Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#পটলার মনের আকাশে আজ...#গল্প#সুস্মিতা
  আকাশ দেখার নেশা পটলার। ওই আকাশটাই পটলার মাথার ওপরের ছাদ। প্রতি রাতে রতনদার গ্যারাজের খাটিয়াতে পটলা রাত আকাশের চাদর গায়ে জড়িয়েই শোয়। ঘুম আসার আগে পর্যন্ত ও তাকিয়ে থাকে অন্ধকার আকাশের দিকে। কত…

 


#পটলার মনের আকাশে আজ...

#গল্প

#সুস্মিতা


  আকাশ দেখার নেশা পটলার। ওই আকাশটাই পটলার মাথার ওপরের ছাদ। প্রতি রাতে রতনদার গ্যারাজের খাটিয়াতে পটলা রাত আকাশের চাদর গায়ে জড়িয়েই শোয়। ঘুম আসার আগে পর্যন্ত ও তাকিয়ে থাকে অন্ধকার আকাশের দিকে। কত কথাই যে লেখা থাকে ওই অন্ধকারের বুকে। কি রহস্যময় এক জগত। সেই জগতের গল্প বুঝতে হলে মনের অন্ধকার পেরিয়ে যেতে হয়। আকাশ দেখতে দেখতে পটলা সারা শরীরে শিহরণ টের পায়।


  কত কিই যে ভাবে তখন পটলা। কত স্মৃতিই যে মনের মধ্যে উথালপাথাল করে। চারিদিক শুনশান। কদিন ধরে পৃথিবীটা কেমন ওলটপালট হয়ে আছে। এক দৈত্য ভাইরাসের জন্য গোটা পৃথিবী যেন ভয় পেয়ে মুখ লুকিয়েছে। পৃথিবী আজ ভয়ে মায়ের আঁচল খুঁজছে। প্রকৃতি মায়ের আঁচল। জয়ের নেশায় দৌড়তে দৌড়তে বড় অবহেলা করা হয়ে গিয়েছে তাকে এতকাল। কি যে করা। কি যে শাস্তি। 


   দিনগুলো খুব অদ্ভুত অন্যরকমভাবে কাটছে পটলার। অবশ্য শুধু পটলার একার নয়, সকলের, এক্কেবারে সকলের, বলতে গেলে গোটা পৃথিবীর। কতদিন হারাণ, নিতাই, ক্যাবলাদের সঙ্গে ভালো করে আড্ডা হচ্ছেনা। সকলের চোখেমুখে অশনি সংকেত।


 রতনদার গ্যারাজেও গাড়ি আসছেনা কয়েকদিন ধরে। চাকায় হওয়া ভরার যন্ত্রটা কিরকম জুবুথুবু হয়ে এক কোণে শুয়ে থাকে। মেশিনের কাজের ধাতব শব্দগুলো এখন বোবা। হারাণের সেলুনে গত দশদিনে একটা লোকও আসেনি। ও অবশ্য দোকানঘরের তালা খুলে বসে থাকে। ওর মায়ের ওষুধের টাকা লাগবে যে। কিন্তু উপায় কি? ওই দৈত্য ভাইরাসটাকে জব্দ করতেই হবে যে। তার জন্যই তো মানুষের থেকে মানুষের দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। 


 ময়দানের কাছেই ক্যাবলা ওর ঝাঁকায় ফুচকা, আলুকাবলি নিয়ে দাঁড়াত, সব বন্ধ। হাতে মাখা ফুচকা, আলু কাবলি আর কেউ খাচ্ছেনা। আরও কতদিন খাবেনা... কে জানে?  বসির চাচার বেলুন বিক্রি একদম বন্ধ। ওদের ঘরের সামনে উনুনটাও এখন রোজ জ্বলছেনা। এরকম আরও কত...কতজন...


