#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন#বিষয়_সামাজিক গল্প#শিরোনাম_গুপ্তধনের খোঁজে#অয়ন্তিকা সেন
"এক কথা কতবার তোমায় বোঝাতে হবে রমা?রায়গঞ্জের ঐ ধ্বংসাবশেষ বাড়ির পিছনে একটা টাকাও আমি দেব না"।
" কিন্তু তুমি যেটাকে ধ্বংসাবশেষ বলে কটুক্তি কর…
#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন
#বিষয়_সামাজিক গল্প
#শিরোনাম_গুপ্তধনের খোঁজে
#অয়ন্তিকা সেন
"এক কথা কতবার তোমায় বোঝাতে হবে রমা?রায়গঞ্জের ঐ ধ্বংসাবশেষ বাড়ির পিছনে একটা টাকাও আমি দেব না"।
" কিন্তু তুমি যেটাকে ধ্বংসাবশেষ বলে কটুক্তি করছ, ভুলে যেও না সেটা তোমার পূর্বপুরুষদের বাড়ি,তোমার আর তোমার ছেলের বাড়ি।তাই,ওই বাড়ির ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও তোমার"।
"কীসের দায়িত্ব রমা?কে যাবে ওখানে?সায়ন?
সায়ন এই যুগের ছেলে।শহরের জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ ছেড়ে ও আর বউমা কখনই ওই পুরোনো ভাঙাচোরা রাজবাড়িতে যাবে না।
"দেখো,আমি আবারও বলছি,ওই বাড়িকে বাঁচাও।ওই বাড়িতে তোমার-বাবার শৈশবকাল,কৈশোরকাল কেটেছে।তোমার গুরুজনদের আশীর্বাদের ছোঁয়া রয়েছে ঐ বাড়ির প্রতিটি দেওয়ালে।কত অম্লমধুর স্মৃতি গাঁথা আছে ঐ রাজবাড়ির প্রতিটি ইঁটের ফাঁকফোকরে। যুগ যুগ ধরে বয়ে আনা স্মৃতির ভারে এখন বাড়িটা নুইয়ে পড়েছে,সেই বাড়ির উত্তরাধিকারী হিসেবে,বাড়িটাকে সোজা করে দাঁড় করাতে যে অবলম্বন দরকার,সেটা তুমি।আর তাছাড়া কে বলেছে তোমায়,সায়ন ঐ রাজবাড়িতে থাকতে চায় না?অবশ্য তুমি কী করে জানবে ছেলের মনের কথা?কোনোদিন ছেলেটাকে পাশে বসিয়ে দুটো কথা বলেছ?কখনও জানতে চেয়েছ ও কী চায় না চায়?সারা জীবনটা তো ব্যবসা আর টাকা টাকা করেই কাটিয়ে দিলে।
কিন্তু এখন আমি কিছুতেই আমার শ্বশুরের ভিটে বেচতে দেব না।সায়নও চায় না বাড়িটা বিক্রি হোক।আমাকে কতবার বলেছে,'মা ঐ বাড়িতে আমার জন্ম না হলেও,ও বাড়ি আমার খুব চেনা লাগে,মনে হয় এর সাথে আমার একটা আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে।তাই বলছি মা,তুমি কোনোমতেই ঐ বাড়ি বেচতে দিও না'।
আর সুনীল,বাবারও তো শেষ ইচ্ছে ছিল ঐ বাড়ি যেন বেচা না হয়"!
"ওসব বাজে সেন্টিমেন্ট আমার নেই রমা।যতদিন ঐ বাড়িতে লোকজন ছিল,ততদিন বাড়িটার অস্তিত্ব আমার কাছে ছিল।এখন লোকজনও নেই,তাই ঐ বাড়ির অস্তিত্বও আর নেই।মিস্টার বাসুর সাথে কথা হয়ে গেছে আমার।তিনি রাজি হয়ে গেছেন চামচিকেদের বাসস্থানটি নিতে।
রমা আর কথা বাড়ালেন না।চুপচাপ নিজের ঘরে শুয়ে পড়লেন।কিন্তু ঘুম আর আসছে কই?যতবার ঘুমোবার চেষ্টা করছেন ততবারই তাঁর শ্বশুরমশাইয়ের শেষ কথাটি মনে পড়ছে,"রমা, তোকে কোনোদিনই আমরা বউমার আসনে বসাইনি,বসিয়েছি মায়ের আসনে।আর তুইও তো তাই মেনে এসেছিস চিরটাকাল।তাই শেষবারের মতো একটা অনুরোধ করছি তোকে,আমি চলে যাওয়ার পর আমার পূর্বপুরুষের ভিটেটা রক্ষা করিস।আমার শরীরটাই শুধু এখানে আটকে,কিন্তু আমার আত্মার বাস যে ওখানেই। আমাদের পূর্বপুরুষদের মৃত্যুর পরেও প্রাণ আছে ঐ বাড়িতে জানিস?এখনও ওদের অস্তিত্ব আছে,আমি অনুভব করেছি..সকলেই পরপারে হারিয়ে গেলেও,উন্মুখ হয়ে রয়েছে আবার ফিরে আসার..
