শিরোনাম : পরিচয়কলমে : কেয়া চক্রবর্তীতারিখ : ০৪.০৩.২১
সবার মনে একটা ই থাকে প্রশ্ন,কি আমার পরিচয়?যখন থাকি আমি মাতৃগর্ভে,কেবল একতাল মাংসের দলা,বেড়ে উঠি মায়ের পরিচয়ে,জন্ম নেয়া মায়ের ছায়ায়,মায়ের বেডের টিকিট তখন থাকে আমার পায়ে,আমি তখন শ…
শিরোনাম : পরিচয়
কলমে : কেয়া চক্রবর্তী
তারিখ : ০৪.০৩.২১
সবার মনে একটা ই থাকে প্রশ্ন,
কি আমার পরিচয়?
যখন থাকি আমি মাতৃগর্ভে,
কেবল একতাল মাংসের দলা,
বেড়ে উঠি মায়ের পরিচয়ে,
জন্ম নেয়া মায়ের ছায়ায়,
মায়ের বেডের টিকিট তখন থাকে আমার পায়ে,
আমি তখন শুধুই ছোট্ট শিশু,
জানিনা আমার নাম, ধর্ম, কি আমার পরিচয়?
কে আমার মা, বাবা, সবকিছু বোঝার নেই কোনোই উপায়।।
হয়তো বাবা মা চেয়েছিল পেতে আমায়,
করেছিল কত আশা, জড়িয়ে রেখেছে আমায় তাদের মায়ায়,
পরম স্নেহে নিয়ে যায় ঘরেতে আমায়,
পাই আমি নাম ও পিতৃপরিচয়,
বেড়ে উঠি তাদের দেওয়া নাম ও ধর্মেই হয় তখন আমার পরিচয়।।
কারো কাছে হয়তো আমি অনাহূত তাই ফেলেছে
ছুঁড়ে আস্তাকুঁড়েতে আমায়,
আমি তখন কূল শীল গোত্র হীন,
বেড়ে উঠি কারো দয়ায়,
জানিনা আদৌ কে আমার বাবা, কে মা, আমার জাত, ধর্ম সবই অজ্ঞাত তখন আমার,
বাবা মা থাকতেও অনাথ আমি এটাই আমার পরিচয়।।
বড় হওয়ার সাথেই আমি ছেলে না মেয়ে তাই নিয়ে
বিচার হয় আমার পরিচয়,
মেয়ে হলেই আমার ওপর চাপে নিষেধের বেড়াজাল,
বাড়ির সবার চোখের মণি, রাজকন্যা আমি,
হঠাৎ দুষ্কৃতীদের হাতে রাতেরবেলায় লাঞ্ছিতা হই
সেই আমি,
রাজকন্যা থেকে এক নিমেষেই বদলে যায় আমার পরিচয়,
সংবাদের শিরোনামে, রাতের অন্ধকারে নিগৃহীতা তরুণী,
হারিয়ে যায় পিতৃদত্ত নাম, পাই নতুন পরিচয়,
সমাজে কুৎসা, বাড়িতে সমালোচনার ঝড়,
এক নিমেষেই বদলে যায় আমার সকল পরিচয়।।
আর যদি কখনো বেচে দেয় রাতের আঁধারে ওই নিষিদ্ধপাড়ায়,
পতিতার পরিচয়ে তখন আমার পরিচয় হয়।।
আমি এখন নারী, বাবা মা করেছেন পরগোত্রে গোত্রান্তর আমায়,
বদলে গেছে আমার পরিচয়,
পিতার পরিচয় বদলে পরিচিতা আমি পতির পরিচয়ে,
আর কিছুদিন পরে এখন আমি দুই সন্তানের জননী,
আবারও বদলে গেলো আমার পরিচয়,
আমি আজ সন্তানের মা এই পরিচয়ে পরিচিতা,
বয়স বাড়ার সাথে সাথেই শরীরের কার্যক্ষমতা যায় হারিয়ে,
সন্তানের কাছে আমি হয়ে উঠি বোঝা,
ফেলে আসতে চায় আমায় বৃদ্ধাবাসে,
যেতে হয় ইচ্ছা বা শত অনিচ্ছায়,
এখানের একজন বোর্ডার আমি এখন
বদলে গেলো আবারও আমার পরিচয়।।
অসুখ করলে যখন ভর্তি আমি হাসপাতালে,
তখন শুধুই পেশেন্ট এটাই আমার পরিচয়,
আমার বেড নম্বরই আশেপাশে রয়,
আমার নাম ধরে কেউ ডাকে না তখন আমায়,
যখন ওপারে যাওয়ার আসে ডাক,
এক নিমেষেই বদলে যায় সব,
জীবন্ত মানুষ বদলে গিয়ে হয়ে যায় শব,
