Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

সৃষ্টি সাহিত্য যাপনকবিতা : কান পেতে আছিকলমে : শক্তিপদ ঘোষতারিখ : ১৩ , ০২ , ২০২১
সেই তুমি , সেই তোমাদের--ঘর ছিল অরণ্য ;ফাঁদ পেতে ওরা অরণ্যের চিতা ধরতো ।ওরা তোমার হাতে লোহার হাতকড়া পরিয়েতোমাকে ধরে নিয়ে এলো বিভীষণ প…

 


সৃষ্টি সাহিত্য যাপন

কবিতা : কান পেতে আছি

কলমে : শক্তিপদ ঘোষ

তারিখ : ১৩ , ০২ , ২০২১


সেই তুমি , সেই তোমাদের--ঘর ছিল অরণ্য ;

ফাঁদ পেতে ওরা অরণ্যের চিতা ধরতো ।

ওরা তোমার হাতে লোহার হাতকড়া পরিয়ে

তোমাকে ধরে নিয়ে এলো বিভীষণ পাহারায় এবং

সার্কাসের খাঁচায় বন্দি বাঘ-সিংহের মতো

তোমাকে জোর করে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল

বন্দিশালার ক্ষুদ্র একটা প্রকোষ্ঠে ।

আলো নাই , বাতাস নাই , স্যাঁতসেঁতে মেঝে ,

নোনা ধরা দেয়াল , চূড়ান্ত অপরিচ্ছন্নতার ছাপ 

চারিদিকে ; আর পেটের ভাত উগরে আসার মতো

বিটকেল এক ভামগন্ধ--কুঠরিময় ।


তোমার অপরাধ--তুমি স্বাধীনতা চেয়েছিলে 

তোমার অপরাধ--তুমি মিছিলের পুরোভাগে থেকে

উচ্চকণ্ঠে ' বন্দে মাতরম ' ধ্বনি দিয়েছিলে ।

তুমি অপরাধ করেছিলে দুর্ধর্ষ সেই রাজশক্তিকে

তোমার আগুনরাঙা দুই রক্তচক্ষু দেখিয়ে ,

তুমি অপরাধ করেছিলে--বোমার আঘাতে

সাহেব মেরে ।


এই তোমার মতো এত ক্ষুদ্র যারা , সেই তাদের

বুকের এতবড় পাটা পৃথিবীর কোন শাসকই

কোনকালে ক্ষমা করেনি এবং সেই ওরাও

অবাক হয়েছিল তোমার দুঃসাহস দেখে ।

তাই ওরা তোমাকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখার

সাহস পায়নি , আর তোমাকেও বেশিদিন 

কাটাতে হয়নি--নরকের সেই দুঃসহ অন্ধকারে ।


মাত্র কয়েকটা মাস গেছে , একদিন হঠাৎই

তোমাকে সেই কুঠুরি থেকে বার করে এনে

ওরা তোমাকে ভরে দিল--সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ভিন্ন এক

কুঠুরিতে এবং তুমি রইলে আরও মজবুত একটা

গরাদের অন্তরালে , আরও সতর্ক পাহারায় ।

সেইদিনই তোমার হাতে ওরা ধরিয়ে দিল

তোমার শেষ বিচারের রায়ের একটা কাগজ ।

তোমার হাত কাঁপলো না একটুও , তোমার

পা কাঁপলো না ; পরিবর্তে আরও শতগুণ বেশি

দৃপ্ত ও তেজোময় হয়ে উঠেছিল তোমার কণ্ঠ ।

মুহূর্তে তোমার বজ্রনিন্দিত কণ্ঠে ধ্বনিত হলো

বারংবার 'বন্দে মাতরম'--'বন্দে মাতরম'-----এবং

তৎক্ষণাৎ বন্দিশালার কক্ষে কক্ষে শোনা গেল তোমার সেই ব্রহ্মধ্বনির প্রতিধ্বনি ।


ওরা একদিন তোমার কাছে জানতে চেয়েছিল

তোমার শেষ ইচ্ছার কথা ; তুমি ওদের বলেছিলে--

তুমি যা চাইবে , তা' দেবার ক্ষমতা কিম্বা সাহস--

কোনটাই তাদের নাই ; কারণ , তুমি চেয়েছিলে--

দেশের স্বাধীনতা , দেশবাসীর নির্যাতন-মুক্তি ,

দেশমাতৃকার হৃত গৌরব । তুমি চেয়েছিলে--

ইউনিয়ন জ্যাকের পরিবর্তে লালকেল্লার মাথায়

ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকা উড়বে পত পত করে ।

ওরা তোমার প্রবল জেদের কাছে হার মেনেছিল ;

