Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-প্রবন্ধ-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

: মহাশ্রমণ চরিত কথা -অংশ বিশেষ -১
গরিবকে জ্ঞান দান, শান্তি লাভের উপায় আর সন্তুষ্টি লাভের পথ,আধারভেদে শিক্ষা, ধৈর্যের ফল, আধারভেদে জ্ঞানের প্রতিফলন।----------------------------------------------------------------কলমে #পম্পা বন্দ্যো…

 


: মহাশ্রমণ চরিত কথা -অংশ বিশেষ -১


গরিবকে জ্ঞান দান, শান্তি লাভের উপায় আর সন্তুষ্টি লাভের পথ,আধারভেদে শিক্ষা, ধৈর্যের ফল, আধারভেদে জ্ঞানের প্রতিফলন।

----------------------------------------------------------------

কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

@কপিরাইট সংরক্ষিত

গরিবকে দেওয়া উপদেশ

-----================

গৌতম বুদ্ধ  একবার  তার শিষ্যদের সাথে একটি গ্রামে গিয়েছিলেন । সেই গ্রামের লোকেরা তাদের সমস্যা নিয়ে গৌতম বুদ্ধের কাছে যেত এবং তাদের সমস্যার সমাধান নিয়ে হাসি মুখে বাড়ি ফিরে যেত। ওই গ্রামের রাস্তার ধরে একটি লোক বসে থাকতো এবং গৌতম বুদ্ধের কাছে আসা প্রতিটি লোককে খুব মনোযোগ সহকারে  লক্ষ্য  করতো , সে এটা দেখে খুব অবাক হতো যে লোকতো  আসে বেশ মনখারাপ নিয়ে , কিন্তু যখন তারা গৌতম বুদ্ধের দর্শন করে ফিরত তারা ভারী খুশি থাকত , এবং মুখে থাকতো একটা হাসি । 


তাই গরিব ব্যক্তিটি মনে মনে ভাবলো যদি আমিও আমার সমস্যার কথা গৌতম বুদ্ধের  কাছে গিয়ে বলি তো কেমন হয় । তাই সে গৌতম বুদ্ধের  সাথে দেখা করতে চলে গেলো । গিয়ে দেখলো লোকজন লাইনে দাঁড়িয়ে আছে এবং সবাই নিজের সমস্যার কথা বলছিলো এবং গৌতম বুদ্ধ হাসিমুখে তাদের সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছিলেন ।


 দেখতে দেখতে ওই গরিব লোকটির নম্বর এলো। সর্বপ্রথম ওই লোকটি গৌতম বুদ্ধকে প্রণাম করে বললো , বাবা এই গ্রামে সবাই সুখী , একমাত্র আমিই গরিব এব দুঃখিত । তখন গৌতম বুদ্ধ  হেসে বললেন তুমি এই গ্রামে একমাত্র গরিব সেটার একমাত্র কারণ হলো, আজ পর্যন্ত তুমি কাউকে কিছু দাও নি । 


গৌতম বুদ্ধের  এই কথা শুনে লোকটি ভীষণ অবাক হয়ে গেলো এবং সে গৌতম বুদ্ধকে বললো , বাবা আমি গরিব অন্যকে দেয়ার মতো আমার কাছে কি আছে ? আমি নিজেই অনেক কষ্ট করে ভিক্ষা করে  দুবেলার দুমুটো অন্ন জোগাড় করি । 


গৌতম বুদ্ধ খুব মনোযোগ সহকারে লোকটির কথা শুনছিলেন এবং বললেন ,সত্যিই তুমি একটা মূর্খ লোক । অন্যকে দেবার জন্য ঈশ্বর তোমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন , তোমার মুখের হাসি দিয়েছেন যা দিয়ে তুমি অন্যে লোকের  মধ্যে আশা জাগাতে পারো ,তোমাকে মুখ দিয়েছেন যা দিয়ে তুমি অন্য লোকের সাথে মিষ্টি কথা বলতে পারো ,অন্যের প্রশংসা করতে পারো ,ঈশ্বর  তোমাকে দুটি হাত দিয়েছেন যা দিয়ে তুমি অন্য লোককে সাহায্য করতে পারো । 


আর ঈশ্বর এই তিনটি জিনিস যাকে  দিয়েছেন সে কখনো গরিব হতে পারে না । গরিব তো মানুষ নিজের মন থেকে হয়ে থাকে । আর এটা একটি ভুল ধারণা ছাড়া আর কিছু না । আর এই ভুল ধারণা  আমাদের জীবন থেকে দূর করাই  আমাদের উদ্দেশ্য  হওয়া দরকার । .


গৌতম বুদ্ধ  লোকটিকে বললেন যদি তুমি তোমার মনে গরিব হওয়া ও টাকা না হওয়ার চিন্তা আসতে  দাও , তা হলে সেটা তোমার গরিব হওয়ার কারণ হবে। আর যদি এগুলো চিন্তা জীবন থেকে দূর করে দাও তাহলে তোমার  একদিন গরিবী  একদিন অবশ্য দূর হয়ে যাবে । 


গৌতম বুদ্ধের এই কথাটি শুনে ওই গরিব ব্যক্তিটির মুখে  হাসি ফুটে উঠে এবং ওই ব্যক্তিটি গৌতম বুদ্ধের  এই উপদেশগুলি তার নিজের জীবনে পালন করে চলতে লাগলো । যার কারণে সে আর কখনো দুঃখী হয় নি ।


জীবনে  শান্তি পাওয়ার উপায় 

======================


মহাত্মা গৌতম বুদ্ধ  একটি নদীর তীরে একান্তে একটি ঝুপড়িতে বসবাস করতেন । গৌতম বুদ্ধ তার ঝুপড়ীর চারিপাশে সবুজ গাছপালা লাগিয়ে রেখেছিলেন এবং তার লাগানো গাছ পালার মধ্যে অনেক পাখিরা বসবাস করতো । 


সকাল , বিকেল পাখির মধুর শব্দে গৌতম বুদ্ধকে সবসময় আনন্দিত করে রাখতো । এমন মনে হতো এই গাছ- পালা , পশু -পক্ষী , নদী সবই যেমন গৌতম বুদ্ধের পরিবার । গৌতম বুদ্ধ নিজের এই পরিবারের সাথে খুব আনন্দে থাকতেন । 


একদিন ভোরবেলা গৌতম বুদ্ধ দেখেন তার দরজার পাশে এক জমিদার দাঁড়িয়ে আছেন । জমিদারকে অনেক চিন্তিত মনে হচ্ছিলো । গৌতম বুদ্ধ জমিদার কে তার কাছে আসার কারণ এবং জমিদার কেন এতো চিন্তিত তার কারণ জানতে চাইলেন । 


জমিদার তখন গৌতম বুদ্ধকে বললেন "বাবা" আমার টাকা -পয়সা , সম্পত্তির কোনো অভাব নেই, আমার একটি সুখী পরিবার আছে , আমার বা আমার পরিবারের কোনো রোগ নেই । তবুও আমি  রাত্রি বেলা ঘুমোতে পারি না । মনে সবসময় একটি অশান্তি বাস করছে , এমন কেন হয়? " , জমিদার গৌতম বুদ্ধের কাছে জানতে চাইলেন । 


গৌতম বুদ্ধ জমিদারের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন । গৌতম বুদ্ধ জমিদার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, দেখো তোমার কাছে সবকিছু আছে ঠিক কিন্তু তোমার কাছে সেই জিনিস নেই , যে জিনিস তোমার নিদ্রার জন্য প্রয়োজন ।


তখন জমিদার গৌতম বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলেন, "সেটা কি জিনিস বাবা ?" গৌতম বুদ্ধ বললেন "তুমি চতুর্দিকে চিন্তার মধ্যে  ঘিরে  আছো । ধন -সম্পত্তির  চিন্তা , ব্যবসার চিন্তা ,পরিবারের চিন্তা । শান্তি এবং চিন্তার মধ্যে সবসময় শত্রুতা থাকে । তোমার ভেতরে ভীষণ চিন্তার শব্দ তোমাকে নৈঃশব্দে আসতে দিচ্ছে না।"


তখন জমিদার এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কি , তা গৌতম বুদ্ধের কাছে জানতে চাইলে, গৌতম বুদ্ধ জমিদারকে বললেন , "তুমি প্রকৃতি থেকে থেকে শিক্ষা নাও , প্রকৃতি  তার গাছ- পালা, ফল-মূল , জল , বাতাস , আলো ,আকাশ অনেক মূল্যবান সম্পদ চতুর্দিকে তার দুহাত দিয়ে ছড়িয়ে রেখেছে । 


গৌতম বুদ্ধ জমিদারকে বললেন, "জমিদার তুমি যদি প্রকৃতি থেকে প্রেরণা নিয়ে প্রকৃতির মতো নিজের জীবন গঠন করো , তাহলে দেখবে তোমার জীবনের সব চিন্তা, সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে এবং রাত্রিতে ভালোভাবে নিদ্রাও হবে । 


জমিদার গৌতম বুদ্ধের কথা বুঝতে পারলেন , জমিদার লোককল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিলেন এবং শান্তিতে জীবন যাপন করতে শুরু করতে লাগলেন ।


গৌতম  বুদ্ধের এই গল্প থেকে একটি শিক্ষা পেলাম যে , জ্ঞান ও ধন যত তুমি দান  করবে তার থেকে অনেক বেশি ফিরিয়ে পাবে । ধন ও জ্ঞান দেন করলে কখনো কমে যায় না , একদিন তোমার দান করা ধন ও জ্ঞান  দ্বিগুন হয়ে তুমার কাছে এই ফিরে আসবে ।


রাজা জীবনে  শান্তি কি ভাবে  পেলেন |


এক রাজ্যে এক রাজা ছিলেন , তিনি সবসময় অশান্তিতে থাকতেন । অনেক চেষ্টা করেও তিনি শান্তিতে থাকতে পারতেন না । একদিন এক গরিব ভিক্ষুক তার প্রসাদে আসে , ভিক্ষুকের জ্ঞান কথাবার্তাতে রাজা  সন্তুষ্ট হন । 


রাজা  ভিক্ষুককে জিজ্ঞাসা করেন , আমি রাজা আমার কাছে সবকিছু আছে তবুও আমি মনে শান্তি পাচ্ছি না কেন । ভিক্ষুক বলে " রাজা আপনি একদিন একা বসে চিন্তা করুন ,আপনার অশান্তির কারণ আপনি নিজেই খুঁজে পাবেন " এই বলে ভিক্ষু চলে গেল । তার পরদিন সকালে রাজা নিজের কক্ষে আসন করে বসে গেলেন । 


তখন রাজার মহলের এক কর্মচারী রাজার কক্ষ পরিষ্কার করতে আসে , রাজা সেই কর্মচারীকে তার কষ্টের কথা জিজ্ঞাসা করেন , কর্মচারীর কষ্টের কথা শুনে রাজা অনেক দুঃখিত হয়ে পরেন । তারপর তিনি তার মহলের প্রত্যেক কর্মচারীর কষ্টের কথা জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেন । 


রাজা বুঝতে পারেন যে তার কর্মচারীরা বেতন কম থাকার কারণে জীবনে কষ্ট পাচ্ছে । তাই রাজা তার কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে দিলেন , বেতন বাড়ানোর জন্য রাজার কর্মচারীরা খুশি হয়ে রাজাকে ধন্যবাদ জানালেন এবং রাজার জয়ধ্বনি দিলেন । 


কর্মচারীদের খুশি দেখে রাজার মনও সন্তুষ্টি ও খুশিতে ভরে যায় । তারপরদিন সেই ভিক্ষুক আবার রাজার কাছে আসে এবং রাজা কে জিজ্ঞাসা করে ," রাজা আপনি শান্তি পেয়েছেন " রাজা বলেন " পুরোপুরি তো শান্তি পাই নি কিন্তু যবে থেকে আমি মানুষের দুঃখ কষ্টের কারণ জানতে পেরেছি তখন থেকে আমার মন থেকে অশান্তি ধীরে ধীরে কম হচ্ছে "। 


তখন ভিক্ষুক রাজাকে বলে " রাজা আপনি শান্তির পথ পেয়ে  গেছেন, এখন কেবল এই পথ ধরে আপনাকে এগোতে হবে , একজন রাজা তখনি সন্তুষ্টি থাকে যখন তার রাজ্যে প্রজারা খুশি থাকে "। 

এই গল্প থেকে আমরা এই শিক্ষা  পেলাম  , আমাদের মনের শান্তির জন্য নিজেকে খুশি করার চেয়ে , অন্যের দুঃখ কষ্ট দূর করে অন্যকে খুশি করলে নিজের জীবনে শান্তি ও খুশি পাওয়া যায় ।  


অস্থির মনকে স্থির করা

------------------=----------------

একবার গৌতম বুদ্ধ তাঁর কয়েকজন অনুসারীদের নিয়ে ভ্রমণ করছিলেন ।পথে এক হ্রদ পড়লে বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের একজনকে বললেন, "আমি তৃষ্ণার্ত। আমার জন্য হ্রদ থেকে কিছু জল আনো।"


শিষ্য হ্রদে গিয়ে পৌঁছানো মাত্র একটি গরুর গাড়ি হ্রদ অতিক্রম করতে শুরু করে। ফলে জলে ঘূর্ণন ওঠে এবং তা কর্দমাক্ত হয়ে যায়।


শিষ্য ভাবলো " এই জল আমি বুদ্ধকে কি করে পান করতে দেব ?"


তাই তিনি ফিরে আসেন এবং বুদ্ধকে বলেন, "সেখানে জল খুব ময়লা। এটা পান করার উপযুক্ত না ।"


প্রায় আধা ঘন্টা পর বুদ্ধ আবার একই শিষ্যকে যেতে বলেন লেকের দিকে.


শিষ্য গিয়ে দেখলেন যে কাদা এখনও জমে গেছে।


তিনি ফিরে আসেন এবং একই কথা বুদ্ধকে জানান।


কিছুক্ষণ পরে, আবার বুদ্ধ শিষ্যকে জল আনতে যেতে বললেন।


এই সময়, শিষ্য দেখলো , কাদা স্থির হয়ে গেছে, এবং জল পরিষ্কার।

অতঃপর তিনি একটি পাত্রে কিছু পানি সংগ্রহ করে বুদ্ধর জন্য নিয়ে এলেন।


বুদ্ধ পানির দিকে তাকিয়ে শিষ্যকে বলেন,

"দেখ, এই জল পরিষ্কার করার জন্য তুমি কি করেছ? কিছুই না । কেবল অপেক্ষা করেছ ,আর কাদাগুলি নিজ থেকেই স্থির হয়ে নীচে জায়গামত ফিরে গেছে এবং তোমার আজলায় পরিষ্কার জল এসে গেছে।"


তোমার মনও ঠিক তেমন ! যখন এটি অস্থির , অশান্ত , বিক্ষুব্ধ হবে তখন শুধু মনকে একটু সময় দেবে। এটা নিজে থেকেই স্থির হবে।


আর এই অশান্ত মনকে শান্ত করার কোন প্রচেষ্টা বা জবরদস্তিরই প্রয়োজন নাই। এটি স্থির হবেই, কোনো প্রচেষ্টা ছাড়াই হবে।


তেমন তোমার প্রিয় মানুষ বা প্রিয় বস্তু হারিয়ে গেলে ভেঙ্গে না পরে স্থির থাকা খুব কষ্টসাধ্য, জানি, কিন্তু অসম্ভব নয়।


প্রেমে পড়া তোমার নিয়ন্ত্রণে নাও থাকতে পারে, কিন্তু সেই প্রেম আঁকড়ে থাকা অবশ্যই নিশ্চিতভাবেই একটি পছন্দ মাত্র ... (Falling in love might not have been under your control, but staying in love is definitely only a choice..)


