সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
আধ্যাত্মিক বিষয়সরস্বতৈ নমঃ নিত্যাং ==================সরস্বতী (সংস্কৃত: सरस्वती) হলেন জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বুদ্ধি ও বিদ্যার হিন্দু দেবী। তিনি সরস্বতী-লক্ষ্মী-পার্বতী এই ত্রিদেবীর অন্যতম। এই ত্রিদেবীর কাজ হল ব…
সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
আধ্যাত্মিক বিষয়
সরস্বতৈ নমঃ নিত্যাং
==================
সরস্বতী (সংস্কৃত: सरस्वती) হলেন জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বুদ্ধি ও বিদ্যার হিন্দু দেবী। তিনি সরস্বতী-লক্ষ্মী-পার্বতী এই ত্রিদেবীর অন্যতম। এই ত্রিদেবীর কাজ হল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে যথাক্রমে জগৎ সৃষ্টি পালন করতে সাহায্য করা।
ওঁ ঐঁ সরস্বত্যৈ নমঃ
সরস্বতী গায়ত্রী মন্ত্র : ওঁ বাগদেব্যৈ বিদ্মহে ব্রহ্মরাজায় ধীমহি তন্নোঃ দেবী প্রচোদয়াৎ।
ওঁ শান্তি ব্রহ্মব্য প্রিয়ে নমঃস্তুতে ।
আমরা যে দেবী সরস্বতীকে হিমালয়কন্যা পার্বতীর কন্যা ও লক্ষ্মী-কার্তিক-গণেশের সহোদরা ভগ্নীরূপে দেখি, সেটা নিতান্তই বাঙালিদের ঘরোয়া মনগড়া গল্প, এর পিছনে কোন শাস্ত্রীয় অনুমোদন নেই।
শাস্ত্রীনুসারে সরস্বতী সৃষ্টিদেবতা ব্রহ্মার সহধর্মিণী এবং বিষ্ণুপত্নী লক্ষ্মী ও মহেশ্বরজায়া পার্বতীর সঙ্গে একযোগে ত্রিদেবী নামে পরিচিতা।
ধ্যানমন্ত্রে বর্ণিত প্রতিমাকল্পটিতে দেবী সরস্বতীকে শ্বেতবর্ণা, শ্বেত পদ্মে আসীনা, মুক্তার হারে ভুষিতা, পদ্মলোচনা ও বীণাপুস্তকধারিণী এক দিব্য নারীমূর্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে,
ওঁ তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ কুচভরনমিতাঙ্গী সন্নিষণ্ণা সিতাব্জে।
নিজকরকমলোদ্যল্লেখনীপুস্তকশ্রীঃ সকলবিভবসিদ্ধৈ পাতু বাগ্দেবতা নঃ।।
অর্থাৎ, “চন্দ্রের নূতন কলাধারিণী, শুভ্রকান্তি, কুচভরনমিতাঙ্গী, শ্বেত পদ্মাসনে (উত্তমরূপে) আসীনা, হস্তে ধৃত লেখনী ও পুস্তকের দ্বারা শোভমানা বাগ্দেবী সকল বিভবপ্রাপ্তির জন্য আমাদিগকে রক্ষা করুন।”
সরস্বতী প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদসমূহের প্রসূতি।
ঋগ্বেদে বাগ্দেবী ত্রয়ীমূর্তি – ভূ: ভুব: স্ব:, জ্ঞানময়ীরূপে সর্বত্রব্যাপিনী। বিশ্বভূবন প্রকাশ তারই জ্যোতিতে। হৃদয়ে সে আলোকবর্তিকা যখন প্রজ্বলিত হয়, তখন জমাট বাধা অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার যায় দূর হয়ে। অন্তরে, বাইরে সর্বত্র তখন জ্বলতে থাকে জ্ঞানের পুণ্য জ্যোতি। এই জ্যোতিজ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান, এই জ্যোতিই সরস্বতী। আলোকময়ী, তাই তিনি সর্বশুক্লা।
তিন গুণের মধ্যে তিনি সত্ত্বগুণময়ী, অনন্ত জ্ঞানময় ঈশ্বরের বাক্শক্তির প্রতীক বাগ্দেবী। গতিময় জ্ঞানের জন্যই ঋগ্বেদে তাঁকে নদীরূপা কল্পনা করা হয়েছে, যিনি প্রবাহরূপে কর্মের দ্বারা মহার্ণব বা অনন্ত সমুদ্রে মিলিত হয়েছেন। কল্যাণময়ী নদীতটে সাম গায়কেরা বেদমন্ত্র উচ্চারণে ও সাধনে নিমগ্ন হতো। তাদের কণ্ঠে উদ্গীত সাম সঙ্গীতের প্রতীকী বীণা দেবীর করকমলে। সরস্বতী বিধৌত ব্রহ্মাবর্ত ভূমি বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত আশ্রয় করে সাধনা করতে আশ্রমবাসী ঋষিগণ। সেই ভাবটি নিয়েই দেবী ‘পুস্তক হস্তে’, গ্রন্থ রচনার সহায়ক লেখনীটিও তাঁর সঙ্গে।