#সৃষ্টি সাহিত্য যাপন#একটুকু_ছোঁয়া_লাগে #কলমে_মৌসুমী চ্যাটার্জী
অভি আর আবির সেক্টর ফাইভের একই অফিসে কাজ করে আজ চার বছর ধরে। ছ’মাস হয়েছে অভি বিয়ে করেছে মিতা কে। ওর শ্বশুরবাড়ি পলাশপুরে। ওদিকে আবিরের জন্য ও মেয়ে দেখা হচ্ছে কিন্ত ওর …
#সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
#একটুকু_ছোঁয়া_লাগে
#কলমে_মৌসুমী চ্যাটার্জী
অভি আর আবির সেক্টর ফাইভের একই অফিসে কাজ করে আজ চার বছর ধরে। ছ’মাস হয়েছে অভি বিয়ে করেছে মিতা কে। ওর শ্বশুরবাড়ি পলাশপুরে। ওদিকে আবিরের জন্য ও মেয়ে দেখা হচ্ছে কিন্ত ওর কোনও মেয়েই পছন্দ হচ্ছে না।
ও স্বপ্নে এক নারীর অবয়ব দেখতে পায় আর ওর এটাই ধারণা সেই নাকি ওর জীবনসঙ্গীনী হবে তাই ও খুঁজে বেড়ায় সেই নারী কে ।
কিন্তু কারুর ছবির সাথে সেই মিল খুঁজে পায়না ও। এতে আবিরের মা, বাবা বা ওর বন্ধুরা ও ওকে নিয়ে ঠাট্টা করে বলে - "এটা কখনো সম্ভব!!!! তার চেয়ে বরং তুই কুমোরটুলি তে গিয়ে অর্ডার দিয়ে আয়।"
ওদের এই বিদ্রুপ মুখ বুজে সহ্য করে নেয় আবির,,, ও জানে স্বপ্নে দেখা সেই নারীকে ও ঠিক খুঁজে পাবেই একদিন ।
অপরূপ সুন্দরী সে,,, একঢাল চুল সেই কোমর ছাড়িয়ে চলে গেছে। গায়ের রঙ দুধে আলতায়,,, বড় বড় টানা টানা চোখ,,,, মাঝারি গড়ন,,,, দু গালে টোল ও পরে । সে ও যেন বসে আছে তারই অপেক্ষায়।
বারংবার সে খালি আবিরের স্বপ্নে আসে কিছু যেন বলতে চায়। যতবারই আবির কাছে যেতে যায় তখনই স্বপ্ন টা ভেঙে যায়।
যাইহোক আবির অফিসে ঢুকতেই অভি এসে বলে - তুই কিন্তু আমাদের সাথে দোলের আগের দিন পলাশপুরে যাচ্ছিস মানে পরশুদিন, আর তিনদিন থাকবো সুতরাং সেইভাবে প্যান্ট - জামা গুছিয়ে নিস (এক নিঃশ্বাসে বলে তবে থামল)।
শুনেই আবির বলল- আরে দাঁড়া , দাঁড়া তুই তোর বউ কে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবি সেখানে আমি কাবাব মে হাড্ডি কেন হতে যাব। না না আমি যাব না রে। প্লিজ কিছু মনে করিস না ।
অভি বলে আরে বাবা ওরকম করছিস কেন? মিতা প্রতিবছর ওখানে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করে কিন্তু এইবারে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি বলে ওরা ওখানে নিমন্ত্রিত । আর আমি একা যাবো মিতাকে নিয়ে তাই তোকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই।