সময় সবকিছু নিরাময় করে !! তাই যা তোমার কাছে এসেছে তা ইতিবাচক ভাবে দেখো এবং মন শান্ত করতে হলেও বিশ্বাস করো যে সব কিছুর জন্যই একটি উচ্চতর কারণ রয়েছে।


এমনকি উপরের সবগুলি কথাও যদি ভুল বলে মনে করো তবুও নিশ্চিত হবে যে একদিন তুমি বুঝতে পারবে এবং সেই দিন তুমি জানবে, যে আমি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছি ।


আধারভেদে শিক্ষা

****************

গৌতম বুদ্ধ তখন অহিংসার বাণী বিতরণ করছেন। এক সাপ এলো তার কাছে দীক্ষা নিতে। তিনি বললেন, না। তুমি মানুষকে দংশন করো। তোমার আচরণে, ধর্মে এখনো হিংসা বিদ্যমান। তুমি দীক্ষার উপযুক্ত নও।


সাপ বলল, প্রভু, উপায় কি নেই কোনো? বুদ্ধ বললেন, আছে। দংশন করা ছাড়তে হবে। সাপ বলল, ছাড়লাম। বুদ্ধ বললেন, না। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। সাপ বলল, কী পরীক্ষা? তিনদিন লোকের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে সজ্জনের মতো ব্যবহার করতে হবে। দংশন করা যাবে না, গৌতম বুদ্ধ বললেন। তাই হবে, বলে সাপ প্রস্থান করলো।


এরপর শহরের সদর রাস্তায় সাপ শুয়ে থাকলো। তাই দেখে বাবাগো মাগো বলে লোকেরা পালাতে লাগলো। কাছে পিঠের এক সওদাগরকে ডেকে সাপ বলল, আমি বুদ্ধের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমি তোমাদের উপকার করবো। সদ্ভাব বজায় রেখে জীবনধারণ করবো। বলো আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?


সওদাগর বলল, তাই কি হয়, সাপ কি সজ্জন হয়? যার বিষদাঁত থাকে সে কি কখনো মানুষের বন্ধু হয়? সাপ হেসে বলল, এই দেখ আমি বিষদাঁত তুলে ফেলেছি। আমি এখন তোমাদের বন্ধু। সওদাগর তখন হাসতে হাসতে বলল, বন্ধু, তবে তো একটা উপকার করতেই হচ্ছে। এই মালসামাল বয়ে নিয়ে যেতে বড়ই কষ্ট হচ্ছে। বাঁধবার জন্য কিছু দরকার। বলে সাপকে দড়ির মতো করে তার মালগুলো বেঁধে হাসতে হাসতে বাড়ির দিকে চলল।


এদিকে সাপের সাধনার কী অবস্থা দেখার জন্য বুদ্ধ ওই রাস্তার দিকে এলেন। এসে দেখেন সাপের অবস্থা খারাপ। চিঁড়ে চ্যাপটা অবস্থা। জিজ্ঞেস করলেন, এ অবস্থা কীভাবে? সাপ সব জানানোর পর বললেন, তা দংশন করতে মানা করেছি, কিন্তু ফোঁস করতে কি মানা করেছি?


 বলল, আমি আমার শিক্ষা লাভ করেছি।


প্রথমত, যে যে কাজে স্বভাবতই পটু সেটা পালন করাই তার ধর্ম, এর অন্যথা অনাসৃষ্টি তৈরি করে সমাজে।


দ্বিতীয়ত, বেঁচে থাকার জন্য যে যে প্রকৃতির আশীর্বাদ পেয়েছে তা ত্যাগ করা উচিত নয়।


তৃতীয়ত, নিজের সাধনার গুমোর অন্যের কাছে ফাঁস করা উচিত নয়। চতুর্থত, কুলগুরু ব্যতীত দীক্ষার ইচ্ছা প্রকাশ করা উচিত নয়।


বুদ্ধ বললেন, আর এই সমস্তটা মিলে তোমার কী মত?

সাপ বলল, প্রথমত, মন্ত্রচর্চা অপেক্ষা বাস্তবতার ভেতর প্রবেশ করে জ্ঞান লাভ উত্তম।

দ্বিতীয়ত, উত্তমগুরু শিষ্যকে যথাযথ আধারে (স্থানে) প্রেরণ করে নিজে থেকে জ্ঞান আহরণ করতে সাহায্য করে স্বাবলম্বী করে তোলেন। তৃতীয়ত, ধ্যানী,ধৈর্যশীলই কেবল এবং শেষপর্যন্ত জ্ঞান লাভ করতে পারে।

গৌতম বুদ্ধ খুশি হয়ে বললেন, ‘তথাস্তু।


ধৈর্যের ফল

***********

একবার গৌতম বুদ্ধ, বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা প্রচারের জন্য গ্রাম গ্রাম শহর শহর নিজের শিষ্যসহ পরিভ্রমণ করছিলেন ,সারাদিন ভ্রমণের শেষে তথাগত খুব তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লেন,জল পিপাসা এতই বেড়ে গেলো যে তিনি আর সহ্য করতে  পারছিলেন না । তাই তিনি তার একজন শিষ্যকে ডেকে বললেন যে তিনি ভীষণ পিপাসার্ত,  সে যেন তাঁর জন্য জল নিয়ে আসে ।


শিষ্য গুরুর আদেশে জল আনার জন্য গ্রামের ভিতরে গেলো ,গ্রামের মধ্যে দিয়ে একটি নদী বইছিল । কিন্তু সেই নদীতে গ্রামের সবাই কাপড় ধুচ্ছিল,কেউ গরু ,মহিষ কে স্নান করাচ্ছিল ,তাই নদীর জল অপরিষ্কার ছিল ,তাই শিষ্য চিন্তা করলো এই জল তো অপরিষ্কার, তার গুরুদেবের জন্য এই অপরিষ্কার জল নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না,তাই শিষ্য জল না নিয়ে খালি হাতে ফিরে এল।গৌতম বুদ্ধা যখন শিষ্যকে খালি হাতে চলে আসতে দেখলেন,তখন খালি হাতে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলেন,তখন শিষ্য পুরো কাহিনী ব্যক্ত করল । 


এইদিকে তথাগত পিপাসায় কাতর, তিনি তখন আরেকজন শিষ্যকে জল আনার জন্য বললেন। সেই শিষ্য একটি মাটির পাত্রতে পরিষ্কার জল নিয়ে এল ,তা দেখে গৌতম বুদ্ধ অবাক হয়ে গেলেন এবং সেই দ্বিতীয় শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন যে সে এই পরিষ্কার জল পেল কোথায়, কিভাবে । 


দ্বিতীয় শিষ্য বলল যে সে যখন নদীর কিনারে জল আনার জন্য যায়, গিয়ে দেখে সবাই নদীতে কাপড় ধুচ্ছিলো,গরু ,মহিষ কে স্নান করাচ্ছিল, সে নদীর কিনারে বসে গ্রামের সবার কাজ শেষ করার জন্য অপেক্ষা করছিল ,সবাই কাজ কর্ম্ম শেষ করে  যাওয়ার পর জলের উপরে থাকা ময়লা জলের নিচে বসার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। যখন ময়লা জলের নিচে বসে যায় ,তখন জল নিয়ে আসে সে । শিষ্যের এই উত্তর শুনে গৌতম বুদ্ধ খুব খুশি হলেন এবং সব শিষ্যকে একটি উপদেশ দিলেন ,যে জীবনে আমাদের যে কোনো কাজ ধৈর্য সহকারে করতে হয়,যে কোনো কাজ শুরু করে, প্রথম বারেই বিফল হয়ে কাজ ছেড়ে না দিয়ে আবার চেষ্টা করে যাওয়া উচিৎ, চেষ্টা করতে করতে একদিন সাফল্য আসবে ,তাই চেষ্টা করে যাওয়া উচিত ।


একই জ্ঞানের আধারভেদে অনেক প্রতিফলন

***************************************

একদিন গৌতম বুদ্ধ এক সভাতে প্রবচন দিচ্ছিলেন। গৌতম বুদ্ধ প্রবচন শেষ করার পর ,যারা প্রবচন শুনতে এসেছিলেন তাদেরকে বললেন ," জাগো ,সময় হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে"। প্রবচন শেষ করার পর গৌতম বুদ্ধ তার প্রিয় শিষ্য আনন্দকে বললেন " চলো আনন্দ একটু ঘুরে আসি"। 

আনন্দ ও গৌতম বুদ্ধ এক সাথে বেরিয়ে পড়লেন । কিন্তু আশ্ৰম এর মুখ্য দরজার সামনে এসে আনন্দ ও গৌতম বুদ্ধ  দরজার এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন, কারণ যারা গৌতম বুদ্ধের প্রবচন শুনতে এসেছিলেন তারা ধীরে ধীরে একজন একজন করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন আর দরজার মুখে ভিড় লেগে গিয়েছিল। 


তাই আনন্দ আর গৌতম বুদ্ধ সবাইকে যেতে দেবার জন্য দরজার এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন। হঠাৎ ,সেই ভিড় থেকে একজন স্ত্রী এসে গৌতম বুদ্ধকে প্রণাম করলেন এবং বললেন," ভগবান আমি একজন নর্তকী ,আজ শহরের সভাপতির ঘরে আমার নৃত্যের অনুষ্ঠান ছিল ,কিন্তু আমি আপনার প্রবচনে এসে নৃত্যের অনুষ্ঠানের  কথা  বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলাম ।


কিন্তু যখন আপনি বললেন যে ," জাগো ,সময় হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে " ,তখন আমার অনুষ্ঠানের কথা মনে পরে যায় ,তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।


ঐদিন এক ডাকাতও এসেছিল গৌতম বুদ্ধের প্রবচন শুনবার জন্য । হঠাৎ ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে গৌতম বুদ্ধকে প্রণাম করে সে বললো , "ভগবান আমি আপনাকে মিথ্যে বলবনা ,আমি একজন ডাকাত ।আজ আমার এক জায়গায় ডাকাতি করার জন্য যাবার ছিল,আমি ভুলে গিয়েছিলাম কিন্তু আপনার প্রবচন শেষ করার পর যখন আপনি বললেন যে ," জাগো ,সময় হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে "- তখন আমার মনে পড়ে গেল,যে আজ আমাকে ডাকাতি করতে যেতে হবে , তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ভগবান" ।


তারপর একজন বৃদ্ধ লোক ধীরে ধীরে এলেন এবং গৌতম বুদ্ধের কাছে এসে প্রণাম করে বললেন,"আমি পুরো জীবন,টাকা পয়সা, সুখ, পরিবার, জাগতিক সবকিছুর পিছনে ছুটেছি ।

জীবনে কোনো সমাজ সেবার কাজ করিনি ,কিন্তু আজ আপনার প্রবচনের শেষে আপনি যখন বললেন ," জাগো ,সময় হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে " - তখন মনে হল যে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছি।এখন মনে হচ্ছে আমার জীবনটা বেকার কাটিয়েছি। আজ আপনার প্রবচনের শেষে আপনার ওই জেগে ওঠার কথায় আমার চোখ খুলে গেছে,আজ থেকে আমি সংসারের মোহ , মায়া ছেড়ে সংসারের ভালোর জন্য,সংসারের লোকের ভালোর জন্য কাজ করব" । এই বলে বৃদ্ধ প্রণাম করে চলে যায় ।


যখন সবাই চলে গেলো ,গৌতম বুদ্ধ তার প্রিয় শিষ্য আনন্দকে বললেন ," দেখো আনন্দ আমি প্রবচন একটি দিয়েছি কিন্তু তার অর্থ সবাই আলাদা আলাদা বের করেছে ।যার যতটুকু ক্ষমতা সে ততটুকু এই দান গ্রহণ করতে পেরেছে ।জ্ঞান অর্জন করতে গেলে তার মনকেও উপযুক্ত ভাবে তৈরি করতে হবে । জ্ঞান অর্জন করতে গেলে মন পবিত্র আর আধার উপযুক্ত হওয়া দরকার ।


চলবে ...


তথ্যসূত্র : বৌদ্ধ সাহিত্য


 : বুদ্ধদেবের জীবনী, সপ্তপদ্ম সুজাতা,ও আনন্দ

†*******************-----*********************

লিখনে : পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

©কপিরাইট সংরক্ষিত


বুদ্ধদেবের সংক্ষিপ্ত জীবনী

*****************-******

বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধ কেবল মাত্র যে একজন ধর্ম প্রচারক ছিলেনতা নয়, তিনি একজন মহান দার্শনিক ছিলেন। বহুবিধ ঐতিহাসিক গবেষণা ও পর্যালোচনা এর মাধ্যমে আমরা তার জীবন সম্পর্কে নানান তথ্য সূত্র লাভ করেছি। বুদ্ধদেব জানিয়েছেন, কিভাবে মানুষ তার জীবনে শান্তি পেতে পারে। এই শান্তির জন্য দরকার অহিংসা, সত্যবাদিত, মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং সাম্যবোধ। আজো এই পৃথিবীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও অনুরাগীর সংখ্যা অসংখ্য আমরা ভাগ্যবান যে গৌতম বুদ্ধ আমাদের এই দেশ ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেন।


যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৫৬৩ বছর আগে নেপালের নিকটবর্তী কপিলাবস্তুতে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। তার পিতা ছিলেন কপিলাবস্তুর নৃপতি শুদ্ধোধন এবং মাতা মায়াদেবী। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে তাঁর জন্ম।


বাল্যকালে তার নাম ছিল সিদ্ধার্থ। খুব কম বয়সেই তিনি তার মাতা মায়াদেবীকে হারান। তার বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী তাঁর লালন-পালনে এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাই সিদ্ধার্থের অপর নাম গৌতম। আবার তিনি শাক্য বংশের সন্তান ছিলেন বলে তাকে বলা হয় শাক্যমুনি।


যৌবনে তিনি বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করেন। তার স্ত্রীর নাম যশোধারা। যশোধারাকে গোপা নামেও অভিহিত করা হতো।


ছেলেবেলা থেকেই গৌতম ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। সর্বক্ষণই মানুষের দুঃখ ও বেদনার ভাবনাতে আত্মমগ্ন। পরমপুরুষের নিকট তার একটাই নিবেদন – মানুষ কিভাবে এই দুঃখ, বেদন , গ্লানি ও হতাশা থেকে মুক্তি পাবে তার উপায়কে জানাতে হবে।


এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, গৌতম বুদ্ধ প্রবর্তিত ধর্মের মর্মকথা আমাদের দেশের সভ্যতা ও ধর্মবোধে প্রাচীন কাল থেকেই উপস্থিত ছিল। বুদ্ধদেব তার নব সংহতরূপ প্রদান করেন। বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা বলেছেন ভগবান বুদ্ধ এর আগে আরো পঞ্চান্নবার এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধ হলেন তার শেষ আবির্ভাব। প্রতিবারই তিনি মানুষের কল্যাণ করে গেছেন উৎসাহ ও উপদেশ ও আশীর্বাদ এর মাধ্যমে। ললিত বিস্তার গ্রন্থে আদি বুদ্ধদেবের নাম আমরা পেয়েছি।


তাঁর আগের জন্মগুলিতে যে নামে পরিচিতি পান তাঁরা হলেন পদ্দত্তোর, ধারমোকেতু, দীপঙ্কর, গুনকেতু, মহাকর, হৃষীকর, ঋষিদেব, শ্রীতেজা, সাত্যকেতু, বজ্রসংহত, সর্বাবিভু, হেমবর্ন, অত্যুচ্চগামী, প্রবাতসার, পুস্পকেতু, বররূপ, সুলোচন, ঋষিগুপ্ত, জিনবত্ত, উন্নত, পুষিপত, ঊরনীতেজা, পুষ্কর, ইরশ্মি, মাঙ্গল, সুদর্শন, সিংহতেজা, স্থিবুদ্ধিদত্ত, বসন্তগন্ধি, বিপুলকীর্তি, পুষ্য, তিষ্য, লোসুন্দর, বিস্তরনভেদ, রত্নকীর্তি, উগ্রত্তেজা, ব্রম্মতেজা, সঘোষ, সুপুশ্য, সুমনোজ্ঞ, সুতেস্ট, প্রহতিনেত্র, গুনরাশি, মেঘস্বর, সুররন, আয়ুস্তেজা, সুনীলগাজগামী, জিতশত্রু, লকাভিলাশি, শিখি, বিশ্বম্ভু, কেনকমুনি, কাশ্যপ, বিপশ্চিৎ, সম্পুজিত, ক্রুকচ্ছেদ ইত্যাদি।


যাই হোক, সংসারের প্রতি গৌতম এর অনাগ্রহ দেখে ১৮ বছর বয়সে তাকে যশোধারা নামে এক সুন্দরী রাজকন্যার সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়। কিন্তু তবুও সংসার জীবনে সিদ্ধার্ত প্রাণবন্ত হয়ে উঠলেন না। মানুষের জরা-ব্যাধি ও মৃত্যু তাকে সর্বক্ষণ ভাবিত করে রাখত। পরিশেষে তার স্ত্রী যশোধারার গর্ভে রাহুল নামে এক পুত্রসন্তান জন্ম হওয়ায় সিদ্ধার্থ ভয় পেয়ে গেলেন – সংসারের মায়ায় বুঝি তিনি আবদ্ধ হয়ে পড়বেন। তাই সেই বন্ধন ছিন্ন করে সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করলেন।