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে শ্রীশ্রীচণ্ডী উত্তরলীলায় শুম্ভ নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তির কল্পনা করা হয়েছিল তা ছিল মহাসরস্বতী। এ মূর্তি অষ্টভূজা – বাণ, কার্মূক, শঙ্খ, চক্র, হল, মুষল, শূল ও ঘন্টা ছিল তাঁর অস্ত্র। তাঁর এই সংহারলীলাতেও কিন্তু জ্ঞানের ভাবটি হানি ঘটেনি, কেননা তিনি ‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়াকা মমাপরা’ বলে মোহদুষ্ট শুম্ভকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করেছিলেন। আরেকটা মতানুসারে, পরমাপ্রকৃতির সত্ত্বগুণের সত্তা দেবী মহাসরস্বতী, যিনি আবার শ্বেত পদ্মাসনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা । দশমহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা তারাদেবী নীলসরস্বতীরূপে পূজিতা, এটাকেও অনেকে সরস্বতীর একটি রূপ বলে মনে করেন । তারা শক্তি আদিশক্তি, তাই শ্রীশ্রীচন্ডীতে দেবী আরাধনায় মহাকালী, মহালক্ষ্মী আর মহাসরস্বতীর আরাধনা করা হয়েছে যা যথাক্রমে তমোগুনের, রজঃ গুণের ও সত্ত্বগুণের তিনটি রূপ ।
স্কন্দ পুরাণে প্রভাসখণ্ডে দেবী সরস্বতীর নদীরূপে অবতরণের কাহিনী বর্ণিত আছে। বায়ু পুরাণ অনুযায়ী কল্পান্তে সমুদয় জগৎ রুদ্র কর্তৃক সংহৃত পুনর্বার প্রজাসৃষ্টির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজ অন্তর থেকেই দেবী সরস্বতীকে সৃষ্টি করেন। সরস্বতীকে আশ্রয় করেই ব্রহ্মার প্রজাসৃষ্টি সূচনা। গরুড় পুরাণে সরস্বতী শক্তি অষ্টবিধা। শ্রদ্ধা, ঋদ্ধি, কলা, মেধা, তুষ্টি, পুষ্টি, প্রভা ও স্মৃতি। তন্ত্রে এই অষ্টশক্তি যথাক্রমে যোগ, সত্য, বিমল, জ্ঞান, বুদ্ধি, স্মৃতি, মেধা ও প্রজ্ঞা। তন্ত্র শাস্ত্রমতে সরস্বতী বাগীশ্বরী – অং থেকে ক্ষং পঞ্চাশটি বর্ণে তাঁর দেহ। আবার পদ্মপুরাণ-এ উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্-এ বর্ণিত হয়েছে –
শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা ইত্যাদি।
এর অর্থ দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা।অধিকন্তু তাঁহার হস্তে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা। অর্থাৎ, “দেবী সরস্বতী আদ্যন্তবিহীনা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা।অধিকন্তু তাঁহার হস্তে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা।”
ধ্যান বা স্তোত্রবন্দনায় উল্লেখ না থাকলেও সরস্বতী ক্ষেত্রভেদে দ্বিভূজা অথবা চতুর্ভূজা এবং মরালবাহনা অথবা ময়ূরবাহনা। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভূজা সরস্বতী পূজিত হন। ইনি অক্ষমালা, কমণ্ডলু, বীণা ও বেদপুস্তকধারিণী। বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভূজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীনা। রাজহংস কেন সরস্বতীর বাহন? কেননা জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই হাঁসের সমান গতি, যেমন জ্ঞানময় পরমাত্মা সর্বব্যাপী – স্থলে, অনলে, অনিলে সর্বত্র তাঁর সমান প্রকাশ। হংস জল ও দুধের পার্থক্য করতে সক্ষম। জল ও দুগ্ধ মিশ্রিত থাকলে হাঁস শুধু সারবস্তু দুগ্ধ বা ক্ষীরটুকুই গ্রহণ করে, জল পড়ে থাকে। জ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রেও হংসের এ স্বভাব তাৎপর্য বহন করে। সংসারে নিত্য ও অনিত্য দুটি বস্তুই বিদ্যমান। বিবেক বিচার দ্বারা নিত্য বস্তুর বিদ্যমানতা স্বীকার করে তা গ্রহণ শ্রেয়, অসার বা অনিত্য বস্তু সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। হাঁস জলে বিচরণ করে কিন্তু তার দেহে জল লাগে না।
দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে, পরম কুস্মন্দেরে প্ৰথম অংশে দেবী সরস্বতীর জন্ম। তিনি বিষ্ণুর জিহ্বাগ্র থেকে উৎপন্ন হয়েছেন। সরস্বতী বাক্য, বুদ্ধি, বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী; সকল সংশয় ছেদকারিণী ও সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িনী এবং বিশ্বের উপজীবিকা স্বরূপিনী। ব্রহ্মা প্রথম তাকে পূজা করেন। পরে জগতে তার পূজা প্রতিষ্ঠিত হয়। সরস্বতী শুক্লবর্ণা, পীতবস্ত্রধারিণী এবং বীণা ও পুস্তকহস্তা। তিনি নারায়ণ এর থেকে সৃষ্টি হয় তাই তিনি তাকে স্বামী হিসেবে ভাবতে লাগলেন পরে তিনি গঙ্গার দ্বারা অভিশাপ পান ও পুনরায় শিবের চতুর্থ মুখ থেকে সৃষ্টি হন ও ব্রহ্মাকে পতিরূপে গ্রহণ করেন। তারপর কৃষ্ণ জগতে তার পূজা প্রবর্তন করেন মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে তার পূজা হয়।
গঙ্গা, লক্ষ্মী ও আসাবারী (সরস্বতীর পূর্ব জন্মের নাম) ছিলেন নারায়ণের তিন পত্নী। একবার গঙ্গা ও নারায়ণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলে, তিন দেবীর মধ্যে তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয়। এই বিবাদের পরিণামে একে অপরকে অভিশাপ দেন। গঙ্গার অভিশাপে আসাবারী নদীতে পরিণত হন। পরে নারায়ণ বিধান দেন যে, তিনি এক অংশে নদী, এক অংশে ব্রহ্মার পত্নী ও শিবের কন্যা হবেন এবং কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর অতিক্রান্ত হলে সরস্বতী সহ তিন দেবীরই শাপমোচন হবে।
গঙ্গার অভিশাপে আসাবারী মর্ত্যে নদী হলেন এবং ব্রহ্মার পত্নী হলেন ও শিবের চতুর্থ মুখ থেকে সৃষ্টি হয়ে তার কন্যা হলেন।
শুক্ল যজুর্বেদ
রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন, সে সময় জ্যোতির্ময়ী ব্রহ্মা প্রিয়া সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন।
সরস+বতী=সরস্বতী অর্থ জ্যোতিময়ী। ঋগ্বেদে এবং যর্জুবেদে অনেকবার ইড়া,ভারতী, সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায়। বেদের মন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় প্রতীতী জন্মে যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি।
মহাবিদ্যা প্রতিটি জীবের মধ্যে থেকেও জীবদেহের কোন কিছুতে তাঁর আসক্তি নেই, তিনি নির্লিপ্তা। হিন্দুদের দেবী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ ও জৈনদের কাছেও পুজো পেয়েছেন সরস্বতী। গান্ধারে পাওয়া বীণাবাদিনী সরস্বতীর মূর্তি থেকে বা সারনাথে সংরক্ষিত মূর্তিতে এর প্রমাণ মেলে।
অনেক বৌদ্ধ উপাসনালয়ে পাথরের ছোট ছোটো মূর্তি আছে তাতে সরস্বতী বীণা বাজাচ্ছেন, অবিকল সরস্বতীমূর্তি। মথুরায় জৈনদের প্রাচীন কীর্তির আবিষ্কৃত নিদর্শনে সরস্বতীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে সেখানে দেবী জানু উঁচু করে একটি চৌকো পীঠের উপর বসে আছেন, এক হাতে বই।
শ্বেতাম্বরদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর অনুমোদন ছিল। জৈনদের চব্বিশজন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ষোলজন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অন্যতমা হলেন সরস্বতী। শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর উভয় জৈন সম্প্রদায়েই সরস্বতীর স্থান হয়ে গেল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে গৃহীতা একজন প্রধান দেবীরূপে।
