Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

♥♥♥♥♥♥♥♥♥
The greatest show on earth
অমৃতা মুখার্জী
হাঁ করে ছবি টা দেখছিল ঝুমুর। 
ভাগ্যিস সে এসেছিল। 
পনের বছর বয়সের হাড় জ্বালানো টীন এজার রা যেমন হয় ঝুমুর একদম মাপে মাপে তেমন। মা বাবার দিনের আতংক রাতের দুঃস্বপ্ন। 
বাঙ্গালী খাবার খাবনা…



♥♥♥♥♥♥♥♥♥

The greatest show on earth

অমৃতা মুখার্জী

হাঁ করে ছবি টা দেখছিল ঝুমুর। 

ভাগ্যিস সে এসেছিল। 

পনের বছর বয়সের হাড় জ্বালানো টীন এজার রা যেমন হয় ঝুমুর একদম মাপে মাপে তেমন। মা বাবার দিনের আতংক রাতের দুঃস্বপ্ন। 

বাঙ্গালী খাবার খাবনা, চুল সর্বদা খোলা আর মুখের উপর ঝুলছে, ব্যাগি, না ইস্ত্রি করা, ঢলঢলে জামা, কানে হেডফোন, হোম ওয়ার্ক ডিঊ, পিকিঊলিয়ার বন্ধু বান্ধব, ঘরে ঢূকলে ছিটকে বুলেটের মত বের হয়ে আসতে হবে এত অগোছালো। 

যাই বলা হবে উত্তর “নোও ওওও! দ্যাট সো বোরিং”, 
যাই খেতে দেওয়া হবে “ ইয়াক, সো ইয়াকী”, 
গাড়ীতে উঠলেই “ আর উই দেয়ার ইয়েট?”

কিন্তু আজ সকালে কোনদিকে সূর্য উঠল ভগা ই জানে, ঝুমুর সারাসোটার রিংলিং মিউসিয়ামে বাবা মার সাথে আসতে রাজী হল। সারাসোটা ফ্লোরিডার একটা ছোট শহর। এখানকার সিয়েস্তা কী বীচ পৃথিবী বিখ্যাত। বালির রঙ দুধ সাদা, ট্যাল্কাম পাউডারের মত মিহি। তার উপর গালফ সমুদ্রের টারকোয়েজ নীলচে সবুজ জল আলতো গরম কুসুম কুসুম ঢেউ এর দোলায় পর্যটক দের মন ভোলায়। ঝুমুর ভাবল আর কিছু না হোক বীচে গিয়ে হুটোপাটি করা তো যাবে।। 

যাবার পথে ছোট শহর ভেনিসে এসে তারা একটু জিরিয়ে নিল। যেমন ঝুমুর পেটুক তেমনি তার বাবা। বেছে বেছে একটা নাম করা ফ্রেঞ্চ বেকারীর সামনে গাড়ী দাঁড়াল । পাতলা পাটিসাপটার মত একটা খাবার এখানে খুব চালূ, এরা বলে ক্রেপ। ঝুমুর আর মা নিল চিংড়ী আর কাঁকড়ার পুর ভরা ক্রেপ। বাবা কিন্তু ঠিক বেছে বেছে মিষ্টি ক্রেপ টাই নিল। ভিতরে মাখন নরম ব্লু বেরী আর স্ট্রবেরীর পুর দেওয়া। উপরে স্বপ্নের মত ফুরফুরে হাল্কা ক্রীম। কাফের নাম জার্দিন। এক বিখ্যাত প্যারিসের নর্তকীর নামে। ঝুমুর বাবা মার সাথে আসল ভেনিস আর প্যারিস দুটোই দেখে এসেছে। তবু তাদের ফ্লোরিডায় বাড়ীর পাশে এই ছোট ভেনিসে এলেই তার মন টা ভাল হয়ে যায়। ওই কাফের দেওয়ালে বিশাল অয়েল পেন্টিং টা দেখলে মন টা ফুরফুরে লাগে। 

