Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

সৃষ্টি সাহিত্য যাপন#পৌরাণিক গল্প: কাঙ্খিত পুরুষের নেপথ্যের নারীরা#✍️পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়22.05.21
অর্জুন ও তার দুই জায়া - চিত্রাঙ্গদা ও উলুপী ««««««««««««««««««««««««««««««««««««
মহাভারতের অন্যতম কাঙ্খিত পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের পরেই যিনি …

 


সৃষ্টি সাহিত্য যাপন

#পৌরাণিক গল্প: কাঙ্খিত পুরুষের নেপথ্যের নারীরা

#✍️পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

22.05.21


অর্জুন ও তার দুই জায়া - চিত্রাঙ্গদা ও উলুপী 

««««««««««««««««««««««««««««««««««««


মহাভারতের অন্যতম কাঙ্খিত পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের পরেই যিনি আপন দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল তিনি তৃতীয় পান্ডব অর্জুন। অর্জুন পাণ্ডু ও কুন্তির তৃতীয় পুত্র। অর্জুনের জন্মনাম ছিল কৃষ্ণ। শুভ-কর্মে তাঁর রুচি ছিল বলে পরে তিনি অর্জুন নামে পরিচিত হন। অর্জুনের আরও অনেকগুলি নাম ছিল। পৃথার (কুন্তির জন্মনাম) পুত্র বলে তিনি ওঁকে অনেকে পার্থ বলে সম্বোধন করতেন। ওঁর অন্য নামগুলি হল – ধনঞ্জয়, বিজয়, শ্বেতবাহন, ফাল্গুন, কিরীটী, বিভৎসু , সব্যসাচী , জিষ্ণু ও গুড়াকেশ।


মণিপুররাজ শিবভক্ত চিত্রবাহন (মতান্তরে চিত্রভানু ) অস্থির পদচারণায় রত, রানী অঙ্গনার প্রসব বেদনা উঠেছে । যদিও রাজা চিত্রবাহন নিশ্চিত যে পুত্র সন্তানই হবে কারণ মহাদেবের তেমনই বরদান আছে চিত্রবাহনকে। কিন্তু রাজবৈদ্য রানীর স্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষ চিন্তিত কারণ তিনি রক্তাল্পতায় ভুগছেন ।অন্তঃস্বত্তাকালীন অবস্থায় দীর্ঘ নমাস তিনি কিচ্ছু খেতে পারেননি ক্রমাগত বমনের কারণে আর তার থেকেই তাঁর এই শারীরিক দৌর্বল্য । এমন সময় রাজমহিষীর পরিচারিকা কুন্তলা এসে খবর দিল যে রাজার একটি সুস্থ কন্যাসন্তান হয়েছে । রাজা ছুটলেন রাজঅন্তঃপুরে । পুত্র না হওয়ায় তিনি খুশি হননি কিন্তু অপরূপা একরাশ ফুলের মত কন্যাকে দেখে তাঁর পিতৃহৃদয় বাৎসল্যে ভরে উঠল । তিনি ঠিক করলেন এই কন্যাকে তিনি পুত্ররূপে পালন করবেন কারণ তাঁর কন্যার সন্তানই যে ভবিষ্যতে হবে মনিপুরের রাজা । তাই সেই কন্যার নামকরণ হল চিত্রাঙ্গদা (মধুলিকা ফুলের আরেক নামে ), রাজকন্যা অভ্যাস করলেন ধনুর্বিদ্যা, শিক্ষা করলেন যুদ্ধবিদ্যা, রাজদণ্ডনীতি।মণিপুররাজ চিত্রবাহন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তার কন্যার সাথে কেবলমাত্র মহাবীর অর্জুনের বিবাহ দেবেন। ওইদিকে ইন্দ্রপ্রস্থে সহবাস রত যুধিষ্ঠির ও পাঞ্চালিকে দেখে ফেলে অর্জুনের দ্বাদশ বর্ষ বনবাস হয়। অর্জুন দ্বাদশবর্ষব্যাপী ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের সময় ভ্রমণ করতে করতে এলেন মণিপুররাজ্যে।