সরস্বতী শব্দের দুই অর্থ – একটি ত্রিলোক্য ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি, অন্যটি নদী। সরস্ + বতী = সরস্বতী, অর্থ জ্যোতির্ময়ী। আবার সৃ ধাতু নিস্পন্ন করে সর শব্দের অর্থ জল। অর্থাৎ যাতে জল আছে তাই সরস্বতী। ঋগ্বেদে আছে ‘অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী’, সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। শুধু বৈদিক যুগেই নয়, পরবর্তীকালে মহাভারত, পুরাণ, কাব্যে পূতসলিলা সরস্বতীর মহিমা বর্ণিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল ছিল হিমালয়ের সিমুর পর্বতে, সেখান থেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলার আদবদ্রী নামক স্থানে সমভূমিতে অবতরণ করেছিল। যে প্রসবণ থেকে এই নদীর উৎপত্তি তা ছিল প্লক্ষ্ণাবৃক্ষের নিকটে, তাই একে বলা হতো প্লক্ষ্ণাবতরণ। ঋগ্বেদের যুগে গঙ্গা যমুনা ছিল অপ্রধান নদী, সরস্বতী নদীই ছিল সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। এর তীরে ছিল প্রসিদ্ধ তীর্থভূমি। সরস্বতী ও দৃষদ্বতীর মধ্যস্থান দেবনির্মিত স্থান হিসেবে বিবেচ্য হত।
ব্রাহ্মণ ও মহাভারতে উল্লেখিত সারস্বত যজ্ঞ এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হত। মহাভারত রচনা হওয়ার আগেই রাজপুতানার মরুভূমিতে সরস্বতী নদী অদৃশ্য হয়ে গেলেও কয়েকটি স্রোতধারা অবশিষ্ট ছিল। এই স্রোতধারা হল চমসোদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ ও নাগোদ্ভেদ। রাজস্থানের মরুভূমির বালির মধ্যে চলুর গ্রামের নিকটে সরস্বতী অদৃশ্য হয়ে ভবানীপুরে দৃশ্য হয়, আবার বলিচ্ছপুর নামকস্থানে অদৃশ্য হয়ে বরখের নামক স্থানে দৃশ্য হয়। তান্ডমহাব্রাহ্মণে সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিসাবে প্লক্ষ্ণপ্রস্রবণ ও বিনাশস্থল হিসেবে বিনশনের নামোল্লেখ আছে। লাট্যায়ণের শ্রৌতসূত্র মতে, সরস্বতী নামক নদী পশ্চিম মুখে প্রবাহিতা, তার প্রথম ও শেষভাগ সকলের প্রত্যক্ষ গোচর, মধ্যভাগ ভূমিতে নিমগ্ন যা কেউ দেখতে পায় না, তাকেই বিনশন বলা হয়। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের মতে, বৈদিক সরস্বতীর লুপ্তাবশেষ আজও কচ্ছ ও দ্বারকার কাছে সমুদ্রের খাড়িতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর বিনাশ ঘটেছিল অবশ্যই বৈদিক যুগের শেষভাগে, একমতে খ্রিস্টের দেড় হাজার বছরেরও আগে। মহাভারতে আছে যে নিষাদদের চোখের আড়ালে থাকার জন্য বিনাশণ নামক স্থানে মরুভূমিতে অদৃশ্য হয়েছে। নদীর স্থানীয় নামই এই ঐতিহ্য বহন করছে। আবার অনেকে বলেন, সিন্ধুনদই সরস্বতী। সরস্বতী ও সিন্ধু দুটি শব্দের অর্থই নদী। সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিককালে প্রচলিত হয়েছে। প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকরা সরস্বতীসদৃশা দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির ওপর তালপাতার দোয়াত-কলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল।
সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী। তিনি বিদ্যাদেবী, জ্ঞানদায়িনী, বীণাপাণি, কুলপ্রিয়া, পলাশপ্রিয়া প্রভৃতি নামে অভিহিতা। তাঁর এক হাতে বীণা অন্য হাতে পুস্তক।
আরেকটা মত অনুসারে, বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, বৃহস্পতি পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ বা ঋগমন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন এ ধরাতে। কালের বিবর্তনে সরস্বতী তাঁর অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবী অর্থাৎ জ্ঞান ও ললিতকলার দেবীতে পরিণত হলেন। সরস্বতী জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার দেবী। ঋগবেদে তিনি বৈদিক সরস্বতী নদীর অভিন্ন এক রূপ। পণ্ডিতরা অনেকেই মনে করেন যে সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী পরে হলেন দেবী। এ বিষয়ে রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, ‘আর্য্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে তাই প্রথমে দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন। বর্তমানে গঙ্গা যেমন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাস্য দেবী হিসেবে পূজা পেয়ে থাকেন তেমনি সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী। নর্মদাও তাই, আমাদের শাস্ত্র মতে আমাদের সমস্ত নদীগুলির দুটি করে সত্তা বিদ্যমান - একটি তাঁদের দিব্যসত্তা আর একটি তাঁদের তোয় অর্থাৎ জলসত্তা । সরস্বতীর তোয় সত্তাটি লুপ্তপ্রায় হলেও সরস্বতীর প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে সূর্যাগ্নির জ্যোতিতে। সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীবদেহে বিরাজ করায় চেতনা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে গোলোকে বিষ্ণুর তিন পত্নী লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যে বিবাদের ফলে গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতীর নদী রূপ পাওয়াই হচ্ছে সরস্বতীর পৃথিবীতে দেবীরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তত্ত্ব।
শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্ররা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। ইংরেজি ম্লেচ্ছ ভাষা হওয়ায় সরস্বতী পূজার দিন ইংরেজি বইয়ের পূজা নিষিদ্ধ ছিল। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সরস্বতী দেবী হলেও মেয়েরা অঞ্জলি দিতে পারত না। কিছু পণ্ডিতের মতে সমাজপতিরা ভয় পেতেন হয়তো এই সুযোগে ধর্মের নামে মেয়েরা দাবি করে বসেন লেখাপড়ার স্বাধীনতা ! শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা হয় সাধারণ পূজার আচারাদি মেনে। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়, যেমন অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ, বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুল। লোকাচার অনুসারে ছাত্রছাত্রীরা পূজার আগে কুল ভক্ষণ করে না। পূজার দিন লেখাপড়া নিষেধ থাকে। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, লেখনী-মস্যাধার, পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করা হয়। পূজার শেষে পুষ্পাঞ্জলি। পরদিন সকালে ফের পূজার পর চিড়া ও দই মেশানো দধিকরম্ব বা দধিকর্মা নিবেদন করে পূজা সমাপ্ত হয় ও সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। বসন্ত পঞ্চমীতে অনুষ্ঠিত সরস্বতী পূজার পরের দিনটি বাংলায় শীতলষষ্ঠী। কোনো কোনো পরিবারে এদিন অরন্ধন পালন ও ‘গোটা-সেদ্ধ’ খাওয়ার প্রথা আছে। অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের অন্নদামঙ্গলে ত্রিপদী ছন্দে সরস্বতী বন্দনায় দেবীর প্রতি ভক্তের শ্রদ্ধার নিদর্শন মেলে সেই সময়ের বঙ্গভূমিতে।
বর্তমানে সরস্বতীর বাহন হাঁস। পণ্ডিত কলহনের মতে, সরস্বতী দেবী হংসের রূপ ধারণ করে ভেড়গিরি শৃঙ্গে দেখা দিয়েছিলেন। এ ধরনের ধারণা সঙ্গত কারণ হংসবাহনা সরস্বতীর মূর্তি তো প্রচুর পাওয়া যায়। তিনি এ বাহন ব্রহ্মার কাছ থেকে পেয়েছিলেন কিন্তু ব্রহ্মা বা সরস্বতী দেবীর বাহন কিন্তু পাখি নয়। বেদে এবং উপনিষদে হংস শব্দের অর্থ সূর্য। সূর্যে সৃজনী শক্তির বিগ্রহাম্বিতরূপ ব্রহ্মা এবং সূর্যাগ্নির গতিশীল কিরণরূপা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব শক্তি সরস্বতী