Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

শিরোনামঃ বিধির বিধান#কলমে-জুলি ব্যানার্জী #তারিখ-15/4/2021
বৈশাখীর বৈঠক বসতো যখন আমাদের বাড়িতে । আমার পরিবারের লোক আর কিছু গুণী মানুষ নিয়ে বেশ জমে উঠত আসরটা। সামনের টেবিলে রাখা থাকতো রবি ঠাকুরের ছবি । ছবির পাশে থাকতো দুটি ফু…

 


শিরোনামঃ বিধির বিধান

#কলমে-জুলি ব্যানার্জী 

#তারিখ-15/4/2021


বৈশাখীর বৈঠক বসতো যখন আমাদের বাড়িতে । আমার পরিবারের লোক আর কিছু গুণী মানুষ নিয়ে বেশ জমে উঠত আসরটা। সামনের টেবিলে রাখা থাকতো রবি ঠাকুরের ছবি । ছবির পাশে থাকতো দুটি ফুলদানিতে রজনীগন্ধার স্টিক । সুগন্ধি ধূপের গন্ধে চারিপাশটা যেন ম ম করত । বাবা খুব ভালো তবলা বাজাতেন তার সঙ্গে মায়ের গান কি অপূর্ব লাগতো শুনতে। 


কবিতা আমার প্রথম ভালোবাসা। আমি নিজের লেখা দুটি কবিতা পাঠ করলাম। সবাই কবিতা শুনে খুব প্রশংসা করলেন। সকলে বলতেন লেখা বন্ধ করিস নি কখনো তুই অপূর্ব কবিতা লিখিস মন ছুঁয়ে যায়। প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে আমারও ভালো লেগেছিলো।


  আমি অপেক্ষায় থাকতাম বিথীর জন্য কখন বিথী আসবে। বিথী আমাদের পাড়াতেই থাকে চারটে বাড়ি পর ।

 বিথী নিজে হাতে মালা তৈরি করে আনত বকুল ফুলের। নিজের হাতে পরিয়ে দিত রবি ঠাকুরের গলায়। পিসিমণি প্রায় জোর করেই বিথীকে দিয়ে গান করাতো। কি অপূর্ব গলা শুনতে বেশ লাগত। আমি আড়াল থেকে দেখতাম বিথীকে । বিথীর শান্ত নদীর মত দুটি চোখ আমাকে যেন ব্যাকুল করে দিত। বীথিকে যে আমার ভালো লাগে মা যেন কি করে বুঝতে পেরে গিয়েছিল।


 বৈশাখী অনুষ্ঠানে সকলেই অংশগ্রহণ করত। লালু কাকা মাঝে মাঝেই চা-কফি মিষ্টির যোগান দিতেন। নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করতেন বাবা। লুচি, কাশ্মীরি আলুর দম , পোলাও মাংস, রাবড়ি। সেই দিনটার জন্য মা, পিসিমণি, ঠাম্মির হেঁসেলে ঢোকার ছুটি থাকতো। লালু কাকা উড়িষ্যা থেকে রান্নার লোক আনতেন। ভারী সুস্বাদু রান্না করতেন। সবাই খুবই প্রশংসা করতেন খেয়ে।


 বিথীর বাবা রাতের বেলা কোথাও ছাড়তো না। তাই বীথির খাবারটা দিয়ে আসতাম বীথির বাড়িতে। এই সুযোগে আরেকবার দেখা হয়ে যেত বীথির সাথে। 

 সবাই খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাবার পর গোছগাছ করে শুতে যেতে প্রায় রাত দুটো বেজে যেত। দু-তলার বাঁদিকের ঘরটা আমার ছিল। দক্ষিণ দিকের জানলাটা খুললে বীথির ঘরটা দেখা যেত। সেদিন দেখেছিলাম বিথীর ঘরে তখনও আলো জ্বলছে। মনের ভেতর কেমন একটা ভয় কাজ করছিল কারোর কিছু হলো না তো?


 তখন ফোনের সেভাবে ব্যবস্থা ছিল না । তা না হলে রাতেই একটা ফোন করতাম। কি আর করা যাবে সারা দিনের ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল । কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানিনা ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকে।

 জয় ( অনিতা দেবীর ছেলে) বললে.... ঘুম ভাঙালে কেন মা ? একটা কথা ছিল সকালে পুকুরে স্নান করতে গিয়ে শুনলাম বীথির মায়ের মুখে... বিথী কে নিয়ে ওর বাবা আসানসোলে গিয়েছে । ওখানে বিথীর পিসির বাড়ি । বিথির জন্য ভালো একটি পাত্রের সন্ধান পেয়েছে পছন্দ হলে পিসির বাড়ি থেকেই বিয়ে দেবে। কাল খুব কান্নাকাটি করেছে বিথী । বাবা কোন কথাই শুনলো না বীথির। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা টা দিতে দিলোনা। 

 জানো মা তাই হয়তো রাত পর্যন্ত বিথীর ঘরের আলো জ্বলছিল।এত তাড়াহুড়ো কিসের জানি না বাবা এই বলে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে অনিতা দেবী( জয়ের মা )।


