Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

সৃষ্টি সাহিত্য যাপন#কোথায়_তুমি#অরিন্দম_ভট্টাচার্য্য 
সন্ধ্যার দিকে একাই চুপচাপ বসেছিলাম বড় লেকটার ধারে। শীতকাল হলেও ঠিক শীততো আর নেই, তাই লেকের দিকে থেকে ছুটে আসা মৃদুমন্দ বাতাসের ছোঁয়া বেশ লাগছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ কয়েকট…

 


সৃষ্টি সাহিত্য যাপন

#কোথায়_তুমি

#অরিন্দম_ভট্টাচার্য্য 


সন্ধ্যার দিকে একাই চুপচাপ বসেছিলাম বড় লেকটার ধারে। শীতকাল হলেও ঠিক শীততো আর নেই, তাই লেকের দিকে থেকে ছুটে আসা মৃদুমন্দ বাতাসের ছোঁয়া বেশ লাগছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ কয়েকটা হাইও উঠে গেল।

হঠাৎ কোথা থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এলো কানে -- আসামী হা-জি---র।

আমি চারিদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে মনের ভুল ভেবে পুনরায় আবেশে ভাসলাম।

কিছুক্ষণ পর আবার এক‌ইরকম সুরে -- আসামী হা-জি---র। তবে এইবার যেন আগের বারের থেকে আরো স্পষ্ট। কেউ যেন একেবারে কানের কাছে হাঁক দিয়ে গেল।

আওয়াজটা ঠিক কোনদিক থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করতে, আমি সেদিকে আর একটু মন দিতেই... সুরুৎ করে কিসের একটা ফাঁক দিয়ে যেন গলে গেলাম। চোখের সামনেই একটা বেশ বড়সড় আদালত নজরে এলো। বুঝলাম আওয়াজটা ওখান থেকেই আসছে।

মনের ঘরে আদালত বসেছে। আমি চুপিসারে সকলের অলক্ষ্যে প্রবেশ করলাম সেখানে। চোখে পড়ল আমার‌ই মতো একজন বসে আছে দর্শকাসনে। চুপিচুপি গিয়ে তার পাশেই বসলাম।

আদালতের কি অবস্থা! চারিদিকে নোংরা, ঝুলকালি পড়েছে দেওয়ালে, এখানে সেখানে মাকড়সার জাল, কেমন একটা ভ্যাপসা পচা গন্ধে ভরে রয়েছে চতুর্দিক। পাশের ভদ্রলোকটি কেমন করে জানি না বুঝতে পেরেছেন, আমি এ সভায় নতুন। তার কাছেই জানতে পারলাম -- উনি প্রথম দিন থেকেই এখানে আসেন। শুরু শুরুতে নাকি এটা ইন্দ্রের রাজসভার মতো ছিল। কানে সবসময় গুঁজতো গন্ধর্বের সুর তাল আর ছন্দে ছন্দে অপ্সরার পায়েলের শব্দ, পারিজাতের সৌরভে ম ম করতো চতুর্দিক, চন্দ্র সূর্যের আলোয় আলোয় ঝলমল করতো কক্ষ। আসলে স্বর্গ রাজ্যের আদলেই তৈরি কিনা....  পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়নি বহুবছর। তাই ধীরে ধীরে নরকের রূপ নিয়েছে এটা।


 আদালতের প্রধান বিচারপতিকে দেখে তো হাসি পাওয়ার জোগাড়। জটলাগা পাকা চুল, চোখে ভালো দেখেন না, কানে ভালো শোনেন না, নড়বড়ে শরীর, কথায় কথায় খক্ খক্ করে শুধু কাশি। বড়বড় গোলগোল আবছা কাঁচের একখানা চশমা পড়ে, চোখবুজে বসে বসে আসামীর সাফাই শুনছেন আর রায় দিচ্ছেন। আসলে হাঁটা চলা নেই, শারীরিক কসরৎ নেই, ঐ এক ঘরে বসে বসে এতো বছর ধরে শুধুই চোর ছ্যাঁচড় সামলাতে সামলাতে যেন অকালবৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন উনি। পাশেরজন ফিসফিসিয়ে আমাকে বললেন, "ইনিই বিবেকবাবু। একসময় এঁর কঠিন রায়ের ভয়ে দুনিয়া কাঁপতো। তবে আজকাল সবাই আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে গলে যায়।"

বিবেকের পাশেই দাড় করানো রয়েছে একটা মস্তবড় দন্ড, যার মাথাটা দেখতে একটা হাঁ করা সাপের মুখের মতো। ওটার কাজ ঠিক বুঝতে না পেরে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম -- আচ্ছা দাদা! ঐ মস্ত লাঠিটা কিসের জন্য ওখানে রাখা আছে?