প্রথমে তিনি উপস্থিত হলেন বিহারে। সেখান থেকে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিভ্রমন করেন। অনেক সাধু ও সন্ন্যাসীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। বড় বড় সাধুদের অনন্য সাধনার প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন দুজন নামী সাধকের নিকট, তারা হলেন আড়ার কলাম ও রুদ্রক। তারপর তিনি চলে যান গয়াতে । সেখানে এক বোধিবৃক্ষের তলায় বসে শুরু হলো তার দীর্ঘ তপস্যা। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সাধনায় সিদ্ধিলাভ না করে তিনি সেই বৃক্ষ ত্যাগ করবেন না। অনেক শারীরিক বাধা-বিপত্তি ও বিড়ম্বনা সত্বেও তিনি সিদ্ধিলাভ করলেন। তখন তার নাম হলো বুদ্ধ। সিদ্ধিলাভ এর এই দিনটি ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। বুদ্ধদেবের বয়স তখন ৩৫ বছর।


সিদ্ধিলাভের পর গৌতম বুদ্ধ ধর্মপ্রচারে প্রথমে উপস্থিত হন ঋষিপত্তমে। এই ঋষিপত্তম বর্তমানে সারনাথ নামে পরিচিত। এখানে তিনি তার পূর্বপরিচিত পাঁচ জন সংসার ত্যাগীকে দীক্ষা দেন। সেই পাঁচজন সন্ন্যাসীর নাম কৌড্রিন্য, অশ্বজিত, বপ্র, ভদ্দিয়া ও মহানাম। এই ঘটনা বৌদ্ধ সমাজে ধর্মচক্র নামে পরিচিত। বুদ্ধদেব তাদের চারটি মহাসত্যের কথা বলেছিলেন। সেগুলি এই প্রকারঃ


প্রথম সত্য – মানুষের সাংসারিক জীবনে দুঃখ হলো মজ্জাগত। একটি দুঃখের পর আরেকটি আসে, তারপর আরেকটি অর্থাৎ ওই বিড়ম্বনা সকল সময়ে সাম্প্রতিক।


দ্বিতীয় সত্য – মানুষের দুঃখ ও বিড়ম্বনার মূল কারণ হলো বিষয় সম্পত্তির উপর লোভ, মানুষের অন্তরে প্রলোভনের এই বিষদাঁত ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।


তৃতীয় সত্য – ওই বিষদাঁতকে সমূলে উৎপাটন করার দায়িত্ব মানুষের নিজেরই।


চতুর্থ সত্য – মানুষের মুখ্য লক্ষ্য হওয়া উচিত নির্বাণ লাভ নির্বাণ লাভ। নির্বাণ লাভ কিভাবে সম্ভব, বুদ্ধদেব তার জন্য পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। এই আটটি উপায় অবলম্বন করলে একজন মানুষের পক্ষে মুক্তিলাভ সম্ভব।


থেরবাদ ত্রিপিটক এবং মহাযানের আগমগুলিতে বলা হয়েছে যে, সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির সময় অষ্টাঙ্গিক মার্গকে পুনরাবিষ্কার করেন। এই সূত্রগুলিতে উল্লিখিত আছে যে, গৌতম বুদ্ধের পূর্বেকার বুদ্ধরা অষ্টাঙ্গিক মার্গের চর্চা করেছেন এবং গৌতম বুদ্ধ এই শিক্ষা তার শিষ্যদের দিয়ে গেছেন। অষ্টাঙ্গিক মার্গ হলো :


সম্যক প্রজ্ঞা যা দুই প্রকার- সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সঙ্কল্প।


কায়িক, বাচনিক ও মানসিক কর্মের সঠিক জ্ঞানকে সম্যক দৃষ্টি বলে। অহিংসা, চুরি না করা, অব্যভিচার ও সত্যভাষণ হল কায়িক সুকর্ম; নিন্দা না করা, মধুর ভাষণ ও লোভহীনতা হল বাচনিক সুকর্ম এবং মিথ্যা ধারণা না করা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ না হওয়া হল মানসিক সুকর্ম।


সম্যক দৃষ্টির উদ্দেশ্য হল ভুল, ভ্রান্তি এবং মতিবিভ্রম দূর করা। বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক অর্জনের উপায় হল সম্যক দৃষ্টি।


সম্যক শীল


সম্যক শীল তিন প্রকার- সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম ও সম্যক জীবিকা। মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, কটুবাক্য ও অতিকথন ত্যাগ করে সত্যভাষণ ও মধুর বচনকে সম্যক বাক্য বলে। অহিংসা, চুরি না করা, অব্যভিচারকে সম্যক কর্ম এবং অসৎ পন্থা ত্যাগকে 

সম্যক জীবিকা বলে। গৌতম বুদ্ধ অস্ত্র ব্যবসা, প্রাণী ব্যবসা, মাংস বিক্রয় এবং মদ ও বিষের বাণিজ্যকে মিথ্যা জীবিকা বলে উল্লেখ করেছেন।


সম্যক সমাধি


সম্যক সমাধি তিন প্রকার- সম্যক প্রযত্ন, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি।


সম্যক প্রযত্নে হলো ব্যায়াম, ইন্দ্রিয় সংযম, কুচিন্তা ত্যাগ এবং সৎ চিন্তার চেষ্টা ও তাকে স্থায়ী করার চেষ্টাকে সম্যক প্রযত্ন বলে।


কায়া, বেদনা, চিত্ত ও মনের ধর্মের সঠিক স্থিতিসমূহ ও তাদের ক্ষণবিধ্বংসী চরিত্রকে সদা স্মরণে রাখাকে সম্যক স্মৃতি এবং চিত্তের একাগ্রতাকে সম্যক সমাধি বলে। অষ্টাঙ্গিক মার্গ পুরোটাই আমাদের পতঞ্জলি যোগদর্শনের অংশবিশেষ।


বুদ্ধদেব তার জীবনে ব্যাপক পরিভ্রমন করেছেন এবং ধর্ম প্রচার করেছেন। তিনি কোথাও এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে না। কেবলমাত্র বর্ষা ঋতুতে কোন একটি স্থানে একটানা চার মাস অবস্থান করত। বহু বিপন্ন বাক্তিকে তিনি মুক্তির পথ দেখান,বহু চঞ্চল মন কে তিনি প্রশান্ত করেন।


রাজা বিম্বিসার বুদ্ধদেবের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। বুদ্ধদেব কপিলাবস্তুতে গমন করলে তার পুত্র রাহুল, পত্নী , ভৃত্য ও নাপিত তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ৮০ বছর বয়সে তিনি পায়ে হেটে যাচ্ছিলেন বৈশালী থেকে কুশিনগর। পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং প্রাণত্যাগ করেন। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ অব্দতে বুদ্ধদেবের দেহত্যাগ করেছিলেন।


মল্লগন বুদ্ধাদেবের দেহ দাহ করেছিলেন। বৌদ্ধারা তার দেহাবশেষ সংগ্রহ করে দশ জায়গায় দশ টি স্তুপ নির্মাণ করেন এবং স্তুপগুলির অভ্যন্তরে সেই দেহাবশেষ সংরক্ষণের চেষ্টা করেছিলেন।


বুদ্ধদেব ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু বলেননি। তিনি মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে ছিলেন। ফলে হিন্দু ব্রাহ্মন্যবাদের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের বিরোধ ছিল অনিবার্য। বুদ্ধদেব বলতেন, যার জন্ম হয়েছে ক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে তার বিনাশ অনস্বীকার্য। এই সময় মধ্যে যিনি সত্য ধর্ম পালন করতে পারেন, তবে তাকে আর এই বিষাদ পূর্ণ পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে না।


*************************---**************


সপ্তপদে প্রস্ফুটিত সপ্ত পদ্মফুলের ইতিহাস

***************************************

ভগবান বুদ্ধের জন্মের পর পরই তিনি জলের উপরে হেঁটে যান যেখানে সপ্ত পদ্ম প্রস্ফুটিত হয়। তিনি যে যে পদ্ম ফুলে  পদচারণা করেছিলেন সত্যিই কি এইগুলো পদ্মফুল ছিল নাকি অন্যে কিছু এবং কেন তিনি - আমি শ্রেষ্ঠ, আমি জৈষ্ঠ বলেছিলেন?


১ম পদ্মফুলের ( বসুমতী )ইতিহাস

------------------------------------

এই পৃথিবীতে বহু যুগের পর, কল্প- কল্পান্তরের পর ভগবান তথাগত বুদ্ধগণের আর্বিভাব ঘটে। বুদ্ধ গণের জন্মের কারনে এই জগত সংসার পূণ্যের স্রোতে প্লাবিত হয়। যে দিকে উনার ধর্মসুধা প্রবাহিত হবে সেই দিকে ধর্মের বন্যা বয়ে যাবে। তাই এমন মহাপুরুষের জন্মের সময় এই পৃথিবী দেবী বসুমতী চিন্তা করিতে লাগলেন- বহু জন্মের পরে ভগবান বুদ্ধ পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করছেন।  আমি আজ ধন্য এমন এক মহামানব আমার এই ভূমিতে পদচারণা করবেন। তাই এই দূর্লভ মুহুর্তকে আমি চিরস্মরণীয় করে রাখবো। আমি স্বয়ং তথাগত বুদ্ধকে অভিনন্দন জানাবো। ওনার চরণে নিজের জীবকে সর্মপন করব। ওনার পা যেন প্রথম মাটিতে না পরে আমার উপর পরে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এই ভেবে দেবী বসুমতী পদ্মফুলের রূপ নিয়ে তথাগত বুদ্ধে সামনে নিজেকে আত্নসর্মপন করলেন।


২য় পদ্মফুলের (দেবরাজ ইন্দ্র )ইতিহাস

----------------------------------

তখন স্বর্গের দেবরাজ ইন্দ্র তা দেখে চিন্তা করিতে লাগলেন-  মহামানব পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করছেন। দেবী বসুমতী পদ্মফুলের রূপ নিয়ে ওনার পদচরণে গেলেন। আমি স্বর্গের অধিপতি হয়ে আমি কেন যাব না এমন মহাপুরুষের আর্বিভাব কালে? আমিও যাব তথাগত বুদ্ধের পদচারণে। নিজের জীবনকে ওনার রাতুলচরণে সর্মপন করব। এই ভেবে তিনিও পদ্মফুলের রূপ নিয়ে মহাপুরুষের পদচারণে নিজেকে সর্মপন করলেন।


৩য় পদ্মফুলের (চারিলোকপাল)ইতিহাস

*********************

স্বর্গে অধিপতি দেবরাজ ইন্দ্র যখন পদ্ম ফুল রূপে তথাগত বুদ্ধের চরণে গেলেন তা দেখে এই পৃথিবী রক্ষাকারী চারিলোকপাল দেবরাজগণ চিন্তা করতে লাগিলেন - স্বয়ং দেবগণের মহারাজা পদ্মরূপে মহাপুরুষের পদচরণে গেলেন আমরা কেন যাবো না। আমরাও মহামানবের চরণে নিজেকে সর্মপন করব। এইভেবে চারিলোকপাল দেবরাজ পদ্মরূপে তথাগত বুদ্ধের পদচরণে নিজেদেরকে সর্মপন করলেন। 


একে একে যখন দেবী বসুমতী, দেবরাজ ইন্দ্র, চারিলোকপাল দেবরাজগণ মহাপুরুষের পদতরে পদ্মরূপে গমন করলেন তখন ব্রহ্মলোকের অধিপতি মহাব্রহ্মরাজা (৪) চিন্তা করিতে লাগলেন - স্বর্গের অধিপতিসহ মর্ত্যলোকে অধিপতিগণ পদ্মরূপে বুদ্ধের রাতুলচরণে গেলেন তাহলে আমি কেন যাব না।  আমিও পদ্মরূপে মহামানবের চরণতরে নিজেকে সর্মপন করব। তাই তিনিও মহাপুরুষের চরণতরে পদ্মফুলের রূপ নিয়ে নিজেকে  সর্মপন করলেন।


ঠিক এইভাবে একে একে সাতটি পদ্মফুলের রুপ নিয়ে সাতজন মহাগুণীজন বোধিসত্ত্বের রাতুল পদচরণে গমন করেছিলেন।


আমি শ্রেষ্ঠ, আমি জৈষ্ঠ বলার কারন:- একে একে ব্রহ্মলোকের মহাব্রহ্মরাজা, স্বর্গের অধিপতি দেবরাজ ইন্দ্র, চারিলোকপাল দেবরাজগণ ও মাতা বসুমতী দেবী যখন পদ্মরূপে মহামানবের রাতুল চরণে গেলেন তা দেখে ব্রহ্মলোকে সকল ব্রহ্মাগণ(৫) চিন্তা করিতে লাগিলেন- আমাদের রাজা স্বয়ং পদ্মরূপে ভাবীবুদ্ধকে পূজা করতে গেলেন আমরা কেন যাব না। আমরাও যাব বোধিসত্ত্বকে পূজা করার জন্য। এই ভেবে সকল ব্রহ্মাগণ লুম্বিনী কাননে উপস্থিত হলেন বোধিসত্ত্বকে দেখার জন্য।  তা দেখে স্বর্গে দেবতাগণ (৬) সবাই চিন্তা করতে লাগলেন - ব্রহ্মলোকে সকল পূজনীয়গণ ও আমাদের স্বর্গের মহারাজা দেবরাজইন্দ্র,  চারিলোকপাল দেবরাজগণ  পদ্মরূপে ওনার চরণে গেলেন এবং সবাই মহামানবকে দেখার জন্য লুম্বিনী কাননে উপস্থিত হয়েছেন আমরাও যাব ভাবীবুদ্ধকে দেখার জন্য।  এইভেবে সমস্ত দেবতাগণ লুম্বীনি কাননে বোধিসত্ত্বকে পূজা করার জন্য সমাগত হলেন। শুধু এইচক্রবালের সত্ত্বগণ নয় দশহাজার চক্রবালের সমস্তসত্বগণ লুম্বীনি কাননে উপস্থিত হলেন ভগবান বুদ্ধকে পূঁজা করার জন্য। 


তা দেখে অসুর অধীপতি সহ সমস্ত যক্ষ ও নাগলোকের নাগরাজ সহ সমস্ত নাগগণ (৭)লুম্বীনি কাননে উপস্থিত হলেন ভাবী বুদ্ধকে পূজা করার জন্য। 


তখন বোধিসত্ত্ব সিদ্বার্থ জন্মের পর পায়ে হেঁটে একে একে ৬টি পদ্মফুল পেরিয়ে সর্বশেষ পদ্মরূপী মহাব্রহ্মরাজার উপর দাড়িয়ে জগৎ অবলোকন করতে লাগলেন। প্রথমে তিনি পূর্বদিকে তাকালেন।  তখন পূর্বদিকের সমস্ত দেব- ব্রহ্মগণ, নাগ- যক্ষগণ বলতে লাগলেন -প্রভু এইদিকে আপনার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও জৈষ্ঠ আর কেউ নেই, আপনিই সকলের শ্রেষ্ঠ ও জৈষ্ঠ। তখন তিনি একে একে দক্ষিণ - পশ্চিম - উত্তর দিকে তাকালেন সেই দিকের উপস্থিত সকল দেব- ব্রহ্মাগণ ও নাগ- যক্ষগণ  একই কথা বললেন- প্রভু আপনি সকলের শ্রেষ্ঠ ও জৈষ্ঠ।  আপনার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও জৈষ্ঠ আর কেউ নেই। তারপর মহামানব বুদ্ধ বলেলেন - "এই জগতে আমিই শ্রেষ্ঠ, আমিই জৈষ্ঠ,  এই আমার অন্তিম জন্ম। আমি আর এই জগৎ সংসারে জন্মগ্রহণ করব না। "


তখন ভগবান বুদ্ধের এই বাণী দশহাজার চক্রবালকে প্রকম্পিত করেছিল।  দশহাজার চক্রবালের সমস্ত সত্ত্বগণ সাধুবাদ দিতে লাগলো। দশহাজার চক্রবালের  সমস্ত সত্ত্বগণ পুষ্প দ্বারা ভগবান বুদ্ধকে পূজা করতে লাগলো। তখন পৃথিবীতে পুষ্প বৃষ্টি হতে লাগলো।  আর সেই পুষ্প বৃষ্টিতে ভাবী বুদ্ধ সহ জগতের সকল সত্ত্বগণ প্লাবিত হয়েছিল।


