Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#শখের_পুতুল#গোপা_ব্যানার্জ্জী 
---সারাদিন আজ একটা পুতুল বানাতেই সময় চলে গেল। এতগুলো পুতুলের অর্ডার পেয়ে এখন যদি ঠিকঠাক না দিতে পারি, কেউ আর আমাদের অর্ডার দেবেনা রে বাবু!কথাগুলো যাকে বলল সুহানি, তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। এক মনে মোবাই…

 


#শখের_পুতুল

#গোপা_ব্যানার্জ্জী 


---সারাদিন আজ একটা পুতুল বানাতেই সময় চলে গেল। এতগুলো পুতুলের অর্ডার পেয়ে এখন যদি ঠিকঠাক না দিতে পারি, কেউ আর আমাদের অর্ডার দেবেনা রে বাবু!

কথাগুলো যাকে বলল সুহানি, তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। এক মনে মোবাইলে কি যেন দেখে চলেছে সুহানির ছেলে বিক্রম। স্বামী মারা যেতেই অল্প বয়সে ছেলেটাকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েছে সুহানি। আসল বাড়ি রাজস্থানে হলেও, এই কোলকাতা শহরে তিন পুরুষ ধরে আছে সুহানির পরিবার। 

বিক্রমের বয়স যখন মাত্র পাঁচ, একদিনের জ্বরে সুহানির স্বামী মারা যায়। তারপর থেকে সংসার, ব্যবসা সবই সুহানি সামলে চলেছে। ছেলেটার হাতের কাজ অসম্ভব ভালো, কিন্তু মোটেও কাজ করতে চায়না।

আজ খুব রাগ হয়ে গেল ওর! এবারে ছুটিতে এসে ওর কাকা, ভাইপোকে আদর করে এই মোবাইল দিয়ে গেছে। তাতেই আরও কাল হয়েছে। দিনরাত ওই মোবাইলে মুখ গুঁজে রয়েছে।

--- আমি তোকে এতগুলো কথা বলে যাচ্ছি, তোর কি দিমাগে কিছু ঘুসছে? কালকের মধ্যে পুতুলগুলো রেডি করতে হবে। মেলায় বেচবে বলেইতো ওরা অর্ডার দিয়েছিল নাকি!

--- তুমি দিনভর আমার পিছনেই কেন পড়ে থাকো? আমি ঠিক সময় করে বানিয়ে ফেলব মা!

বলেই এসে মাকে জড়িয়ে খানিক আদর করে দিল বিক্রম।

---তোর যা খুশি কর, উফফ... আমাকে ছাড় দেখি! এত বড় হলি, তবুও দুনিয়াদারি শিখলি না বাবু।

গজগজ করতে করতে সুহানি রাতের রান্না করতে চলে গেল।

বিক্রম এতক্ষণ একটা সিনেমা দেখছিল, ইংরেজি সিনেমা। একটা পুতুল, তার উপরে নাকি শয়তান ভর করে! ওই শয়তান, আত্মা খোঁজে! সেই জন্য একটা বাচ্চার ওপরে নজর পড়ে শয়তানের। সেই বাচ্চাটাকে বাঁচাতে তার মা, কি না করল!

সব মায়েরা বোধহয় এরকম হয়। বিক্রমের মাও ওর জন্য কত কষ্ট করে। না! এবারে পুতুলের অর্ডারটা ঠিকঠাক সাপ্লাই করতেই হবে।

অনেক রাত জেগে বিক্রম দশটা পুতুল বানিয়ে রেখে, ভোরবেলা ঘুমিয়ে পড়ল।

স্বপ্নে ও দেখল...মেলায় ওর পুতুল খুব বিক্রি হওয়াতে, আরও অনেক অনেক অর্ডার পাচ্ছে ওরা। সারা ঘর ভর্তি করে ও শুধু পুতুল বানিয়ে চলেছে!

কিন্তু সবকটা পুতুল ওই সিনেমার পুতুল, কি যেন নাম ছিল... হ্যাঁ অ্যানাবেল! সেই পুতুলটার মতো দেখতে!


ধড়মড় করে উঠে বসে বিক্রম বাইরে তাকিয়ে বুঝল বেশ বেলা হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি উঠে মাকে খুঁজতে গিয়ে দেখল, মা খুব খুশি মনে ওর বানানো পুতুলগুলোকে গয়না পরিয়ে, সাজিয়ে তুলেছে। পুতুলগুলোকে রাজস্থানী ঘাগড়া চোলি পরিয়ে দিলেও, ওদের মুখগুলো দেখে চমকে উঠল বিক্রম!