ওরা তোমার পেটের ভেতর থেকে--কথা

বার করার জন্যে তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল

ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো ; তোমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে

রক্তাক্ত করেছিল , সর্বাঙ্গে জ্বলন্ত ছ্যাঁকা দিয়েছিল ,

বারংবার সূঁচ বিঁধিয়েছিল নখের মাংসে ;

ওদের পরাজয় হয়েছিল , ওরা পারেনি--তোমার

পেটের থেকে একটা কথাও--বার করতে পারেনি ।


তোমার শেষ দেখার সূর্য তখন অস্তগামী ;

শুনেছি--তুমি নিশ্চুপ বসেছিলে ধ্যানে ।

গোধূলির রাঙা আলোয় তুমি মনে মনে

শেষ সূর্যস্নান করলে , সেই সিঁদুরে আলোয়

চিত্তে তোমার শাণ দিলে--সূর্য তখন

প্রায় ডোবে ডোবে ; তুমি কারাকক্ষের মেঝেতে

মাথা ঠেকিয়ে সারলে তোমার শেষ সূর্যপ্রণাম ।

তুমি বুঝলে খুব ভালো করে--আর কোন সকাল

তুমি দেখবে না এবং তাই , কারাকক্ষের 

আবছায়া অন্ধকারে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থেকে

বুকে হাত রেখে গলাছেড়ে অনেকক্ষণ ধরে

তুমি গাইলে , " রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো

এবার যাবার আগে " ।


শুনেছি , সেদিন রাত্রে তুমি খুব ঘুমিয়ে পড়েছিলে ;

ভোর হতে তখনও বেশ বাকি , ভারী বুটের শব্দে

তোমার ঘুম ভাঙলো । 

তোমার সময় হয়েছে জানিয়ে ওরা তোমাকে

বার করে নিয়ে গিয়ে ভালো করে স্নান করালো , 

নতুন পোশাক দিল , পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করলো ;

বলির পাঁঠাকে যূপকাষ্ঠের সামনে দাঁড় করিয়ে

যেমনটা যা-যা করা হয় , ঠিক তেমনটাই

সব সব করা হলো ; তারপর তোমাকে মঞ্চে তুলে

ওরা তোমার হাত বাঁধলো , পা বাঁধলো ,

তোমার মুখ ঢাকলো কণ্ঠলগ্ন একটা

মোটা কালো কাপড়ের ঢাকনায় ।


ফাঁসির দড়ি তোমার গলায় আলতো স্পর্শ করতেই

তোমার অগ্নিকণ্ঠে ধ্বনিত হলো সেই ব্রহ্মধ্বনি--

' বন্দে মাতরম ' ' বন্দে মাতরম ' 'বন্দে মাতরম '--

চতুর্থবার মাঝপথে থেমে গেল তোমার কণ্ঠ ,

তুমি বিপুল অন্ধকারে হারিয়ে গেলে ;

যদিও তখনও হারায়নি তোমার সেই ব্রহ্মধ্বনি ।

বেশকিছুক্ষণ ধরে তোমার ফেলে যাওয়া ধ্বনির

প্রতিধ্বনি শোনা গেল বন্দিশালার কক্ষে কক্ষে ,

বাহিরে অপেক্ষমান অগণিত মানুষের মুখে মুখে , 

সমস্বরে সেই ধ্বনির প্রতিধ্বনি শোনা গেল

আসমুদ্রহিমাচল ; সেই ধ্বনি প্রতিহত হতে হতে

ঘুরতে রইলো পাহাড়ে পাহাড়ে , 

মর্মরিত হতে রইলো গাছের পাতায় পাতায় ।


এই তুমি বা তোমরা--যারা স্বাধীনতা দেখলে না ,

স্বাধীনতা দিয়ে গেলে , আজ কোথায় তোমরা ?