তোর সাথে যেদিন থেকে বন্ধুত্ব হয়েছে সেদিন থেকেই একসাথে থেকেছি । তবে এই মাস ছয়েক হলো বিয়ে হওয়ায় অভ্যাস টা একটু বদল হয়েছে । কিন্তু চারটে বছর দোলের দিন আমরা একসাথে থেকেছি তাই তোকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই । আর মিতার মুখে শুনেছি পলাশপুরে বসন্ত উৎসব দারুণ হয়। আর ওখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার মত ।
কিন্তু কিন্তু করে ও অভির চাপে পড়ে অগত্যা আবির রাজি হয়ে গেল ।
দোলের আগের দিন ভোরে ওরা অল্ট্রো গাড়ি নিয়ে রওনা দিল পুরুলিয়ার পলাশপুরে ।
গাড়ি নিয়ে যখন পুরুলিয়ার দিকে ঢুকছি তখন দেখছি দুধার দিয়ে সারি সারি পলাশ গাছ আর মাটিতে অসংখ্য পলাশ ফুল স্তূপাকার হয়ে বিছানো যেন লাল রঙের গালিচা পাতা । যেদিকে দুচোখ যায় শুধু পলাশ আর পলাশ । লাল হয়ে আছে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। দোলের সময়ই উপচে পড়ে পলাশ । আর শোনা যাচ্ছে 'পিউ কাঁহা ' ও কোকিলের মধুর ডাক ।
এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে আবির বলে ওঠে - " ভাগ্যিস এলাম নইলে তো খুব মিস হয়ে যেত ।
ওর কথা শুনে অভিরা হেসে ওঠে ।
মিতা বলে -" দাঁড়ান, দাঁড়ান আর ও অনেক কিছু দেখা বাকি আছে সবে তো শুরু ।"
এরপরে ওরা পৌঁছে যায় অভির শ্বশুরবাড়ি । বাড়ির সকলেই খুব আদর- আপ্যায়ন করল ওদের ।
বিকেল হতেই মিতা ওদের সবাইকে নিয়ে স্কুলমাঠে চলে গেল বসন্ত উৎসব দেখার জন্যে । খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে মাঠটাকে। ঠিক মনে হচ্ছে যেন শান্তিনিকেতনে বসে আছি । একদম সামনের সারিতে মিতা ওদের নিয়ে বসলো । " ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল " গানের সাথে নাচ দিয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান । একদল ছোট থেকে বড় ছেলে মেয়ে মিলে নাচটি করল। একটার পর একটা নাচ চলছিল গ্রুপের, এরপরে শুরু হয় সিঙ্গেল নাচ।
আবির বেশ উৎসাহ নিয়েই দেখছিল হঠাৎই "একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি-
তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী ।। " যে নাচ করছিল তাকে দেখে চমকে ওঠে ও ,,, অবিশ্বাস্য ব্যাপার ।
ওই মূহুর্তে আবির কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা । এতদিন ধরে যে ওর স্বপ্নে এসেছে সেই ওর সামনে, অবিকল একইরকম দেখতে , এ ও সম্ভব!
অনুষ্ঠান দেখা ওর মাথায় উঠলো । শুধু ভাবতে লাগল তার নাম টা কি, কতক্ষণে তার সাথে একটু আলাপ হবে।
অনুষ্ঠান দেখা ওর মাথায় উঠলো । শুধু ভাবতে লাগল তার নাম টা কি, কতক্ষণে তার সাথে একটু আলাপ হবে।
অনুষ্ঠান শেষে জানতে চাইলো -"একটুকু ছোঁয়ার নাচের মেয়েটির নাম কি? "