সংগৃহীত :- প্রজ্ঞামিত্র বৌদ্ধ ভিক্ষু শ্রমণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।


সুজাতা কেন বুদ্ধদেবকে পায়েস খাইয়েছিলেন

-----==------------------------------------------------------


বুদ্ধদেব তখন বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হননি ; তিনি তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করতে চাইছেন । তখন তিনি সত্যজ্ঞান লাভের জন্য কঠোর তপস্যায় মগ্ন । দিনের পর দিন মাসের পর মাস কঠোর তপস্যায় , অনিদ্রায় , অনাহারে তাঁর শরীর শীর্ণ শুষ্ক হয়ে গেছে । এই সময় একদিন তিনি নদীতে স্নান করতে গেলেন । স্নান সেরে ফিরে আসার সময় তিনি শারীরিক দুর্বলতার জন্য মুছিত হয়ে পড়লেন । এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন । এক দেবপুরুষ সেতার বাজাচ্ছেন । তাঁর সেতারের তিনটি তার , প্রথম তারটি খুব শক্ত আর খুব টান করে বাঁধা । তৃতীয় তারটি খুব আলতো করে কোনো মতে দুপ্রান্ত বাঁধা আছে , এতে কোনো রকম টান নেই , ঝুলে পড়ে আছে । আর মাঝের তারটি না খুব টান করে বাঁধা , না খুব আলতো করে সুন্দরভাবে সুর দিয়ে বাঁধা । যে দেবপুরুষ সেই সেতার বাজাচ্ছেন । তিনি শুধু মাঝের তারটিতেই মধুর সুর তুলছেন ।


বুদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন , বললেন - বুঝেছি এটাই জীবনের সত্য । আমাদের জীবন সেতারের তারের মতো । কঠোর তপস্যা করেও নয় , চরম ভোগ বিলাসে জবন এলিয়ে দিয়েও নয় , মাঝের পথ বা মধ্যপথ ( মঝঝিম পন্থা ) হল আসল পথ , সত্য লাভের উপায় । তখনি তিনি স্থির করলেন আর চরম কৃচ্ছ ধন নয় , পরিমিত আহার করে তপস্যা করতে হবে । কঙ্কালসার দেহ নিয়ে কিছু কাজ হবে না ।


এসব ভাবতে ভাবতে এক বট গাছের তলায় এসে বসে আছেন , সেই সময় সুজাতা এসেছেন বন দেবতার পূজা দেওয়ার জন্য । পুজোর জন্য তিনি যে পায়েস এনেছিলেন তা তিনি সন্ন্যাসীকে নিবেদন করলেন । সন্ন্যাসী গৌতম সুজাতার দেওয়া সেই পায়েস গ্রহণ করলেন । পায়েস খেয়ে তিনি শরীরে বল পেলেন । তারপর তিনি সেখান থেকে উঠে গিয়ে এক অশ্বথ গাছের তলায় তপস্যা করে সিদ্ধি লাভ করলেন — তিনি বোধি লাভ করে বুদ্ধ হলেন ।


এখন প্রশ্ন হল , সুজাতা কে ছিলেন ? কেনই বা তিনি বুদ্ধদেবকে পায়েস খাইয়েছিলেন ? ঘটনা হল –


নৈরঞ্জনা নদীর তীরে বন আর বনের এক প্রান্তে সেনানী নামে একটি গ্রাম । সেই গ্রামে নন্দিক নামে এক ধনী বণিক ছিলেন , সুজাতা ছিলেন তাঁর স্ত্রী । তাদের কোনো সন্তান ছিল না , তাই তারা ওই বনের বট গাছের তলায় বন - দেবতার কাছে মানত করেছিলেন যে , এঁদের সন্তান হলে তারা দেবতার পুজো দেবেন । তাদের সন্তান হয়েছিল , তাই সুজাতা সেই আনন্দে পূর্ণা নামে এক দাসীকে সঙ্গে নিয়ে দেবতার পুজো দিতে গিয়েছিলেন । আর পুজোর জন্য অন্য উপাচারের সঙ্গে পায়েস নিয়ে গিয়েছিলেন ।


দেবতার স্থানে গিয়ে সুজাতা দেখলেন যে বট গাছের তলায় দেবতার পুজো হয় , সেই গাছের তলায় এক সন্ন্যাসী বসে আছেন । সুজাতার মলে হল ইনি হয়তো সেই দেবতা , সন্ন্যাসীর রূপ ধরে বসে আছেন । সুজাতা পুজোর সেই পায়েস ভক্তি সহকারে সন্ন্যাসীকে নিবেদন করলেন । সন্ন্যাসী সেহ পায়েস গ্রহণ করলেন । আসলে এই পায়েস গ্রহণ তার সাধন পথের পরিবর্তনের সূচক , কঠোর কৃচ্ছ সাধনের পরিবর্তে মধ্যপথ গ্রহণের ইঙ্গিত । এই পায়েস মুছে দিল তার দীর্ঘ ছয় বছরের নিস্ফল কঠোর তপস্যা ।


পায়েস খেয়ে তিনি শরীরে বল পেলেন । সেখান থেকে উঠে তিনি নৈরঞ্জনা নদীর তীর ধরে এগিয়ে চললেন । চলতে চলতে সন্ধ্যা নেমে এল । বৈশাখী পূর্ণিমার শুভ্র আলোকে তিনি এক অশ্বত্থ গাছের তলায় গিয়ে বসলেন । এখানেই তিনি রাতের তৃতীয় প্রহরে বুদ্ধত্ব লাভ করে  ঋষি গৌতম থেকে হলেন প্রভু বুদ্ধদেব ।


বুদ্ধের অন্যতম প্রধান শিষ্য,

 পরিচারক ও সচিব আনন্দ 

----------------------------------»-

সমস্ত প্রধান শিষ্যদের মধ্যে, আনন্দের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুদ্ধের নিকটতম সম্পর্কে। বিশেষত বুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, আনন্দ ছিলেন তাঁর পরিচারক এবং নিকটতম সঙ্গী। বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধের  স্মরণে প্রথম বৌদ্ধ কাউন্সিলের স্মৃতিচিহ্ন শোনাবার শিষ্য হিসাবে আনন্দকেও স্মরণ করা হয়।


আমরা আনন্দ সম্পর্কে কি জানতে পারি? এটি ব্যাপকভাবে সম্মত হয় যে বুদ্ধ ও আনন্দ পরস্পর খুড়তুতো ভাই ছিলেন।


আনন্দের বাবা রাজা শুদ্ধোধনকে একটি ভাই ছিলেন অমিতোদানন্দ ও তাঁর স্ত্রী মৃগী যাঁদের সন্তান আনন্দ । মনে করা হয় যে বুদ্ধ যখন জ্ঞান অর্জনের পর প্রথমবার কপিলাবস্তুতে ফিরে আসেন তখন খুড়তুতো ভাই আনন্দর সঙ্গে কথা বলেন এবং পরে আনন্দ তাঁর শিষ্যত্ব নেন।


যে ছাড়াও, বিভিন্ন দ্বন্দ্বমূলক গল্প আছে। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, ভবিষ্যতে বুদ্ধ এবং তাঁর শিষ্য আনন্দ একই দিনে জন্মগ্রহণ করেন এবং একই বয়স ছিল। অন্যান্য ঐতিহাসিকের কথা হলো আনন্দ এখনও একটি শিশু, সম্ভবত সাত বছর বয়সী, যখন তিনি সংঘে প্রবেশ করেন, যা তাকে বুদ্ধের চেয়ে কমপক্ষে ত্রিশ বৎসর কম করে দিতেন। আনন্দ বুদ্ধ ও অন্যান্য প্রধান শিষ্যদের মধ্যে বেঁচে ছিলেন, যা এই গল্পটির পরবর্তী সংস্করণটি আরো সম্ভাব্য বলে মনে করে।


আনন্দের পরিচিতি ছিল একটি বিনয়ী, শান্ত ব্যক্তি যিনি সম্পূর্ণ বুদ্ধকে অনুগত এবং বুদ্ধদেবের প্রতি সম্পূর্ণ শরণাগত ছিলেন। তাঁর একটি অদ্ভুত স্মৃতি আছে বলা হয়; বুদ্ধের কথাবার্তা কেবলমাত্র একবার করে শুনে পরে সেটি তিনি স্মৃতি থেকে উচ্চারণ করতে পারতেন অর্থাৎ এখনকার পরিভাষায় ফোটোগ্রাফিক মেমোরি ছিল তাঁর ।


এক বিখ্যাত কাহিনী অনুসারে, বুদ্ধদেবকে বৌদ্ধ ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্বুদ্ধ করেন আনন্দ । তবে, বুদ্ধের মৃত্যুর পরেই তিনি অন্যান্য শিষ্যদের কাছ থেকে উপলব্ধি অর্জন করেছিলেন ।


বুদ্ধের পরিচারক


যখন বুদ্ধদেব 55 বছর বয়সী ছিলেন তখন তিনি সংহতিকে একটি নতুন পরিচারক প্রয়োজন বলে জানান।


পরিচারকের কার্য ছিল সে হবে দাস, সচিব, এবং বিশ্বাসী তিনটির সমন্বয়। তিনি বুদ্ধদেবকে শিক্ষার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার জন্য "পোষাকগুলি" যেমন ধৌতকরণ ও পরিচ্ছদ পরিধানের যত্ন নিতেন। তিনি বার্তা প্রেরণ করেন এবং কখনও কখনও দ্বারক হিসাবে কাজ করেন, যাতে বুদ্ধদেবকে একাধিক দর্শক একযোগে আক্রমণ করতে না পারে।


অনেক সন্ন্যাসী আপনার বক্তৃতা এবং চাকরি জন্য নিজেদের মনোনীত করতে চেষ্টা করলেও আনন্দ শান্ত ছিলেন । যখন বুদ্ধদেব তার খুড়তুতো ভাইকে কার্যভার গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন, তখন আনন্দ কেবল শর্তগুলির সাথে মেনে নিলেও তিনি জিজ্ঞাসা করেন যে, বুদ্ধ তাঁকে খাদ্য বা পোশাক বা বিশেষ কোন আবাস প্রদান করতে পারবেন না, যাতে অবস্থানটি বস্তুগত লাভের সাথে যুক্ত হয়ে যায় ।


আনন্দের অনুরোধে বুদ্ধের সঙ্গে তাঁর সন্দেহের কথা বলার সুযোগও চাওয়া হয়েছিল। এবং তিনি অনুমতি চান  যে বুদ্ধদেব তাঁর কাছে যে কোন ধর্মোপদেশ পুনরাবৃত্তি করবেন যাতে তাঁর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। বুদ্ধদেব অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন, তিনি আনন্দের কথায়  সম্মত হন, এবং আনন্দ বুদ্ধের জীবনের বাকি 25 বছরের জন্য পরিচারক হিসেবে কাজ করেন। বুদ্ধদেবের প্রবচন কালীন অনেক প্রবচনের পরিসমাপ্তি বুদ্ধদেব আনন্দকে দিয়ে করাতেন তাঁরই উপস্থিতিতে এবং আনন্দের 

পরিসমাপ্তি সর্বদা গ্রহণযোগ্য ছিল তাঁর কাছে, এতটাই ভরসা তিনি করতেন আনন্দকে। সাধনে আনন্দ অতি উচ্চস্তরে অবস্থান করেও সেটা কখনো প্রকাশ করেননি।


আনন্দ এবং প্রজাপতির নিয়ম


প্রথম বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের সমন্বয়ের গল্প পালি ক্যাননের সবচেয়ে বিতর্কিত অংশগুলির একটি। এই কাহিনীটি আনন্দের বৌদ্ধকে তার সৎমা এবং মাতৃষ্মসা, মহাপ্রজাপতি গৌতমীকে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী বলে মনে করে।


বুদ্ধদেব শেষ পর্যন্ত সম্মত হয়েছিলেন যে, নারীরাও তাদের মুক্তির জন্য এই সংঘে পুরুষদের মত নিযুক্ত  হতে পারবে । কিন্তু তিনি পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে, নারীদের অন্তর্ভুক্তি হবে বৌদ্ধ সংঘের অন্যতম পতনের কারণের একটি ।আনন্দ মনোনীত হওয়া নারীর অধিকারের পক্ষে সমর্থন করেন ।


বুদ্ধের পরিনির্বাণ 


পালি সুপ্ত-পিঠকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলির একটি হলো মহা- পরিবর্ধন সুতার, যা বুদ্ধের শেষ দিন, মৃত্যুর এবং পরিনির্বাণকে বর্ণনা করে। এই সূত্রে আবার এবং আবার আমরা বুদ্ধদেবকে আনন্দের পরিচয় করিয়ে দেখি, তাঁকে পরীক্ষা করে, তাঁকে তাঁর চূড়ান্ত শিক্ষা ও সান্ত্বনা প্রদান করে।


এবং বৌদ্ধরা নির্বাণে তার সাক্ষাৎকারের  সাক্ষী স্বরূপ  তাঁর চারপাশে জড়ো হয়, বৌদ্ধ আনন্দের প্রশংসা করেছেন- "ভিক্ষুগণ [সন্ন্যাসী], আনন্দ সর্বদা আশীর্বাদস্বরূপ,  অতীতেও বারংবার প্রজ্ঞাময় আধ্যাত্মিক জনগোষ্ঠী চমৎকার এবং অনুগত আন্তরিক  ভিক্ষুক [সন্ন্যাসী] ছিলেন। , যেমন আমার আনন্দ আছে। "


আনন্দ এর বুদ্ধত্ব লাভ এবং প্রথম বৌদ্ধ কাউন্সিল বা সাঙ্গিতিকি 


বুদ্ধের মহাপরিনির্বানের  পর 500 জন আলোকপ্রাপ্ত সন্ন্যাসী একসঙ্গে তাদের গুরুর  শিক্ষাগুলি কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছিলেন। বুদ্ধের কোন উপদেশই লেখা হয়নি। উপদেশের স্মৃতি স্মরণ করাই ছিল সম্মানিত পন্থা, কিন্তু যিনি এখনো জ্ঞান অর্জন করতে পারেন নি বা শ্রবণ করেন নি, তিনি কী করে সেগুলো মনন ও স্মরণ করবেন?


বুদ্ধের মৃত্যু পরে আনন্দ অনেক দায়িত্ব পালন করেছিলেন, এবং তিনি এখন ধ্যান করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন। কাউন্সিলের আগে সন্ধ্যায় শুরু হয়, আনন্দ ধ্যানে বসেন জ্ঞান অর্জন করতে এবং বোধি অর্জন করেন। তিনি মহা সাঙ্গীতিকি বা মহা সম্মেলন বা কাউন্সিলে যোগ দেন এবং বুদ্ধের বক্তব্য পাঠ করার আহ্বান জানান।কিন্তু সঙ্গীতিতে গৌতম বুদ্ধের অন্যতম শিষ্য আনন্দের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বিবাদ উপস্থিত হয়। একজন অর্হত না হওয়ায় আনন্দের  অংশগ্রহণের ব্যাপারে মহাকশ্যপের আপত্তি ছিল। তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ আনা হয় বলে বিভিন্ন বৌদ্ধ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছেসংঘে নারীদের প্রবেশের ব্যাপারে  আনন্দের সক্রিয়তা, গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুশয্যায় তাকে জলপান না করানো,  গৌতম বুদ্ধের মৃতদেহে প্রথমে নারীদের স্পর্শ করানো ইত্যাদি অভিযোগের যথাযথ উত্তর দেওয়ায় সন্তুষ্ট ভিক্ষুগণ আনন্দকে  সংগীতিতে যোগদানে অনুমতি প্রদান করেন।সুত্তপিটকের  পাঁচটি নিকায়ের বিভিন্ন বিষয়কে প্রশ্নের আকারে উপস্থিত করা হয়, যার যথাযথ উত্তর আনন্দ দিতে সক্ষম হন, ফলে সুত্তপিটকের অবয়ব তৈরী করা সম্ভব হয়।


পরের কয়েক মাস তিনি পড়তেন এবং সমাবেশে স্মৃতিচারণে বক্তৃতা করতেন এবং মৌখিক পাঠের মাধ্যমে শিক্ষাগুলি সংরক্ষণের জন্য সম্মত হন। আনন্দকে "ধর্মাচরণের রাখালের দোকান" বলা হয়।


বলা হয় আনন্দ একশো বছর বয়স মতান্তরে আশি বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন ।  আনন্দর এক শিষ্য তাঁর কাছ থেকে শেখা বুদ্ধদেবের কোনো বাণী যথাযথ না বলতে পারায় তিনি বলেন যে আনন্দর বয়স হয়ে গেছে, তিনি এখন আর আগের মত স্মরণ করতে পারেননা, এই কথা জেনে আনন্দ দেহত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর বুদ্ধদেবের স্মৃতির কিছু কিছু তিনি তাঁর শিষ্য সনবসি ও মাঝঝান্তিকার মধ্যে দান করেন, তারপর তিনি বৈশালীতে যান। তিনি রাজা অজাতশত্রুকে কোনো একসময় কথা দিয়েছিলেন যে তাঁর নির্বাণের সময় তিনি তাকে জানাবেন। সেই মত আনন্দ যখন রোহিনী (মতান্তরে গঙ্গা ) নদীর মাঝামাঝি পৌঁছন তখন দেখেন যে রোহিনী নদীর একদিকের তীরে অজাতশত্রু দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর দেহত্যাগের সাক্ষী হতে আর আরেকদিকে দাঁড়িয়ে আছেন লিচ্ছবি ও কোলীয়রা যাদের তিনি বংশে জন্মেছিলেন, তিনি বুঝতে পারেন যে যেকোনো তীরেই তিনি দেহত্যাগ করুন না কেন, তাঁর দেহের পারলৌকিক ক্রিয়া নিয়ে বিবাদ অবশ্যম্ভাবি, তাই তিনি যোগবলে রোহিনী নদীর মাঝখানে ধ্যানযোগে ব্রহ্মলীন হন এবং তাঁর দেহ বাতাসেই অগ্নিসংযোগ হয়ে দুটো অংশে ভাগ হয়ে যায়, একটি ভাগের ওপরে রাজা অজাতশত্রু স্তুপ নির্মাণ করেন, আরেকটি অংশের ওপরে লিচ্ছবিরাও স্তুপ নির্মাণ করেন, পরে সম্রাট অশোক এই স্তুপগুলোতে তাঁর প্রভূত সম্পদ দান করেন।পঞ্চম শতাব্দীতে, একটি চীনা তীর্থযাত্রী আনন্দ এর অবশেষ ধারণকারী  স্তূপ  খুঁজে পান, এক বৌদ্ধ ভিক্ষুণীর চেষ্টায় । তার জীবন, ভক্তি এবং সেবা পথ একটি আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হয় ।


চলবে.....