শুনছো , কোথায় তোমরা ? 

তোমরা এসো একবার , নিজেদের চোখে একবার

দেখে যাও--এরা কী হাল করেছে দেশের ।

ঘরে ঘরে দারিদ্র্য ও বেকারত্বকে বাঁচিয়ে রেখে ,

শিক্ষার গুণগত মানের বারোটা বাজিয়ে ,

দু'হাতে ভিক্ষার দান ছড়িয়ে লক্ষহাতে কীভাবে 

লুটছে এরা--নিজেদের চোখেই দেখে যাও ।

ধর্মকে হাতিয়ার করে ক্ষমতায় আসীন থাকার

কী ভয়ঙ্কর খেলা এরা খেলছে , 

খেলার নামে-মেলার নামে , উৎসবে-কার্নিভালে ,

বাহারী রথ সাজিয়ে ভারতবর্ষের মতো

হতদরিদ্র একটা দেশে--অর্থের

কি বিপুল অপচয় এরা করছে , দেখে যাও ।


আমার কথা কি তোমাদের কানে পৌঁছাচ্ছে না ?

যদি পৌঁছায় , তবে সেই তোমরা দলবেঁধে

আর একবার এসো--যাদের এক হুঙ্কারে সেদিন

মহাকরণের অলিন্দ থেকে শাসকের মসনদ অবধি

থরথরিয়ে কেঁপেছিল , বুড়িবালামের জল

টগবগিয়ে ফুটেছিল , জালালাবাদের পাহাড় থেকে

দেশের সর্বত্র পাহাড়ে পাহাড়ে--যাদের সেই হর্যক্ষ-হুঙ্কারের উঠেছিল প্রতিধ্বনি , 

যাদের হুঙ্কারে বঙ্গোপসাগরে , আরবসাগরে ঘটেছিল বিপুল জলোচ্ছ্বাস , 

হ্যাঁ , আমি সেই তোমাদেরই বলছি :

তোমরা এসে এদের দু'গালে বজ্র-থাপ্পড় হাঁকিয়ে

বুঝিয়ে দাও দেশপ্রেম বা দেশসেবা কাকে বলে ,

ত্যাগ কাকে বলে , বলিদান কাকে বলে ।


এই যারা গলা ফাটিয়ে দেশসেবার বড়াই করছে ,

এরা আসলে সব বেতনভুক সরকারী কর্মচারী ;

তবে তফাত অনেক : এদের পরীক্ষা নাই , 

বয়স নাই , বেতন আকাশছোঁয়া , বিনাপয়সায়

গাড়ি-বাড়ি-ফোন-বিদ্যুৎ-সিকিউরিটি ইত্যাদি ইত্যাদি সব লুটছে ; তার ওপর ব্যাঙ্কব্যালেন্স ও উপরিপাওনার ব্যাপারটাতো কহতব্য নয় । 

তোমরা এসো , কার্নিভালের সুসজ্জিত মঞ্চ থেকে ,

ফুলসাজানো বাহারী রথের থেকে

টেনে এদের নামিয়ে দাও , একসাথে হাঁটাও

সেই তাদের সঙ্গে রোদে-বৃষ্টিতে-নগ্নপায়ে,

রোদের আগুনে পিচগলা পথে , পোড়া বালির

সুতপ্ত আগুনে রাস্তায় ।


হাঁটাও সেই তাদের সঙ্গে , অর্থের অভাবে যাদের

বোনেদের বিয়ে আটকে আছে , বিনা চিকিৎসায়

বাবা কিম্বা মা দিন গুনছে বিছানায় , যাদের

উনুনে দু'দিন হাঁড়ি চড়েনি , যাদের বুকে

প্রত্যাশা জাগিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতারণার 

ছ্যাঁকা দিয়েছে , সেই তাদের সঙ্গেই এদের হাঁটাও ।

হ্যাঁ , এদের হাঁটাবার জন্যেই তোমরা আসবে ,

এই জেনে আমি সেই দিনটার অপেক্ষাতেই

 কান পেতে আছি ।

-----------------------------------------------------------------