Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন#গল্প#জাতিস্মর#সুপ্রিয়া_হালদার
ছোট্ট তুলতুলির জন্মের পরে সুপর্ণ-রাধিকার সংসারে আনন্দ-উচ্ছ্বাস বাঁধ ভেঙেছে । কোথা দিয়ে যে দিন-সপ্তাহ-মাস পেরিয়ে যাচ্ছে , বোঝা যাচ্ছে না । তুলতুলি একটা করে নতুন জিনিস করে বা করতে…

 


#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন

#গল্প

#জাতিস্মর

#সুপ্রিয়া_হালদার


ছোট্ট তুলতুলির জন্মের পরে সুপর্ণ-রাধিকার সংসারে আনন্দ-উচ্ছ্বাস বাঁধ ভেঙেছে । কোথা দিয়ে যে দিন-সপ্তাহ-মাস পেরিয়ে যাচ্ছে , বোঝা যাচ্ছে না । তুলতুলি একটা করে নতুন জিনিস করে বা করতে শেখে , আর সেটা নিয়ে নব্য বাবা-মায়ের উচ্ছ্বাস দেখার মতো । 

অবশ্য পরিবারটা এই আড়াই জনে সীমাবদ্ধ নয় । সুপর্ণর বোন সুবর্ণা আর মা শুভ্রাদেবীও থাকে ওদের সঙ্গে । সন্তানের জন্মের আগে পর্যন্ত রাধিকার জীবনটা বিভীষিকাময় ছিল শ্বশুরবাড়িতে । ননদ সুবর্ণা সবসময়েই তার নামে মিথ্যা কথা বলে মাকে উত্তেজিত করত । শুভ্রাদেবীও সত্যাসত্য বিচার না করেই রাধিকাকে প্রচণ্ড বকাবকি করতেন । রাধিকার সব কাজেই ভুলত্রুটি খুঁজে বের করা , আর তার জন্য তাকে গঞ্জনা দেওয়াটা যেন মা-মেয়ের নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল ।


তুলির জন্মের পরে শুভ্রাদেবীর মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল । যদিও একবার ঠারেঠোরে শুনিয়েছিলেন---"প্রথমটা ছেলে হলেই ভালো হত ।" কিন্তু নাতনীকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন । শত হলেও ছেলের ঘরে প্রথম সন্তান --- তাঁর আদরের নাতনী । সেই সুবাদে রাধিকার উপরে খিটিমিটি করাটাও কমেছিল । সুবর্ণাও ভাইজিকে খুব ভালবাসত । 

আসলে , বাড়িতে একটা ছোট বাচ্চার উপস্থিতি বাড়ির পরিবেশটাকেই বদলে দিয়েছিল ।


তুলি কিন্তু ছোট্ট থেকেই পিসির কাছে যেতে চাইত না । কখনও প্রয়োজনে পিসি তাকে কোলে নিলেই তুলি চেঁচিয়ে কেঁদে পাড়া মাথায় করত । 

অথচ , এমনিতে তুলি খুব মিশুকে বাচ্চা ছিল । বাড়িতে বাবার বন্ধুরা এলে , অথবা পাড়ার কারও কোলে যেতে তুলি কখনও কোনও ঝামেলা করেনি । 


এরপরে তুলি যখন নতুন কথা বলতে শিখল , তখন মা-বাবা-ঠামি---সব বলতে শিখল । কিন্তু শত চেষ্টা করেও রাধিকা ওকে "পিসি" বা "পিপি" বলা শেখাতে পারল না । সুবর্ণাকে সামনে দেখলেই তুলি কেমন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত ।


সুপর্ণর বন্ধু শৈবাল প্রায়ই ওদের বাড়িতে আসত । তুলিকে খুব ভালবাসত শৈবাল । শৈবালের স্ত্রী নন্দিনী দার্জিলিংয়ে বেড়াতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করে । সে সময়ে নন্দিনী দুমাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল । হয়ত শৈবাল তুলির মধ্যে নিজের হারানো সন্তানকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে । 