চিত্রাঙ্গদা ছিলেন একজন নারী, যাঁকে তার পিতার ইচ্ছায় পুরুষরূপে বেড়ে উঠতে হয়। তার আকৃতি ও আচরণ উভয়ই একজন পুরুষের প্রতিভূ। কিন্তু একজন নারীর যে সুপ্ত বাসনা, তা ঠিকই আত্মপ্রকাশ ঘটে তৃতীয় পাণ্ডব—অর্জুনকে দেখার পর।নারী হিসেবে চিত্রাঙ্গদা খুব স্বাভাবিকভাবেই অর্জুনের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার সাহচর্য কামনা করেন। কিন্তু পুরুষালি গুণসম্পন্ন চিত্রাঙ্গদাকে অর্জুনের মনে ধরে না! নারীত্বের পূর্ণ স্বাদ পেতে চিত্রাঙ্গদা তাই পরিপূর্ণ নারী হতে চান; প্রেমের দেবতা অতনুর কাছে প্রার্থনা করে পঞ্চশর বা কন্দর্পের প্রেমের পঞ্চবাণ লাভ করে হয়ে ওঠেন অসামান্যা সুন্দরী। এরপর স্বভাবতই অর্জুন তার প্রতি অনুরক্ত হন। নারীত্বের পরিপূর্ণ স্বাদ পেলেও চিত্রাঙ্গদা অনুভব করেন, তার প্রতি অর্জুনের যে প্রেমাসক্তি, তা কেবল বাহ্যিক রূপের কারণেই! ফলে চিত্রাঙ্গদার অন্তরে দেখা দেয় দ্বৈতসত্তার দ্বন্দ্ব। একদিকে তার নারীত্বের প্রাপ্তি, অন্যদিকে তার প্রকৃত রূপ। এরই মধ্যে অর্জুন চিত্রাঙ্গদার প্রকৃত রূপের কথা জানতে পারেন। এবং একজন পুরুষের মনে একজন সবল বীর্যবতী রমণীকে দেখার উদগ্র বাসনায় অর্জুন প্রকাশ করেন তার আগ্রহ সেই নারীকে দেখার যে কোষবিমুক্ত কৃপাণের মত দারুণ,সে কোনো ভোগীর চোখের লুব্ধদৃষ্টির আকাঙ্খা নয়, সে ক্ষত্রিয় বাহুর ভীষণ শোভা,বাহুবলে রাজা, স্নেহবলে মাতা, যিনি আর্তত্রাণ নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছেন।

তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে অর্জুন তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়াতে আগ্রহী দেখে চিত্রাঙ্গদা তাঁর আত্মপরিচয় দেন, প্রেমের জয় হয়। বাহ্যিক রূপের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান যে মানুষের চরিত্রশক্তি এবং এতেই প্রকৃতপক্ষে আত্মার স্থায়ী পরিচয় তা প্রতিষ্ঠিত হয়। চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে অর্জুনের বিবাহ হয় । তাঁদের মিলনের ফলে অর্জুনের ঔরসে চিত্রাঙ্গদার গর্ভে সন্তান জন্মায়। তাদের সেই মিলনজাত পুত্রের নাম বভ্রূবাহন।অর্জুন বভ্রূবাহনের জন্মের পরে তাকে মানুষ করার দায়িত্ব চিত্রাঙ্গদার হাতে দিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে যান।চিত্রাঙ্গদাকে সঙ্গে করে না নিয়ে এলেও তাকে হস্তিনাপুরে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন। বলেন, যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করবেন। তাতে যেন চিত্রাঙ্গদা উপস্থিত থাকেন।


ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে উলুপীকে উপেক্ষিতা মনে হয়। চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন অর্জুন। অন্তঃস্তত্বা স্ত্রীর কথা ভেবে পুনরায় তার কাছে ফিরেও এসেছেন। কিন্তু উলুপীর ক্ষেত্রে তা হয়নি। উলুপীকে তিনি বিয়ে করেছেন কিন্তু তার সঙ্গে তিনি মাত্র একটি রাত কাটিয়েছেন। তার মনে ইচ্ছে জাগেনি অন্তত একবার স্ত্রীর কাছে ফিরে যেতে। চিত্রাঙ্গদার মতো অর্জুনের ঔরষে উলুপীর গর্ভেও এক সন্তানের জন্ম হয়, নাম ইরাবান। কিন্তু অর্জুন সেকথা জানতেনই না। ইরাবানকে পিতার কাছে দিয়ে মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পিতৃত্বের স্বীকৃতি আদায় করতে হয়। উলুপী পূর্বের স্বামীকে অল্প বয়সেই হারিয়েছিল। অর্জুনকে স্বামী হিসেবে পেলেও তাকে একটিমাত্র রাত ছাড়া আর পাশে পাননি। একাকী জীবন কেটেছে তার। নিজের দায়িত্বে সন্তানকে মানুষ করেছেন। কিন্তু এর জন্য তার মধ্যে কোনো অভিযোগ বা অনুযোগ দেখা যায়নি। অনার্য বলে তিনি ক্ষত্রিয় অর্জুনকে স্বামী হিসেবে পেয়েই কি নিজেকে ধন্য মনে করেছেন? এভাবে বিশ্লেষণ করলে উলুপীর চরিত্রটিকে ছোটো করা হবে। আসলে উলুপীর মন ছিল উদার, বিশাল। পাশাপাশি নারী হিসেবে তিনি ছিলেন ব্যক্তিত্বময়ী। তাই সামাজিক অনেক বাধা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও একা তার সন্তানকে মানুষ করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। চিত্রাঙ্গদার মতো সৌভাগ্য তার হয়নি। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ দূরে থাক, কোনোরূপভাবে তাকে আমন্ত্রণ জানাননি অর্জুন। দুটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যায়-চিত্রাঙ্গদাকে বিয়ে করে নিজে ধন্য হয়েছিলেন অর্জুন। আর উলুপীকে বিয়ে করে যেন তাকে ধন্য করেছিলেন তিনি। চিত্রাঙ্গদার মতো ক্ষত্রিয় বংশজাত ছিলেন না বলেই কি এই অবহেলা? নাকি উলুপী ছিলেন বিধবা, সেই জন্য? যে কারণেই হোক না কেন, এটা স্পষ্ট অর্জুনের কাছ থেকে উপেক্ষা আর অবহেলা পেয়েছেন তিনি, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। খুবই বেদনাদায়ক লাগে, যখন দেখা যায় ইরাবানকে অর্জুনের কাছে গিয়ে পিতৃত্বের স্বীকৃতিলাভের জন্য চেষ্টা করতে হচ্ছে। আমরা যদি চিত্রাঙ্গদা আর উলুপীর চরিত্র বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবো অর্জুনকে ভালোবাসার নিরিখে চিত্রাঙ্গদার থেকে অনেক এগিয়ে উলুপী। একথা অস্বীকার করা যাবে না, অর্জুনকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন চিত্রাঙ্গদাও। কিন্তু ভালোবাসার নিরিখে উলুপীর থেকে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন তিনি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে আমরা দেখতে পাই স্বামীর কথা ভেবে উলুপী তার একমাত্র সন্তান ইরাবানকে পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য। তাকে হারাতে হতে পারে এ-কথা জেনেও ইরাবানকে পাঠাতে দ্বিধা করেননি। স্বামীর প্রয়োজনে তার পাশে দাঁড়ানো যেমন নিজের কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন, তেমনি পিতার বিপদে পুত্রেরও তার পাশে থাকা কর্তব্য বলে তিনি মনে করেছিলেন। অথচ চিত্রাঙ্গদা কিন্তু তার ছেলে বভ্রুবাহনকে পাঠাননি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশ নিতে। বভ্রুবাহন তার পিতার বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী। তার খারাপ কিছু হয়ে গেলে তার পিতার বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে, এই ভাবনা হয়তো মনে কাজ করছিল। তা যদিও হয়, তাহলে পরিস্কার চিত্রাঙ্গদা কর্তব্যের আগে স্বার্থের কথা ভেবেছিলেন। যেটা ভাবেননি উলুপী। ইরাবানের কিছু হয়ে গেলে সে নিঃস্ব হয়ে যাবে, এই ভাবনা মাথায় প্রশ্রয় দেয়নি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দিয়ে একাধিক শক্তিশালী যোদ্ধাকে হত্যা করে ইরাবান কিন্তু নিজেও মারা যান। পুত্রের মৃত্যুতে তেমন শোক করতে দেখা যায় না অর্জুনকে। ছেলের বীরত্ব নিয়ে গর্বের কথা শোনা যায় না তার মুখে। এটাও কি উলুপীর প্রতি উপেক্ষা নয়? ইরাবানের এই আত্মাহুতি অর্জুনের কাছে কি কেবল একজন পুত্রের পিতার প্রতি কর্তব্য কিংবা যোদ্ধার কর্তব্য ছিল? এর মধ্যে মায়ের ত্যাগের মহত্বের কথা কি তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন?