একি! সব পুতুলগুলোর মুখ একেবারে ওই অ্যানাবেল পুতুলটার মতো কিকরে হল! একটা পুতুলকে তখনো সাজানো বাকি! ও তাড়াতাড়ি মার কাছথেকে ওটা কেড়ে নিয়ে বলল,

-- এটার সাজ আমি করে দিচ্ছি।

নিজের হাতে ওই পুতুলটার জন্য গাউন, হেয়ারব্যান্ড, সব বানালো বিক্রম। হুবহু অ্যানাবেলের মতো দেখতে হয়েছে বলে, মনে মনে বেশ খুশি হল।

বিকেলে সব পুতুল সাপ্লাই করতে গিয়ে সুহানি দেখল, একটা পুতুল কম! এদিকে যারা অর্ডার দিয়েছে, এসে অপেক্ষা করছে! ওদের হাতে তুলে দিলে, তবেই কিছু টাকার মুখ দেখবে বহুদিন পর। 

ছেলের ঘরে ঢুকে দেখল, সে ঘর অন্ধকার করে পুতুলটা নিয়ে বসে আছে বিক্রম। অবাক হয়ে সুহানি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে উঠল! ছেলের চোখ জবা ফুলের মতো লাল। কেমন ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,

--- এই পুতুল আমি দেব না! ওদের অন্যগুলো দিয়ে দাও!

--- কি যা তা বকছিস? দে শিগগিরই! ওনারা বসে আছেন!

--- বলেছি তো! দে..এ..এ.. বো.. না...

একি রূপ ছেলের! সুহানি চমকে উঠল! তবুও সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ছেলের থেকে কেড়ে পুতুলটা নিয়ে, বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিল! তারপর ছুটে গিয়ে ওনাদের সব পুতুল বুঝিয়ে দিয়ে, ছেলের ঘরে ফিরল। দরজা খুলে দেখল, ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুহানির খুব মায়া হল। পাশে বসে মাথায় হাত দিতেই বুঝল জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা!

--- হে ভগবান! কি হল ছেলেটার!

নিজের মনেই বলে উঠল সুহানি। তারপর জলপট্টি আনতে রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে শুনল, ছেলে ঘোরের মধ্যে ভুল বকছে! ফিরে এল সুহানি! কি বলছে বোঝার চেষ্টা করল! নাহঃ! উদ্ধার করতে পারল না! তবে মনে হল আত্মা শব্দটা শুনল!

ভয়ে আঁতকে উঠে তাড়াতাড়ি জলপট্টি নিয়ে ফিরে দেখল, ছেলে খুব ছটফট করছে! মাথায়, চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে, ও তাড়াতাড়ি ছেলের দু একজন বন্ধুকে ফোন করল যাতে ওরা ডাক্তার ডেকে আনে!

কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা চলে এল। ডাক্তার দেখে ওষুধ লিখে দিয়ে, একটা ইনজেকশন দিয়ে চলে গেল! ওর একটা বন্ধু সঞ্জয় রাতে থেকে গেল। ছেলেকে কিছুই খাওয়াতে পারল না সুহানি! সঞ্জয় বলল,

--- মাসি তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, আমি আছি!

জ্বরটা নেমেছে দেখে, সুহানিও নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

মাঝরাতে সুহানির ঘুম ভেঙে গেল। দরজায় খুব জোরে কেউ যেন ধাক্কা মারছে! তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলতে যাবে, এমন সময় দেখল ছেলের ঘরে আলো জ্বলছে। এদিকে হঠাৎ করে আকাশে মেঘের ডাক! ভয়ে আতঙ্কে ও ছেলের ঘরের দিকে ছুটল! গিয়ে দেখল ছেলে উঠে বসে জানলার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে! ছুটে ছেলের কাছে গিয়ে বলল,

--- কি হয়েছে রে বাবু!

বিক্রম কোনো কথা না বলে হাতটা তুলে বাইরে দেখালো!