রিংলিং মিউসিওমের নাম টা হল কি ভাবে ? পিছনের সীটে বসে সে গুগল হাতড়াল। জন রিংলিং ছিলেন সাত ভাইয়ের মধ্যে পাঁচ নম্বর। বাবা মা রা এসেছিলেন জার্মানি থেকে। ইমিগ্রান্ট ফ্যামিলি হয়ে আইওয়া আর উইস্কন্সিনে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল ট্রাভেল কোম্পানি। ঘোড়ার হারনেস বিক্রীর পুরনো ব্যবসা তাদের। সেই থেকে টুক টাক শো করতে লাগলেন, নানা ভানুমতীর খেল, জন্তূ জানোয়ারের কসরত, ট্রাপিজে ঝোলা সুন্দরী। রম রম করে দাঁড়িয়ে গেল ব্যবসা। যোগ দিলেন বারনাম আর বেইলী । রাতের অন্ধকারে ট্রেনে চেপে এক শহর থেকে অন্য শহরে চলতে লাগল সার্কাসের চলমান, রংদারি যাযাবর বাহিনী। বিশ্বযুদ্ধের বিষাদ ভুলতে আপামর জনতা আঁকড়ে ধরল এই ঝলমলে, মনোহারিণী কিছুক্ষণের সব পেয়েছির রঙ্গীন ভুলভুলাইয়া। লক্ষ লক্ষ ডলারের ব্যবসা আর হাজার হাজার লোকের চাকরীর ব্যবস্থা। এ এক আশ্চর্য আলাদীনের প্রদীপের মত রূপকথা। তৈরী হল কালজয়ী হলিঊড মুভি “দি গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ”। অভিনয় করলেন চার্ল্টন হেস্টন আর জেমস ডীন। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল এই অভূতপূর্ব সার্কাসের গল্প। 

পাম গাছে ঘেরা সুন্দর গোলাপি মিউসিওমের বাড়ী। চারিদিকে বড় বড় সিসাল্পিনীয়া গাছে আগুনের মত লাল ফুলের ঝাড়। মার কাছে শোনা এই গাছ গুলোকে নাকি বলে কৃষ্ণচূড়া, ইন্ডীয়া তে। গরম কালের ছুটিতে তারা যখন দেশে যায়, ঝুমুর ও দেখেছে এই ফুলে গাছ লাল হয়ে থাকে পথের দু ধারে। ফ্লোরিডা আর ইন্ডীয়া যেহেতু এক কর্কট ক্রান্তীর উপরেই পড়ে, আবহাওয়া আর গাছপালা অনেকটাই মিলে যায়। ভিতরে ঢুকেই দেখা গেল গাছে থরে থরে আম ঝুলছে। কি মজা রে বাবা! কেউ খাচ্ছে না, পাখিদের পুরো ব্যাংকোএট বসে গেছে। 

সার্কাস মিউসিওমের ভিতরে ঢুকেই সে ছবি টা চোখে পড়ল। সে হাঁ করে দেখছিল। একটা বিরাট পোস্টারে অনেক গুলো হাতি। হাতি ছাড়া কবে কোন সার্কাস হয়েছে ? কিন্তু যেটা অবাক করছিল যে হাতিদের মাথায় বসে আছে পাগড়ী পরা ভারতীয় মাহুতের দল। তাদের হাতে একরকম ধারালো ব্রর্শার মত অস্ত্র। সেটা দিয়ে তারা যেন হাতির মাথায় খোঁচা মারছে। ইশ! এটা তো খুব খারাপ ব্যপার । পশুদের এভাবে অত্যাচার করা। মা বলল অই বর্শার মত জিনিষ গুলো কে নাকি অংকুশ বলে। হাতিদের জন্য আলাদা ওয়াগন ছিল। ঢালু পাটাতনের উপর পা ফেলে হাতিরা উঠে যেত ট্রেনে। সারারাত ধরে ট্রেন চলত নতুন শহরের দিকে। এক কামরায় জল হস্তী, অন্য কামরায় রান্না, বান্না খাবারের সরঞ্জাম, কোনটায় সুন্দরীদের দল মুখে রূপটান মেখে হই হই করছে, তার পাশেই হয়তো আফ্রিকান দাস দের ডিব্বা, যাদের ঘাম, রক্ত, আর কঠোর শ্রমে ঘোরে সার্কাসের চাকা। ওদিকে বাঘেরা হূংকার দিচ্ছে, এদিকে জোকার রা তামাশায় ব্যস্ত লাল, নীল বল নিয়ে। এক কামরায় মালিক বসে আছে চিন্তায় চিন্তায়, কে জানে পরের শহরে বিক্রি কেমন হয়। যে শহরের দিকে সার্কাস চলেছে তাদের চোখেও ঘুম নেই। ছেলে , বুড়ো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন সার্কাসের ট্রেন ঢোকে। সারা শহরে যেন উৎসবের সানাই বাজছে। বিরাট বাজার বসে গেছে তাঁবুর বাইরে। পপকর্ন, আইস্ক্রীম, ভেঁপু, টুপি, মালাই সব দিব্যি বিক্রী হচ্ছে হইহই করে। 

