সৃষ্টি সাহিত্য যাপনকবিতা : শ্রীচরণেষু বাবাকেকলমে : শক্তিপদ ঘোষতারিখ : ১৬ , ০৪ , ২০২১
বাবা , তোমাকে ভূমিষ্ট প্রণাম জানাই প্রথমেই ,জীবনের এই উপান্ত বেলায় কেন জানি না--আজ এত বেশি করে মনে পড়ছে খুব তোমাকেই ।যদিও চোখের…
সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
কবিতা : শ্রীচরণেষু বাবাকে
কলমে : শক্তিপদ ঘোষ
তারিখ : ১৬ , ০৪ , ২০২১
বাবা , তোমাকে ভূমিষ্ট প্রণাম জানাই প্রথমেই ,
জীবনের এই উপান্ত বেলায় কেন জানি না--
আজ এত বেশি করে মনে পড়ছে খুব তোমাকেই ।
যদিও চোখের সম্মুখে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না ,
তবু চোখের পাতা ফেললেই স্পষ্ট দেখতে পাই ,
হাতে আমার--তোমার দক্ষিণ হাতের স্পর্শ পাই ,
যেহাতে আমার হাত ধরে এই আমাকে,
প্রথম হাঁটতে শিখিয়েছো , হাঁটতে শেখাতে ।
আমি সেই হাতটাই আজও খুঁজি মনে মনে ,
শয়নে-স্বপনে-জাগরণে ।
জীবনের বিগত দগ্ধ সেই দিনগুলোতে
আমি ক্লান্তিহীন কাটিয়েছি দিন
তোমার সেই বটের ছায়া খুঁজে ।
তোমার সেই দখিন হাত--আছে আমার মাথায় ,
আজও প্রখর দিনে পথ হাঁটি সেই ভরসায় ।
আমি জানি--একমাত্র সেই হাতটাই
আমাকে নিয়ে যেতে পারে
তোমার স্বপ্নময় স্বপ্নতীর্থের সেই পাড়ে ।
তোমার স্বপ্ন আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে ;
আমি তাই তোমার চোখ দিয়ে স্বপ্ন দেখি ,
তোমায় চোখে না দেখি--স্বপ্নে তোমাকে দেখি ।
চোখের পাতা ফেললেই আমি
তোমার সেই ঘামে ভেজা জামাটা
স্পষ্ট দেখতে পাই ,
বাতাসে সেই ভিজে জামার গন্ধ পাই ;
তোমার ফেলে যাওয়া ব্যবহৃত জিনিসপত্রের ভিতরে--আমি তোমাকে পাই ।
জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কিছু বোঝার আগেই
তুমি চলে গেলে ;
তারপর থেকে ভেবেছি কত ,
কত মজা হতো--কত আনন্দ হতো
তুমি ফিরে এলে ।
কত তুচ্ছতার ভিতরে তুমি
কত অসামান্যতার ছাপ গেছো রেখে ,
আজ অবাক হই ভেবে ।
ভেবে অবাক হই--কি অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য
সহিষ্ণুতার কত দৃষ্টান্ত গেছো রেখে ।
গ্রামে তখন বিদ্যুৎ ছিল না ,
তখন বিদ্যুৎ ছিল আমাদের কাছে
অসম্ভব এবং অবিশ্বাস্য অলীক একটা কল্পনা ।
গ্রীষ্মের দুপুরে তোমার হাতে
তালপাতার বিরামহীন সেই পাখা
আমাদের ঘুম পাড়াতো ;
ভাবলে তোমায়--তোমার পাখার সেই মিষ্টি হাওয়া
গায়ে তেমনই লাগে আজও ।
আজও তোমার নামে
আমার দুই ক্লান্ত চোখে ঘুম নামে--স্বপ্ন নামে ,
দগ্ধ দুপুরে আগুনে আকাশ--মেঘের ছায়া টানে ।
আজও দু'চোখ বন্ধ করে দেখি খুব স্পষ্ট ,
তুমি তেমনি হাঁকছো-ডাকছো- আদর করছো ,
তেমনি খুব কষে বকছো ।
এমন তো হতো প্রায়ই ,
সন্ধ্যায় পড়তে বসে সদরে--খুব ঘুমিয়ে পড়েছি ;
তুমি ঘুম থেকে তুলে কত করেছো বকাবকি ।
আজ তুমি নাই ,
তবু তোমার সেই মিষ্টি বকাবকিটা আজ আমি
মনে মনে খুব চাই ।
তুমি নাই , তোমায় না দেখি দুই চোখে ,
তবু তোমাকে পাই আমার সত্তার অণুতে অণুতে ।
তুমি আছো আমার মনে
আদর্শ জীবনের উজ্জ্বল একটা দৃষ্টান্ত হয়ে ,
সুকঠিন জীবনসংগ্রামের ব্যতিক্রমী উদাহরণ হয়ে ,
আমার এক-আকাশ অহঙ্কার হয়ে ।
ঘরের দেয়ালে সাঁটানো--তোমার সেই
ফ্রেমে-বাঁধানো ছবিটার দিকে তাকালেই
আমার দেহে মনে স্নিগ্ধ একটা শিহরণ জাগে ;
আমি খুব সহজেই তোমাকে ছুঁতে পারি ,
ছুঁতে পারি তোমাকে ঘিরে আমার এই
অপরিসীম মুগ্ধতাকে ।
আমার মুগ্ধতা জুড়ে রয়েছে--তোমার সেই
সহজ-সরল মুখের অনিন্দ্যসুন্দর ছবি ;
আমার গভীরে আমি কখনও যদি
চোখ রাখি , দেখি ছড়িয়ে রয়েছে চারিধারে
এক সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনের
অজস্র উদাহরণ ।
সেইসব কথা--কোন অবসরে যখন
স্মরণ করি , তখনই মনে হয়
কোন সুখ--না নেবার অঙ্গীকার করেই বোধ হয়
তুমি এসেছিলে এবং শেষাবধি হয়তো তাই
অবিমিশ্র দুঃখের ও কষ্টের একটা বিন্ধ্যকে
মাথায় নিয়েই হঠাৎই হারিয়ে গেলে ,
দূর সেই আকাশের নিঃসীম নীলে ।
সেই থেকে তোমার কথা যখনই মনে পড়ে ,
আকাশের কোন্ তারাটা তুমি
ভিড় ঠেলে খুঁজি সেই--অযুত তারার ভিতরে ।
তুমি যাওয়া থেকে বুকের ভিতরে
এক-সাহারা শূন্যতা--যা পূর্ণ হবার নয় ;
অসম্ভব জেনেও মাঝে মাঝে তবু মনে হয়
তোমার ফেরার সময় হবে কবে ,
তুমি না থাকলে বাড়িতে
ঠিক যেমনটাই ভাবতাম শৈশবে ।
সেদিন বুঝতাম না ,
আজ বুঝি--তুমি গেছো যেখানে
সেখান থেকে ফেরা যায় না ;
কেউ ফেরেওনি কোনদিন সেখান থেকে ,
তুমিও ফিরবে না , অবুঝ মন তথাপি
তোমার ফেরার পথে থাকে চোখ পেতে ।
------------------------------------------------------------------