সুহানি দেখল ভীষণ জোরে হাওয়া দিচ্ছে, আর জানলার বাইরে সেই পুতুলটা দুলছে! যেন কেউ ওর মুখ চোখ মেরে ভেঙে দিয়েছে! কপাল থেকে রক্ত পড়ছে!

কিকরে সম্ভব এটা! ও নিজের হাতে আর সব পুতুলের সাথে ওই পুতুলটা দিয়েছিল! সুহানি দরজার দিকে এগোতে গেল! বিক্রম হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল ওকে! এরমধ্যে সঞ্জয়ের ঘুমও ভেঙে গেল!

বিক্রম বলতে লাগল,

--- মা তোমাকে আমি বলিনি! এই পুতুলের কথা আমি সিনেমা দেখে জানতে পেরেছি! বিশ্বাস করো, আমি নিজেও বুঝিনি সব পুতুলের মুখ ওই অভিশপ্ত পুতুলটার মতো হয়ে গেছে। একটা অদৃশ্য শক্তি আমাকে দিয়ে ওর সাজ পোশাক পর্যন্ত করিয়েছে। পুতুলটা কিছুতেই আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছিলো না। যতবার তোমাকে দেওয়ার জন্য যাচ্ছিলাম, কান্নার শব্দ পাচ্ছিলাম। তাই দিতে চাইনি। কিন্তু এখন কিকরে ও ফিরে এল মা?

সুহানি মনে জোর এনে বলল,

-- কিছু হবে না বাবু! আমি বাইরে গিয়ে একবার দেখে আসছি!

দরজা খুলে বাইরে এল সুহানি! কই পুতুল! কোনো চিহ্ন নেই। সবই মনের ভুল, এই ভেবে ও যেই ফিরে আসতে গেল, মনে হল ওর পা কেউ জড়িয়ে ধরেছে! কিছুতেই ঘরের দিকে এগোতে পারছে না!

চিৎকার করে সঞ্জয়কে ডাকল সুহানি! সঞ্জয় বেরিয়ে এসে ওর কাছে আসতে, দেখল সুহানি কাঁদতে কাঁদতে বলছে,

--- আমি কি করব! আমার স্বামী, শাশুড়ি সবাই মিলেই জোর করে সেদিন আমার গর্ভেই তোকে মেরে ফেলল! ওরাতো মেয়ে চায়নি! ডাক্তার আগেই ওদের বলে দিয়েছিল, আমার গর্ভে মেয়ে সন্তান। তাই ওরা জোর করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে, তোকে মেরে দিল রে মা! আমাকে ক্ষমা করে দে!

হঠাৎ সঞ্জয় খেয়াল করল, বাইরেটা আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এসেছে! ঝড় থেমে গেছে! বিক্রম কখন যে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি। সুহানি কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল! বিক্রম ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াল! তারপর দুহাত দিয়ে মাকে টেনে তুলে বলল,

--- ও চলে গেছে মা! আমার বোন! কত আদরের বোন! ওকে পৃথিবীতে আসার সুযোগটুকুও দিল না! তাইতো দাদি আর বাবা কিভাবে হঠাৎ করে মারা গেল কেউ জানতে পারেনি। আজ আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল! কিন্তু এতে তোমার কোনো দোষ ছিল না! তাই ও তোমাকে কিছু করেনি! শুধু আমাকে জানাতে চেয়েছিল সত্যিটা!

দুদিন পর সুহানি ফোন করল যারা মেলার জন্য পুতুল নিয়ে গিয়েছিল তাদের! কটা পুতুল বিক্রি হল, আর কোনো অর্ডার আছে কিনা এসব জানতে! শুনল সব পুতুল বিক্রি হয়ে গেছে, শুধু যে পুতুলটাকে অ্যানাবেলের সাজ পোশাক করিয়ে পাঠিয়েছে, সেটা কেউ কিনতে রাজী হচ্ছে না। এবার আরও একশো পুতুল অর্ডার দিল ওনারা! কিন্তু একটাই শর্ত, সবকটার সাজ যেন ঘাগড়া চোলি দিয়েই হয়!

চোখের জল মুছে সুহানি বলল,

--- ওই পুতুলটা আমাকে ফেরত দিয়ে দিন! ওর বদলে আমি আরেকটা পুতুল দিয়ে দেব! আমার ছেলের খুব শখের পুতুল ওটা!!

_________________(সমাপ্ত)__________________

©® গোপা