ঝুমুর অবাক হয়ে দেখল এই সব খন্ড খন্ড চিত্র নিখুঁত ভাবে ছোট ছোট পুতুলের মত মডেল দিয়ে মিউসিয়ামের টারবাইনের মত ভিঊ গ্যালারিতে সুন্দর ভাবে সাজানো। ভিতরে এক আশ্চর্য কল্পনার জগত। আলো ঢিমে হয়ে আসছে। ঘাড়ের কাছে হুম হুম করে বাঘ ডেকে উঠল। ট্রাপিজের বাজনা বাজছে দ্রুত লয়ে। ওই তো জোকার বাটন, একদল সাদা ফুরফুরে কুকুর নিয়ে একচাকার সাইকেল চড়ে ঢুকে প্ড়ল এক নম্বর তাঁবুতে। ওদিকে সাত টা হাতি ওয়াউউউ স্বরে আকাশে মন্দ্র ধ্বণি তুলে ধীরে ধীরে ধুকে পড়ছে তাঁবু নম্বর দুই তে। তাদের পিঠে লাল টুকটুকে পোষাক পরা মেবেল আর ক্রিস্টিনা। 

সেন্ট্রাল তাঁবুতে জনতা ফেটে পড়ছে হাততালি তে । ইতালীয়ান ট্রাপিজ মাস্টার সেবাস্টিয়ান শূণ্যে দুলছে, দেখাচ্ছে অমানুষিক আর রক্ত হিম করা ব্যালেন্সের খেলা। জনতা রূদ্ধশ্বাস, এই বুঝি পড়ে গেল, এই বুঝি তার ছিঁড়ে গেল। না না না! সামলে নিয়েছে, ওই তো হাসছে, কাঁধে দু ধারে দুজন সুন্দরী, রুমাল নাড়ছে, হাসছে। পাশের স্টেজে জ্বলন্ত আগুনের গোলার ভিতর দিয়ে লাফিয়ে পার হচ্ছে বাঘ, সিংহ। তুমুল গর্জন। ছেলে পিলে হাতে আইস্ক্রীম নিয়ে ভুলে গেছে খেতে। হাঁ করে দেখছে । কি অসাধারণ সাহস রিং মাস্টারের! অকুতোভয়, ঢুকে গেল খাঁচার ভেতর। সাত টা সাইবেরিয়ান টাইগার সাত দিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। যেকোন মুহুর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে। দু হাত খালি। শুধু একটা চাবুক। 

রঙ্গমঞ্চের পিছনে চলছে আর এক বিশাল কর্ম যজ্ঞ। রিহার্সালের তাঁবু তে জোর কদমে ছুটছে ঘোড়ার দল। পরের শো তাদের। ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠে পড়ছে সুন্দরী। ডিগবাজি মারছে। ওদিকে পোষাকের তাঁবুতে সারি সারি পোষাক, রঙ বেরঙ্গের ফার, লেস, বোতাম, সাটিন, চুমকীর ঝালর দেওয়া কস্টিউম। বাহারী পালক দেওয়া টুপি। মেয়েদের আর ছেলেদের ড্রেসিং রুম ভাগ করা পর্দা দিয়ে। খেলা দেখাতে গিয়ে কার পা ভেঙ্গেছে ? তাকে নিয়ে গেল ডাক্তারের তাঁবুতে। ওদিকে মেস ম্যানেজার ডাক পাড়ছে। রান্না বান্না শেষ। না খেলে খেলোয়াড় রা জোর পাবে কি করে গায়ে। রজার হেঁকে বলে দিল এখন যেতে পারবনি বাপু। জেব্রা কে চান করাতে হচ্ছে। এর পর জিরাফের পালা, তারপর যদি সময় পায় তাহলে দানাপানি পড়বে। ওদিকে খাবার তাঁবুতে সারি সারি বেঞ্চে বসে অন্তঃত হাজার লোক খাবার খাচ্ছে। আর বড় বড় বালতি তে তাজা মাংস আর ফল পাকুড় নিয়ে ট্রলি তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জানোয়ার দের খাওয়ানোর জন্য। আলো আর সাউন্ডের মিস্ত্রী রা রাত জেগে কাজ করছে। দী শো মাস্ট গো অন।  