আবার ফিরব আমরা যুগে যুগে ঐ বাড়িতে,নতুনরূপে।আবার ঐ বাড়িতে ছোটাছুটি করব সকল ভাইবোন মিলে।দুপুরবেলা বাগানের আমগাছ থেকে আম পাড়ব,আবার ছাদে শুকোনো মা-ঠাকুমা-জ্যাঠাইমাদের আচারের বয়াম থেকে আচারও চুরি করব।দুষ্টুমি করলে বাবা-জ্যেঠুদের কঞ্চির মারও খাব।আবার আমরা রহিম চাচার সাথে জঙ্গলে খরগোশের পিছনে দৌড়ে বেড়াব।তবে আর বাঘ-সিংহ-হরিণের চামড়া,খন্ডিত মস্তক আর হরিণের শিংজোড়া দিয়ে রাজবাড়ির দেওয়াল সজ্জিত হবে না।আমার বিশ্বাস,তাতে রাজবাড়ির ঐতিহ্য একটুও কমবে না,বরং বাড়বে!
রমা,একমাত্র তুইই পারবি তোর এই বুড়ো ছেলেটার শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে।আমি আর ফিরতে পারব না ঐ বাড়ি না থাকলে।সেখানে যে ভালোবাসার গুপ্তধন লুকিয়ে আছে..তুইই রক্ষা করিস বাড়িটাকে।আমি আসব,আবার ফিরে আসব ঐ রাজবাড়িতে,সায়ন দাদুভাইয়ের মতো.."
"বাবা..বাবা.."
ধড়ফড় করে উঠে বসলেন রমা।স্বপ্ন দেখছিলেন কী?কিন্তু এরকম জীবন্ত স্বপ্ন আগে দেখেননি তো?সত্যিই কী বাবা এসেছিলেন?শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে রমার।জানলার রডটাতে মাথা দিয়ে সদ্যফোটা ভোরের আলোর কোমলতা অনুভব করার চেষ্টা করলেও ভারাক্রান্ত মনটা কিছুতেই যেন হাল্কা করতে পারছেন না।দেওয়ালে টাঙানো শ্বশুর মশাই আর শাশুড়ি মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন রমা।আর সেই সঙ্গে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন,সুনীলকে চিঠিটা দেখাতেই হবে,বিশ্বাস করবে না জানি।তাও শেষ চেষ্টা করতেই হবে।
"কী গো কিছু বলবে?তখন থেকে উশখুশ করছো দেখছি"?
"হ্যাঁ সুনীল,খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা"।
রমার দৃপ্তস্বরে বলা কথাগুলোয় সুনীল একটু অবাকই হলেন।
সকালের সদ্য ধোঁয়া ওঠা চায়ে নিজের ঠোঁটা ছোঁয়াতে ছোঁয়াতেই,সুনীল বলে উঠলেন, "নতুন কিছু বললে শুনব।আগেই বলে দিয়েছি,শত বছরের জীর্ণ বাড়ির পিছনে আমি আর একটা টাকাও নষ্ট করব না"।
"সরি গো।এবারেও একই কথা বলব আমি, তবে এবারে একটু তোমার লাভের কথা বলতে এসেছি"।
"আমার লাভ?আমার লাভ একটাতেই।আর সেটা ঐ জঞ্জাল দূর করে"।
"ভুল করছ।ঐ বাড়ি হাতছাড়া করো না।এতে ক্ষতি তোমারই"।
"মানে"?
"মানে কিছু না।তোমাদের ঐ পুরোনো রাজবাড়িতে কোথাও একটা গুপ্তধন লুকানো আছে"।
"গুপ্তধন?কী আবোল তাবোল বকছ তুমি?আজকাল এইসব থাকে নাকি"?