ভদ্রলোক হেসে বললেন -- আরে! ওটাইতো বিচারের প্রধান জিনিস। ওটা একটা অনুভুতি যন্ত্র। বিবেকবাবু ভালো মন্দ কাজ বিচার করে ওটা দিয়েই কখনো প্রীতিকর সুখানুভূতি প্রেরণ করেন বা কখনো অপ্রীতিকর বেদনাদায়ক দুঃখানুভুতি প্রেরণ করেন।


-- তারমানে ঐ অপ্রীতিকর অনুভূতিটাকেই আমরা বিবেকের দংশন বলি?


-- একদম। এখানে কোনো অন্যায় বা মন্দ কর্মের জন্য কোনো জেল হেফাজত বা শুলিফাঁসির ব্যবস্থা নেই। শুধুমাত্র ঐ অনুভূতির দংশন। তবে ঐ যন্ত্র এখন আর ঠিক কাজ করে না। বিবেক বাবু নিয়ম মতো যন্ত্রটি ব্যবহার করার চেষ্টা করেন ঠিক‌ই, কিন্তু দংশন করতে করতে ওর ব্যাটারীর চার্জ কবে শেষ হয়ে গেছে....


-- আরে! এ আবার কি রকম ব্যবস্থা? এ রকম একটা যন্ত্রের জন্য কোনো চার্জার থাকবে না?


-- সে আবার নেই! আছে তো। অটোমেটিক রিচার্জের ব্যবস্থা আছে। কোনো ভালো কর্মের জন্য যখন ঐ যন্ত্রটি সুখানুভূতি প্রেরণ করে, তখন ঐ পজিটিভ অনুভূতিকে ব্যবহার করে সে নিজেও কিছুটা রিচার্জ হয়ে নেয়। কিন্তু দাদা! আজকাল ভালো কর্ম, সুচিন্তা আদালতে আর আসে ক‌ই? তাই দন্ডের এই হাল।


-- ও... বুঝলাম। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।


দেখলাম আদালতের ভাঙাচোরা কাঠগড়ার পাশেই কাঁচুমাচু মুখে ভিড় করে আসামীরা সব দাড়িয়ে। ওদের দিকে ভালো করে নজর দিতেই অবাক হয়ে গেলাম। চিনতে পারলাম, ওরা আমার‌ই বিভিন্ন কাজকর্ম আর ভাবনা চিন্তা। একে একে সবাই কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াচ্ছে, আর একে একে তাদের বিচার করছেন বিচারপতি। সত্যিই এ বিচার এক অন্য ধরনের বিচার। প্রত্যেক কর্ম আর ভাবনা চিন্তার ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, প্রশংসা-নিন্দা, গৌরব-অগৌরব, কল্যাণ-অকল্যাণ ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে বিচার হচ্ছে এখানে।

আশ্চর্য ব্যাপার! আজ আমার দু-একটা সু-চিন্তার বিচারের পরেই দন্ডটা কেমন ঝকঝক করতে লাগলো। বুঝলাম ওটা কিছুটা রিচার্জ হয়ে গেছে এবার। আমার পাশের জড়সড় ভদ্রলোক‌কেও বেশ খুশি খুশি লাগছে এখন। এরপর শুরু হলো আমার কু-কর্মগুলির বিচার। বিচারে এক একটা কর্ম যখন ঘৃণ্য বা অনুচিত প্রতিপন্ন হচ্ছে,  বিচার শেষে বিচারপতি তখন অনুভূতি যন্ত্রটি আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। বুঝলাম কর্মের শুধু বিচার হয়, তার কোনো সাজা হয় না। যেহেতু কর্মটি আমি করেছি, তাই সাজা যা পাওয়ার তার আমিই পাবো।


কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার! কুকর্মের সাজা স্বরূপ সেরকম কোনো দুঃখ কষ্ট‌ই অনুভব করছি না আমি । বরং আমার পাশের ভদ্রলোকটিকে দেখছি, অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করছে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে যন্ত্রনায়। আমি তাকে তুলে ধরে জিজ্ঞেস করলাম -- আপনি কেন অযথা কষ্ট পাচ্ছেন? কর্ম তো আমার। আপনি কি সবার কর্মফল ভোগ করার জন্য এখানে এসে বসে থাকেন?


ভদ্রলোক খুব অবাক চোখে আমার দিকে তাকালেন। বললেন -- আপনি কি এখনো আমাকে চিনতে পারেন নি? আমি আপনার অন্তরাত্মা, আপনার সুক্ষ্ম একক। সে আনন্দ হোক বা দুঃখ, অনুভূতি সর্বদা সুক্ষ্মেই কাজ করে।


পকেটের মোবাইলটা সজোরে ভাইব্রেট করে উঠলো। কিছু একটা মেসেজ এসেছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম, কেউ কোত্থাও নেই। আমি এক‌ইভাবে লেকের ধারে‌ই বসে আছি। দু'চোখে একরাশ শূন্যতা নিয়ে একটা গভীর অথচ শান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুকে হাত দিয়ে মনে মনে প্রশ্ন করলাম -- কোথায় তুমি?