   পৃথিবীটা একদম অচেনা লাগে এই মাত্র কদিনেই। ক্ষিদের সঙ্গে পটলারা ভালোভাবেই পরিচিত, সেই জ্ঞান হওয়ার বয়স থেকেই। জন্ম থেকেই ওটাই ওদের একমাত্র অনুভূতি। ক্ষিদে পেলেই যে মুখের সামনে খাবার পাওয়া যায়না, সেই কোন শৈশব থেকে ওরা শিখে যায়। তাই ক্ষিদে চেপে থাকাটাই ওদের অভ্যাস।


   তবে এই ক'দিনে দৈত্যের ভয়ে ঘুমন্ত পৃথিবীতে চৈত্রের হওয়াটা বড় মিঠে লাগে। বহু বছর ধরে সভ্যতার দৌড় এই হওয়ার গলা টিপে চেপে ধরে রেখেছিল। আজ সে গাড়িঘোড়াবিহীন, কলকারখানার ধোঁয়াহীন শহরে একটু খেলার  সুযোগ পেয়েছে।


  হওয়াটা তো সত্যিই মিঠে লাগে, কিন্তু পেটের আগুন? তার কি হবে?


চৈত্র সেলের বাজার বন্ধ। বিক্রিবাটা বন্ধ। পটলাদের বস্তির কতগুলো পরিবারেরই তো সারা বছরের খোরাক আসত শুধু এই চৈত্র সেলের ব্যবসা থেকে। ওদের মুখগুলো ঘোর অন্ধকার। কি দুর্দিন আসছে সামনে। 


  বস্তির একেবারে শেষেরদিকে থাকে পদ্মদি, গোলাপিদি আর মিনতিমাসিরা। এখন আর সারারাত ওদের ঘরে আলো জ্বলেনা। সন্ধে থেকে "চিকনি চামেলি কিম্বা বিড়ি জ্বালাইলে জিগর সে পিয়া" গানের সুর ভেসে আসেনা। ওরা সবাই কি খেয়েপরে আছে কে জানে। 


 ছোটবেলা থেকে পটলাদের ওইদিকে যাওয়া বারণ ছিল, বস্তির কাকা জ্যাঠারা অবশ্যই ওদের খবরাখবর রাখত। 


শুধু আষাঢ় মাসে যখন দুগ্গা প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হ'ত, তখন পালবাড়ির দাদু অনুমতি দিতেন "পদ্মদিদিদের বাড়ির সামনে থেকে সসম্মানে একটু মাটি নিয়ে আসার জন্য।" বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা না মেশালে মায়ের  মৃন্ময়ীমূর্তি  সম্পূর্ণতা পায়না যে। 


   কাজ নেই, অলস চৈত্রর দুপুরে খাটিয়ায় শুয়ে পটলা আকাশ দেখে আর ভাবে। ঝিরঝিরে হওয়া বয়... টুপটাপ পাতা খসে পড়ার আওয়াজ। কোথায় যেন গাছ থেকে একটা দুটো আম পড়ল। 


চারিদিকে শুধু অসুখের গল্প। তাই সুখের পাখি কোকিল হঠাৎ ডাকাডাকি বন্ধ করে দিয়েছে। কাক, চড়ুই, শালিখগুলো মাঝেমাঝেই  অস্থির হয়ে ডানা ঝাপটিয়ে চেঁচামেচি করে খাবারের খোঁজ করছে। দোকানপাট সব বন্ধ, উচ্ছিষ্ট খাবার কোথায়? 


সবাই সবার থেকে দূরে হয়ে যাচ্ছে। রাবেয়া চাচীর গত পরশু রাত থেকে খুব জ্বর। একলা ঘরে ভুল বকছে। তার ছেলেরা আরব দেশে মজদুরী করে। অন্য সময় পাড়ার লোকজনই হেমেন ডাক্তারকে খবরটবর দেয়। এখন জ্বরের কথা শুনে কেউ আর কাছেই এগোচ্ছেনা। যদি ছোঁয়াচ লেগে যায়। ভয় করছে,  বড্ড ভয় করছে। পটলার নিজেরও ভয় করছে। সকলেই দিশাহারা। সকলেই অসহায়...


