Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#বিভাগ_গল্প#শিরোনাম_আপন_কে?✍️সীমা রাহা
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই রমাদেবী স্নান সেরে ঘরটা হাতে হাতে গুছিয়ে ফেললেন।ভারী তো জিনিস আছে গোছানর।"নবনীড়" বৃদ্ধাশ্রমের তিনতলার চার নম্বর ঘরের একটা দিক তার।বাকী ঘর জুড়ে আরও তিন আবাসিক…

 


#বিভাগ_গল্প

#শিরোনাম_আপন_কে?

✍️সীমা রাহা


সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই রমাদেবী স্নান সেরে ঘরটা হাতে হাতে গুছিয়ে ফেললেন।ভারী তো জিনিস আছে গোছানর।"নবনীড়" বৃদ্ধাশ্রমের তিনতলার চার নম্বর ঘরের একটা দিক তার।বাকী ঘর জুড়ে আরও তিন আবাসিকের সংসার।সংসারই বটে।নিজের কাছের মানুষদের কাছে যাদের শেষ বয়সে একটু স্থান সঙ্কুলান হয় না,তারা বৃদ্ধাশ্রমে এসে কোনোরকমে শেষ জীবন তরীটা বায় নিজের "সংসার" গোছানোর অছিলায়। আজ রমাদেবীর জন্মদিন। তিমমাস আগে তার একমাত্র পুত্র যখন তাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেল,বৌমাও নতুন চাকরিতে যোগ দেবে, বয়স্ক মানুষকে একা বাড়িতে রাখা খুব রিস্কের, এই অছিলায়..... তখনই ছেলে প্রণব বলে গিয়েছিল," মা তোমাকে জন্মদিনে আমরা দেখতে আসব"। তাই হতভাগ্য রমাদেবী সকাল থেকে ছেলের অপেক্ষায় বসে। তার ছোট্ট ফুটফুটে নাতনিটা কে ওরা আয়ার জিম্মায় রেখে আপিস যাবে,তাও তার কাছে রেখে যাবে না।ঠিকই করেছে হয়তো,তার বয়স হয়েছে,ধকল নিতে পারবেননা ভেবেছে হয়তো।রমাদেবী জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

        হঠাৎ সুজাতার ডাকে রমাদেবীর চেতনা হয়।

"ও ঠাকুমা,আজ খাবেই না নাকি গো? সেই সকাল থেকে সেজেগুজে বসে,জলখাবারও তো খেলে না।খালি বলছো ছেলে তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসবে।তা বাপু, খাবার আনলে না হয় খেয়ো তখন।এখন তো চলো,বেলা তো অনেক হল।এরপর দুপুরের খাবারও আর দেওয়া হবে না।চলো চলো।"

          রমাদেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন," না রে মনি,খাবার ইচ্ছে নেই।" বলে বিছানায় চোখের জল লুকিয়ে শুয়ে পরলেন।কিন্তু চোখের জল বাঁধ মানে কই? বালিশ ভিজে গেল মুহূর্তে। রমাদেবীর ঘরের অন্যান্য আবাসিকরা যুক্তি করে গেলেন প্রতাপ বাবুর কাছে।প্রতাপ বাবু "নবনীড়" বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকদের দেখভালের দায়িত্বে আছেন।খুব হাসিখুশী আর ভালো মনের মানুষ তিনি।সবসময় আবাসিকদের আনন্দে রাখার নানান পন্থা তিনি খুঁজে বার করেন।দোলের দিন দোলখেলার সাথে সাথে সন্ধ্যেবেলা আবাসিকদের নিয়ে ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা থেকে শুরু করে পঁচিশে ডিসেম্বরে কাছাকাছি কোথাও বনভোজনের আয়োজন পর্যন্ত সব তারই জিম্মায়,তার চেষ্টাতেই হয়ে থাকে।রমাদেবীর ঘরের অন্যান্য আবাসিকদের থেকে বিষয়টি জানতে পেরে প্রতাপ বাবু বললেন,"চলুন আজ রমাদির জন্মদিনে ওনাকে আমরা একটা সারপ্রাইজ দি।" বলে তিনি রমাদেবীর কাছে গিয়ে বললেন,"দিদিভাই,একটু জলদি তৈরি হয়ে নিন তো।একটু বেরতে হবে।" শুনে তো রমাদেবী অবাক।বলেন," কেন,আজ যে বেরনো আছে,তা তো আমাকে আগে থেকে জানানো হয়নি।" 