: মহাশ্রমণ চরিত কথা ২

✍️পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

©কপিরাইট সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত


বুদ্ধদেবের জীবনের ও বৌদ্ধবিহারের কিছু ঘটনা

=================================


গৌতম বুদ্ধ (পালি: গোতম) বা শাক্যমুনি বুদ্ধ হলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা। জন্মের পর তাঁর নাম ছিল সিদ্ধার্থ গৌতম। আধ্যাত্মিক সাধনা ও জীবন নিয়ে নিজস্ব জ্ঞান-উপলব্ধির পর তিনি বুদ্ধ নামটি গ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম ৬২৩ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ এবং মহাপরিনির্বাণ সাল ৫৪৩ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ।


 প্রধান ক্ষত্রিয় বংশের শুদ্ধোধনের পুত্র ছিলেন তিনি । তার মাতা মায়াদেবী কোলিয় গণের রাজকন্যা ছিলেন। সিদ্ধার্থ গর্ভে থাকাকালীন গৌতম বুদ্ধের মা সাদা হাতি ও পদ্ম ফুলের স্বপ্ন দেখেন ।শাক্যদের প্রথা অনুসারে গর্ভাবস্থায় মায়াদেবী শ্বশুরালয় কপিলাবস্তু থেকে পিতৃরাজ্যে যাবার পথে অধুনা নেপালের তরাই অঞ্চলেরে অন্তর্গত লুম্বিনী গ্রামে এক শালগাছের তলায় সিদ্ধার্থের জন্ম দেন। তার জন্মের সময় বা সপ্তম দিনে মায়াদেবীর জীবনাবসান হয়।শুদ্ধোধনের  কুল -পুরোহিত জানান বুদ্ধ - এর  মধ্যে 32 টি মহাপুরুষের লক্ষণ আছে এবং 80 টি অন্যান্য লক্ষণ আছে । শুদ্ধোধন শিশুর জন্মের পঞ্চম দিনে নামকরণের জন্য আটজন ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ জানালে তারা শিশুর নাম রাখেন সিদ্ধার্থ অর্থাৎ যিনি সিদ্ধিলাভ করেছেন।এই সময় পর্বতদেশ থেকে আগত অসিত নাম একজন সাধু নবজাত শিশুকে দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে এই শিশু পরবর্তীকালে একজন রাজচক্রবর্তী অথবা একজন সিদ্ধ সাধক হবেন। একমাত্র সর্বকনিষ্ঠ আমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ  কৌণ্ডিন্য  স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, এই শিশু পরবর্তীকালে বুদ্ধত্ব লাভ করবেন।মাতার মৃত্যুর পর তিনি বিমাতা  মহাপজাপতি গোতমী কর্তৃক লালিত হন।ষোলো বছর বয়সে তাকে সংসারের প্রতি মনোযোগী করার জন্য তার পিতামাতা তাকে কোলিয় গণের সুন্দরী কন্যা যশোধরার সাথে বিবাহ দেন ও রাহুল নামক এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন।


রাহুল (জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব: ৫১১ ) ছিলেন বৌদ্ধ  ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের একমাত্র পুত্র পালি এবং সংস্কৃত ভাষা অনুসারে রাহুল শব্দটি  রাহুলা শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ বন্ধন। তার মায়ের নাম যশোধরা বা গোপা দেবী। তার বয়স যখন মাত্র ৭ দিন তখন তার পিতা সিদ্ধার্থ গৌতম সংসার ত্যাগ করেন। বিশ বছর বয়সে তার পিতা গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধিত্ত্ব অর্জন করে রাজধানী কপিলাবস্তু-তে ফিরে আসলে তিনি পিতার কাছ থেকে দীক্ষিত হয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু তে পরিণত হন। এর পর তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুক হয়ে রাজত্ব করেন এবং রোজ ভিক্ষুক এর মত থাকতেন , খাবার খেতেন এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য অনেক কিছু করেছিলেন। বৌদ্ধরা তা‌কে ভ্রাতা রাহুল‌ ব‌লে স‌ম্বোধন ক‌রে।


সিদ্ধার্থ তার জীবনের প্রথম উনত্রিশ বছর রাজপুত্র হিসেবে অতিবাহিত করেন। বৌদ্ধ পুঁথিগুলি অনুসারে পিতা শুদ্ধোধন তার জীবনে বিলাসিতার সমস্ত রকম ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও সিদ্ধার্থ বস্তুগত ঐশ্বর্য্য যে জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না, তা উপলব্ধি করা শুরু করেন। কথিত আছে, উনত্রিশ বছর বয়সে রাজকুমার সিদ্ধার্থ প্রাসাদ থেকে কয়েকবার ভ্রমণে বেরোলে তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ, একজন অসুস্থ মানুষ, একজন মৃত মানুষ ও একজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পান। সাংসারিক দুঃখ কষ্টে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ সিদ্ধার্থ তার সারথি ছন্নকে  এঁদের প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে, ছন্ন তাকে বুঝিয়ে বলেন যে সকল মানুষের নিয়তি যে তারা একসময় বৃদ্ধ, অসুস্থ হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হবে। মুণ্ডিতমস্তক পীতবর্ণের জীর্ণ বাস পরিহিত সন্ন্যাসী সম্বন্ধে ছন্ন  তাকে বলেন, যে তিনি মানুষের দুঃখের জন্য নিজ গার্হস্থ্য জীবন ত্যাগ করেছেন, তিনিই সন্ন্যাসী। এই নূতন অভিজ্ঞতায় বিষাদগ্রস্ত সিদ্ধার্থ বাধর্ক্য, জরা ও মৃত্যুকে জয় করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে একজন সন্ন্যাসীর জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নেন।সংসারের প্রতি বীতরাগ সিদ্ধার্থ এক রাত্রে ঘুমন্ত গৌতম বুদ্ধের ঘোড়ার নাম কন্থক। এই কন্থক তাঁর খুব প্রিয় ছিল ।স্ত্রী, পুত্র, পরিবারকে নিঃশব্দ বিদায় জানিয়ে প্রিয় অশ্ব কন্থক ও সারথি ছন্নকে নিয়ে প্রাসাদ ত্যাগ করেন। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে বনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে রাজবস্ত্র ত্যাগ করে তলোয়ার দিয়ে তার লম্বা চুল কেটে মুণ্ডিতমস্তক হন।এরপর কন্থক ও  ছন্নকে বিদায় জানিয়ে  রাজগৃহের  উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

=================================

সিদ্ধার্থ সারথি ছন্ন সম্পর্কে 

************************

ছন্ন (পালি: छन्न) বা ছন্দক (সংস্কৃত: छन्दक) সিদ্ধার্থ গৌতমের সারথি ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি বৌদ্ধ সংঘে যোগদান করে অর্হত হন।


ছন্ন শাক্য প্রজাতন্ত্রের প্রধান শুদ্ধোধনের একজন পরিচারিকার পুত্র ছিলেন। প্রথম জীবনে দুঃখ ও কষ্ট থেকে দূরে প্রাসাদের বিলাসপূর্ণ জীবনযাপনের পর উনত্রিশ বছর বয়সে শুদ্ধোধনের পুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম তার সারথি ছন্নকে নিয়ে প্রাসাদ থেকে প্রথমবার ভ্রমণে বেরোন।পথে তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ, একজন অসুস্থ মানুষ, একজন মৃত মানুষ ও একজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পান।সাংসারিক দুঃখ কষ্টে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ সিদ্ধার্থ তার সারথি ছন্নকে এঁদের প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে, ছন্ন তাকে বুঝিয়ে বলেন যে সকল মানুষের নিয়তি যে তারা একসময় বৃদ্ধ, অসুস্থ হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হবে।মুণ্ডিতমস্তক পীতবর্ণের জীর্ণ বাস পরিহিত সন্ন্যাসী সম্বন্ধে ছন্ন তাকে বলেন, যে তিনি মানুষের দুঃখের জন্য নিজ গার্হস্থ্য জীবন ত্যাগ করেছেন, তিনিই সন্ন্যাসী।এই নূতন অভিজ্ঞতায়  বিষাদগ্রস্ত সিদ্ধার্থ বাধর্ক্য, জরা ও মৃত্যুকে জয় করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে একজন সন্ন্যাসীর জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নেন। সংসারের প্রতি বীতরাগ সিদ্ধার্থ এক রাত্রে ঘুমন্ত স্ত্রী, নবজাত পুত্র, পরিবারকে নিঃশব্দ বিদায় জানিয়ে প্রিয় অশ্ব কন্থক ও সারথি ছন্নকে নিয়ে প্রাসাদ ত্যাগ করেন। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে বনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে রাজবস্ত্র ত্যাগ করে তলোয়ার দিয়ে তার লম্বা চুল কেটে মুণ্ডিতমস্তক হন। এরপর ছন্নের অনুরোধকে উপেক্ষা করে তাকে বিদায় জানিয়ে  সিদ্ধার্থ রাজগৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।ছন্ন সিদ্ধার্থের অলঙ্কার ও রাজনস্ত্র নিয়ে  কপিলাবস্তু  ফিরে এলে উদ্বিগ্ন শুদ্ধোধন  সিদ্ধার্থের খোঁজে সৈন্য পাঠাতে চাইলে ছন্ন সিদ্ধার্থের স্থির প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করে তাকে বারণ করেন।


ছন্নের ভিক্ষু জীবন 


পরবর্তীকালে সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করে শুদ্ধোধনের আমন্ত্রণে কপিলাবস্তু শহরে এলে ছন্ন তাকে অনুসরণ করে সংসার ত্যাগ করে সংঘজীবনে যোগ দেন। কিন্তু পূর্বজীবনে গৌতম বুদ্ধের প্রিয়পাত্র হওয়ায় তিনি ভিক্ষুজীবনে তার অহঙ্কার ত্যাগ করতে অসমর্থ হন। কোশাম্বী রাজ্যের ঘোষিতাশ্রমে তিনি একটি অপরাধ করে অস্বীকার করায় গৌতম বুদ্ধ উখ্খেপনিয়-কম্ম আরোপ করে তার সংঘজীবনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পরে ছন্ন তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাকে সংঘ জীবনে ফিরিয়ে আনা হয়। ধম্মপদত্থকথা অনুসারে, গৌতম বুদ্ধের বারংবার সাবধানবাণী সত্ত্বেও সারিপুত্ত ও মোগ্গলনের সঙ্গে ছন্ন দুর্ব্যবহার করার কারণে গৌতম বুদ্ধ ছন্নের জন্য ব্রহ্মদণ্ড নামক নৈতিক শাস্তি করার জন্য আনন্দকে নির্দেশ দেন। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি আহ্বান করা হলে, সেখানে ছন্নের ওপর ব্রহ্মদণ্ড আরোপ করে তাকে সংঘ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই সংবাদে ছন্ন অনুতপ্ত হয়ে অর্হত হিসেবে গণ্য হন।

-----------------------------------------------------------------

প্রথমে সিদ্ধার্থ আলার কালাম নামক একজন সন্ন্যাসীর নিকট যোগ শিক্ষা করেন যিনি ছিলেন সাংখ্য দর্শনের অনুসারী ।কিন্তু তার প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর লাভ না করায় এরপর তিনি উদ্দক রামপুত্ত নামক অপর একজন সন্ন্যাসীর নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করে যোগশিক্ষা লাভ করেন।কিন্তু এখানেও তার জিজ্ঞাসা পূরণ না হওয়ায় তিনি তাকে ত্যাগ করে বুদ্ধগয়ার নিকট উরুবিল্ব নামক একটি রম্য স্থানে গমন করেন।


শরীরকে অপরিসীম কষ্ট প্রদানের মাধ্যমে মুক্তিলাভ হয় এই বিশ্বাসে তিনি ও অন্য পাঁচজন তপস্বী ছয় বছর ধরে অনশন, শারীরিক নিপীড়ন ও কঠোর সাধনায় অতিবাহিত করেন। দীর্ঘকাল ধরে কঠোর তপস্যার পর তার শরীর অস্থিচর্মসার হয়ে পড়ে ও তার অঙ্গসঞ্চালনের ক্ষমতা কমে গিয়ে তিনি মরণাপন্ন হলে তার উপলব্ধি হয় যে, অনশনক্লিষ্ট দুর্বল দেহে শরীরকে অপরিসীম কষ্ট দিয়ে কঠোর তপস্যা করে বোধিলাভ সম্ভব নয়। ধর্মচক্রপ্রবর্তন সূত্রানুসারে, অসংযত বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং কঠোর তপস্যার মধ্যবর্তী একটি মধ্যম পথের সন্ধান করে বোধিলাভ সম্ভব বলে তিনি উপলব্ধি করেন।তিনি তাই আবার খাদ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন ও সুজাতা নাম্নী এক স্থানীয় গ্রাম্য কন্যার কাছ থেকে তিনি এক পাত্র পরমান্ন আহার করেন।( সুজাতার কথা বিস্তারিত আগেই বর্ণিত হয়েছে )সিদ্ধার্থকে খাদ্য গ্রহণ করতে দেখে তার পাঁচজন সঙ্গী তার ওপর বিরক্ত হয়ে তাকে ছেড়ে চলে যান।বুদ্ধ  যেখানে ধ্যানে বসে ছিলেন সেটি নৈরঞ্জনা নদীর তীরে। নৈরঞ্জনা নদীর বর্তমান নাম ফল্গু (Falgu)।


এই ঘটনার পরে একটি অশ্বত্থ গাছের তলায় তিনি ধ্যানে বসেন এবং সত্যলাভ না করে স্থানত্যাগ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেন।উনপঞ্চাশ দিন ধরে ধ্যান করার পর তিনি বোধি প্রাপ্ত হন।দিব্যজ্ঞান বা বুদ্ধত্ব অর্জন করার পর তাঁর নাম হয় বুদ্ধ বা তথাগত বা পরম জ্ঞানী। বুদ্ধ শব্দের অর্থ হল যিনি পরম শাশ্বত বোধ বা জ্ঞান লাভ করেছেন ।বুদ্ধত্ব অর্জন করার পর গৌতম বুদ্ধ আরো সাত সপ্তাহ বোধিবৃক্ষের তলায় উপবেশন করে তাঁর নবলব্ধ জ্ঞান সম্পর্কে চিন্তাশীল ছিলেন ।এই সময় তিনি মানব জীবনে দুঃখ ও তার কারণ এবং দুঃখ নিবারণের উপায় সম্বন্ধে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন, যা চতুরার্য সত্য  বা Four Noble Truths নামে খ্যাত হয়।তার মতে এই সত্য সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করলে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ সম্ভব।