পটলার মনের আকাশ জুড়ে মেঘ...


সুপ্রতীকদাদাটার কথা আজ বড্ড মনে পড়ছে। দাদা বেঁচে থাকলে পটলা আজ ঠিক একবার তাঁর কাছে যেত। কত গল্পই যে বলত ওই দাদাটা। অবাক হয়ে শুনত কিশোর পটলা। অর্ধেক কথাই অবশ্য বুঝতে পারতনা। তবু কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগত। দাদা বলত "দেখ পটল, মানুষ একা কখনোই বাঁচতে পারেনা, তার অস্তিত্ব অন্য মানুষের মধ্যেই, আমরা আসলে থাকি আর একজন মানুষের চোখের তারায়। মানুষ মানুষেরই জন্য।" 


সুপ্রতীকদাদা কি সুন্দর গান গাইত। দাদা পটলকে বুঝিয়ে বলত- "জানিস পটল, গান কখনও একা একা সম্পূর্ণ হয়না, গায়ক গাইবে, শ্রোতা শুনবে... তবেই তো সেই গান সম্পূর্ণ হবে। লেখক যখন লেখেন, পাঠক যদি সেই লেখা না পড়েন, তবে তার কোনও মূল্যই থাকেনা রে। যে কোনো শিল্পীরই তার সৃষ্ট শিল্পের জন্য চাই সমঝদার দর্শক। তা নাহলে স্রষ্টা বড় একা... তার কোনও অস্তিত্বই নেই।


 গতকাল সন্ধ্যায় একটু ঝড় উঠেছিল। বোধহয় কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও। আকাশ থেকে বৃষ্টি কিনা কে জানে? পটলা নিজের গালে বৃষ্টিধারা অনুভব করেছিল। 


 রতনদা আর পটলা কাল সকালে একটু চাল জোগাড় করেছিল। সন্ধ্যাবেলা বৌদি ভাত বানাল। কি সুন্দর ভাতের গন্ধ। রাত্রিবেলা বৌদি ডাক দিয়ে পটলাকেও একটু ভাত দিলো, সঙ্গে নুন দিয়ে মাখা আলুসিদ্ধ। বৌদি যখন ডাক দিলো, পটলা তখন অন্ধকার আকাশের তারা দেখছিল, কে জানে কোনো একটা তারায় সত্যি ওর মরে যাওয়া "মা"টা লুকিয়ে আছে কিনা। বৌদির ডাক শুনে ঠিক যেন মনে হল মা ডাকছে- "ও পটল আয়... ভাত মেখেছি, খাবি আয়।"


 নাহ, "পেটভরা ভাতের" লোভ পটলা করেনা। এই অবস্থাতে তো ভাবতেই পারেনা। অল্পস্বল্প জুটলেই হল।


তাই নিজের জন্য অর্ধেকটা রেখে ,ভাতের থালাটা নিয়ে পটল গিয়ে দাঁড়াল গলির মুখে। খোঁড়া পা ভেবলুটা কেমন নেতিয়ে পড়ে আছে কদিন। তবুও পটলকে দেখে শুয়ে শুয়েই লেজ নাড়াতে শুরু করল। এক গরাস ভাত পটল ওর মুখে ঢেলে দিলো। ফুটপাথের পাগলিটা আবার পোয়াতি। ওর গায়ের সাথে এঁটুলির মতো লেগে আছে তিনটে ন্যাংটা শিশু। ওদের অ্যালুমিনিয়ামের থালাটায় দু মুঠো ভাত রেখে দিলো পটলা।


  গলি থেকে বড় রাস্তার দিকে যেতেই বাঁ হাতে বড় মন্দিরটা। গত কদিন ধরে মন্দিরটা বন্ধ। কেউ আসেনা। মন্দিরের সামনে পৌঁছে পটলা একবার থমকে দাঁড়াল। মনে পড়ে গেল সুপ্রতীকদাদার কথা। একবার ভাবল... যদি বিগ্রহের সামনে গিয়ে প্রশ্ন করে জানা যেত- "ভগবান তোমার একলা লাগেনা? মন খারাপ লাগেনা স্রষ্টা? তোমার মন কোথায় গো?"