এক ক্ষত্রিয় হিসেবে অর্জুন স্বাভাবিকভাবে চাইবেন তার সন্তানদের মধ্যে বিরোচিত সত্বার প্রকাশ। পুত্র ইরাবানের বীরত্ব দেখে তিনি কতটা খুশি বা মুগ্ধ হয়েছিলেন সেকথা বিশেষ বলা নেই। তবে পুত্র বভ্রুবাহনের মধ্যে বীরত্বের অভাব তাকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছিল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। সেই অশ্ব অনেক রাজ্য ঘুরতে ঘুরতে হাজির হয় মণিপুরে। তখন মণিপুরের রাজা বভ্রুবাহন। পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে বভ্রুবাহন শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকে বরণ করে নিতে হাজির হন। কিন্তু ক্ষত্রিয়ের এমন বিনীত আচরণ অর্জুনকে একদম মুগ্ধ করতে পারেনি। সন্তানের মধ্যে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন ক্ষত্রিয়োচিত বীরভাব। তার এই দুর্বল মনোভাবে ক্ষুন্ন হন তিনি। ঠিক এমন সময় সেখানে আশ্চর্যজনকভাবে হাজির হন উলুপী। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি বভ্রুবাহনকে উত্‍সাহিত করেন অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। কিন্তু বভ্রুবাহন পিতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে চান না। উলুপী তখন তাকে বোঝান, এক আদর্শ সন্তানের কর্তব্য হল পিতাকে খুশি করা, তার মনোবাসনা পূরণ করা। পিতা তার মধ্যে বিনয় নয় বীরত্ব দেখতে চান। তাই তার উচিত পিতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা। বিমাতা উলুপীর কথায় অর্জুনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন বভ্রুবাহন। তার প্ররাক্রমের কাছে অর্জুন শুধু পরাজিতই হন না, নিহত হন।


স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে চিত্রাঙ্গদা ছুটে আসেন। তিনি যখন জানতে পারেন এই যুদ্ধের পেছনে উলুপীর মদত রয়েছে তখন তিনি নানাভাবে উলুপীকে তিরস্কার করেন। তার হয়তো মনে হয়ে থাকতে পারে স্বামীকে কাছে না পাওয়ার আক্রোশবশত উলুপী পুত্রকে দিয়ে পিতাকে হত্যা করিয়েছেন। কিন্তু উলুপী নিজের সর্বস্ব দিয়ে অর্জুনকে ভালোবেসেছিলেন। মাত্র একদিনের জন্য তিনি অর্জুনকে স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার জন্য স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা একবিন্দুও কমে যায়নি। সারাজীবন ধরে তিনি স্বামীর মঙ্গল চেয়ে এসেছেন। বভ্রুবাহনকে পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করার ক্ষেত্রে তার মহত্‍ উদ্দেশ্যই ছিল।


কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পরাক্রমশালী ভীষ্মকে পরাজিত করার জন্য ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন অর্জুন। ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় তিনি শ্রীখণ্ডীকে সামনে রেখেছিলেন। শ্রীখণ্ডী ছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারী। এই নিয়ে মহাভারতে নানাবিধ মত আছে। সে প্রসঙ্গ এখানে থাক। উল্লেখ্য ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি কখন রূপান্তরকামী, নারী ও দুর্বলদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না। শ্রীখণ্ডীকে সামনে দেখে তিনি অস্তর ত্যাগ করেন। নিরস্ত্র ভীষ্মকে শরবিদ্ধ করেন অর্জুন। ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন। শরসয্যায় শায়িত হয়েও তিনি মারা যামনি। তবে এই যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে তিনি ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেন। ভীষ্মের এমন অন্যায়ভাবে হত্যা মেনে নিতে পারেনি তার বসু ভাইয়েরা। তারা খুব ক্ষুব্ধ হয় অর্জুনের ওপর। মাতা গঙ্গার অনুমতি নিয়ে তারা অর্জুনকে নরক দর্শনের অভিশাপ দেন। গঙ্গাবক্ষে যখন তারা অর্জুনকে অভিশাপ দিচ্ছিলেন তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন উলুপী। স্বামীর নরক দর্শনের অভিশাপ শুনে তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। ছুটে যান পিতা কৌরব্যের কাছে। তাকে সবকিছু খুলে বলেন। কৌরব্য বসুগনের কাছে অনুনয় করেন এই অভিশাপ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু একবার দেওয়া অভিশাপ আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। তবে বসুগন তাকে জানায়, ভীষ্মকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে অর্জুন যে পাপ করেছে তার জন্য তাকে প্রায়শ্চিত্য করতে হবে। যে যদি পুত্রের হাতে নিহত হয় তাহলে তার এই শাপমুক্তি ঘটবে। আর এ-কারণেই উলুপী বভ্রুবাহনকে প্ররোচিত করেছিলেন তাকে পিতার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের জন্য। স্বামীকে নরকভোগের অভিশাপ মুক্ত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।

যাই হোক, শোকার্ত চিত্রাঙ্গদা আর বভ্রুবাহনের অনুরোধে তিনি নাগজাতির সঞ্জীবনী মণি এনে বভ্রুবাহনের হাতে দেন। বভ্রুবাহন সেই মণি পিতার বুকের ওপর ছোঁওয়ালে প্রাণ ফিরে পান অর্জুন। জীবন ফিরে পাওয়ার পর উলুপীর মুখে সব বৃত্তান্ত শুনে অর্জুন মুগ্ধ হন। তিনি তাকে 'দেবী' সম্বোধন করেন। শুধু তাই নয়, অশ্বমেধ যজ্ঞে উপস্থিত থাকার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানান।

মাত্র একদিন উলুপীর সঙ্গে কাটিয়েছিলেন অর্জুন। তাসত্ত্বেও তিনি তাকে পুরোপুরি বিস্মৃত হননি কিংবা স্ত্রীর মর্যাদা দিতে অস্বীকার করেননি-এটা উলুপীর কাছে একটি বিরাট প্রাপ্তি। সর্বসমক্ষে অর্জুনের স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্তি-অনেক উপেক্ষার পর বলা যেতে পারে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠত হন তিনি। এখানেই শেষ নয়, উলুপী আর চিত্রাঙ্গদা যখন অশ্বমেধ যজ্ঞের আসরে উপস্থিত হন কুন্তী, দ্রৌপদীরা তাদের মর্যাদার সঙ্গে বরণ করে নেন। যজ্ঞ শেষ হওয়ার পর হস্তিনাপুরেই তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। একদা নাগবধু পাণ্ডববধূ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। এতখানি প্রাপ্তি উলুপী নিজেও বোধহয় কখনও প্রত্যাশা করেননি। সময় অতিবাহিত হয়েছে। পাণ্ডবদের পুত্রবধূ হিসেবে তার স্বীকৃতি আরও মজবুত হয়েছে।


সময় বয়ে যায়। একসময় পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা শুরু করেন। পাণ্ডবদের সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ ঘটে একমাত্র দ্রৌপদীর। অর্জুনের অন্যান্য স্ত্রীরা হস্তিনাপুরে থেকে গেলেও উলুপী থাকেন না। নিজের পিতৃগৃহেও ফিরে যান না। গঙ্গাবক্ষে প্রাণ বিসর্জন দেন তিনি। অর্জুনকে কাছে না পান, অর্জুন ছিলেন, তাই তার বেঁচে থাকাটাকে সার্থক মনে করেছিলেন। সেই স্বামী যখন মহাপ্রস্থানে যাত্রা করেছেন, তখন আর বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো সার্থকতা খুঁজে পাননি উলুপী। তাই তিনি নিজের জীবন বিসর্জন দেন। এটা প্রমাণ করে কত গভীরভাবেই না তিনি ভালোবাসতেন অর্জুনকে।

