলো ।


নীলিমা জীবনকে ভালোবাসে , নীলিমা ভালোবাসে সবাইকে নিয়ে বাঁচতে ।  নীলিমার জীবনে একমাত্র রয়েছে ওর দাদু শ্রী নৃপতি শঙ্কর রয় । বাবা মাকে দেখেনি কখনো নীলিমা শুধু শুনেছে বাবা মা ওর যখন এক বছর বয়েস তখন একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছে । নীলিমার মনে অন্তরে বাবা মাকে ঘিরে হাজার কল্পনা থাকলেও কোনো স্মৃতি নেই । জ্ঞান হবার পর থেকে দাদুকেই দেখেছে ও , দাদু ওর সব  । দাদু নিজের ভালোবাসায় মমতায় আগলে ওকে বড়ো করে তুলেছে তিলে তিলে । দাদু তো সারাদিনে শুধু দিদিভাই দিদিভাই বলতে অস্থির , আসল কথা হলো  নীলিমা আর নৃপতি বাবু একে অপরকে চোখে হারায় ।


নীলিমা এখন রবীন্দ্রভারতীতে পড়াশুনো করে , সারাদিন কাটে কলেজে, টিউশনে । বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যে হয় যায় । বাড়ি ফিরে যতক্ষণ না দাদুর মুখটা দেখতে পায় ততক্ষন মনের ভেতরে শান্তি হয় না । সবসময় শুধু মনে হয়  দাদু কি করছে দাদু ঠিক মতো খেলো কিনা , ওষুধ খেলো কিনা । দুপুরে ঘুমোলো কিনা , সবকিছু । বাড়ি ফেরার পর নীলিমা দাদুর থেকে সারাদিনের সমস্ত খবর নেয় ।


নৃপতি শঙ্কর রয় যার কথা এতক্ষন হচ্ছিল , একজন রিটায়ার্ড শিক্ষক । সারাজীবন যুক্ত ছিলেন পড়ানোর  পেশার সঙ্গে । ছেলে বৌমা  মারা  যাবার পর , স্ত্রীও চলে গেলো হটাৎ করেই । তারপর পুরো যেন একটা পাথর হয়ে গেছিলেন , মনে হচ্ছিল জীবনের সমস্ত কিছু শেষ  ঠিক তখনই ওনার নাতনির নিষ্পাপ ফুটফুটে মুখটার দিকে তাকিয়ে জীবনকেই বেছে নিলেন । নাতনিকে সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে ধীরে ধীরে বড়ো করে তুললেন উনি , আগলে রাখলেন । নর্থ ক্যালকাটা ওনার বরাবরের প্রিয় তাই মানিকতলায় এই বাড়িটা সেই জীবনের প্রথম দিকে শুরু করেছিলেন আর বেরোতে পারেননি এই বাড়ি থেকে । এই বাড়ির সঙ্গে মায়া ভালোবাসা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে । ওনার ছেলে বৌমার স্মৃতি , ওনার স্ত্রীয়ের স্মৃতি , নীলিমার বেড়ে ওঠা  এই সমস্ত কিছু এই বাড়ির প্রতিটা জায়গায় জড়িয়ে রয়েছে । এই বাড়িতেই দাদু নাতনি মিলে রয়ে গেলেন । বাড়ির নামটা উনি ভালোবেসে রেখেছিলেন  “আনন্দনিকেতন " ।


ঋকের আজকাল খুব মায়ের কথা মনে পড়ে , মা বেঁচে থাকলে ঋক মাকে নিয়ে আসতো নিজের সাথে এই আনন্দনিকেতনেই । বাবাকে চোখে দেখেনি ঋক , মার কাছে জিজ্ঞেস করে কখনো কোনো উত্তর মেলেনি । মা ওর কাছে সব , ওর প্রাণ কিন্তু মা যে আর রইলো না । কয়েক মাস আগে একটা কঠিন অসুখে চলে গেলো মা , ওকে একলা করে দিয়ে । আজ ও  যে সম্পূর্ণ একা , কি করবে কিছু না বুঝতে না পেরে এসে গেলো কলকাতায় । নিজের আত্মীয় বলতে তো কেউই নেই  ওর জীবনে , শুধু থাকার মধ্যে রয়েছে কলকাতায় একটা বন্ধু । সেই বন্ধুর কাছে আসতেই কিছুটা সাহায্য হলো । বন্ধু  নর্থ ক্যালকাটায় একটা গ্যারেজে কাজ করে দিল আর তার সঙ্গে দিল থাকার ঠিকানা । নৃপতিবাবু আনন্দনিকেতনের নিচতলায় ভাড়া দেবার কথা ভেবেছিলেন , পেপারে অ্যাড দিয়েছিলেন আর সেই সূত্রেই ঋক বন্ধুর কাছ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে চলে গেলো আনন্দনিকেতনে ।