পিছনের একটা ছোট তাঁবুতে একজন ন্যানী ছোট বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত। বাবা মা রা খেলা দেখাচ্ছে, ফিরতে অনেক রাত হবে। পথেই জীবন, পথেই দেখা, পথেই মিলন, পথেই সংসার। ঘরের স্বপ্ন দেখা কি সবার ভাগ্যে হয় ? প্রানপুতলীরা যখন গভীর ঘুমে বাবা মা রা তখন ঝলমলে আলোর নীচে, দুরন্ত বাজনার সাথে মরণ দড়ির উপর এক পা এক পা ফেলে জীবনের ভয়ংকর পাশায় দান ফেলছে। 

খেলতে কজন পারে? 

এ নেশা যে কি মারাত্মক! 

যেকোন দিন পা পিছলে যাবে, ঘাড় মটকে মৃত্যু, কিন্তু ওই যে তুমুল হাততালির মদিরা, সাবাশির ফেনিল উত্তেজনা। তার নেশায় মাতাল রক্ত। বার বার জীবন কে বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক। ওরা উপেক্ষা করতে পারে না। ঘরে আর ফেরা হয় না।একদিন আলো নিভে যায়। 

পথেই।

আস্তে আস্তে গ্যালারীর শেষে এসে পড়ল ওরা। অসম্ভব সুন্দর, বর্ণাঢ্য ক্যারাভানের সারি চলছে। দারুণ সাজ পরা হাতির দল, পালকের তাজ পরা ঘোড়ার দল, উট চলেছে পায়ে ঘুঙুর পরা, ট্রাকের মাথায় বসা হাত নাড়া সুন্দরীদের দল, জোকার দের পিঠে বাঁদর রা টুপি ছূড়ছে, রণপা পরে সিগার মুখে নৌটংকীর দল, হাতে নীল, বেগুনি, কমলা মশাল নিয়ে ট্রাপিজ প্লেয়ার দের সুগঠিত দেহের সাদা পোষাকের মিছিল। খেলা শেষ। রাজকীয় সমাপ্তি। 

রাত ঢলতে আর দেরি নেই। চাঁদ হেলে পড়েছে মেঘের গায়ে। 
অল আবোর্ড। আবার চড়ে বসা ট্রেনে। রাতের আধাঁর পেরিয়ে তীব্র সিটি বাজিয়ে ট্রেন চলছে নতুন শহরের দিকে। নতুন দিনের দিকে। দী গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। দী শো মাস্ট গো অন। 

বাড়ী ফেরার পথে ঝুমুরের মন টা খুব উদাস হয়ে গেল। তাদের আকাশেও আলো করে একটা পেপার মুন উঠেছে। সে মাকে জিজ্ঞেস করল “আচ্ছা মাম? ছোট বেলায় তুমি সার্কাস দেখেছ? 

মা খুব আনমনা গলায় হেসে বলল “খুব দেখেছি, নাম ছিল জেমিনী সার্কাস। বাবার সাথে যেতাম প্রতি বার বড়দিনের ছুটিতে। জানিস তো ? শুনলে হাসবি, ছোট বেলা খুব ইচ্ছে ছিল বাড়ি থেকে পালিয়ে সার্কাসের দলে নাম লেখাবো ! সারা পৃথিবী ঘুরব ওদের সাথে, ট্রাপিজের খেলা দেখাব!”

সেদিন গভীর রাতে ঝুমুর একটা অদ্ভূত স্বপ্ন দেখল। 
দারুণ আলো ঝলমলে আরেনা তে একটা দুর্দান্ত সার্কাস হচ্ছে। 

লোকে পাগলের মত চীয়ার্স দিচ্ছে। 

ট্রাপিজের তিন নম্বর সুইং এ সাদা পোষাক পরে বিদ্যুতের মত এক জন পরী বাতাসের মত ভেসে যাচ্ছে। 

আরেনা ফেটে পড়ছে হাত তালিতে। 

সে অবাক হয়ে দেখল ঠিক মুখখানা তার মামের মত।

♥♥♥♥♥♥♥
♥©Amrita Mukherj