অর্জুনের প্রতি উলুপীর এই ভালোবাসার গভীরতা আমাদের মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। তার ভালোবাসা ছিল অনেকটাই একতরফা। তার দাবি ছিল সামান্য। আর পাঁচটা স্ত্রীর মতো তার মনে ক্ষোভ, অভিমান কিংবা অভিযোগ ছিল না। ভালোবাসা তার কাছে ছিল পূজা। সারাজীবন তিনি সেই পূজা করে গেছেন। আর তার ভালোবাসা এত গভীর ছিল যে, একদিন সেই ভালোবাসাই তার স্বামীকে তার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।


মহাভারত আলোচনায় আমরা বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলার কথা জানতে পারি যাদের নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা হয়েছে। গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদীর কথা বাদ দিলাম, এমনকি চিত্রাঙ্গদার চরিত্রও যেভাবে আলোচিত হয়েছে সেভাবে আলোচিত কিংবা আলোকিত হননি উলুপী। অথচ ভালোবাসা আর ত্যাগের মহত্বে তার অবদান অন্যান্যদের থেকে কোনো অংশে কম তো নয়ই, বরং বেশিই ছিল। পতিব্রতা রমনীদের কথা আলোচনা করতে গেলে অনেক বড়ো বড়ো নাম আমাদের মাথায় আসে। সেই দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলে উলুপীরও বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার কথা।

নাগরাজকন্যা উলুপী ছিলেন নাগরাজ কৌরব্যের কন্যা।তার বাবা গঙ্গা নদীর জলভাগের সর্পরাজ্যের শাসক ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রশিক্ষিত যোদ্ধা।বিয়ের কিছুদিন পর তার স্বামী সুপর্ণকে অপহরণ করে হত্যা করে গরুড় । বিধবা উলুপী বাবার বাড়িতে থাকতেন। অর্জুনের জীবনে প্রথম নারী উলুপী-একথা বললে বোধহয় ভুল বলা হবে না। যদিও উলুপীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পূর্বে দ্রৌপদীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল অর্জুনের, কিন্তু শুধু মাল্যদানই হয়েছিল, স্ত্রী হিসেবে তাকে কাছে পাননি। নিয়ম আর শর্তের যাঁতাকলে পড়ে দ্রৌপদীকে কাছে পাওয়ার আগেই অর্জুনকে ব্রহ্মচারীর ব্রত নিয়ে বারো বছরের জন্য বনবাসী হতে হয়েছিল। উলুপীকেই তিনি প্রথম আপন করে পেয়েছিলেন স্ত্রী হিসেবে। অর্জুনের প্রথম সন্তানের জন্ম হয় উলুপীর গর্ভে। অর্জুন-উলুপীর প্রেম পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে মহত্বের এক উচ্চ শিখরে তার অবস্থান। যদিও উলুপীর জীবনে অর্জুনের উপস্থিতি খুব সামান্য, তবুও আমরা দেখতে পাব, উলুপী এমন এক নারী, যিনি আপন কর্তৃত্ব ও মহিমায় অর্জুনের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। অর্জুনের মতো এমন এক বীরকে তার ব্রহ্মচার্যের ব্রত ভাঙিয়েছেন, তার কামনার আহ্বানে সাড়া দিতে বাধ্য করেছেন। শুধু তাই নয়, পুত্রের হাতে নিহত অর্জুনকে তিনিই জীবনদান করেছিলেন এবং তাকে নরক দর্শনের অভিশাপ মুক্ত করেছিলেন।কথিত আছে যে,ঘুরতে ঘুরতে অর্জুন এলেন বর্তমানের হরিদ্বারে। এখানকার আশ্রমিক পরিবেশ তার খুব ভালো লাগে। এখানে আশ্রম বানিয়ে তিনি থাকতে শুরু করেন। একদিন তিনি গঙ্গায় নেমেছেন স্নান করার জন্য। স্নান সেরে আশ্রমে ফিরে অগ্নিহোত্র করবেন। সেই মতো স্নান সেরে পিতৃপুরুষের তর্পণ সেরে তিনি উঠতে যাবেন, এমন সময় আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেন এক সুন্দরী রমনী তাকে বাহু বেষ্টনীতে নিয়ে টেনে নিয়ে চলেছেন। সেই সুন্দরী নারীকে দেখে অর্জুন এতটাই মোহিত হয়ে যান যে তার বাহুবেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কথা ভুলে যান। এই সুন্দরী নারী হলেন উলুপী, নাগরাজ কৌরব্যের কন্যা। উলুপী তাকে পিতার প্রাসাদে নিয়ে আসেন। সেখানে পৌঁছে অর্জুন দেখেন অগ্নিহোত্র করার জন্য হোম প্রজ্জ্বলিত হয়ে আছে। তখন অর্জুনের মনে পড়ে অগ্নিহোত্রের কথা। মাথা থেকে অন্য চিন্তা সরিয়ে তিনি প্রথমে অগ্নিহোত্র সমাধান করেন। নির্বাসনে থাকাকালীন উলুপী অর্জুনের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন এবং তাঁর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন । তিনি অর্জুনের ঔরসে তাঁর পুত্র ইরাবানকে জন্ম দেন। বিদায়কালে উলুপী অর্জুনকে বর দেন যে, তিনি জলের ভেতর অজেয় হবেন এবং জলচররা সবাই ওঁর বশীভূত থাকবে। উলুপীর পরপূর্বা হওয়ায় তাঁর গর্ভজাত পুত্র ইরাবান্, ওঁর পূর্বপতির ক্ষেত্রজ পুত্র হিসেবেই পরিচিত হন। তবে ইন্দ্রলোকে গিয়ে ইরাবান অর্জুনের কাছে নিজেকে অর্জুন-পুত্র বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও পাণ্ডবদের হয়ে যুদ্ধ করে তিনি প্রাণদান করেন।