মিতা ও রসিকতা করে বলে ওঠে - "সেকি রাধিকা বুঝি আপনার মনে ছোঁওয়া দিলো । "
নাম টা জেনে ভীষণ ভালো লাগলো আবিরের। কিন্তু কিছুতেই মনের কথাটা কাউকে বলতে পারলো না সে । অস্থির হতে থাকল মনে মনে , আর ওর এই অস্থিরতা লক্ষ্য করলো অভি জানতে চাইলে ও বলতে পারলো না আবির পাছে যদি বিশ্বাস না করে ।
অভিই মিতাকে বলে রাধিকা সহ ওর আরও কাছের দুচারজন বন্ধুদের দোলের দিন সকালে নিমন্ত্রণ করলো যাতে সবাই মিলে দোল খেলা হবে ।
দোলের দিন সকালে রাধিকারা এসে হাজির । বান্ধবীর বরকে রঙ মাখাতে চায় রাধিকা, মিতা জানায় ওর বর ছাদে আছে, ওখানেই খেলা হবে তারই প্রস্তুতি করছে ।
রাধিকা চুপিচুপি পা টিপে টিপে ছাদে যায় আর পিছন থেকে দুই হাত দিয়ে এক মুঠো গোলাপি রঙ অভিকে লাগিয়ে দেয়।
আচমকা এইভাবে কেউ রঙ লাগাতে ঘুরে দাঁড়ায় আবির। আর অভির বদলে এ কাকে দেখছে রাধিকা - "এমাআআআ ,, আমি ভেবেছিলাম অভিদা ", বলেই জিভ কেটে লজ্জায় লাল হয়ে যায় আর ওখান থেকে ছুটে পালিয়ে যায়।
কিন্তু আবিরের বেশ ভালোই লাগে ওর এই ছোঁয়ায় মনটা আবেগে ভাসতে থাকে ।
মিতার এই দুষ্টুমি তে অভি ও যুক্ত ছিল । অভি হাসতে হাসতে উঠে এসে আবির কে দেখে বলল - "একি কে রঙ মাখিয়ে দিল তোকে?"
"আরে তোকে ভেবে ভুল করে আমায় মাখিয়ে ফেলেছে বলে আবির।"
এরপরে হৈ হৈ করে মিতারা ছাদে আসে ও আবিরের সাথে সবার আলাপ করিয়ে দেয় ও একসাথে রঙ খেলায় মেতে ওঠে । সারাদিন ওদের খুব ভালোই কাটে। বিকেলবেলায় সবাই বাড়ি চলে যায় শুধু রাধিকা কে যেতে দেয় না মিতা, বলে ওদের আমাদের পলাশপুর ঘুরিয়ে দেখাব, ফেরার পথে তোকে বাড়ি পৌঁছে দেবো।
রাধিকা কিছু বলতে পারে না কারণ ওর ও আবির কে মনে মনে ভালো লাগে ।
সেদিন রাতে আর ঘুম আসে না আবিরের কারণ তারপরের দিনই ওদের ফিরে যাওয়ার কথা,, অথচ ও যদি বলতেই না পারে তাহলে তো বৃথা হবে ওর এই খুঁজে পাওয়া । খালি এপাশ ওপাশ করছে ।
তাই দেখে অভি বলল -" আরে ভাই খালি এপাশ ওপাশ করে কিছু হবে???? মুখে কিছু বল।"
আবির বলে -" তোকে কি করে বলব বুঝতে পারছি না । কিন্তু বিশ্বাস কর এতদিন আমার স্বপ্নে যে আসত সে এই রাধিকা । প্লিজ তুই কিছু একটা ব্যবস্থা কর। ওকে আমার ভালো লেগেছে ওকেই আমি বিয়ে করতে চাই ।"
অভি বলে -" আমরা থাকতে কোন চিন্তা নেই। কালই ওদের বাড়ি যাবো আর বিয়ের কথা পেরে আসবো।"
শুনে নিশ্চিত হয় আবির,,, বলে বেশ কিন্তু একবার রাধিকার সাথে আমার দেখা করাস ওর সাথে একবার কথা বলে নিতে চাই এই ব্যাপারে ওর মত আছে কিনা?"