আনন্দনিকেতনে আজ কতগুলো মাস যে দেখতে দেখতে কেটে গেলো ঋক নিজেই খেয়াল করেনি , আজ অজান্তেই মনে পড়তে লাগলো পুরোনো কথাগুলো । কয়েকদিন আগে সেই যে নীলিমার সঙ্গে প্রথম আলাপ , সেই আলাপ যে কখন বদলে গেলো ধীরে ধীরে ভালো লাগায় ঋক জানেনা । ও শুধু জানে নীলিমা ওর মনের অনেকটা জায়গা জুড়ে , আর এই নীলিমার সঙ্গে আলাপের পরেই পুরোনো স্মৃতিগুলো আবার ভেসে উঠতে লাগলো দুই চোখের সামনে । আজ মা থাকলে মার কোলে মাথা রেখে শুয়ে সেই ছোটবেলার মতো , নীলিমার গল্প বলতো ।


নীলিমার জীবনটা যেন একটা স্বপ্নের মতো লাগছে ঋকের সঙ্গে দেখা হবার পরে , এই তো কটা দিন আগেই এলো ছেলেটা ওদের বাড়ির নিচে ভাড়াটে হয়ে । তখন  নীলিমা যেতে আসতে একবার দুবার ওকে কিন্তু সেইভাবে কথা হয়নি কখনো কিন্তু প্রথম যেদিন ঋক বাড়ির বাইরে ওই বড়ো রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ওকে ওর মনের কথাগুলো বললো  , সেদিন পুরো বিস্ময় হয়ে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে ছিল ও । ওর এই জীবনে ঋক  একটা ভালোলাগার পরশ নিয়ে এসেছে যা ওর জীবনটা সাজিয়ে দিয়েছে সাতরঙা রামধনুর রঙে ।


ঋক সারাদিন কাজ করে গ্যারেজে । ওর পরিশ্রম ওর সততা ওকে এগিয়েছে অনেকটা । গাড়ির কাজ এখন ভালোভাবে শিখে গেছে ও , নিজের হাতে প্রায় অনেকটা কাজই দেখাশুনো করে তাই আগের থেকে মাইনে কিছুটা বেড়েছে । নীলিমাকে ও ওর মনের সব কথাগুলো খুলে বলে এখন , ওর জীবনের জমে থাকা গল্পগুলো । নীলিমাকে বলে ওর সমস্ত স্বপ্নগুলো , একটা সুন্দর সুস্থ জীবনের স্বপ্ন । নিজে ও আরেকটু দাঁড়িয়ে তারপর গিয়ে দাঁড়াবে নৃপতিবাবুর সামনে , ওদের ভালোবাসার কথা জানাবে  , নীলিমাকে দেবে জীবনের গল্পে , ওদের এই চলার পথে এক নতুন পরিচয় ।

নীলিমারও তাতে সায় রয়েছে , নীলিমা বলেছে দাদু খুব খুব ভালো । ও নিয়ে যাবে ঋককে দাদুর কাছে আর বলবে ওদের ভালোবাসার কথা ।


******


নৃপতিবাবু  ইদানিং লক্ষ্য করেছেন ওনার নাতনির মুখটা সবসময় হাসিখুশি থাকে , সারাক্ষন কি যেন ভাবে দিদিভাই । কদিন আগে দিদিভাইয়ের ঘরে ডায়েরিতে লেখা কবিতাও দেখতে পেয়েছেন  উনি । দিদিভাইকে এরকম খুশি দেখতে পেয়ে উনিও খুব খুশি , তবে এই খুশির কারণটা জানতে হবে শীঘ্রই ।


সময় এগোলো , নীলিমা আর ঋক যখন মনে করেছিল নিজেদের মনের কথা , নিজেদের ভালোবাসার কথা দাদুকে বলবে ঠিক তখনই একটা বড়ো আঘাত নেমে এলো ওদের জীবনে । একদিন নীলিমার কাছে কলেজেই খবর আসে দাদুর রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা গাড়ি ধাক্কা মেরেছে । দাদুকে অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে , অনেকটা রক্তক্ষয় হয়েছে । খবরটা শোনা মাত্রই মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়লো নীলিমার , ওর জীবনে যে দাদু সব । দাদুর কিছু হয়ে গেলে ও যে শেষ হয়ে যাবে নিজে ।