দেবীর বাহন হয়েছেন হংস বা সূর্য একেবারেই যুক্তিসঙ্গত কারণে। তবে বৈদিক সাক্ষ্য থেকেই জানা যায় সিংহ ও মেষ সরস্বতী দেবীর আদি বাহন ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেবী দুর্গা সরস্বতী দেবীর কাছ থেকে সিংহ কেড়ে নিলেন আর কার্ত্তিক কেড়ে নিলেন ময়ূর। পরবর্তী সময়ে সরস্বতী দেবী হংসকেই তাঁর চিরস্থায়ী বাহনের মর্যাদা দিলেন। আর সরস্বতীর এ বাহন সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই তাঁর সমান গতি ঠিক যেমনভাবে জ্ঞানময় পরমাত্মা সব জায়গায় বিদ্যমান। মজার ব্যাপার হলো হংস জল ও দুধের পার্থক্য করতে সক্ষম। জল ও দুধ মিশ্রিত থাকলে হাঁস শুধু সারবস্তু দুধ বা ক্ষীরটুকু গ্রহণ করে আর জল পড়ে থাকে। জ্ঞান সাধনায় হাঁসের এ স্বভাব যথেষ্ঠ তাৎপর্য বহন করে। তাই বিদ্যাদেবীর বাহন হিসেবে হাঁসকে খুব ভালোই মানায়।
হাতে বীণা ধারণ করেছেন বলেই তাঁর অপর নাম বীণাপাণি। বীণার সুর মধুর। পূজার্থী বা বিদ্যার্থীর মুখ নিঃসৃত বাক্যও যেন মধুর হয় এবং জীবনও মধুর সংগীতময় হয় এ কারণেই মায়ের হাতে বীণা।
হিন্দুদের দেবী হয়েও বৌদ্ধ বা জৈনদের কাছ থেকেও পূজা পেয়েছেন সরস্বতী। অনেক বৌদ্ধবিহারেও সরস্বতীর মূর্তি পাওয়া যায়। জৈনদের ২৪ জন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ষোলজন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অনন্যা মা সরস্বতী। সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন হয়। সরস্বতী পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়। তবে এই পূজায় আলাদা কিছু সামগ্রী যেমন : অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ ছাড়াও লাগে বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুল।
পূজার দিন লেখাপড়া একেবারেই নিষেধ থাকে। পূজার পরে দোয়াত-কলম পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রের পূজারও প্রচলন আছে। এ দিনেই অনেকের হাতেখড়ি দেওয়া হয়। পূজা শেষে অঞ্জলি দেওয়াটা খুব জনপ্রিয়। আর যেহেতু সরস্বতী বিদ্যার দেবী তাই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এ উৎসব অনেক বড় করে পালিত হয়। আর সেখানে দল বেঁধে অঞ্জলি দেয় শিক্ষার্থীরা। মানুষের ভেতরের পশুকে নিবৃত্ত করে জ্ঞান দান করেন বিদ্যার দেবী সরস্বতী।
সনাতন ধর্মের এ অন্যতম ধর্মীয় উৎসব এবার আবার ফাল্গুনের প্রথম দিনে হওয়াতে বসন্তের বাসন্তী আমেজের সাথে ধর্মীয় উৎসবের আমেজ মিলেমিশে একাকার।
মা সরস্বতী আমাদের আশীর্বাদ করছেন- জীবনকে শুভ্র ও পবিত্র রাখ। সত্যকে আঁকড়ে রাখ। মূল গ্রন্থের বাণী পালন কর। জীবন ছন্দময় কর। স্বচ্ছন্দে থাক।’ এ বিশ্বের সবাই মনের কলূষতা দূর করে জ্ঞানের আলোয় নিজেকে ও অন্যকে আলোকিত করুক মা সরস্বতীর কাছে এই প্রার্থনা
।
সরস্বতৈ নমঃ নিত্যাং
==================
দ্বিতীয় ভাগ
***********
বিদ্যাদায়িনীর পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রে ভদ্রকালী কেন ?
প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক মা সরস্বতীর পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রটি -
'সরস্বত্যৈঃ নমো নিত্যং ভদ্রকাল্যৈঃ নমো নমঃ।/ বেদো বেদান্তো বেদাঙ্গো বিদ্যাস্থানেভ্যঃ এবচ।
হিন্দু শাস্ত্র মতে - 'শিক্ষা বিভাগ' তিনটি স্তরে ভাগ করা আছে। এবং এই তিন স্তর একে অপরের পরিপূরক। এই তিনটি স্তরের প্রধান দায়িত্বে আছেন তিনজন বিভাগীয় প্রধান। শুরুর স্তরে মা সরস্বতী। তাঁর উপরে দ্বিতীয় স্তরে আছেন মা কালী, যিনি ভদ্রকালী নামে বিরাজ করছেন। তৃতীয় সর্বোচ্চ স্তরে দেবাদিদেব মহাদেব শিব। অর্থাৎ : বিদ্যা - মহাবিদ্যা - বিশ্ববিদ্যা।