বন্ধুরা শৈবালকে আবারও বিয়ে করার কথা বললেও , শৈবাল এখনও নন্দিনী ও সেই অনাগত সন্তানের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি ।


তুলিও খুব পছন্দ করত শৈবালকে । 

যখন ভাল ভাবে কথা বলতে শিখে গেল তুলি , তখন নিজের বাবার দেখাদেখি সেও শৈবালকে নাম ধরে ডাকতে লাগলো । রাধিকার "কাকু" বা "আঙ্কেল" বলে ডাকানোর সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল । শৈবালও হেসে বলত , "ডাকুক না নাম ধরে , বেশ মিষ্টিই তো লাগে শুনতে ।"


ছ'বছরের জন্মদিনে তুলি বায়না ধরল , সে শৈবালের বাড়িতে যাবেই । নিজেদের বাড়িতে সামান্য কজন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে জন্মদিন পালনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল । তুলির বায়নার চোটে তাড়াতাড়ি করে বাড়ির অনুষ্ঠান সাঙ্গ করে সুপর্ণ-রাধিকা তুলিকে সঙ্গে নিয়ে শৈবালের বাড়িতে গেল । শৈবালও অবশ্য ওদের সঙ্গেই ছিল ।

শৈবালের শোবার ঘরে ঢুকে টেবিলের উপরে রাখা নন্দিনীর ছবির দিকে অনেকক্ষণ শান্তভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ তুলি বলে উঠল , "ওখানে একটা কেক দাওনি কেন শৈবাল ?"

রাধিকা খুব বিব্রত হয়ে মেয়েকে জোরে এক ধমক দিল ---"কি হচ্ছে কি তুলি ? তুমি এখন বড় হয়ে গেছ । আঙ্কেলকে যা খুশি তাই বলছ কেন ?"

রাধিকাকে বাধা দিয়ে শৈবাল বলে উঠল---" ও ঠিকই বলেছে । আজ নন্দিনীরও জন্মদিন । ও না জেনেও ঠিক কথাই বলেছে । আমার তো এটা করাই উচিত ছিল ।"

সুপর্ণ-রাধিকা এমন একটা কাকতালীয় ব্যাপারে বেশ অবাক হল । সুপর্ণ এবারে বাড়ি ফেরার জন্য তাড়া লাগালো । তুলি সে কথা কানে না তুলে শৈবালকে প্রশ্ন করল---"খাটটা জানালার ধার থেকে এনে ঘরের মাঝখানে রেখেছ কেন ? এখনও খুব বৃষ্টির ছাঁট আসে বুঝি ?"

রাধিকা মেয়ের পাকামো দেখে হেসে ফেলল । শৈবাল কিন্তু মনে মনে বেশ চিন্তিত হল----বৃষ্টির ছাঁট আসার কথা এইটুকু মেয়ে জানলো কি করে !!

এবারে তুলি বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল---- "বাথরুমে নতুন বক্স লাগিয়েছ বুঝি !! আগেরটা ভেঙে গেছিল একদম ?"

সুপর্ণ এবারে বলে উঠল----" নে , এবারে সারা রাত ধরে ওর উল্টোপাল্টা প্রশ্নের জবাব দিয়ে যা ।" 

রাধিকা বোঝানোর সুরে বলল---"তুলি , অনেক হয়েছে । এবারে আঙ্কেলকে বিশ্রাম করতে দাও । আমরাও বাড়িতে গিয়ে তোমার গিফ্টগুলো দেখব তো । তারপরে শুতে হবে তো ।"

তুলির যদিও চলে আসার একটুও ইচ্ছা ছিল না , তবু বাবা-মা ওকে জোর করে নিয়ে চলে এল বাড়িতে ।

আসবার আগে তুলি শৈবালকে বলে এল---"অ্যালবামটা আলমারীতে আছে । দেখেছ কখনও ?"

