বিভাগ-গল্পশিরোনাম-সুখের সন্ধানেকলমে-সুতপা ব্যানার্জী(রায়)তারিখ-১৯/৩/২১
মোহন দাওয়ায় বসে ঘাম মুছতে মুছতে বউ শাঁউলিরকাছে এক ঘটি জল চায়-"বউ কোথায় গেলে গো...ও ছোটনের মা।" না কোনো সাড়াশব্দ নেই। অগত্যানিজেই ঘটি নিয়ে কুঁয়ো তলা…
বিভাগ-গল্প
শিরোনাম-সুখের সন্ধানে
কলমে-সুতপা ব্যানার্জী(রায়)
তারিখ-১৯/৩/২১
মোহন দাওয়ায় বসে ঘাম মুছতে মুছতে বউ শাঁউলির
কাছে এক ঘটি জল চায়-"বউ কোথায় গেলে গো...
ও ছোটনের মা।" না কোনো সাড়াশব্দ নেই। অগত্যা
নিজেই ঘটি নিয়ে কুঁয়ো তলায় যায়। কদিন যা পরিশ্রম যাচ্ছে। পুকুরের পোনাগুলোকে বেছে বেছে
ইনজেকশন দিয়ে আবার পুকুরে ছাড়া। সঙ্গে সনাতনকে নেয় বটে। তবে এ কাজ অন্তত ছ-জন মনিষ্যির। লোকসান ঠেকাতে শুধু সনাতনকে নিয়েই কাজ সারে মোহন। আকাশের পানে ক্লান্ত চোখে চায়
মোহন, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে এতো করেও কি সে লোকসান ঠেকাতে পারবে। সেবার আঁতুড় পুকুরেই
সব ছানাগুলো মরে গেল। পুকুর ভাড়ার টাকা, মাছের খাবারের টাকা সব জলে গেল। গেলবারের আগের বারে প্রায় আধ হাতের ছানাগুলো সঞ্চয়ীপুকুর থেকে বৃষ্টির জল বেড়ে, নদীর হঠাৎ বানে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। প্রতি বছরই মহাজনের কাছে তার দেনা বেড়ে চলে। রোজগারে শক্ত সমর্থ হতে পারছে না বলে বউ শাঁউলিও তাকে আর বিশেষ পাত্তা দেয় না। একটু রোজগার বাড়ানোর আশায় যে যা পরামর্শ দেয়, সেখানেই পাগলের মতো ছুটে যায়। এই যেমন ভাবছে ওর বন্ধু নারায়ণ বলেছে গঞ্জে কম সেলামিতে একটা দোকান পাওয়া যাচ্ছে, সাথে দোকানে কিছু মাল মানে নতুন জুতো আছে তাই দিয়ে জুতোর দোকান খুলবে।
মনে শঙ্কা পুরোনো সুদ জমা করতে না পারলে কি মহাজন ধার দেবে। তা শাঁউলি কদিন আগে বললে-
"তুমি চিন্তা কোর নি, ও ধার মহাজনের থেকে আমি ব্যবস্থা করে দেব।" মোহন ভেবে পায় না যে ধার ও পাবে না তা শাঁউলি কিভাবে জোগাড় করবে।
যাহোক মাসখানেকের চেষ্টায় সে দোকান খোলা হয়েছে। বড় বড় করে সাইনবোর্ডে লেখা আছে-"শাঁউলি সু হাউস।" মোহন আশায় বুক বাঁধে
এবার বোধ হয় ওই দূরের সূয্যিটা ওর ভাগ্যের আকাশে দেখা দেবে। নারায়ণ মাঝে মাঝে দোকানে
এসে বসে আর বলে-"তুই ঘর বাগালতে পারিস না,
কপালখানাও তেমনি। শাঁউলিকে এবার রাশ দে।"
মোহন সুযোগসন্ধানী নয়, রগচটা নয়, লোককে দুকথা শোনাতে পারে না, তাই অসম্মানের অমাবস্যায়
ঢেকে থাকে। ওর যত ভাব ছেলে ছোটনের সঙ্গে, সে বুঝি তার বাবাকে বুঝতে পারে। মোহনের অন্ধের যষ্ঠী
ওই-ই, দুদন্ডের সুখ। নতুন দোকানও সেভাবে জমাতে
পারে না মোহন। সেদিন মানকার বউ এসে বলে গেল-
"মোহনদা তোমার এসব পুরোনো আদলের জুতো কে
কিনবে বল, আধা ঘন্টার পথ গেলেই তো সব হাল ফ্যাশানের দোকান।" মাছচাষের ধার বাবদ আগেকার
ধার ও সুদের টাকার জন্য মহাজন জোর তাগাদা দেওয়া শুরু করেছে। শাঁউলি কইলে-"উসব ছাড়ো,
লটারির ব্যবসা এখন ভাল চলে, তাই একখান কর।"
মোহন মনে মনে ভাবে যে নিজের ভাগ্যের সন্ধান জানে না, সে অন্যের ভাগ্যের উন্নতি কিভাবে করবে।
যাহোক জুতোর দোকান ক্ষয়ক্ষতি করেই হয়ে গেল
লটারির দোকান। তা যাতায়াতের পথে ভাগ্যের সন্ধান
করতে কিছু লোক জুটল বইকি। যেটুকু যা বিক্রিবাটা
হল তাতে মহাজনের সুদও কয়েক কিস্তি শুধল।
শাঁউলির কিছু আবদারও মেটানো গেল। কিন্তু তারপর আবার যে কে সেই। নারায়ণ পরামর্শ দিল-
" কিছু লটারির টিকিট বউয়ের নামে কাট, তোর তো মন্দ কপাল, নিজের নামে কাটিস নি।" এরই মধ্যে
বাউরী পাড়ার বিলু বাউরীর কপালে লটারির লাখখানেক টাকা জুটে গেল। টিকিট মোহনের দোকানের। মোহন মনে মনে ভাবে, যাক নিজের নাহোক ওর দৌলতে কারুর কপাল খুলল।
কিন্তু সাথে এটাও ভাবে এবার তো ওর বউয়ের কপাল
খোলার ব্যাপার তাহলে খুলছে না কেন। সেদিন ঘরে
ফিরে দেখল সুদের টাকা না পেয়ে মহাজনের পোষা
গুন্ডা ঘর তছনছ করে রেখে গেছে। ছেলেটা দাওয়ায় বসে কাঁদছে, শাঁউলি ঘরে নেই। আজ যেন মোহনের মনে নিজের ওপর নতুন করে ধিক্কার জন্মাল। কোনমতে ভাঙাচোরা জিনিস সামলে ছেলেটাকে রেঁধে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে সেঁকো বিষ কতকটা গলায়
ঢেলে নিল। শাঁউলি ফিরে ভাবল বাপ-ছেলে ঘুমোচ্ছে
ঘরের অবস্থাও ঠিক করে ঠাওর না করে ও-ও ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন পাড়া-প্রতিবেশীতে ছেয়ে গেল ঘর, শাঁউলির নামে কাটা টিকিটে নাকি পঞ্চাশলক্ষটাকা উঠেছে। কিন্তু ছোটনের বাপ এখনো ঘুমায় কেন। সবাই মোহনের গায়ে হাত রাখে। না লটারির টাকার আনন্দ পাওয়ার আগেই মোহন দূর দেশে পাড়ি জমিয়েছে।