 কে জানে... মন্দিরের বিগ্রহ তো মানুষেরই সৃষ্টি, আসল দেবতার বাস বোধহয় মানুষের অন্তঃস্থলে। আজ সেই দেবতার কাছাকাছি পৌঁছনোরই সময়। আজ তাই মানুষকে পৌঁছতে হবে মানুষের কাছে।


 মন্দিরের ঠিক বাইরে বসে থাকে অন্ধ দয়ালকাকা। সেই কোন আমল থেকেই কাকা বসে থাকে ওখানে। আগে তবু এখানে একটা বটগাছ ছিল, বটের ছায়া ছিল। প্রমোটার বিল্ডাররা গাছটাছ কেটে সাফ করে সেই জায়গায় বিশাল ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়েছে। দয়াল কাকা ওইরকমই একটা বিল্ডিংয়ের ঢোকার মুখেই রোজ বসে থাকে। লোকজন যাতায়াত করে আর অন্ধকাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে- "কে যায়? কে যায়?" বেশিরভাগ লোকজনই উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনা। 


 পটলা  প্রতিদিন একবার দয়ালকাকার খোঁজখবর নিতে যায়। এটা ওর বহু বছরের অভ্যাস। পটলার পায়ের শব্দ কাকা ঠিক চিনতে পারে। কোনোদিন ভুল হয়না। পটলা কাছে গিয়ে দাঁড়ালে অন্ধ নিজের থেকেই দুহাত বাড়িয়ে দেয়, বলে- "পটলা এসেছিস বাবা, আয় কাছে আয়।"


 ভেবলুকে, পাগলিকে আর তার বাচ্চাগুলোকে খাইয়ে বাকি ভাতটুকু নিয়ে পটলা এগিয়ে যায় দয়ালকাকা যেখানে বসে আছে, সেইদিকে...


  আজও পটলার পায়ের শব্দ চিনতে কাকার ভুল হয়না। দয়ালকাকা দুহাত বাড়িয়ে বলে ওঠে- "পটলা এসেছিস...পটলা।" শুধু আজ তার গলার আওয়াজটা কেমন যেন হাহাকারের মতো শোনায়।  পটলার বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। গলার কাছে কি যেন দলা পাকিয়ে যায়। মা নেই, বাবা নেই। "বাবা বাছা" বলে ডাকার মতো লোকজন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পটলার শৈশবটুকু তো আজও বেঁচে আছে এই মানুষগুলোর মধ্যেই। 


সুপ্রতিকদা একদিন বলেছিল "মানুষ একাএকা বাঁচতে পারেনা, তার অস্তিত্ব অন্য মানুষের চোখের তারায়।"


না, দয়ালকাকাকে মরতে দেওয়া যাবেনা, কিছুতেই না, তাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। মানুষের জন্যই মানুষকে বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে। পটলার মনের মেঘ কেটে যাচ্ছে। একদিন আবার রোদ উঠবেই। উজ্জ্বল আলোর মতো রোদ...


বাকি ভাতটা দয়ালকাকার থালায় ঢেলে দিয়ে অস্ফুট স্বরে পটলা বলে- "খাও কাকা, খেয়ে নাও।"


তিনদিনের অভুক্ত দয়াল কাকার অন্ধ চোখের কোটরে দু ফোঁটা আশার আলো চিকচিক করে ওঠে...


***********