Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

তমলুকে সুভাষ চন্দ্র বসু

জয়দীপ পন্ডানেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর 125 তম জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই ।  ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আপোষহীন বিপ্লবী যোদ্ধা অনন্য দেশনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু স্বদেশ মুক্তি যজ্ঞে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সুভাষচন্দ্রকে…

 


জয়দীপ পন্ডা

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর 125 তম জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই ।  ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আপোষহীন বিপ্লবী যোদ্ধা অনন্য দেশনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু স্বদেশ মুক্তি যজ্ঞে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সুভাষচন্দ্রকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ দেশনায়ক অভিধায় ভূষিত করেছিলেন। তাকে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে কত কিংবদন্তি মিথ। এহেন মানুষটির শুভ পদার্পণ ঘটেছিল আমাদের তমলুক শহরে । জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে বিশিষ্ট কংগ্রেস কর্মী সুভাষচন্দ্র বসু সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিল।1938 সালে ওই বছর তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন। জাতীয় কংগ্রেসের কর্মসূচিকে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে সুভাষ বিভিন্ন স্থানে জনসমাবেশ করতে লাগলেন ।আমাদের মেদিনীপুর জেলার তমলুক শহরের এরূপ এক জনসভায় আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু ।তমলুক মহকুমা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা ও সমাজসেবী শ্রী মহেন্দ্রনাথ মাইতি মহাশয় এর সঙ্গে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি যোগাযোগ করলো ।


 অবশেষে স্থির হল1938 সালে 11 এপ্রিল তমলুকে জনসভা অনুষ্ঠিত হবে এবং  প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সুভাষচন্দ্র বসু। আয়োজনের ব্যবস্থা হল তমলুক রাজবাড়ীর মাঠে। কিন্তু গোপন সূত্রে এই জনসভার কথা জানতে পেরে ইংরেজ সরকার তা বন্ধ করার সবরকম চেষ্টা চালাতে লাগলো।


1929সালে নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস প্রার্থী দের সমর্থন করতে তমলুক বার লাইব্রেরি সদস্য দের প্রতি সুভাষ চন্দ্র বসু ও যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এর আবেদন।

 প্রসঙ্গত এই রাজবাড়ীর মাঠটি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সবচেয়ে প্রাচীন হ্যামিল্টন হাই স্কুলের ছাত্রদের খেলার মাঠ হিসাবে ব্যবহৃত হতো। সেই জন্য সরকার হ্যামিল্টন স্কুল এর সম্পাদক কে এক পত্র লিখে জানিয়ে দেন যদি স্কুল কর্তৃপক্ষ মাঠটি জনসভার জন্য ব্যবহার করতে দেয় তবে স্কুলের গভর্নমেন্ট গ্রান্ড বাতিল করা হবে । তখন হ্যামিল্টন স্কুল এর সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা শ্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় এর পিতা শ্রী শরৎচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয়। স্কুলের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে শরৎচন্দ্র মাঠটির ব্যবহার করার অনুমতি না দেওয়ায় কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় তমলুক চরক মেলার মাঠে বর্তমানে যেখানে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা হাসপাতাল রয়েছে সেখানেই হবে সুভাষ বাবুর জনসভা।



 এই মাঠটি ছিল সাহাদের। সরকারক সেই খবর জানতে পেরে সাহাদের বিভিন্নভাবে নাস্তানাবুদ করতে থাকে ।শহরে এই সাহাদের আবগারি দোকান রয়েছে । সরকার থেকে তাদের হুমকি দেওয়া হয় যদি তারা এই জনসভার অনুমতি দেন তবে তাদের দোকানের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে । ফলে তারাও এই অবস্থায় শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলেন । এমতাবস্থায় তমলুক মহাকুমার কংগ্রেস কমিটি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল । শেষ পর্যন্ত তারা তাম্রলিপ্ত রাজপরিবারের স্বদেশপ্রেমী রাজা সুরেন্দ্র নারায়ন রায় মহাশয় এর শরণাপন্ন হলেন। বর্ষিয়ান রাজা সুরেন্দ্র নারায়ন কংগ্রেস কমিটিকে তাদের বাগান বাড়ির ভেতর সভা করার অনুমতি দিয়ে আশ্বস্ত করলেন । রাজ পরিবার তাদের খোস রং-এর ফলন্ত আমবাগান কেটে সুভাষ চন্দ্রের জনসভার সমস্ত আয়োজন করলেন।

 সুরেন্দ্রনাথ এর পুত্র শতবর্ষ অতিক্রান্ত বীরেন্দ্র নারায়ন রায় লেখককে স্মৃতিচারণায় বলেন," দশই এপ্রিল রাত্রিতে কংগ্রেস কর্মী ও সমাজসেবী হরি দোলই তার কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মী নিয়ে সভা মঞ্চ তৈরি করলেন ।আমাদের খোস রঙের মাঠে আমি সুভাষ বাবু কে অভিনন্দন জানাবার জন্য সৈয়দপুর ও পদুম্বসান থেকে 28 জন কুমারী মহিলা সংগ্রহ করেছিলাম। সুভাষ বাবু যখন মঞ্চে প্রবেশ করবেন তখন ওই মহিলারা ফুল দূর্বা ও শঙ্খধ্বনি দিয়ে জনতাকে অভিবাদন জানাতে তৈরি ছিলেন হাজার 1938 সালের 11 ই এপ্রিল প্রত্যুষে হাওড়া স্টেশনে বিএন রেলওয়ে তৃতীয় শ্রেণীর একটি কম্পার্টমেন্টে সুভাষচন্দ্র, হেমন্ত রায়, প্রমথনাথ ব্যানার্জি, অধ্যাপক জ্যোতিষ ঘোষ, রামসুন্দর সিং, নিকুঞ্জ বিহারী মাইতি, ললিত কুমার সিনহা, বসন্ত কুমার দাস প্রমুখ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ট্রেন কোলাঘাট স্টেশন পৌঁছলে সুভাষচন্দ্র কে মেদিনীপুর জেলা বাসীর পক্ষ থেকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা জেলা আইনসভার সদস্য শ্রী গোবিন্দপ্রসাদ ভৌমিক মহাশয় । 