এদিকে গঙ্গাবক্ষে সুপুরুষ অর্জুনকে দেখে মোহিত হয়ে যায় উলুপী। তার মধ্যে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে। অর্জুনের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। অর্জুনকে কাছে পাওয়ার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং তাকে সরাসরি নিয়ে আসেন পিতার প্রাসাদে।


অগ্নিহোত্র সমাধা হওয়ার পর উলুপী অর্জুনকে তার পরিচয় দিয়ে ব্যক্ত করে তার মনোবাসনা। কোনোরূপ রাখঢাক না রেখে তিনি সরাসরি অর্জুনকে জানান তার কামনার কথা, তার মিলন সুখ পাওয়ার বাসনার কথা। অর্জুনকে তিনি অনুরোধ করেন তার মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য। প্রাথমিকভাবে উলুপীর এমন অভিপ্রায় প্রকাশ আমাদের অবাক করে। এক যুবতী বিধবা অন্য এক পুরুষের সঙ্গসুখ আকাঙক্ষা করছে, তার কাছে সন্তানের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে-ব্যাপারটা যেন উলুপীর চরিত্রের দীনতা প্রকাশ করে। এ-প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলার। সে যুগে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যার যাকে লাভ করার বাসনা জাগত তা তারা অকপটভাবে একে-অপরের কাছে প্রকাশ করতে পারতেন। পরপুরুষ কিংবা পরনারীর সঙ্গে মিলনের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে মহাভারতে। দ্বিতীয়ত, কোনো মহিলা বিধবা হলে অন্য পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতে পারবে না এমনটা ছিল না। বরং দেখা যায় কোনো মহিলা সন্তানহীন অবস্থায় বিধবা হলে বংশ রক্ষার্থে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ক্ষেত্রজ পদ্ধতিতে তার গর্ভে সন্তান উত্‍পাদনের ব্যবস্থা করতেন। মহাভারতে দেখি, সত্যবতীর পুত্র বিচিত্রবীর্য অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে মাতা সত্যবতী প্রথমে ভীষ্মকে বলেন তার ভার্তৃবধূদ্বয়ের গর্ভে সন্তান উত্‍পাদনের জন্য। ভীষ্ম রাজি না হওয়ায়, তারই পরামর্শে সত্যবতী তার কুমারী অবস্থায় জন্ম দেওয়া সন্তান ব্যাসদেবের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। মাতৃ আদেশে ব্যাসদেবের ঔরষে দুই পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে যথাক্রমে জন্ম নেয় ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। বিয়ের পূর্বে কুন্তীকে দেখা যায় সূর্যের ঔরষে গর্ভে সন্তান ধারণ করতে। জন্ম হয়েছিল কর্ণের, যদিও কুন্তী লোকানিন্দার ভয়ে তার মাতৃত্ব স্বীকার করেননি। কুন্তীর অন্য তিন সন্তানও তার স্বামী পাণ্ডুর ঔরষজাত নয়। এক অভিশাপের কারণে স্ত্রীদের সঙ্গে পাণ্ডুর মিলনের উপায় ছিল না। তাহলে তার মৃত্যু অবধারিত ছিল। তই বংশরক্ষায় কুন্তী তিন দেবতার ঔরষে যথাক্রমে যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনের জন্ম দিয়েছিলেন। মাদ্রীর দুই সন্তান নকুল ও সহদেব, তার স্বামী পাণ্ডুর ঔরষজাত ছিলেন না। অর্থাত্‍ দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র কুমারী অবস্থায় নয়, বিবাহিত স্ত্রীও পছন্দের পুরুষের সঙ্গে মিলনের সুযোগ পেত। সেসব বিচার করে উলুপীর অর্জুনকে কাছে পাওয়ার আকাঙক্ষার মধ্যে আশ্চর্য বা অন্যায়ের কিছু ছিল না। একে যুবতী নারী হিসেবে তার মধ্যে শরীরী মিলনের আকাঙক্ষা থাকবেই। এক নারী হিসেবে সন্তানের জননী হওয়ার বাসনা থাকাও তার মধ্যে স্বাভাবিক। আর সেক্ষেত্রে এক অনার্য রমনী হয়ে অর্জুনের মতো এক ক্ষত্রিয় বীরের সঙ্গলাভ ও তার সন্তানের জননী হওয়া তার কাছে অনেক গৌরবের।