আমার পরিচয় চিতাতেই হয়ে যায় শেষ,
যাত্রা তখন আমার অনন্তলোকে,
আমি তখন প্রেতাত্মা রূপেই পরিচিতি পাই।।
আর যদি হতাম আমি ছেলে, কুলের আমি দীপক,
বংশের দেবো বাতি,
তখন কপালে জুটতো আমার কত খ্যাতি,
করতাম যতই দস্যিপানা, কেউ আমার কোনো দোষই দেখতে পেতো না,
প্রতিবেশিদের চোখে আমি অবাধ্য, গুন্ডা এই আমার পরিচয়,
চাকরি পাইনি তখনও বাবার পয়সাতেই খাই,
বেকার নামে হয় আমার পরিচয়,
একটু আধটু হতাশা কাটাতে নেশা ও এখন করি,
মায়ের চোখে এখন অবাধ্য মাতাল আমি,
আর যদি বউ এর কথা একটু শুনে চলি,
আমার স্ত্রৈণ্য নাম জোটে কপালে, এটাই আমার পরিচয়,
আর যদি পরিবারের ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে করি কোনো প্রতিবাদ কুলাঙ্গার আমি পাই আরো একটি নতুন পরিচয়,
কাউকে যদি ভালোবেসে মনে আঘাত পাই,
দেবদাস নামে চেনে সবাই তখন, পিতৃ পরিচয় কোথায় হারিয়ে যায়,
আমি কারোর স্বামী, পিতা, ও ঠাকুর্দার পরিচয়ে পরিচিত,
লালসার টানে করি যখন দুষ্কর্ম, ধর্ষক নামই তখন আমার পরিচয়।।
অফিসে হয়তো বড়বাবু, বাড়িতে বাবা, পাড়ায় আমি রাশভারী দাদা
একই মানুষ কিন্তু পরিচয় হয় ভিন্ন,
এই ধাঁধার উত্তর খুঁজে পাইনি জানিনা কেন?
কারো কাছে মন্দ আমি, কারো কাছে ভালো, অতিশয়
যে আমাকে যেমন দেখে তেমনই আমার পরিচয়,
কারো কাছে আমি দয়ার সাগর, কারো কাছে অতি কৃপণ।।
পরিস্থিতির চাপে একই মানুষের হয় ভিন্ন পরিচয়,
মানুষ হলেও সবাই কি মানুষ হয়ে যায়?
মনুষ্যত্ব হোক আমাদের প্রথম পরিচয়,
তারপরে না হয় নাম, জাত, ধর্মের হোক শত বিচার,
কবি বলেছেন "নামে কি আর যায় এসে?"
নাম ছাড়া ডাকবো যে তোমায় বুঝতে পারবে তবে তুমি তবে কেমন করে?
"সবার ওপরে মানুষ সত্য, তার ওপরে নয়" গুণীজনের কথা অমান্য করার সাহস কেমনে হয়?
গীতায় আছে বলা কর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম,
ফলের আশার বদলে কর্মেই হোক তোমার আমার পরিচয়,
জাত, ধর্ম , বাকি সব পরে বিচার করো পরে।
নরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম ম্লান হয়েছে স্বামীজির কাছে,
বিদ্যাসাগর মহাশয়, বা বিশ্বকবি নিজ কর্মেই গড়েছেন নিজ পরিচয়,
গদাধরকে ভুলেছে সবাই মনের মাঝে রামকৃষ্ণ করেছেন স্থান,
মনিকর্ণিকা কে ছিল কারো মনে নেই ঝাঁসির রাণী রূপেই তিনি বিরাজিত সবার হৃদয়ে,
চিত্তরঞ্জন দাসকেও দেশবন্ধু বলেই সবাই জানেন,
এঁরা সবাই আমাদের প্রণম্য, কর্মের জন্যই এঁরা মহান,
মানবসেবায় ব্রতী তাঁরা আজ ও বিরাজিত স্বমহিমায়,
নিজেরাই গড়েছেন নিজের পরিচয়,
যে তোমাকে যে চোখে দেখে তার কাছে তুমি ঠিক তাই,
একই অঙ্গে বহু রূপে মোরা জীবনের এই রঙ্গমঞ্চে করে চলি নিত্য অভিনয়,
বেঁচে থাকতে গেলে তাই গড়ে তোলো তোমার "পরিচয়"।
©কেয়া চক্রবর্তী®