শুনে অভি বলে -" ওই দিকেও মনে রঙ ধরেছে বাব্বা সে চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছি । "
শুনে মৃদু হাসি হাসে আবির। কোনক্রমে রাত টা কাটে ওদের ।
সকালেই ফিরে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু আবিরের জন্যেই টাইমটা পিছালো। ঠিক করল রাধিকাদের বাড়ি কথা বলে, একেবারে দুপুরে খেয়ে বেরোবে ।
মিতা রাধিকা কে ডেকে নিয়ে আসায় এবং তাকে সব কিছুই বলে ও এটাও জানায় আবির ওর সাথে একবারটি কথা বলতে চায়।
শুনে রাধিকা ধীর পায়ে ছাদে যায়, যেখানে আজ আবির ওর জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ।
ওকে আসতে দেখে আবির সোজাসুজি বলে -" নিশ্চয়ই মিতা তোমাকে সব কিছু বলেছে ? আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই যে এই বিয়েতে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? বা তোমার জীবনে অন্য কেউ নেই তো? প্লিজ আমায় খুলে বলতে পারো, লজ্জার কিছু নেই । মনে করো আমি তোমার বন্ধুর মতো ।
ওদিকে রাধিকা মুখে বলবে কি,,, ওর বুকের ভেতর তখন ধুকপুক ধুকপুক করছে, কোন মুখে বলবে যেদিন প্রথম ওকে রঙ মাখিয়ে ছিল সেই রঙে যে ওর মন ও রাঙিয়ে গেছে । এ রঙ যে আর ওঠার নয়। তাই চুপটি করে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল আর লজ্জায় সারা মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে । শুধু বলল, -" আমি কিছু জানি না, আমার বাবা, মা যা ঠিক করবে বলেই ছুটে চলে যেতে যায়।
ওই দেখে আবির দৌঁড়ে এসে ছাদের দরজা টা আটকে দাঁড়ায় বলে আরে বাব্বা এখানে তো এইভাবে পালিয়ে যেও না,, উত্তর টা দিয়ে যাও। স্বপ্নের মধ্যে রোজ পালিয়ে যাও,, কিন্তু এখানে সেটা হতে দেব না ম্যাডাম ।"
"স্বপ্নে মানে" বেশ অবাক হয়ে যায় রাধিকা ।
"সে সব পরে শোনাবো।"
"না না আমি এক্ষুনি শুনতে চাই বলেই জোড় করতে থাকে রাধিকা ।"
অবশেষে আবির শোনায় কিভাবে রাধিকা কে সে স্বপ্নে পেয়েছিল আজ থেকে পাঁচ বছর আগে থেকেই।
শুনে তো তাজ্জব হয়ে যায় রাধিকা বলে -" কি করে সম্ভব"!!!!
"ইশ্বর সহায় থাকলে সবই সম্ভব । তা এবারে কি জানতে পারি তোমার মনের কথা বলে আবির ।"
"কিছু কিছু কথা এমন আছে যা বুঝে নিতে হয় মশাই ,,, মুখে বলা যায় না বুঝলেন,,,, বলেই ও পাশ দিয়ে ছুটে পালিয়ে যায়।"
এরপরে মিতা, অভি রাধিকার বাড়ি যায় ও বিয়ের প্রস্তাব দেয়, এতো ভালো ছেলে আর যেখানে কিচ্ছু নেবেনা। আজকের বাজারে এমন ছেলে পাওয়া খুবই মুশকিল তাই তারা যেন হাতে চাঁদ পেল। ঠিক হলো কিছু দিনের মধ্যেই আবিরের মা বাবা এসে মেয়ে কে একেবারে দেখে যাবে আর আশীর্বাদ ও করে যাবে । তবে বিয়ে পনেরো দিনের মধ্যে হওয়া চাই বলে ওরা ওখান থেকে বেরিয়ে আসে।
পলাশপুর থেকে সেদিন ওরা রাতের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসে।
বাবা মা কে সব খুলে বলে ও রাধিকার ছবি দেখায় । ওদের ও খুব ভালো লাগে । এরপরে খুব ধুমধাম করে আবির ও রাধিকার বিয়ে হয়ে যায়। ওরা মহা সুখে ঘর করতে থাকে ।
আবির গান শুনতে চাইলে রাধিকা ওর কানের কাছে গুন গুন করে গেয়ে শোনায়- " ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান-
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান-
আমার আপনহারা প্রাণ আমার বাঁধন-ছেঁড়া প্রাণ ।
............................
সমাপ্ত