বোধিলাভের পর গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে তপুস্স ও ভল্লিক নামক বলখ অঞ্চলের দুইজন ব্যবসায়ীর সাক্ষাত হহয়, যারা তাকে মধু ও বার্লি নিবেদন করেন। এই দুইজন বুদ্ধের প্রথম সাধারণ শিষ্য। বুদ্ধ তার প্রাক্তন শিক্ষক আলার কালাম ও উদ্দক রামপুত্তের সাথে সাক্ষাত করে তার নবলব্ধ জ্ঞানের কথা আলোচনার জন্য উৎসাহী ছিলেন, কিন্তু তাদের দুইজনেরই ততদিনে জীবনাবসান হয়ে গেছিল। এরপর তিনি বারাণসীর নিকট  ঋষিপতনের মৃগদাব উদ্যানে যাত্রা করে তার সাধনার সময়ের পাঁচ প্রাক্তন সঙ্গী, যারা তাকে একসময় পরিত্যাগ করেছিলেন, তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন ও তাদেরকে তার প্রথম শিক্ষা প্রদান করেন, যা বৌদ্ধ ঐতিহ্যে ধর্মচক্রপ্রবর্তন  নামে  খ্যাত। এইভাবে তাদের নিয়ে ইতিহাসের প্রথম বৌদ্ধ সংঘ গঠিত হয়।যশ নামে এক ধনী বণিক ও তার পিতা হল  গৌতম বুদ্ধের প্রথম গৃহী শিষ্য ।যশের স্ত্রী ও মা দুজনেই বুদ্ধের প্রথম উপাসিকা।


এরপর মহাকশ্যপ নামক এক অগ্নি-উপাসক ব্রাহ্মণ ও তার অনুগামীরা সংঘে যোগদান করেন। বুদ্ধ সম্রাট বিম্বিসারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিমতো বুদ্ধত্ব লাভের পরে রাজগৃহ যাত্রা করলে সঞ্জয় বেলাঢ্বিপুত্তের দুইজন শিষ্য সারিপুত্ত ও  মৌদ্গল্যায়ন  সংঘে যোগদান করেন।


বুদ্ধত্ব লাভের এক বছর পরে শুদ্ধোধন তার পুত্রকে কপিলাবস্তু শহরে আমন্ত্রণ জানান। একদা রাজপুত্র  গৌতম রাজধানীতে সংঘের সাথে ভিক্ষা করে খাদ্য সংগ্রহ করেন। কপিলাবস্তুতে তার পুত্র রাহুল তার নিকট শ্রমণের দীক্ষাগ্রহণ করেন। এছাড়া আনন্দ ও অনুরুদ্ধ নামক তার দুইজন আত্মীয় তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। (আনন্দ সম্পর্কে বিস্তারিত আগেই বলা হয়েছে)


মহাকশ্যপ, সারিপুত্ত, মৌদ্গল্যায়ন, আনন্দ, 

অনুরুদ্ধ ও রাহুল ছাড়াও উপালি, মহাকাত্যায়ন,পুণ্ণও সুভূতি বুদ্ধের দশজন প্রধান শিষ্য ছিলেন।


তিন বছর পরে রোহিণী নদীর জলের অংশ নিয়ে শাক্যদের সাথে কোলীয় গণের একটি বিবাদ উপস্থিত হলে বুদ্ধ সেই বিবাদের মীমাংসা করেন। এর কয়েকদিনের মধ্যে শুদ্ধোধন মৃত্যুবরণ করলে গৌতম বুদ্ধের বিমাতা মহাপজাপতি গোতমী সংঘে যোগদানে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। গৌতম প্রথমে নারীদের সংঘে যোগদানের ব্যাপারে অমত প্রকাশ করলেও আনন্দের উৎসাহে তিনি সংঘ গঠনের পাঁচ বছর পরে সংঘে নারীদের ভিক্ষুণী হিসেবে প্রবেশের অনুমতি দেন।


উত্তর ভারতের বারাণসীর বর্তমান হরিণ-পার্ক বা মৃগদাব নামক জায়গাটিতে বৌদ্ধ তাঁর পাঁচ-সঙ্গীকে প্রথম ধর্মদেশনা প্রদান করেছিল। বুদ্ধ সহ তাঁর এই পাঁচ সন্ন্যাস সহচর মিলে প্রথম সংঘ (ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীদের দ্বারা গঠিত সম্প্রদায়) গঠন করেন। বিভিন্ন বৌদ্ধ-গ্রন্থ অনুযায়ী,প্রাথমিক অনিচ্ছা থাকার সত্ত্বেও গৌতম বুদ্ধ পরে সন্ন্যাসীনিদেরও সংঘের আওতাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীনিদের "ভিক্ষুণী" হিসেবে অভিহিত করা হয়।বুদ্ধের মাসি এবং তাঁর সৎ-মা  মহাপজাপতি  গোতমী ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রথম ভিক্ষুণী। খৃষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দিতে তিনি ভিক্ষুণী হিসেবে সন্ন্যাস পদ গ্রহণ করেন।


জানা যায়, বুদ্ধ তাঁর অবশিষ্ট জীবনের বছরগুলোতে ভারতের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলগুলোতে পরিভ্রমণ করেন।

গৌতম বুদ্ধ যে স্থানগুলিতে ধর্ম প্রচার করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— রাজগৃহ ,দক্ষিণাগিরি, শ্রাবস্তী, কপিলাবস্তু, বৈশালী ,বারানসী , চম্পা ,পাবা, কুশিনগর ইত্যাদি।তিনি সর্বাধিক সময় বাস করেন কোশলের  রাজধানী শ্রাবস্তীতে – দীর্ঘ 21 বছর।মগধ রাজ বিম্বিসার গৌতম বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নেন।যে সমস্ত বিখ্যাত রাজারা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন তাদের নামগুলো  হল বিম্বিসার, অজাতশত্রু, প্রসেনজিৎ, উদয়ন, প্রদ্যোত, অশোক, দশরথ, ইন্দো গ্রিক শাসক মিলিন্দ বা মিনান্দার,  কুষাণ রাজা কনিষ্ক, বর্ধন রাজ হর্ষবর্ধন, পাল রাজা গোপাল, ধর্মপাল ও রামপাল।


গৌতম বুদ্ধ তাঁর পিতা শুদ্ধোধন, পালিতা মা  মহাপ্রজাপতি গৌতমী, স্ত্রী যশোধরা, পুত্র রাহুল  ও ঘনিষ্ঠ দেবদত্ত কে দীক্ষা দিয়েছিলেন ।গৌতম বুদ্ধের শিষ্যা বিশাখা সন্ন্যাসিনী দের জন্য পুব্বারাম নামে একটি বৌদ্ধমঠ তৈরি করে দিয়েছিলন ।বৈশালীর বিখ্যাত বারাঙ্গনা আম্রপালি বৌদ্ধসংঘে তাঁর বিখ্যাত আম্রকুঞ্জ দান করেছিলেন।


মহাপরিনিব্বাণ সুত্ত অনুসারে গৌতম বুদ্ধের বয়স যখন আশি বছর, তখন তিনি তার আসন্ন মৃত্যুর কথা ঘোষণা করেন। পওয়া নামক একটি স্থানে অবস্থান করার সময় চণ্ড নামক এক কামার তাকে ভাত ও শূকরমদ্দভ ইত্যাদি খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। এই খাবার খাওয়ার পরে গৌতম আমাশয়  দ্বারা আক্রান্ত হন। চণ্ডের দেওয়া খাবার যে তার মৃত্যু কারণ নয়, আনন্দ যাতে তা চণ্ডকে বোঝান, সেই ব্যাপারে বুদ্ধ নির্দেশ দেন।


এরপর আনন্দের আপত্তি সত্ত্বেও অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় তিনি কুশীনগর যাত্রা করেন। এইখানে তিনি আনন্দকে নির্দেশ দেন যাতে দুইটি শাল বৃক্ষের মধ্যের একটি জমিতে একটি কাপড় বিছিয়ে তাকে যেন শুইয়ে দেওয়া হয়। এরপর শায়িত অবস্থায় বুদ্ধ উপস্থিত সকল ভিক্ষু ও সাধারণ মানুষকে তার শেষ উপদেশ প্রদান করেন। তার অন্তিম বাণী ছিল “বয়ধম্মা সঙ্খারা অপ্পমাদেন সম্পাদেথা”, অর্থাৎ “সকল জাগতিক বস্তুর বিনাশ আছে। অধ্যবসায়ের সাথে আপনার মুক্তির জন্য সংগ্রাম কর।”বুদ্ধ কুশীনগরের  পরিত্যাক্ত এক জঙ্গলে দেহত্যাগ বা মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। মারা যাওয়ার পূর্বে বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের বলে গিয়েছিলেন যে, তাঁর প্রচার করা ধর্মীয়দেশনাই  হবে তাদের শাস্তা যা তাদের দিক-নির্দেশনা প্রদানে সহায়তা করবে। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর হতে বুদ্ধবাণীকে সংরক্ষণের জন্য শত শত অহরত পণ্ডিত ভিক্ষু তিনটি সঙ্গায়নের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক সংকলিত হয়েছে।


বৌদ্ধ ধর্ম পূর্বে গাঙ্গেয় উপত্যকায় কেন্দ্রীভূত থাকলেও পরে এই প্রাচীন ভূ-খন্ড থেকে বৌদ্ধ ধর্ম অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধ ধর্মের ধর্মীয় শাস্ত্রের উৎসগুলো দুইটি ধর্মীয় মহাসঙ্গীতি সংরক্ষণ করেন, যার একটি হলো বুদ্ধের পাঠগত শিক্ষা সংরক্ষণের জন্য সন্ন্যাসী সংঘ ও আরেকটি হলো সংঘের অভ্যন্তরীণ নিয়মানুবর্তিতামুলক সমস্যাগুলো সমাধানের উপায়সমূহ।


বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী  বুদ্ধের জন্মের প্রতীক হল Lotus and বুলেট বা পদ্ম ও ষন্ড।বৌদ্ধধর্ম  অনুযায়ী গৃহ পরিত্যাগ বা মহাভিনিষ্ক্রমণ  এর প্রতীক হল Horse বা অশ্ব।বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী নির্বাণ লাভের প্রতীক হল Bodhi Tree.বা বোধি বৃক্ষ।বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী  প্রথম ধর্ম প্রচার বা  ধর্মচক্রপ্রবর্তন এর প্রতীক হল Wheel বা ধর্মচক্র।বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী মহাপরিনির্বাণ এর প্রতীক  হল Stupa বা স্তুপ।বৌদ্ধ ধর্মে স্তুপ এর অর্থ হল যেখানে বুদ্ধ বা বিখ্যাত বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের অবশেষ  সংরক্ষিত করা  হয় ।এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ কে বৌদ্ধধর্মে “চারিকা” বলে।বৌদ্ধ ধর্মে চৈত্য মানে যেখানে প্রার্থনা করা হয়।আর্যসত্য বৌদ্ধধর্ম এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বৌদ্ধধর্ম  চারটি মহান সত্যের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে, এগুলিকে আর্যসত্য বলে ।আর্যসত্য চারটি। এগুলি হল- দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখের নিরোধ ও দুঃখ নিরোধগামী মার্গ ।অষ্টাঙ্গিক মার্গ এর প্রবর্তক হলেন গৌতম বুদ্ধ। বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী দুঃখের বিনাশের জন্য গৌতম বুদ্ধ আটটি পথের কথা বলেছেন যাকে  অষ্ট মার্গ বা অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলে।অষ্টাঙ্গিক মার্গ গুলি হল – সৎ বাক্য ,সৎ কার্য, সৎ জীবন, সৎ চেষ্টা, সৎ চিন্তা, সৎ সংকল্প, সৎ দৃষ্টি ও  সৎ সমাধি।গৌতম বুদ্ধ যে পথ অবলম্বন করেছিলেন তার নাম “মঝঝিম পন্থা” বা মধ্যপন্থা বা মধ্যপথ। তিনি চরম ভোগ বিলাস ও চরম কৃচ্ছসাধনের মধ্যবর্তী পথের কথা বলেছেন।বৌদ্ধধর্ম মতে দুঃখের আসল কারণ  Desire বা চাহিদা।বৌদ্ধধর্ম অনুসারে মানুষের আসল লক্ষ্য হল নির্বাণ লাভ করা ।বৌদ্ধধর্ম অনুসারে মানুষের আসল লক্ষ্য হল নির্বাণ লাভ করা ।বৌদ্ধধর্মে  প্রজ্ঞা মানে পরম জ্ঞান বা অন্তর্দৃষ্টি।বৌদ্ধধর্মে গৌতম বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘ এই তিনটি ত্রিরত্ন নামে পরিচিত।


পঞ্চশীল নীতি বৌদ্ধধর্মের অংশ। বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী গৌতম বুদ্ধ পাঁচটি মূলনীতিকে মেনে চলতে বলেছেন  যা পঞ্চশীল নামে পরিচিত।


এগুলি হল চুরি না করা, মিথ্যা কথা না, ব্যভিচারী না হওয়া, অহিংস নীতি গ্রহণ করা ও অন্যায় না করা।


বৌদ্ধধর্মে জ্ঞানের  সাত উৎস – স্মৃতি, কৌতুহল,  কর্মশক্তি, আনন্দ, প্রশান্তি, ধ্যান ও  সুষমাবোধ ।বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী পূন্যার্জনের   চারটি সহজ উপায় হল-  ঔদার্য, দানশীলতা,সহযোগিতা ও সেবা ।গৌতম বুদ্ধ শান্তি পাবার জন্য চারটি ভাব অর্জন করার কথা বলেছেন -মৈত্রী,করুণা ,মুদিতা ও উপেক্ষা।


১ম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি (খৃষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দি)


প্রথম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি গঠিত হয় বুদ্ধের পরিনির্বাণ লাভের পর অর্থাৎ বুদ্ধের দেহত্যাগের পর। খৃষ্ট-পূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দিতে মহাকাশ্যপ নামক বুদ্ধের একজন কাছের শিষ্যের তত্ত্বাবধানে এবং রাজা অজাতশত্রুর সমর্থনে এই প্রথম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি গঠিত হয়। এই মহাসঙ্গীতি গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধের মুখ-নিঃসৃত বাণীগুলোকে মতবাদ-সংক্রান্ত শিক্ষায় (তথা সূত্রে) এবং অভিধর্মে রূপান্ততরিত করা এবং বৌদ্ধের সন্ন্যাসগত নিয়ামাবলীকে লিপিবদ্ধ করা। এই মহাসঙ্গীতি বৌদ্ধের খুড়তুতো ভাই এবং তাঁর প্রধান শিষ্য আনন্দকে ডাকা হয় বুদ্ধের উপদেশ এবং অভিধর্ম আবৃত্তি করার জন্য এবং বুদ্ধের আরেক প্রধান শিষ্য উপালি কে বলা হয় বিনয়ের সূত্রসমূহ পাঠ করার জন্য। এগুলোই মূলত ত্রিপিটকের মূল ভিত্তি হিসেবে পরিচয় লাভ পায় যেগুলো পালি ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়।


ত্রিপিটক বৌদ্ধ ধর্মীয় পালি গ্রন্থের নাম। পালি তি-পিটক হতে বাংলায় ত্রিপিটক শব্দের প্রচলন। তিন পিটকের সমন্বিত সমাহারকে ত্রিপিটক বোঝানো হচ্ছে। এই তিনটি পিটক হলো বিনয় পিটক, সুত্র পিটক ও অভিধর্ম পিটক। পিটক শব্দটি পালি এর অর্থ - ঝুড়ি, পাত্র, বক্স ইত্যাদি।অরিজিনাল লেখাগুলি লেখা হয়েছিল তাল পাতার উপর এবং রাখা হয়েছিল একটি ঝুড়িতে তাই গ্রন্থগুলোকে বলা হয় ত্রিপিটক।ত্রিপিটক গুলি রচিত হয় পালি ভাষায়।প্রথম বৌদ্ধ সম্মেলনে সুত্তপিটক ও বিনয় পিটক পুস্তকাকারে প্রকাশ পায় ।সুত্ত পিটক সংকলন করেন আনন্দ।বিনয় পিটক সংকলন করেন  উপালি ।সুত্ত পিটক এর বিষয়বস্তু হল বুদ্ধের উপদেশাবলী ।বিনয় পিটক এর বিষয়বস্তু হল বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী দের পালনীয় বিধি এবং সংঘের নিয়মাবলী।