"ঐ বাড়ি একশো বছরের পুরোনো।ডাকাতদের ভয়ে বাড়ির মাটির নীচে গুপ্তধন লুকিয়ে রাখাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়"।
রমার কথায় সুনীল চোখ থেকে চশমাটি খুলে কী একটা ভাবলেন।
"হ্যাঁ তা ঠিক। আমার দাদাঠাকুরই ছোটোবেলায় আমায় গল্প বলেছিলেন এই ডাকাতদের নিয়ে।আমরা সকল খুড়তুতো- জ্যাঠতুতো ভাইবোনেরা মিলে বেশ উপভোগ করতাম দাদাঠাকুরের গল্পগুলো"।
কথাগুলো বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন সুনীল।একটু পরে রমার দিকে তাকিয়ে বলেন,"তুমি কী করে জানলে এসব"?
সুনীলের কথার উত্তরে রমা একটি পুরোনো ভাঁজ করা চিঠি এগিয়ে দিয়ে বলেন,
"কাল ভোর রাতে বাবা স্বপ্নে এসেছিলেন।ঘুমটা ভেঙে যাওয়ার পর কী মনে হল বাবার আলমারিটা খুলি।বাবার স্মৃতিগুলো হাতড়াতে হাতড়াতে এই চিঠিটা পাই।এখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে ঐ বাড়িতে গুপ্তধন রয়েছে।
"কী বলছ রমা?তাহলে তো একবার রায়গঞ্জে যেতেই হয়"।
"সে তো না হয় বুঝলাম।কিন্তু মিস্টার বোসের কী হবে সুনীল?উনি তো সব কাগজপত্র তৈরী করে ফেলেছেন"।
"ও নিয়ে তুমি চিন্তা করো না।আমি কিছু করে হোক ডিলটা পোস্টপন করিয়ে দেব।আচ্ছা রমা আমরা কালই সেখানে রওনা দিলে হয় না"?
"কাল হবে না।আকবর চাচাকে বলে বাড়িটা একটু পরিষ্কার করিয়ে নিতে হবে।পরশু চলো।শুধু সায়ন আর বউমাকে একটু জানিয়ে দিতে হবে ফোন করে"।
পরশুদিন সকালেই সুনীল রমাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
রাজবাড়ির গেটটা খুলতেই সুনীলের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে।মনে হল যেসকল প্রিয় মানুষেরা একদিন তার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল,আজ তারাই যেন তাদের অদৃশ্য বাহুডোরে সুনীলকে স্বাগত জানাচ্ছে।
ভাঙাচোরা রাজবাড়িটা দেখে সত্যিই সুনীলের আজ মায়া হল।
আজ থেকে তিরিশ বছর আগে যখন সুনীলের মা বিমলা দেবী এখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন,তখন সুনীলের বয়স কুড়ি।সুনীল ওর বাবা অনিলবাবুকে একপ্রকার জোর করেই এই পোড়ো বাড়ি থেকে বের করে এনেছিলেন।আবার এতগুলো বছর পর এখানে সে।
"কী গো কোথায় যাচ্ছ এই সন্ধ্যেবেলা ? গুপ্তধন খুঁজতে?আরে কাল সকালে যেও।এখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে.."
আমি বাগানে যাচ্ছিলাম।ওখানে আকবর চাচা আমাদের ভাইবোনদের জন্য একটা দোলনা করে দিয়েছিল,রোজ বিকেলে আমরা পালা করে দোল খেতাম!সেটাই দেখতে যাচ্ছিলাম"।
হঠাৎ করেই রান্নাঘর থেকে ঠুংঠাং আওয়াজ আসতে লাগল। রান্না করার সময় খুন্তি আর কড়াইয়ের ঠোকাঠুকি লাগলে যেমন হয় ঠিক তেমন।আর তার সাথে আসছে কারোর হাতের চুড়ির টুংটাং মিঠেলা আওয়াজ।ঠিক যেন মায়েদের হাতের চুড়ির আওয়াজ।সুনীলের বুকটা ধড়াস করে ওঠে।কেমন একটা ঘোর লেগে যায় ওর।নিজের অজান্তেই "মা মা" করতে করতে রান্নাঘরে ছোটে সুনীল।
"কে তুমি?কী করছ এখানে"?
"আজ্ঞে বাবু,আমি বিজয়া।এই পাশেই থাকি।আকবর চাচা বললেন আপনারা আসবেন।তাই রান্না করে দিয়ে আসতে..."