এরপর পাঁশকুড়া স্টেশন সুভাষচন্দ্র কে অভিনন্দন জানানো হয় তমলুক মহাকুমার কংগ্রেস কমিটির পক্ষ থেকে। মাল্য ভূষিত করেন বিশিষ্ট নেতা সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয়। এরপর সুভাষচন্দ্র তার কর্মীদের নিয়ে কনভয় রওনা দেয় তমলুক পাঁশকুড়া বাস রাস্তা ধরে ।তমলুক শহরের উদ্দেশ্যে পথিমধ্যে জোড়া পুকুরের কাছে উন্মুক্ত জনতা রাস্তা আটকে সুভাষ বাবু কে সংবর্ধনা জানায় । জননেতা তার অনুরোধে সুভাষ এখানে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। এরপর কলাতলার কাছে সমবেত জনতা সুভাষচন্দ্রের উদ্দেশ্যে জয়ধ্বনী দেন। সুভাষচন্দ্র জনতাকে নমস্কার জানান । প্রথমে সুভাষ তমলুক পৌরসভায় পৌঁছলেন। সেখানে যে চেয়ারে তিনি বসেছিলেন তা আজও পৌরসভায় রক্ষিত আছে। এখান থেকে তিনি সতীশ চক্রবর্তী মহাশয় এর বাড়ি 'বৈকুণ্ঠ ধাম এর' জন্য যান । এখানে তাকে বরণ করেন মহকুমা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি মহেন্দ্রনাথ মাইতি  মহাশয় ।

দুপুরে সুভাষচন্দ্র কনভয় করে রাজ বাটির সভাস্থলের দিকে রওনা দেয়। সেখানে বিভিন্ন স্থানে থেকে উপস্থিত হাজার হাজার আবালবৃদ্ধবনিতা সুভাষচন্দ্রকে বর্ষিয়ান রাজা সুরেন্দ্র নারায়ন ফুলের মালা পরিয়ে চন্দনের টিপ দিয়ে ধান দূর্বা সহযোগে বরণ করে নিলেন। মেয়েরা শঙ্খধ্বনি দিলেন । এরপর চলল বরণ করবার পালা। প্রথমে তমলুক পৌরসভা তারপর রাজ পরিবারের পক্ষ থেকে বরণ করে নেয়া হয় তাদের প্রিয় জননেতা সুভাষচন্দ্র বসুকে।

 এরপর ছাত্র শ্রমিক ও হরিজনদের পক্ষ থেকেও তাকে বরণ করে নেওয়া হয় সেদিনের ওই ঐতিহাসিক সভার সভাপতি ছিলেন ইন্দুমতী ভট্টাচার্য সুভাষচন্দ্র তার জনমুখী ভাষণে স্বাধীনতা আন্দোলনে মেদিনীপুর বাসির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। সেইসাথে জেলাবাসীর পরাধীন ভারত মাতার শৃংখল মুক্তির জন্য যে গভীর ত্যাগ স্বীকার করে চলেছে তার জন্য ধন্যবাদ জানান । সভাশেষে সুভাষচন্দ্র তমলুক শহরের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনে বেরিয়ে পড়লেন সতীপীঠ দেবী বর্গভীমা মায়ের মন্দিরে গিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে পূজা নিবেদন করেন । 

এরপর তমলুক রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমে পৌঁছন সেখানে মিশনের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে লেখেন ,"তমলুকে আসিয়া রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম পুরী দর্শন করিবার সুযোগ পাইয়া বিশেষ আনন্দিত হইলাম । যেরূপ শৃঙ্খলা  ও পরিচ্ছন্নতার সহিত জনসেবা করা হয় তাহা প্রশংসনীয়। প্রত্যেক শহরে যদি এইরূপ প্রতিষ্ঠান থাকিত তাহা হইলে কত উপকার না হইত । এই প্রতিষ্ঠানের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি আমি কামনা করি । তমলুক রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম visitors' বুকে সুভাষ চন্দ্রের হাতে স্বর্ণাক্ষরে লেখা এই শংসাপত্র আজও ইতিহাসের উজ্জ্বল সাক্ষী।



 এরপর সুভাষ বাবু বৈকুণ্ঠধাম সতীশ চক্রবর্তীর বাড়িতে রাত্রি বাস করেন সেখানে তিনি তমলুকের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে গোপন বৈঠক করেন । পরেরদিন প্রত্যুষে রাজবাড়ীতে গিয়ে রাজা সুরেন্দ্র নারায়ণ রায় মহাশয় এর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ছেড়ে কাঁথির উদ্দেশ্যে রওনা দেন । সুভাষ চন্দ্রের ঐতিহাসিক তমলুক সফর মহকুমার স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবতী করতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল । সুভাষচন্দ্রের সেদিনের উদাত্ত ভাষণ উপস্থিত আবালবৃদ্ধবনিতাদের স্বদেশপ্রেমে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং পরবর্তী আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করেছিল সন্দেহ নেই। এখানেই সুভাষচন্দ্রের তমলুক শহরের তাৎপর্য নিহিত রয়েছে ।

আজ সুভাষ চন্দ্রের 125 তম জন্ম দিবস উপলক্ষে সমগ্র তমলুক মহকুমা বাসীর পক্ষ থেকে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা অর্পন করছে ।

জয় হিন্দ , বন্দেমাতরম।