ইতিহাসে এরকম এই পর্যন্ত ছয়টি সঙ্গায়ন হয়েছে। প্রথম সঙ্গায়ন হয়েছিল বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর রাজা অজাতশত্রু'র পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতের  সপ্তপর্ণী গুহায়। দ্বিতীয়টি হয়েছিল বৈশালীতে  কালাশোকের পৃষ্ঠপোষকতায়। তৃতীয়টি হয়েছিল  সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় যেখানে অভিধর্ম পিটক প্রথম আলোচিত হয় । অভিধর্ম পিটকে বৌদ্ধদের দার্শনিক তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে।এভাবে বড় বড় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ত্রিপিটক বুদ্ধবচন  সংরক্ষিত হয়ে আসছে।তৃতীয় বৌদ্ধ সম্মেলনে ভিক্ষুদের মধ্যে একতা বজায় রাখার কথা বলা হয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ধর্মপ্রচারের কথা বলা হয়।সম্রাট অশোক ধর্ম প্রচারের জন্য নিজের পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সঙ্ঘমিত্রাকে শ্রীলংকা পাঠান ।


চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলন হয় 98 খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীরের কুন্দলা বনে।চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন বসুমিত্র ও সহ-সভাপতি ছিলেন অশ্বঘোষ ।চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলনের  পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কুষানরাজ কনিষ্ক।চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলনে  সংকলিত হয় মহাভিভাষা শাস্ত্র  যা ত্রিপিটকের সংস্কৃত রূপ যা রচনা করেন সভাপতি বসুমিত্র। কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের সভাকবি অশ্ব ঘোষ এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য হল-  বুদ্ধ চরিত, সারিপুত্র প্রকরণ, সৌন্দরানন্দ, বজ্রসূচী, ও সূত্রালঙ্কার। সব বই গুলিই সংস্কৃত ভাষায় লেখা।চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলন এর সভাপতি বসুমিত্রের  লেখা বিখ্যাত বইয়ের নাম হল মহাবিভাষা শাস্ত্র যা সংস্কৃত ভাষায় লেখা।এই সম্মেলনে বৌদ্ধরা হীনযান ও মহাযান  নামে দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়।হীনযানরা পালিভাষাকে পছন্দ করে।হীনযানরা মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করে না।হীনযানেরা গৌতম বুদ্ধের আসল টিচিং অনুসরণকারী। হীনযানেরা Southern Buddhist Religion নামে পরিচিত কারণ ইন্ডিয়ার দক্ষিণে Sri Lanka, Burma (Myanmar ), Shyam( Thailand ), Java  ইত্যাদি স্থানের লোকেরা হীনযান মত অনুসরণকারী।হীনযানদের দুটি শাখা ছিল- বৈভাষিক (Vaibhasika) ও সৌতান্তিক বা সৌতান্ত্রিক (Soutantrika)।


মহাযানরা বুদ্ধকে  ভগবান বলে বিশ্বাস করত।মহাযানরা সংস্কৃত ভাষাকে পছন্দ করে।মহাযানেরা Northern Buddhist Religion নামে পরিচিত। কারন  চীন, কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশে এদের প্রভাব বেশি ।মহাযানদের ও দুটি শাখা ছিল-মাধ্যমিক ও যোগাচার।মাধ্যমিক বা শূন্যবাদের প্রতিষ্ঠাতা হলেন নাগার্জুন ।যোগাচার বা বিজ্ঞানবাদ এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন মৈত্রেয়নাথ (Maitreyanath) এবং তার শিষ্য  অসঙ্গ (Asanga)।মহাযান সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ সূত্র গুলি হল “সদ্ধর্ম পুণ্ডরিকা সূত্র”।পন্ডিতদের মতে মহাযান শব্দটি ছিল না তার পরিবর্তে ব্যবহৃত হত প্রাকৃত শব্দ ”মহাজান” বা “মহাজ্ঞান”।চীন দেশে মহাযান ধর্মমত সর্বপ্রথম প্রচার করেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী লোকক্ষেমা খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে।


এছাড়া বজ্রযান বলে বৌদ্ধধর্মের  আরও একটি উল্লেখযোগ্য ভাগ আছে যারা গোপন মন্ত্র তন্ত্রের উপর বিশ্বাস রাখে। এরা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম পালন করে ।বজ্রযানের প্রভাব Eastern India (West Bengal, বিহার, তিব্বত বা Tibet etc ), Bangladesh প্রভৃতি স্থানে এদের প্রভাব বেশি ।


Milindapanho এর অর্থ হল মিলিন্দ এর প্রশ্ন– Question of Milinda. Milinda ও Menander একই।Milinda অনেক প্রশ্ন করেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী নাগসেনকে। নাগসেন উত্তর দিয়েছিলেন। এই সমস্ত তথ্য নিয়েই Milindapanho  ।


বুদ্ধঘোষের দুটি  উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম হল বিশুদ্ধমগ্গ ও সুমঙ্গলভাষিণী।নাগার্জুন এর লেখা দুটি গুরুত্বপূর্ণ বই হল -মাধ্যমিক কারিকা  ও  প্রজ্ঞাপারমিতা কারিকা ।


বৌদ্ধধর্মে আটটি স্থানকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয় । এদেরকে  অষ্টস্থানস বা Asthasthanas    বলে।  এগুলি হল –লুম্বিনী, সারনাথ, বোধ গয়া, কুশিনগর, শ্রাবস্তী, রাজগৃহ, বৈশালী এবং সাংকাস্য (Sankasya)।Asthasthanas ছাড়া প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ ধর্মের উল্লেখযোগ্য স্থান গুলি হল বিহারের নালন্দা, গুজরাটের জুনাগড় ও বলভি, মধ্যপ্রদেশের সাঁচি, মহারাষ্ট্রের অজন্তা ইলোরা, উড়িষ্যার ধৌলগিরি, উত্তর প্রদেশের কনৌজ, কুশাম্বি, মথুরা, বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) জগদ্দল এবং সোমাপুরী, অন্ধ্রপ্রদেশের নাগার্জুনিকোন্দা ও অমরাবতী ।ছটি  বিখ্যাত বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল – নালন্দা, ওদন্তপুরী, বিক্রমশিলা, সোমাপুরী, জগদ্দল বা জগদল  ও বলভি বা বল্লভি ।নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যে,  বর্তমানে বিহারের পাটনা শহর থেকে 95 কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বা নালন্দা বৌদ্ধ বিহার।নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় 30 একর বা 12 হেক্টর  জায়গার উপর।নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বা নালন্দা বৌদ্ধ বিহার এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন গুপ্ত সম্রাট প্রথম কুমার গুপ্ত বা শক্রাদিত্য।নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত  বিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম হল  আর্যভট্ট, নাগার্জুন, আর্যদেব, অতীশ দীপঙ্কর, শীলভদ্র,  হিউয়েন সাং, ইৎসিং ইত্যাদি ।হিউয়েন সাং দু’বছর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এ  ছিলেন। হিউয়েন সাং এখানে অধ্যয়ন  করেন এবং অধ্যাপনার কাজও করেন।ইৎসিং নামক এক চীনা পর্যটক প্রায় 10 বছর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে  ছিলেন। তাঁর  লেখা থেকে জানা যায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এ ৮ টি সভা গৃহ ও 300 টি কক্ষ ছিল।হিউয়েন সাং এর  শিক্ষক হলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের  অধ্যক্ষ শীলভদ্র ।খুব সম্ভবত 1200  খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বকতিয়ার খিলজি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কে ধ্বংস করেন ।


ওদন্তপুরী বর্তমান বিহারে অবস্থিত একটি  বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় যা নালন্দা থেকে 10 কিমি দূরে অবস্থিত ছিল ।ওদন্তপুরী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন পাল বংশের রাজা গোপাল।ওদন্তপুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হলেন শীল রক্ষিত।নালন্দা ও বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের পর অতীশ দীপঙ্কর শীল রক্ষিতের কাছেও শিক্ষা গ্রহণ করেন ।


বিক্রমশীলা মহাবিহার পাল যুগে ধর্মপালের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় ।বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে বিহারের ভাগলপুরের 50 কিমি পূর্বে অবস্থিত।বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিখ্যাত অধ্যক্ষ হলেন অতীশ দীপঙ্কর ।বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের 6 দিকে 6 টি প্রবেশদ্বার ছিল এবং প্রত্যেকটিতে একজন করে বিখ্যাত পন্ডিত  দ্বারপাল হিসেবে থাকতেন।জেতরি বলে এমন  একজন বৌদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন তিনি প্রথমে  বিক্রমশিলা  বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বারপাল ছিলেন পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হন।


সোমপুর বা সোমাপুরী বা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান বাংলাদেশের পাহাড়পুর নওগাঁ ডিস্ট্রিক্টে অবস্থিত।পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল এই মহাবিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন ।জগদল বিহার নওগাঁ জেলার সদর থেকে 65 কিমি উত্তরে জগদল গ্রামে অবস্থিত।জগদল বিহার এর প্রতিষ্ঠাতা  হলেন রামপাল।জগদল বিহার এর দুজন বিখ্যাত পণ্ডিতের নাম হল দানশীল ও বিভূতিচন্দ্র।1200 সাল নাগাদ বিখ্যাত কাশ্মীরি পন্ডিত শাক্যশ্রীভদ্র জগদ্দল বা জগদল বিহারে যান।


বলভি বা বল্লভি মহাবিহারটি বর্তমানের সৌরাষ্ট্র গুজরাটে অবস্থিত ।বলভি মহাবিহারের  প্রতিষ্ঠাতা ভট্টার্ক ।


অনুরাধাপুরা মহাবিহার শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত।


বুদ্ধ মহাজনপদের যুগে মগধ সাম্রাজ্যের শাসক বিম্বিসারের রাজত্বকালে জীবিত ছিলেন, শিক্ষাদান করেছিলেন এবং একটি ভিক্ষু সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন (আনু. ৫৫৮ – আনু. ৪৯১ BCE),তার মৃত্যু হয়েছিল বিম্বিসারের উত্তরসূরি অজাতশত্রু শাসনকালের প্রথম দিকে। সেই হিসেবে বুদ্ধ ছিলেন জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরের  কনিষ্ঠ সমসাময়িক। বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদ ছাড়াও বুদ্ধের জীবন ছিল আজীবক, চার্বাক, জৈনধর্ম  ও অঞ্জন প্রভৃতি প্রভাবশালী শ্রমণ চিন্তাধারার উদয়কালের সমসাময়িক।দীর্ঘ নিকায় গ্রন্থে  ব্রহ্মজল সুত্রে এই ধরনের বাষট্টিটি মতবাদের কথা বিবৃত হয়েছে। সেই যুগেই মহাবীর, পূরণ কস্সপ, মক্খলি গোসাল, অজিত কেশকম্বলী, পকুধ কচ্চায়ন, সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্ত প্রমুখ প্রভাবশালী দার্শনিক তাদের মত প্রচার করেছিলেন। পিটকে সামান্নফল সুত্র এঁদের কথা উল্লিখিত হয়েছে। বুদ্ধ নিশ্চয় এঁদের মতবাদ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।বুদ্ধের প্রধান দুই শিষ্য সারিপুত্ত ও মৌদ্গল্যায়ন প্রথম জীবনে ছিলেন সংশয়বাদী সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্তর প্রধান শিষ্য।ত্রিপিটকে প্রায়শই দেখা যায় যে, বুদ্ধ তার প্রতিদ্বন্দ্বী মতধারার সমর্থকদের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিচ্ছেন। অর্থাৎ, বুদ্ধ নিজেও ছিলেন সমসাময়িক কালের অন্যতম শ্রমণ দার্শনিক।এমনও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে আলার কালাম ও উদ্দক রামপুত্ত নামে দুই দার্শনিকও ঐতিহাসিক চরিত্র। বুদ্ধের জীবনকথায় “জন্ম, বয়ঃপ্রাপ্তি, সন্ন্যাসগ্রহণ, আধাত্মিক অনুসন্ধান, বোধিলাভ, শিক্ষাদান ও মৃত্যু”র ধারাটি সাধারণভাবে স্বীকৃত হলেও, প্রথাগত জীবনীগ্রন্থগুলিতে বিভিন্ন বিবরণের সত্যতা সম্পর্কে মতৈক্য খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায়।


মানুষ যাকে ধারণ করে থাকে সেটাই ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও নীতির পুরোটাই প্রাচীন হিন্দু ধর্ম বা সনাতন ধর্মের অংশ বিশেষ, যা বুদ্ধদেব হিন্দু ধর্ম থেকেই নিয়েছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মের উদগাতা গৌতম বুদ্ধ নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হিন্দুই ছিলেন। হিন্দু ধর্মের অহিংসা, প্রেম, সেবা, ত্যাগ, তিতিক্ষার কথাই বুদ্ধদেব বলেছেন তাঁর মত করে  আবার এই বৌদ্ধ ধর্ম ও শৈব সম্প্রদায়ের ধর্মনীতি নিয়ে যীশু খ্রীষ্ট প্রতিষ্ঠা করেন খ্রীষ্ট ধর্ম যার নীতি পুরোটাই বৌদ্ধ ধর্মের থেকে নেওয়া, তার মানে দাঁড়ালো প্রকারান্তরে হিন্দু ধর্মেরই নীতি নিয়ে খ্রীষ্ট ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মের নির্বাণ লাভ আমাদের সনাতন ধর্মে মোক্ষপ্রাপ্তি এবং নির্বাণ লাভকেই জীবনের উদ্দেশ্য বলছেন বুদ্ধদেব যা পরে ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও সমস্ত সাধু মহাত্মারা বলে গেছেন ঈশ্বর দর্শনই মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য বলে । ঈশ্বর দর্শনের অনেক পথ, কিন্তু ইউনিভার্সাল পন্থা হলো শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ করে চেতনাকে ষটচক্র ভেদ করে আজ্ঞাচক্রে বা তার ওপরে স্থাপন করা যা কারো পক্ষেই কোনো এক জন্মে সম্ভব নয়, সেই স্তরে চেতনা যেতে কয়েক হাজার জন্ম লাগে যার পুরোটাই গুরুপ্রদত্ত কর্ম ও গুরুকৃপায় সম্ভব, এটা আমার কথা নয়, সিদ্ধ মহাত্মা ও সদগুরুদের প্রবচনে আছে। নির্বাণ লাভ বা মোক্ষপ্রাপ্তি মানে জীবন মৃত্যুর চক্রের বাইরে যেতে পারা সেও গুরুকৃপায়, বুদ্ধদেবকেও সাংখ্য দর্শনের সাধনা ও ষটচক্রের সাধনা করতে হয়েছে এবং মধ্যম পন্থা দিয়েই তিনি সিদ্ধিলাভ করেছেন যা সেই সনাতন হিন্দু ধর্মেরই পথ। সব ধর্মেরই নীতি শিক্ষা মানবপ্রেম, অহিংসা, সেবা, ত্যাগ কিন্তু তার উপস্থাপনার জন্য পাল্টে যায় তাকে অনুসরণ করে চলা মানুষের জীবনবোধ। তার অন্যতর ব্যাখ্যা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে যা ধ্বংসের রাস্তাই সুগম করে। তাই সনাতন হিন্দু ধর্ম আজও বলে, " আত্মনং বৃদ্ধি ".... আত্মাকে জানা অর্থাৎ আত্মদর্শন, যা হলে পূর্ব পূর্ব জন্মের কর্মও মানুষ অবগত হয়। এই সাধনার অধিকারী একমাত্র মানুষ, তাই মনুষ্যজন্ম দুর্লভ। চুরাশি হাজার অচেতন ও সচেতন যোনি পেরোলে লাভ হয় মনুষ্যজন্ম, সেখান থেকে শুরু হয় তার উত্তরণের ও চেতনাকে উর্দ্ধগামী করার সাধনা, ক্ষেত্র তৈরী হলে তবেই সদ্গুরু এসে হাতটা ধরেন তাকে উন্নীত করতে উচ্চস্তরে।বুদ্ধদেব বলছেন চাহিদা জীবের দুর্দশার কারণ সেই চাহিদা বা আকাঙ্খার শেষই করতে বলছেন সারদা মা, ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ, আদি শংকর।বহিরঙ্গের চাহিদা নয়, আপন অন্তরে ডুব দিলেই হবে আত্মদর্শনের রাস্তা সুগম।