রাত্রে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কীসব হিজিবিজি স্বপ্ন দেখে সুনীল,পুরোনো ভাঙাচোরা রাজবাড়িটা আর নেই।তার বদলে বাবা-মা,জেঠু-জেঠিমা,দাদু-ঠাকুমা আর সকল ভাইবোনদের কোলাহলে এই রাজবাড়ি জীবন্ত হয়ে উঠেছে আগের মতো।দাদুর গল্পের আসর বসেছে বাড়ির উঠোনে।
"এই সুনী,একটু সরে বোস না।কোলে উঠে এসেছিস যে।এতই ভূতের ভয় যখন,আসিস কেন গল্প শুনতে"?
"এই সুনী,দৌড়ে আয়,দেখ কালকের ঝড়ে আমগাছের পাখির বাসাটা ভেঙে পড়েছে।ছানাগুলো কষ্ট পাচ্ছে।তাড়াতাড়ি আয়..নতুন করে বাসা করে দিতে হবে তো"..
"আসছি দাদা দাঁড়া..."
"খোকা..সাবধানে যা বাগানে।পায়ে কাঁটা ফোটাস না.."
"খোকা দেখে যা,তোদের জন্য পুকুরে জাল ফেলে বড়ো রুই মাছ আনিয়েছি.."
"আসছি.. বাবা" ...
"কী গো কীসব ভুলভাল বকছ ঘুমের মধ্যে"?
সকালের জলখাবারটা খেয়ে সুনীল বাগানের দিকে দৌড়লো।বেশ খানিক বাদে হাঁপাতে হাঁপাতে রমার কাছে আসে সে।
"রমা শিগগির একবার বাগানে এসো।একটা জিনিস দেখাব"।
"উফ! এত চিৎকার করছ কেন?তোমার উত্তেজনা দেখে মনে হচ্ছে গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছ "?
"আরে ধূর..রাখো তো তোমার গুপ্তধন।কাল বলেছিলাম না আমাদের বাগানটাতে একটা দোলনা ছিল,সেটা এখনও আছে সেখানে।আর পাখির বাসাটাও আছে।ঠিক একই গাছে,একই ডালে।দেখবে এসো।আমার মনে হয় ওই পাখিগুলোর বংশধরেরাই সেই বাসায় আছে"।
সুনীলের চোখেমুখে একটা শিশুসুলভ আনন্দ ফুটে উঠেছে।
"সুনীল তোমার ফোনটা কখন থেকে বাজছে,ধরো এসে"।
"হ্যাঁ মিস্টার বোস বলুন।
সরি মিস্টার বোস,বাড়িটা বিক্রি হবে না।না,কখনই হবে না।রাখছি"।
"যাক বাবা,গুপ্তধনের লোভে বাড়িটা তো বাঁচলো"?
"ঠিক বলেছ রমা,গুপ্তধনের লোভে।তবে আমার পূর্বপুরুষের গুপ্তধন পোঁতা নেই রাজবাড়ীর কোন নির্দিষ্ট অংশে ,গুপ্তধন তো লুকিয়ে ছিল এ বাড়ির প্রতিটি ইঁটের পাঁজরে আর আমার বদ্ধমনের কোণে । যার খোঁজ আমি পেয়ে গেছি রমা।আর ফিরব না কোথাও।এখানেই কাটাব জীবনের শেষটুকু পুরোনো স্মৃতির সুখসাগরে।আকবর চাচাকে নিয়ে একবার শহর যেতে হবে কাল।বাড়িটা মেরামত করার লোক আনতে হবে তো"।
রমা মনে মনে শ্বশুরমশাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,"আমি পেরেছি বাবা,আমি হার মানিনি,তুমি যেই গুপ্তধনের কথা লিখেছিলে,সেই প্রকৃত গুপ্তধনেরই খোঁজ দিতে পেরেছি সুনীলকে।সুনীল সেই গুপ্তধনের অর্থ বুঝতে পারেনি আগে।এখন পেরেছে।তুমি খুশী হয়েছ তো বাবা"?
পরের দিন...
"হ্যাঁ বাবু বল।ভালো আছিস তো তোরা?তিয়াস কেমন আছে"?
"মা,একটা সুখবর আছে।আমাদের রাজবাড়িতে নতুন সদস্য আসতে চলেছে।আমি কাল সকালেই তিয়াসকে নিয়ে রাজবাড়ি ফিরছি"..
আনন্দে রমার চোখটা ছলছল করে উঠল।নিজের মনেই বলে উঠলেন,"নতুন সদস্য নয় রে,পুরোনো সদস্যই আসতে চলেছে তার প্রাণের পুরোনো রাজবাড়িতে.."
সমাপ্ত