সুপর্ণ হো-হো করে হেসে উঠে বলল---"পাগলি মেয়ে আমার । খালি পাকা পাকা কথা ।"


ওরা চলে যেতেই শৈবাল ঘরে এসে আলমারী ঘাঁটতে শুরু করল । কতদিন মনে হয়েছে অ্যালবামটা খুলে দেখি । কিন্তু হাতের কাছে কোথাও পায়নি ওটাকে । তুলি হঠাৎ ওটার কথা মনে করিয়ে দিল ।

খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেল অ্যালবামটাকে নন্দিনীর শাড়ির তাকে । 

নন্দিনী চলে যাবার পরে কতদিন আলমারী খুলে সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে শৈবাল । নন্দিনীর শাড়িগুলোতে ওর গায়ের গন্ধ শুঁকেছে । কিন্তু কোনদিনও শাড়িগুলো সরিয়ে দেখেনি । অ্যালবামটা কটা শাড়ির নীচেই ছিল । 


অস্থির হয়ে পড়ছে শৈবালের মন । তুলি জানল কি করে অ্যালবামের কথা !! মনের অস্থিরতা দমন করতে অ্যালবামটা খুলে নিজের বিয়ের ছবিগুলো দেখতে লাগলো । নিজের মনের সন্দেহের কথাটা এখনই সুপর্ণকে বলাটা ঠিক হবে কি !!

****************

সামনেই গ্রীষ্মের ছুটি । তুলির স্কুলে অনেক দিনের ছুটি আছে । সুপর্ণ আর রাধিকা সন্ধ্যাবেলায় বসে আলোচনা করছে , কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায় । সুবর্ণা আর শুভ্রাদেবীও যোগ দিয়েছে আলোচনায় । প্রতিদিনের মতো শৈবালও এসেছে আড্ডা দিতে ।


রাধিকা বলল---"চলো , আবার পুরী থেকেই ঘুরে আসি সবাই মিলে । শৈবাল ঠাকুরপোও চলো আমাদের সঙ্গে । বেশ হৈহৈ আনন্দ করে ঘুরে আসা যাবে ।"

সুপর্ণ বলল---"ধুর , গত বছর গ্রীষ্মেই তো পুরী গেছিলাম । তার চেয়ে চলো গ্যাংটক যাই । দার্জিলিং গেলেও গ্যাংটকে কোনদিন যাওয়া হয়নি । আর শৈবালকে বাদ দিয়ে আমরা কখনও কোথাও গেছি নাকি !! সেবারের ঐ দুর্ঘটনার পরে আর কোনও পাহাড়ি জায়গায় যাইনি এত বছর । এবারে গ্যাংটক...গ্যাংটক । কি বলিস শৈবাল !!"


শৈবাল কোন উত্তর দেওয়ার আগে , এতক্ষণ স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে চুপ করে বসে থাকা তুলি সুবর্ণার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল---"ও গেলে আমি যাব না ।"

রাধিকা খুব বিরক্ত হয়ে বলল---"এটা আবার কেমন করে কথা বলতে শিখছ তুলি ? পিসিকে কেউ 'ও' বলে নাকি ?"

তুলির চোখে-মুখে স্পষ্ট ভীতির ছাপ ফুটে উঠল । বলল---"ও আমাকে আবারও পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দেবে ।"

"কি সব যা তা বলছ তুলি --- দিনে দিনে অসভ্য হয়ে উঠছ তুমি !"----রাধিকা শাসন করল মেয়েকে ।

তুলি এবারে মরিয়া হয়ে বলে উঠল---"ও শৈবালকে চায় । তাই তো আমাকে দার্জিলিং-এর পাহাড়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল । ও গেলে আমি কিছুতেই যাব না ।"


বিস্ময়ে সকলের হতচকিত অবস্থা । সুপর্ণ-রাধিকা হাঁ হয়ে গেছে মেয়ের কথা শুনে । শৈবাল মনে মনে অনেক হিসাব মেলাতে ব্যস্ত । সকলের চমক ভাঙল চড়ের চটাস্ শব্দে । সুবর্ণা চেয়ার ছেড়ে উঠে প্রচণ্ড রাগে তুলির গালে চড় মেরেছে । তুলির কচি গালে লাল হয়ে আঙুলের দাগ বসে গেছে । দুচোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এসেছে । তবু গলা দিয়ে কান্নার আওয়াজ বেরোয়নি । শৈবালের কোলের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একরোখা ভাবে বলল---"আমি কি কিছু ভুল বলছি !"