হাসপাতালে এসে পৌঁছলো যখন ঋক আর নীলিমা তখন বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে । দাদুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওটিতে জানা গেলো । নীলিমাকে সামলে রাখা কঠিন হয়ে উঠছিল, নীলিমার যখনই দাদুর মুখটা ভেসে উঠছে ঠিক তখনই চোখের কাছটা ঝাঁপসা হয়ে উঠছে । 


ডাক্তার বেরোলো একটা সময়ের পরে এবং এসে জানালো প্রচুর রক্তক্ষয় হয়েছে । আর্জেন্ট রক্ত লাগবে , রক্ত না পাওয়া গেলে দাদুকে বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়বে । জানা গেলো হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে দাদুর গ্রূপের কোনো ব্লাড নেই , কিন্তু যেভাবেই হোক ইমিডিয়েট ব্লাড এরেঞ্জ করতে হবে । ঋক দেরি করলো না , দাদুর আর ওর ব্লাড গ্রূপ একই তাই ও তড়িঘড়ি ডাক্তারকে বললো , রক্ত ও দেবে সবকিছু এরেঞ্জ করতে ।


হাসপাতালের বেডে শুয়ে রয়েছে নৃপতিবাবু । সামনে দাঁড়িয়ে উদগ্রীব চোখে নীলিমা আর ঋক । ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে থাকা চোখের পাতা খুললেন উনি , হাতের শীর্ণকায় আঙ্গুলগুলো নাড়াতে লাগলেন । চোখের সামনে দেখলেন দিদিভাই আর নিচের ভাড়া থাকা ছেলেটাকে । দুজনেই হাসি মুখে চেয়ে রয়েছে ওনার দিকে । ঠিক তখনই ঢুকলো ডাক্তার  ,  বাকিটা বললেন উনি..


ওনার মুখেই নৃপতিবাবু শুনলেন কিভাবে অচৈতন্য অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে ওনাকে ।  কিভাবে ওনার নাতনি কান্নায় ভেঙে পড়েছিল ওনার খবর জেনে , কিভাবে রক্ত লাগবে শুনতেই ঋক এগিয়ে এসে নিজের রক্ত দিয়েছে ।  সবকিছু শোনবার পরে চোখদুটো ছলছল করে উঠলো ওনার , দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন উনি নীলিমা আর ঋককে ।


*****


(কিছু মাস বাদে ,)


আনন্দনিকেতন আজ সেজে উঠেছে ঝলমল আলোয় । সেজে উঠেছে গোটা আনন্দমহল আলোর রোশনাইয়ে । বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে সানাইয়ের সুর । নৃপতি শঙ্কর রয় দাঁড়িয়ে রয়েছেন  বাড়ির দালানে , আজ  যে উনি খুব খুশি । আজ ওনার জীবনের স্বপ্ন সত্যি হলো , যে স্বপ্ন উনি তিলে তিলে সাজিয়েছিলেন নিজের অন্তরে আজ সে স্বপ্ন যে প্রাণ পেল । আজ যে ওনার মিষ্টি দিদিভাই আর দাদুভাইয়ের বিয়ে সম্পন্ন হলো । উনি নিজের হাতে করলেন কন্যাদান । আর কোনো কষ্ট কোনো দুঃখ নেই ওনার...আজ যে স্বপ্ন সার্থক হলো ওনার ।  অজান্তে চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো ওনার ।


আর ঋক আর নীলিমা । ওদের জীবন আজ এক হলো । ওদের দেখা সব স্বপ্নগুলো প্রাণ পেল আজ । ঋক ভাড়াটে হয়ে এসেছিল এই আনন্দনিকেতনে আর আজ দাদু নিজের হাতে চার হাত এক করলো । সত্যি তো পুরোটাই একটা রূপকথার গল্পের মতো , জীবনের গল্পগুলো বোধহয় এইভাবে রূপ পায় ।


এইভাবেই বোধহয় স্বপ্ন সত্যি হয় । এইভাবেই দাদুকে নিয়ে ভালোবাসায়  ওরা থাকবে সারাজীবন এই আনন্দনিকেতনে ।