 ১লা বৈশাখ.... শেষ দেখা বীথির সাথে । বেশ কয়েকদিন মন খারাপ ছিল। আমিও কেমন নিজের কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। চাকরি সূত্রে চলে গেলাম হরিয়ানা বেশ কিছু বছর ছিলাম ঐখানেই। একা থাকা খাওয়ার খুব কষ্ট। তাছাড়া ওখানে প্রচন্ড গরম শরীরকে অসুস্থ করে দিচ্ছিল। বাবাকে চিঠি লিখেছিলাম বাবা বললে ওখানের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে আয়।


 কলকাতায় একটি চাকরির ব্যবস্থা করে তবেই ওই চাকরি ছাড়ি । কলকাতায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েই থাকতে হল। কেননা গ্রামের বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করা অসম্ভব'। ১লা বৈশাখের আগের দিন গ্রামের বাড়ি চলে এলাম। লালু কাকা আর বাবা মিলে সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছে। ঠাকুরদালান সেই আগের মতই সাজানো। শুধু ঠাকুমা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন এক বছর হল।


 মা যখন আমার ঘরে চা দিতে এসেছিল মায়ের মুখটা যেন অন্য রকম লাগলো। মায়ের হাতটা ধরে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কিছু বলবে আমায় মা? এত চুপ কেন? আমি আসার পর থেকে একটাও সেভাবে কথা বলছো না । শরীর ঠিক আছে তো ?

  আরে না না আমি ভালোই আছি ।মেয়েটার কপাল খুব খারাপ রে... কার কথা বলছো মা .... বিথী আবার নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে জানিস। জয় বলে কেন? সঠিক জানিনা ।

 মেয়েটার শরীরে কালশিটে দাগ গুলো চুপি চুপি আমায় দেখিয়েছিল। আমার কাছে অনেক কান্নাকাটি করছিল । আমি দুই রাত্রি ভালো করে ঘুমাতে পারিনি। এই ব্যাপারে আমরাই বা কি করতে পারি বল ।


  পরের দিন বিকেলে... 

পরেরদিন বৈশাখী আড্ডায় অনেক গুণী মানুষকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। নাচে-গানে, নাটক... সব মিলিয়ে সন্ধাটা জমজমাট হয়ে উঠেছিল। 


হঠাৎ চোখ পড়ল বিথীর দিকে। ঠাকুর দালানের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে হলুদ রঙের ছাপা শাড়ি আর আলগা খোঁপা। আমার চোখে যেন আগের বিথী কে খুঁজে পেলাম। কাছে গিয়ে বললাম কেমন আছো? কোন উত্তর না দিয়ে শুধু ঘাড় নাড়লো। বকুল ফুলের মালা টা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে অনেকক্ষণ। কত কথা হয়তো সে বলতে চাই আমায় । জিজ্ঞাসা করলাম তুমি আমায় কিছু বলবে ? চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুকণা । আঁচলে চোখের জল মুছে ছুট্টে চলে গেলো দরজা দিয়ে ।  

  এত বছর পর বুঝতে পারলাম বিথী আমাকেই মনে মনে ভালোবাসে..... সে বলতে পারেনি মুখ ফুটে কোনদিন। বিথীর মনের কথা বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না আমার। আমি সত্যিই খুব বোকা, বিথীকে দুবেলা দেখতাম কিন্তু তবুও বুঝতে পারিনি বিথীর মনের কথা ।


  আর এক মুহূর্ত দেরি করা যাবে না।সেই রাতেই বাবা-মাকে সব খুলে বললাম। মা তো আগে থেকেই জানতো। বাবা আর পিসি কোনো আপত্তি জানালো না। পরেরদিন বিকেলে বীথির বাড়িতে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয় মা।

 বিথীর বাবা .... মায়ের হাত দুটো ধরে কেঁদে ফেললেন। জেদের বশে বীথির জীবনটা আমি নষ্ট করে দিয়েছি। নিজের বোন এভাবে ঠকাবে আমি বুঝতে পারিনি। কৌস্তব একজন পাগল ( বিথীর বর)। ওষুধ খেলে একটু ঠিকঠাক থাকে ... আবার মাঝে মাঝে যা হাতের কাছে পেত তাই দিয়ে বিথীকে মারধর করতো। বাড়ির কেউ কাছে যেতে ভয় পেত ।


 আমাদের বাড়িতে কাজ করে কানাই তাকে দিয়ে কিছু ফল, মিষ্টি পাঠিয়েছিলাম বীথির বাড়ি। কানাই নিজের চোখে নির্মম অত্যাচার হতে দেখে বিথীর উপর। সেইদিনই কানাইয়ের সঙ্গে চলে আসে আমাদের বাড়ি। সেই দিন মা সমস্ত ঘটনা শোনার পর চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি ।

  

  মা বলেছিল পুরনো কথা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যান। একটা ভালো দিন দেখুন । বিথী আমার ঘরের লক্ষী হয়ে যাবে।

 ফাল্গুন মাসের ভালো একটি দিন দেখে বিথী আর জয়ের বিয়ে হয়ে গেল। আবার নতুন করে পড়াশোনা আর গান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল বিধী। বিথীর জীবনের না পাওয়া গুলো পূর্ণতা পেল জয়ের কাছে এসে।