শৈবাল আর সুপর্ণ--- দুজন মিলে জড়িয়ে ধরল তুলিকে । 

শৈবালের হিসাব মিলে যাচ্ছিল । সুপর্ণও এবারে হিসাব মেলাতে শুরু করল । 

সুপর্ণ-রাধিকার তখন সবে এক বছর হল বিয়ে হয়েছে । নন্দিনী সদ্য সন্তানসম্ভবা । ওরা সকলে একসঙ্গে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিল । সঙ্গে সুবর্ণা আর শুভ্রাদেবীও গিয়েছিল । সুবর্ণা যে শৈবালকে পছন্দ করে , এটা সুপর্ণ বুঝত । কিন্তু সুবর্ণা যে এমন কিছু করে ফেলেছে , এটা কখনও ভাবেনি । 


সকলের থেকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে সূর্যোদয় দেখছিল নন্দিনী আর সুবর্ণা । হঠাৎ পাহাড় থেকে খাদে পড়ে যায় নন্দিনী । নন্দিনীর দেহটা যখন উদ্ধার হয় , তখন ওর মুখটা আর চেনা যাচ্ছিল না । পাথরে ধাক্কা খেয়ে থেঁতলে গেছিল মুখটা । দার্জিলিং-এই ওর সৎকার করে ফিরে এসেছিল ওরা । একবছর পরেই রাধিকাও সন্তানসম্ভবা হয় । নন্দিনী যে এভাবে ফিরে আসতে পারে , এটা ওদের কারোর ধারণাতেই আসেনি । 


বেড়াতে যাওয়া মাথায় উঠল । এ অতীত ওকে ভোলাতেই হবে । সুপর্ণ-রাধিকা বিভিন্ন ঠাকুর-দেবতার মন্দিরে পুজো দিল । কোন কিছুতেই যখন কিছু হল না , তখন ওরা মনোবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করল । মনোবিদের পরামর্শ অনুযায়ী বাধ্য হয়ে সুপর্ণ শৈবালকে বলল---"তুই সুবর্ণাকে যা শাস্তি দিতে হয় , দে । কিন্তু তুলিকে স্বাভাবিক করার একটাই উপায় ---তুই এখন কিছুকাল আমাদের বাড়িতে আসিস না । তোকে না দেখলে হয়ত ও সব ভুলে যাবে । আমার মেয়েটার ভবিষ্যৎ ভেবে এটা তোর কাছে আমার বিনীত অনুরোধ ।"

শৈবাল বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত স্বরে বলল---"তুলি আমারও মেয়ে । ধরে নিই না , নন্দিনীর গর্ভে যে সন্তান ছিল , সে-ই তুলি হয়ে এসেছে । আমি নিশ্চয়ই তোর কথা রাখব । তুই আমার বাড়িতে আসবি । আমাদের যোগাযোগটা ঐভাবেই থাকবে , যতদিন না তুলি সব ভুলে স্বাভাবিক হচ্ছে । আর সুবর্ণাকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলছিস । একটা বাচ্চা মেয়ের কিছু কথার উপর ভিত্তি করে , কোনও প্রমাণ ছাড়া কি শাস্তি দেওয়া যায় রে !! ওকে তো আমিও চিরকাল বোন বলে মেনেছি রে ।"


মনোরোগবিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসা করিয়ে তুলির মনের অতীতের হাতছানিকে দূর করা গেল অবশেষে ।