প্রতাপ বাবু হেসে বলেন, " এই ট্রিপ শুধু আপনার জন্য স্পেশাল। আজ আপনার জন্মদিনটাকে উদযাপন করব কিছু বিশেষ মুহুর্ত উপহার দিয়ে আপনাকে।চলুন আপনার আপন লোকেদের সাথে আজ বিশেষ দিনটিকে সেলিব্রেট করার ব্যবস্থা করি।উঠুন, উঠুন।যাবেন তো নাকি ছেলে,বৌমা,নাতনিকে দেখতে?" আনন্দে রমাদেবীর প্রায় কেঁদে ফেলার দশা।তিনি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেন।তারপর প্রতাপ বাবুর গাড়িতে চেপে রওনা দেন নিজের উত্তর কলকাতার বনেদী শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে।একসময় ওই বাড়িতে আত্মীয় পরিজন, ঠাকুর চাকর গিজগিজ করতো।প্রত্যেক বছর দুর্গাপুজো হোত।আর আজ,অতো বড় বাড়িতেও তার জায়গা হল না।তিনি মনে মনে ভাবেন,তার চোখের মণি, তার একমাত্র ছেলে প্রণব যা করেছে নিশ্চয়ই ভালো বুঝেই। যাক গে,কারুর উপর তার কোনো অভিমান বা রাগপোষণ নেই।এই "নবনীড়" এ তিনি তার সমবয়সী বান্ধবীদের সাহচর্যে ভালোই আছেন।সারাদিন গল্প গাছা,বৃদ্ধাশ্রমের নিজস্ব মন্দিরে পুজো দেওয়া,ফুল তোলা এইসব করে তার ভালোই দিন কেটে যায়। একাকিত্ব বোধ করেন না।তবে রাতে শুতে গেলেই তার চোখ দুটো তার সাথে বেইমানি করে।পুরাতন স্মৃতির সরণী বেয়ে অতীতে পৌঁছে গেলে,তার আঁখিদুটি অঝোর ধারায় ঝরতে থাকে।

হঠাৎ বাজারের মধ্যে গাড়ি রেখে প্রতাপ বাবু "একটু আসছি" বলে নেমে পরলেন।কিছুক্ষণ পর একটা বড় কেকের প্যাকেট হাতে করে ফিরেছেন।লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে যেতে রমাদেবী বলেন," আরে আপনি করেছেন কি? আমি কি বাচ্ছা নাকি যে জন্মদিনে এতো বড় কেক কিনে আনলেন।" শুনে প্রতাপ বাবু বলেন," বুঝলেন রমাদি,আমাদের সবার অন্তরে একটা করে শিশুর বাস আছে।সেও আনন্দে হাসতে চায়,ছুটতে চায়,মন খুলে কথা বলতে চায়।কিন্তু সামাজিকতার আর বয়সের দোহাই দিয়ে আমরা আমাদের সেই শিশু মনকে শাসনে রাখি।তাকেও মাঝেমাঝে ছাড় দিতে হয়।বাঁচতে দিতে হয় নিজের খেয়ালখুশিতে।" শুনে রমাদেবী হাসলেন।

বাড়ির সামনে গাড়ি পৌঁছাতেই তিনি তো হতবাক।তার অতো বড় বনেদী বাড়িখানা ভাঙা হচ্ছে।কিন্তু প্রণব তো একটিবারও জানায়নি যে সে বাড়ি ভেঙে নতুন করে করতে চলেছে।তাকে হাঁ করে বিস্ময়ান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশের বাড়ির শুভেন্দু সেন গেট খুলে বাইরে এসে তাকে ডাকলেন।তার থেকেই তিনি জানতে পারলেন তার ছেলে প্রণব এই বাড়ি বিক্রি করে নতুন ফ্ল্যাট কিনে অন্যত্র চলে গিয়েছে।কোথায় জানতে চাওয়াতে শুভেন্দু বাবু জানালেন

তারা পাড়ার কাউকেই জানায়নি তাদের নতুন বাসভবনের কথা।শুনে আরক্তমুখে রমাদেবী প্রতাপ বাবুর গাড়িতে এসে বসলেন।দেখে মনে হবে তাকে বোবায় পেয়েছে।প্রতাপ বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠে বসলেন।গাড়ি ঘুরিয়ে ফেরার পথে তিনি রমাদেবীকে বললেন,জীবন বড় বৈচিত্র্যময় দিদি।কতোই না ভেল্কিবাজি দেখায়।যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজের অন্তরকে শক্ত রেখে তার মোকাবিলা করাই মনুষ্য ধর্ম।কষ্ট পাবেন না দিদিভাই।আমরা তো আছি।"

সারা রাস্তা রমাদেবী একটিও কথা বলতে পারলেন না,হয়তো নিজেকে গুছিয়ে নিতে একটু সময় নিচ্ছিলেন। গাড়ি "নবনীড়" এর সামনে থামলে তিনি নিঃশব্দে গাড়ি থেকে নেমে পা বাড়ালেন অন্দরের দিকে।হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রতাপ বাবু কে বললেন," আপনি কেকটা নিয়ে আসুন।আমার বন্ধু,বান্ধবীদের সাথে কেক কেটে আজ আমি আমার জন্মদিন উদযাপন করব।শুনে প্রতাপ বাবু একগাল হেসে মাথা নাড়লেন।