আমাকে রবীন্দ্রনাথ হতে হবে
✍🏼সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
লখনউ স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে ফিরবেন কলকাতা। সঙ্গে অসুস্থ মেজ মেয়ে রাণী। চুরি হয়ে গেল টাকার ব্যাগ। কী করা যায়! আমরা হলে কী করতাম? ডাক ছেড়ে কাঁদতে বসতাম অথবা ভীষণ রেগে বাছাই করা গালাগাল…
আমাকে রবীন্দ্রনাথ হতে হবে
✍🏼সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
লখনউ স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে ফিরবেন কলকাতা। সঙ্গে অসুস্থ মেজ মেয়ে রাণী। চুরি হয়ে গেল টাকার ব্যাগ। কী করা যায়! আমরা হলে কী করতাম? ডাক ছেড়ে কাঁদতে বসতাম অথবা ভীষণ রেগে বাছাই করা গালাগালমন্দ করতাম চোরকে! কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথ। প্রচন্ড রাগ হলেও, শান্ত! ভাবলেন, যে নিয়েছে হয়তো তার প্রয়োজন অনেক বেশি!
বঙ্গভঙ্গ বিষয়ে সন্ধ্যায় জোর আলোচনাসভা চলছে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। এসেছেন বড়ো নেতারা। সভা শেষে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী রাণীর কথা জিজ্ঞাসা করতে জানালেন, সে আজকেই ইহলোকের মায়া কাটিয়ে অমৃতলোকে পাড়ি দিয়েছে! আমরা হলে কী করতাম? কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথ! মনে ঝড় উঠেছে উত্তাল। বাইরে স্থিতধী। ব্যক্তিগত শোককে সমষ্টিগতের আবর্তে টেনে আনবেন না।
মুঙ্গের থেকে ট্রেনে বোলপুর ফিরছেন। সাহেবগঞ্জ স্টেশনে পরিচিতদের সঙ্গে আলাপ করলেন। কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। কে বলবে যে সদ্য সন্তানহারা হয়েছেন তিনি! কলেরায় মৃত ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথকে দাহ করে ফিরছেন! ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে গিয়েছে চারপাশ। তিনি ভাবছেন, শমী নেই অথচ কোথাও তো কিছু কম পড়ছে না। পৃথিবীতে সবকিছু ঠিক চলছে। এই জ্যোৎস্নাকে কতভাবে লেখায় ব্যবহার করা যায়, তাই ভাবছেন! তিনি যে রবীন্দ্রনাথ।
না, এগুলি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলি তাঁর অমানুষিক চেষ্টা ও নিষ্ঠার জীবন ম্যানেজমেন্টের স্ট্র্যাটেজি! অমানুষিক কঠিন প্রজেক্ট তাঁর! আমাকে রবীন্দ্রনাথ হতে হবে। ছাড়িয়ে যেতে হবে নিজেকে। ব্যক্তিগত শোক তাপ পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে বৃহত্তর ক্ষেত্রে। বিস্তৃত করাতে হবে নিজেকে আরো মহৎ ও বৃহত্তর চিন্তায়। অযূত সৃষ্টিকে ছড়িয়ে যেতে হবে নতজানু পাঠকদের সমুখে। শত্রু অনেক। আলস্য, খ্যাতির আত্মতৃপ্তি, অখ্যাতির হতাশা, সমালোচকদের হুল বিঁধানো...
কিন্তু স্থিতপ্রজ্ঞ জারি রাখতে হবে। এতটুকুও টলে যাওয়া যাবে না। শিরদাঁড়া খাড়া করে কলম চলবে। মুহুর্তের জন্য লেখা থামানো চলবে না। অজস্র বাধা। কিন্তু শান্ত থাকতে হবে। মনের ভিতরে এক নিভৃত ধ্যানকক্ষ তৈরি করে ফেলতে হবে। এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সারস্বত সাধনা। নিষ্ঠুর, নিরাসক্ত হয়ে নিজ লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হবে। তবেই তো তিনি রবীন্দ্রনাথ হবেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হবেন। তাবৎ বাঙালির প্রাণের স্পন্দন হবেন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর গান, কবিতা নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করবে বাঙালি। সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করবে নিজেকে তাঁর সৃষ্টির সাথে। উপাসনার মন্দ্রিত ক্ষণ বেছে নেবে এক আবিলতামুক্ত অপাপবিদ্ধ বৈশাখী সন্ধ্যায়।
"শুধু তোমার বাণী নয়তো
হে বন্ধু হে প্রিয়
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার
পরশখানি দিয়ো..."
২৫শে বৈশাখ ১৪২৮
09/05/2021