যাই হোক, উলুপীর আবেদনে অর্জুন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এমন এক সুন্দরী রমনীর প্রণয় আহ্বানকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না তিনি। কিন্তু তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার শর্ত। তিনি উলুপীকে সবকিছু জানান। বলেন, তার কথা রাখতে তিনিও চান, কিন্তু তার শর্তই তার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উলুপী বুঝতে পারেন অর্জুনও তার প্রতি আকৃষ্ট। তিনি তাকে বোঝান, তার ব্রহ্মচারী হওয়ার শর্ত কেবল দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অন্য কোনো নারীর ক্ষেত্রে নয়। তাতেও অর্জুন পুরোপুরি দ্বিধামুক্ত হতে পারেন না। ওদিকে উলুপী অর্জুনকে পেতে ব্যাকুল। তখন উলুপী তাকে বলেন, অর্জুনকে কাছে না পেলে তিনি মারা যাবেন। আর একজন ক্ষত্রিয় হিসেবে অর্জুনের উচিত্‍ পীড়িতের জীবন রক্ষা করা। অর্জুনকে তার শর্তের থেকে তার ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করা বেশি জরুরি।


উলুপীর কথার মধ্যে যুক্তি খুঁজে পায় অর্জুন। উলুপীর আহ্বানে সাড়া দেন তিনি। উলুপীর প্রণয় আকাঙক্ষা পূরণ করেন। তবে শুধু উলুপীর প্রণয় আকাঙক্ষা পূরণ করেছেন বললে বোধহয় ভুল হবে। অর্জুন নিজেও গভীরভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন উলুপীর প্রতি। যাই হোক, একরাত তিনি কাটান উলুপীর সঙ্গে। পরের দিন উলুপীর পিতা কৌরব্যের সম্মতিতে তাকে বিয়েও করেন। বিয়ের পর উলুপী অর্জুনকে বর দেন, যে জলের কোনো প্রাণী কোনোদিন অর্জুনের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এরপর তিনি উলুপীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান। উলুপীও তার কাছে আর বেশি কিছু প্রত্যাশা করেনি। অর্জুনকে তিনি কাছে পেয়েছেন, অর্জুনের স্ত্রীর মর্যাদা পেয়েছেন, এতেই তার জীবন সার্থক হয়ে যায়। পরেরদিন তিনি নিজেই অর্জুনকে ফিরিয়ে দিয়ে যান সেই জায়গায় যেখান থেকে তিনি তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অর্জুনের মধ্যেও কোনো ইচ্ছা দেখা যায়নি উলুপীর সঙ্গে আরও কিছুটা সময় থাকার। তাকে কথাও দেননি পরবর্তী সময়ে নিজের রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার। অর্জুনের প্রতি উলুপীর ভালোবাসা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি অর্জুনকে কতখানি গভীরভাবে ভালোবাসতেন তা পরবর্তী সময়ে পরিস্ফুট হবে। কিন্তু অর্জুনের মধ্যে যেন স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও কর্তব্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি তাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার আচরণে এমনটা মনে হয় যেন তিনি তাকে দয়া করেছেন। অনেকটা যেন, এক অনার্য নারী যে আবার বিধবা তাকে তিনি সঙ্গ সুখ দিয়েছেন, তাকে বিয়ে করেছেন, এটাই অনেক বিরাট ব্যাপার। অর্জুনের জীবনে অনেকটাই উপেক্ষার আড়ালে রয়ে যান উলুপী। দীর্ঘ্য বনবাস জীবনে তার একবারও মনে পড়েনি উলুপীর কথা। তার কাছে অন্তত একবার ফিরে যাওয়ার কথাও মনে হয়নি যেমনটা তিনি করেছিলেন চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে।


উলুপী অর্জুনের সংবাদ সব সময়ে রাখতেন। তিনি অর্জুন-চিত্রাঙ্গদা পুত্র বভ্রূবাহনের লালন-পালনে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। অর্জুন শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখে ভীষ্মকে শরশয্যায় শায়িত করেছিলেন বলে বসুগণ যখন গঙ্গাদেবীর সামনে অর্জুনকে নরকাবাসের অভিশাপ দিচ্ছেন, উলুপী তখন সেটা শুনতে পান। তাঁর অনুরোধে পিতা কৌরব্য শাপমোচনের জন্য বসুগণকে অনুরোধ করলে বসুগণ বলেন যে, পুত্র বভ্রূবাহনের বাণে পরাস্ত হয়ে রণভূমিতে শয্যাশায়ী হলেই অর্জুনকে আর নরকাবাস করতে হবে না।


যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ-যজ্ঞের অশ্বকে নিয়ে যুদ্ধার্থী অর্জুন যখন মণিপুরে এসে পৌঁছলেন, তখন পুত্র বভ্রূবাহন যুদ্ধ না করে ভক্তি সহকারে পিতা অর্জুনকে অভ্যর্থনা জানালেন। অর্জুন পুত্রের এই কাপুরুষতা দেখে যখন ধিক্কার দিচ্ছেন, তখন অর্জুনের দ্বিতীয় স্ত্রী উলুপী ভূমিতল থেকে উঠে এসে নিজেকে বভ্রূবাহনের বিমাতা বলে পরিচয় দিয়ে পুত্রকে বললেন যুদ্ধ করতে। বিমাতার আদেশে তিনি যুদ্ধ শুরু করলেন এবং তাঁর বাণে অর্জুন ভূমিশয্যা নিলেন। বভ্রূবাহনের দ্বারা যুদ্ধে নিহত হওয়ার পরে উলুপী অর্জুনকে পুনজীবিত করে তাকে বসুদের অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছিলেন। উলুপী সঞ্জীবন-মণি এনে অর্জুনকে সুস্থ করে বসুগণের শাপের কথা সবাইকে বললেন। অশ্বমেধ যজ্ঞে অর্জুনের আমন্ত্রণে চিত্রাঙ্গদা ও বভ্রূবাহনের সঙ্গে উলুপীও এসেছিলেন।


পরীক্ষিৎকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে এবং যুযুৎসুর উপর রাজ্য পালনের ভার দিয়ে যাদবদের একমাত্র বংশধর কৃষ্ণপৌত্র বজ্রকে ইন্দ্রপ্রস্থে অভিষিক্ত করে যুধিষ্ঠির হিমালয় অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেন মহাপ্রস্থানের পথে । যাত্রাপথে এক কুকুর তাঁদের পিছু নিল । চিত্রাঙ্গদা ও উলুপীও পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থানে যাওয়া পর্যন্ত পাণ্ডবদের সঙ্গেই ছিলেন। পাণ্ডবরা চলে গেলে তাঁরা আবার চিত্রাঙ্গদা মণিপুরে এবং উলুপী আবার গঙ্গা-গর্ভে ফিরে যান।


গন্ধর্বদের রাজত্বকালে মহাভারত-খ্যাত পঞ্চপাণ্ডবদের তৃতীয় ভ্রাতা অর্জুন মণিপুর রাজ্যে পরিভ্রমণে গিয়ে গন্ধর্ব রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করেন। অর্জুনের সঙ্গে ক্ষত্রিয় যোদ্ধা যারা মণিপুর গিয়েছিল, তাদের অনেকে গন্ধর্ব কন্যাদের বিয়ে করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার একমাত্র ঔরসজাত সন্তান বভ্রূবাহন মণিপুরের সিংহাসনে অধিপতি হন। মণিপুরে গন্ধর্বদের পরে আর্য-ক্ষত্রিয়দের শাসন শুরু হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর যুধিষ্টির অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে রাজা বভ্রূবাহন সেই যজ্ঞে যোগদান করতে মিথিলার রাজধানী হস্তিনায় গমন করেন। যজ্ঞশেষে মণিপুরে ফেরার সময় বভ্রূবাহন হস্তিনার বিষ্ণুপ্রিয়া মন্দিরস্থ অনন্তশায়ী সুবর্ণ ও বিশাল বিষ্ণুমূর্তি সঙ্গে নিয়ে আসেন। বিষ্ণুবিগ্রহ স্থাপনের পর থেকে মণিপুরের রাজধানী ‘বিষ্ণুপুর’ নামে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। অর্জুনের বংশধর ক্ষত্রিয় বংশী এবং বিষ্ণুর উপাসক বলে তাদেরকে বিষ্ণুপ্রিয়া বলা হয়।সংস্কৃত নাম মণিপুর ('মণিমুক্তার আবাস') রাজ্যের নাম হিসাবে গৃহীত হয়।


মহাভারতের সব চরিত্রদেরই যৌগিক গুরুত্ব আছে, গীতার আলোকে পঞ্চপান্ডব পাঁচটি তত্ত্বের প্রতীক যাদের অধিষ্ঠান শরীরের পাঁচটি চক্রে আর কুলকুন্ডলিনী শক্তি হলেন দ্রৌপদী অর্থাৎ এদের চালিকা শক্তি, তৃতীয় পান্ডব অর্জুন তেজতত্ত্বের প্রতীক যা আমাদের নাভির কাছে মণিপুর চক্র অবস্থিত। যা তেজতত্ত্ব বা অগ্নিতত্ত্বকে বোঝায়।মণিপুর, (সংস্কৃত: मणिपुर, Maṇipūra) সৌর স্নায়ুজাল চক্র (নাভি ক্ষেত্র)।এটা দেখতে ১০টি পাপড়ি যুক্ত পদ্মের মতো। ১০টি পাপড়ি দশটি চরিত্রের প্রতীক। এটি হলুদ রঙের। এই চক্রকে কেউ কেউ ব্যক্তিগত ক্ষমতা চক্রও বলেন। কারণ এই চক্র যদি ঠিক থাকে, তখন তা আমাদের সাহায্য করে থাকে শক্তি সঞ্চয়ে। যে শক্তি আমাদের মধ্যে না থাকলে আমাদের আত্মসম্মান এবং আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি পড়ে। আমাদের মধ্যে আত্মসচেতনতা বোধ গড়ে ওঠে না। এই মণিপুর চক্রের অধিপতি অগ্নিসম তেজদীপ্ত রাজার রাজদুহিতা অর্থাৎ তেজস্বীনী রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা। উলুপী নাগরাজ কন্যা অর্থাৎ পাতাল তত্ত্বের অন্তর্গত।


তথ্যসূত্র : মহাভারত, ভগবদগীতা আর প্রণবগীতা