দেবাদিদেব মহাদেব শিব হলেন সমস্ত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। আমাদের বোধে তিনি লয়ের প্রধান। আবার তিনিই বিশ্ববিদ্যা আর জ্ঞানের একমাত্র দেবতা। তিনিই বিভিন্ন ভাগ করে দিয়েছেন - সূর্যদেবের উপাসনা আরগ্য কামনায়, ধন লাভে অগ্নিদেব প্রার্থনা, মুক্তির জন্য কেশব নারায়ণের উপাসনা।
আর মা কালী মহাবিদ্যা, যিনি ভদ্রকালী নামে পুরো ব্যাপারটার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তাই শাস্ত্রে তাঁর কাছে প্রার্থনা মন্ত্রে আছে - আমাদের অশিক্ষার অন্ধকার অর্থাৎ মূর্খতা দূর করে জয় দেবার জন্য। দশমহাবিদ্যার 'দেবি মাতঙ্গী' তন্ত্রমতে মা সরস্বতী।
বিদ্যার দেবী মা সরস্বতী। যদিও বিভিন্ন পুরানে তাঁর রূপ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশ হয়েছে। কোথাও তিনি ত্রিনয়না চতুর্ভুজা, কোথাও তিনি গৌরবর্ণা সিংহবাহিনী অষ্টভুজা। বেদে ইনি ব্রহ্মস্বরূপা পরমা জ্যোতিরূপা সনাতনী সর্ববিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী। তিনি বিন্দু-বিসর্গ-মাত্রা, তাই সকল বর্ণের অধিষ্ঠাত্রী। আবার তিনি বাগাধিষ্ঠাত্রী। তবে সবটাই তাঁকে ঊর্ধ্বতন দুই প্রধানের অনুমতি ও সম্মতি নিয়ে কাজ করতে হয়।
শিবঞ্জান বাগময়ী হয়ে আছে বেদে। বেদ হল সাক্ষাৎ জ্ঞান। বেদের অন্তর্গত হল বেদান্ত আর বেদাঙ্গ। তাই মা সরস্বতী পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রে ত্রিস্তরীয় তিন প্রধান'কে প্রণাম জানানোর শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে বসন্ত পঞ্চমী বা সরস্বতী পুজো হয়।
পলাশ না থাকলে সরস্বতী পুজো সম্পন্ন হয় না।
এই আচারের সঙ্গে অনেকগুলি ব্যাখ্যা বা কারণ প্রচলিত আছে।
মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে পুজিত হন দেবী সরস্বতী। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি বাগদেবীর আরাধনায় মেতে উঠবেন সকলে। পলাশ (Palash Flower) না থাকলে সরস্বতী পুজো (Sarawati Puja) সম্পন্ন হয় না। তবে জানেন কেন এই পুজোয় পলাশ ফুলের এত মাহাত্ম্য? রইল বিস্তারিত...
সরস্বতী পুজোয় পলাশ ফুল থাকা আবশ্যক। তবে এর কারণ অনেকরই অজানা। যদিও এই আচারের সঙ্গে অনেকগুলি ব্যাখ্যা বা কারণ প্রচলিত আছে। সরস্বতী পুজোর আরেক নাম 'বাসন্তী পঞ্চমী'। মূলত বসন্ত কালেই পড়ে এই পুজোর তিথি। আর বছরের এই সময়েই বিশেষত রাঢ় অঞ্চলগুলি রাঙা হয়ে যায় পলাশ ফুলে। তাই মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতীকে পলাশ ফুল অর্পণ করা হত। আর সেই রীতিই এখনও প্রচলিত আছে।
এছাড়াও পুরাণ মতে, দেবী সরস্বতীর সঙ্গে প্রজনন এবং উর্বরতা অর্থাৎ বন্ধ্যাত্ব মোচনের সম্পর্ক রয়েছে। ঋষি গৃৎসমদ ঋক্মন্ত্র উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘অম্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতি।’ যেখানে সরস্বতীকে মাতৃশ্রেষ্ঠা, শ্রেষ্ঠ নদী এবং শ্রেষ্ঠ দেবীরূপে উপস্থাপন করা হয়েছেন। এছাড়াও ব্যুৎপত্তিগত অর্থেই সরস্বতী নদী। সরস্ (জল) + বতুপ্ + ঈ(অর্থাৎ স্ত্রীলিঙ্গবাচক ‘ঈ’ = সরস্বতী। নদীদের মধ্যে তিনি শুদ্ধা, ‘নদীনাং শুচির্যতী’, আসমুদ্র তার ধারপথ, ‘গিরিভ্য আসমুদ্রাৎ’।
শুধু তাই নয়, সরস্বতী পুজোর সময়কাল মাঘী শ্রীপঞ্চমী তিথি। জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘শীতকাল হল জড়তার কাল। মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথি থেকেই শীতের জড়তা কেটে যেতে থাকে, ঋতুতে লাগে প্রথম বসন্তের ছোঁয়া। সরস্বতীর আবির্ভাবে সকল জড়তামুক্তি, মনেরও, ঋতুরও।’
পলাশ ফুল, সরস্বতী পুজোর অন্যতম উপচার। ঋতুমতী নারীই গর্ভধারণে সমর্থ, তা কারো অজানা নয়। আর পলাশ রক্তবর্ণ। ঋতুমতীর রজোদর্শনের রং তাই। সেজন্যে বলা হয়, এর প্রতীক হিসেবে শ্বেতশুভ্রা দেবী হয়ে উঠেছেন ‘পলাশপ্রিয়া’।
এটা যে কারও কল্পনা তা নয়। জেনে রাখা ভালো, পলাশ পাতা আজও বন্ধ্যাত্ব দূর করতে ব্যবহৃত হয়। বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার মতো লাল মাটি অধ্যুষিত অঞ্চলে পুত্রসন্তান লাভের জন্যে মহিলারা পলাশপাতা বেটে খেতেন। এছাড়াও সরস্বতী পুজোর ঠিক পরের দিন শীতল ষষ্ঠীর অর্চনা করা হয়। মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদে সন্তান হয় বলেই বিশ্বাস। আর সরস্বতী পুজোর ঠিক পরদিন ঠান্ডা খাবার খেয়ে তাঁরই অর্চনা করা হয়। এইসব কারনেই পলাশ ফুল ছাড়া 'পলাশ প্রিয়া' সরস্বতীর পুজো সম্পন্ন হয় না।
*সরস্বতী পুজোর আগে কুল না খাওয়ার পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রচলিত রীতি। তার মধ্যে কৃষি প্রধান রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। হিন্দু ধর্মে কোনও মরসুমের প্রথম ফলই দেবতাদের উৎসর্গ করে খাওয়ার রীতি রয়েছে। পৌষ-মাঘ এই সময়টাতে বাজারে খুব সহজে এবং ভালো বিভিন্ন রকমের কুল মেলে। আর সেই সময়ই পঞ্চমী তিথিতে হয় সরস্বতী পুজো। তাই বসন্ত পঞ্চমীতেই উৎসর্গ করে তা প্রসাদ হিসেবে খাওয়ার রীতি।
* শাস্ত্র মতে দেবী সরস্বতীকে তুষ্ট করতে ব্যাসদেব দীর্ঘদিন তপস্যা করেছিলেন। শোনা যায়, সে তপস্যার আগে দেবী সরস্বতী তাঁর তপস্যাস্থলের পাশেই একটি কুল বীজ রেখে একটি শর্ত দিয়েছিলেন। সেই শর্তানুযায়ী বলা ছিল, যতদিন না কুল বীজ অঙ্কুরিত হয়ে বড় গাছ হবে এবং সেই গাছের ফল পেকে ব্যাসদেবের মাথার উপর পড়বে। ততদিন অবধি দেবীর তপস্যা করতে হবে।তারপরেই দেবী তাঁর তপস্যায় তিনি তুষ্ঠ হবেন। সেই শর্তানুযায়ী, ব্যাসদেব তপস্যা শুরু করেন। যেদিন গাছের নতুন ফল তাঁর মাথায় পড়ে, তিনি বুঝতে পারেন দেবী তাঁর তপস্যায় তুষ্ঠ হয়েছেন। বিশেষ দিনটি ছিল পঞ্চমী। সেই দিন দেবীকে কুল নিবেদন করে ব্যাসদেব ব্রহ্মসূত্র রচনা আরম্ভ করেছিলেন। সেইজন্যই শ্রীপঞ্চমীর দিনই সরস্বতী দেবীকে নিবেদন করার পর কুল খাওয়া হয়।
* প্রচলিত এই লোকাচারের পিছনে আরও একটি কারণ রয়েছে। বসন্তকালে বিভিন্ন রকমের রোগ দেখা দেয় চারিদিকে। সর্দি-কাশি, জ্বর, পেটের সমস্যা এই সময়ে ঘরে ঘরে লেগে থাকে। আধ পাকা বা কাঁচা কুল বসন্তকালে খেলে পেটের সমস্যা হতে পারে। এছাড়াও এই ফল মারাত্মক টক হয় যা দাঁতের জন্যে ক্ষতিকারক। তাই এটি খাওয়ার নিয়ম নেই সেই সময়ে।
* এছাড়াও শাস্ত্রে বলা রয়েছে, "বার্তাকু কার্তিককে বর্জ্যং মূলং বা বদরং মাঘে। চৈত্রে শিম্বী পুনস্তুম্বী ভাদ্রে বর্জ্যং দ্বিজাতিভিঃ।" যার অর্থ, দ্বিজাতিগণ কার্তিক মাসে বেগুন, মাঘ মাসে মুলো বা কুল, চৈত্রে শিম এবং ভাদ্র মাসে গোলাকার লাউ খাবেন না।
তবে এই সমস্ত লোকাচার বা শাস্ত্রের নিয়ম ছোটরা বুঝবে না বা মানবে না। তাই তাদেরকে বাড়ির বড়রা ভয় দেখান এই বলে যে সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেলে পরীক্ষায় পাশ করা যায় না। হয় তারা লুকিয়ে কুল খান অথবা অধীর ভাবে অপেক্ষা করে সরস্বতী পুজোর, যাতে নারকেল, টোপা ইত্যাদি ভিন্ন ধরণের কুলের স্বাদ তারা নিতে পারে।
সূত্র: বেদ সংহিতা, সর্বভারতীয় প্রাচ্যবিদ্যা, জয়ন্ত কুশারী, অধ্যক্ষ।
ছবি : অন্তর্জাল