পরের পর্বে সমাপ্ত 


তথ্য সূত্র : বৌদ্ধসাহিত্য গ্রন্থ সমূহ ও বুদ্ধচরি

মুসলমান সেবায়েত হিন্দু মন্দিরে 

******************************

তুষারতীর্থ অমরনাথের উল্লেখ আছে কলহনের রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থে যাকে কাশ্মীরের ইতিহাসের অন্যতম উৎস মানা হয়। অমরনাথ বিখ্যাত তার প্রাকৃতিক বরফের শিবলিঙ্গের জন্য যা গোটা শ্রাবণ মাস থাকে। এই শিবলিঙ্গ প্রথম আবিষ্কার করেন বুটা মালিক বলে এক মুসলমান মেষপালক। কথিত আছে বুটা মালিক ওই জায়গায় এক সাধুর দর্শন পান যিনি তাকে এক থলে ভর্তি কয়লা দেন, বুটা মালিক বাড়ি এসে দেখেন যে সেই কয়লা সবটাই সোনায় রূপান্তরিত হয়েছে। দেখে অভিভূত বুটা সেই সাধুকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে দেখেন সেখানে ওই বরফের শিবলিঙ্গ। বুটা মালিকের বংশধররাই আজও এখানে বাবা অমরনাথের সেবায়েত।আমাদের প্রাচীনশাস্ত্র অনুযায়ী এখানে বসে মহাদেব পার্বতীকে অমরত্ব লাভের গুপ্তকথা শুনিয়েছিলেন। জীবন ও মৃত্যুর চক্র থেকে বের হবার এই  কথা গুপ্তস্থানে বলবেন বলে শিব পাহেলগাঁওতে তাঁর ত্রিশূল, চন্দনবাড়িতে মস্তকের চন্দ্র, শেষনাগে গলার সর্প, পঞ্চতরণীতে পঞ্চভূত যথা ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও  আকাশ তত্ত্ব আর মহাগুনাস পর্বতে পুত্র গণেশকে রেখে অমরনাথের গুহায় গেছিলেন। কিন্ত এই গুপ্তকথা অদ্ভুত ভাবে শুনে ফেলেছিলো দুটি কবুতর। শিব পার্বতীকে বলেছিলেন যে উনি এই কথার মাঝে মাঝে পার্বতীকে জিজ্ঞেস করবেন তিনি বুঝেছেন কিনা, পার্বতী যেন তখন "হুঁ হুঁ "বলে সাড়া দেন। কথা শুনতে শুনতে পার্বতী ঘুমিয়ে পড়েন আর ওই কবুতর জোড়া সেই হুঁ হুঁ করে সাড়া দিয়ে যায়। শিব কথা শেষ করে পার্বতীকে নিদ্রিত দেখে ভাবেন যে কে তাহলে সাড়া দিল এবং দেখেন ওই জোড়া কবুতর। দেখে ত্রিশূল নিয়ে মারতে উদ্ধত হলে তারা গিয়ে আশ্রয় নেয় এক মুনির স্ত্রীর আঁচলের আড়ালে। তখন সেই মুনি শিবকে নিরস্ত করে বলেন যে অমর কথা শ্রবণ করে ওরা তো অমর হয়ে গেছে। সেই জোড়া কবুতর আজও ওখানে বিদ্যমান। 


আরেক সতীপীঠ মরুতীর্থ হিংলাজ যে হিংলাজ মাতার মন্দিরে (এটি পাকিস্তানে) পৌঁছতে হলে হাঁটতে হয় প্রায় 200 কিলোমিটার পথ।মরুভূমির মধ্যে দিয়ে সে পথ  দুর্গম আর রাস্তা হারালে নির্ঘাত মৃত্যু কেননা সেই বিস্তীর্ণ মরুভূমির মধ্যে ছিল মাত্র ৩-৪ টি জলের কুয়ো। দিনেরবেলায় প্রচন্ড গরমে হাঁটা সম্ভব নয় তাই তীর্থযাত্রীরা হাঁটতেন রাতে। পথ দেখানোর জন্য প্রত্যেকটি দলের সঙ্গে থাকতেন একজন "ছড়িদার"।আসলে এই ছড়িদাররা কিন্তু বেশির ভাগই হিন্দু নন - তারা মুসলিম। আর কি আশ্চর্য ! সেই "আল্লাহ কি বান্দে", ছড়িদাররাও মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন নিকষ কালো রাতে, তারার আলোয়, ধু ধু মরুভূমিতে তাদের পথ দেখান স্বয়ং শিব - তারা নিমিত্ত মাত্র ! কে জানে, হয়তো ব্যাপারটা উল্টো ! হয়তো সেই দুর্গম যাত্রায়  "ইন্সাআল্লায়" ভরসা রাখেন স্বয়ং অমরনাথ !   


মরুতীর্থ হিংলাজ একটি মহাশক্তিপীঠ কেননা এখানে নাকি পড়েছিল সতীর খণ্ডিত মস্তক - আর হিংলাজ মাতারও এমনই মাহাত্ম্য যে তাকে মানেন পাকিস্তানের সে অঞ্চলের মুসলিমরাও - আজও ! তারা হিংলাজ যাত্রাকে বলেন "নানী মাতা কি হজ" ! 


হিংলাজ মাতার আরেকটি মাহাত্ম্য আছে আর সেটি পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরের সঙ্গে সম্পর্কিত। আসলে পুরীর মন্দিরও একটি মহাশক্তিপীঠ - এখানে পড়েছিল সতীর পা এবং এখানে দেবী পূজিত হন "বিমলা" নামে ।পুরীর রাজা ইন্দ্রদুম্ন যখন জগন্নাথদেবের স্বপ্নাদেশ পান যে তাকে রোজ ৫৬টি পদে  রেঁধে  "মহাপ্রসাদ" ভোগ দিতে হবে তখন তিনি ভীত, সন্ত্রস্থ হয়ে পড়েন। পরের দিন তার স্বপ্নে আবির্ভূত হন দেবী হিঙ্গলা (হিংলাজ মাতা) এবং বলেন কোনো ভয় নেই, তিনি সেই রান্নাঘরের আগুন হবেন - রাজা শুধু মাটির হাঁড়িতে একটার উপর আরেকটা রান্না চাপিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবেন, রান্না করার দায়িত্ব তার !

.

পুরীর মন্দিরের সেই রান্নাঘরে এখনো কাঠের আগুনে একটা মাটির হাঁড়ির উপরে আরেকটা হাঁড়ি চাপিয়ে রান্না হয়। রান্নার দায়িত্বে থাকা পুরোহিতরা বলেন হিংলাজ মাতার এমনই সে রান্না যে সবার আগে রান্না হয় সবচেয়ে উপরের হাঁড়িতে আর সবার শেষে সবচেয়ে নিচের হাঁড়িতে। সে রান্না মন্দিরে এনে জগন্নাথদেব ও মাতা বিমলাকে উৎসর্গ না করা পর্যন্ত নাকি তার থেকে কোনো গন্ধ বের হয় না ! এমনই সম্প্রীতির ছবি কিন্তু আজও ছড়িয়ে আছে বহু তীর্থক্ষেত্রে বা জনপদে কিন্তু অন্তরের আঁধার ঘোচাতে সেটুকু বুঝতে হবে যে!!!


পথের ক্লান্তি ভুলে হিংলাজ মাতার স্নেহ ভরা কোলে বসে "শীতল হবার" সৌভাগ্য হয়তো সবার হয়না, কিন্তু তার হাতে রাঁধা জগন্নাদেবের মহাপ্রসাদের অনন্য স্বাদ কিন্তু আমরা অনেকেই পেয়েছি - তাই বা কম কি ? 


বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর !


জয় জগন্নাথ !      


            

তথ্য ঋণ : কালিকানন্দ অবধূতের মরুতীর্থ হিংলাজ ও লেখক শ্রীষষ্ঠীপদ  চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ, আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন, ইন্টারনেটের ছবি।


আধ্যাত্মিক বিষয়


শিবতত্ত্ব


দ্বিতীয় পর্ব

*********

শিব কী?

সত্য ও সুন্দরই শিব। এই পৃথিবীতে সবাই সত্যকে, সুন্দররূপে মঙ্গলকেই চায়। কেউই অমঙ্গল, অসুন্দর, অশিবকে চায়না। ফলে সকলেই এই শিব পূজার অধিকারী।


শিব লিঙ্গম কি?


“লীনং বা গচ্ছতি, লয়ং বা গচ্ছতি ইতি লিঙ্গম্” যা লয়প্রাপ্ত হয় তাই লিঙ্গ। 


আবার কারো মতে সর্ববস্তু যে আধারে লয়প্রাপ্ত হয় তাই লিঙ্গম। কিন্তু বৈয়াকরণিকগণের মতে “লিঙ্গতে চিহ্নতে মনেনেতি লিঙ্গম্”। লিঙ্গ শব্দের অর্থ ‘প্রতীক’ বা ‘চিহ্ন’। যার দ্বারা বস্তু চিহ্নিত হয়, সত্য পরিচয় ঘটে তাই-ই লিঙ্গ। অর্থাৎ যার দ্বারা সত্যবিজ্ঞান লাভ হয়, যার সাহায্যে বস্তুর পরিচয় পাওয়া যায় তাকেই বস্তু পরিচয়ের চিহ্ন বা লিঙ্গ বলে। আর এজন্যই দেহ প্রকৃতিতে লীনভাবে অবস্থান করে বলেই চিদ্ জ্যোতিকে বলা হয় লিঙ্গ। ভূমা ব্রহ্মের গুহ্য নাম “শিব” এবং ভূমা ব্রহ্মের পরিচায়ক বলে আত্মজ্যোতির উদ্ভাসনের নাম শিবলিঙ্গ।


শিবলিঙ্গের আবির্ভাবঃ


মাঘে কৃষ্ণচতুর্দ্দশ্যাম আদিদেবো মহানিশি।

শিবলিঙ্গ তয়োদ্ভুতঃ কোটিসূর্য্যসমপ্রভঃ।।


মাঘ মাসের কৃষ্ণ পক্ষীয় চতুর্দশী তিথির মহানিশিতে কোটি সূর্য সমপ্রভ তেজোময় আদিদেব (জ্যোতিমূর্তি) লিঙ্গমূর্তিতে আবির্ভূত হন।


শ্রী রামচন্দ্র কর্তৃক  শিবের আরাধনাঃ

প্রলয়ের কারণ বলে লোকে মহাদেবকে লিঙ্গ বলে। 

এই লিঙ্গ ব্রহ্মের পরম শরীর। আর এ জন্যই ত্রেতাযুগে রাবণ বধে যাত্রার সময় সেতুবন্ধে শ্রীরামচন্দ্র রামেশ্বরে শিবের পূজা করেন। আবার পরশুরামও পশুপতি শিবের তপস্যা করেই পশুপাত অস্ত্র লাভ করেন।


শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক লিঙ্গপূজাঃ

দ্বাপরযুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্ত্রী জাম্ববতীসহ উপমন্যু মুনির আশ্রমে গমন করেন এবং তথায় দেবতা, ঋষি ও পিতৃগণের তর্পণান্তে অমিত মহাদেবের লিঙ্গমূর্তিতে পূজা করেন। আবার শ্রীকৃষ্ণ মার্কণ্ডেয় মুনির আশ্রমে গিয়ে ভুতিভূষণ শিবের পূজা করেছিলেন।


শ্রীকৃষ্ণের শিবের আরাধনার কারণঃ

“মহাদেব আত্মারই মূল। ইহা জানাবার জন্যই আমি তাঁহার পূজা করছি। বেদতত্ত্বজ্ঞ পন্ডিতগণ আমাকেই শিবলিঙ্গ বলে থাকেন। অতএব আমি স্বয়ং আপনাতে আপনি মহাদেবের পূজা করছি। আমি শিবময়, ফলে আমাদের মধ্যে রূপ ভিন্ন হলেও কোন প্রভেদ নেই। সংসার-ভীরু সাধারণ লোক লিঙ্গমূর্তিতে দেবাদিদেব মহেশ্বরের ধ্যান ও পূজা বন্দনা করবে।”


শিবতত্ত্বঃ

জ্ঞানের রাজ্য পার হয়েই জানা যায় শিবকে। জ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী পূজার পরই আসে শিবরাত্রি। এরও একটি গভীর তাৎপর্য আছে। দেবী সরস্বতী হংসরূঢ়া। হংসটি কিন্তু সাধারণ হংস নয়। মানুষের কূটস্থে যে দ্বিদলপদ্ম আছে, এতে “হং” এবং “সঃ” দুইটি বীজ। এই দুইটি বীজে দৃষ্টি স্থির রাখতে পারলেই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞানক্ষেত্র খুলে যায়। আবার জ্ঞানক্ষেত্রে চতুর্বেদ রাগিনী সরস্বতী উপবিষ্ট। তাই ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধিকে সুসংযত করে কুটস্থে রাখতে পারলে সরস্বতীর কৃপা লাভ সম্ভব।


জ্ঞানক্ষেত্র পার হলে পৌঁছা যায় ব্যোমক্ষেত্রে আমাদের কূটস্থের পর দহরাকাশ, চিদাকাশ, পরাকাশ, মহাকাশ ও আত্মাকাশ। এই পঞ্চ আকাশেই ব্যোমক্ষেত্র বা শিবক্ষেত্র। এ জন্যই শিবের অপর নাম পঞ্চানন। মানুষ সাধন ক্রিয়া দ্বারা এই ব্যোমক্ষেত্রে পৌছালে শিব শীঘ্র তুষ্ট হন। এ জন্য শিবের আর এক নাম আশুতোষ।


এছাড়াও শিব আরও যে যে রূপে মূর্ত হন তা নিম্নরূপ :


০১। চন্দ্রনাথদেবেরই আর এক নাম শিব। শিব অর্থ মঙ্গল বা শুভ। পুনর্জন্ম নিরোধ করে অর্থাৎ মোক্ষ দান করে তিনি জীবের মঙ্গলই করেন। তিনি আবার পঞ্চানন নামেও খ্যাত। পঞ্চ আনন (মুখ) যাঁর তিনিই পঞ্চানন। পঞ্চমুখ দেবতাই শিব।


০২। ‘ওঁ’-তত্ত্বের ত্রিদেবতা-ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। পঞ্চানন শিবই এই মহেশ্বর। মহেশ্বরী শক্তির অধিকারী তিনি। মহাপ্রলয়ের নটরাজ তিনি। তিনি ঈশান নামেও খ্যাত। ঈশান-ই বিষাণে অর্থাৎ শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে তিনি মহাপ্রলয় ঘোষণা করবেন।


০৩। মহাশক্তির দেবতা মহেশ্বর। সকল দেবতা ঐক্যশক্তি দিয়ে যা করতে পারেননা, মহেশ্বর একাকী তা সম্পন্ন করতে সমর্থ। দেবতার মাঝে বিচিত্র অদ্ভূতকর্মা দেবতা তিনি।


০৪। মৃত্যুকে জয় করেছেন বলে তিনি মৃত্যুঞ্জয়। তাইতো তিনি অকাতরে সমুদ্র মন্থনের হলাহল অর্থাৎ বিষ কণ্ঠে ধারণ করেছেন। বিষের ক্রিয়ায় তার কণ্ঠদেশ হয়েছে নীল। সে কারণে তার নাম নীলকণ্ঠ।


০৫। বাঘের চামড়াকে বলে কৃত্তি। কৃত্তি পরিধান করে নাম ধরেছেন কৃত্তিবাস।


০৬। বিচিত্রকর্মা মহেশ্বর। অর্থাৎ তার সকল কর্মই অদ্ভূত ও বৈচিত্র্যময়। গঙ্গার ধারা ধারণকালে ত্রিশূল হাতে তিনি হিমালয়ের পাদদেশে থমকে দাঁড়িয়েছেন এবং মস্তকের জটাজুটকে উত্থিত করে দিয়েছেন ব্যোমে অর্থাৎ আকাশের দিকে এবং নাম ধরেছেন ব্যোম্‌কেশ। তার সেই উত্থিত জটাজুটের মাধ্যমে গঙ্গার ধারা পৃথিবীতে নেমে আসে। তবেই না মর্ত্যের মানুষ গঙ্গার পূত-পবিত্র সলিলে অবগাহন করে নিষ্পাপ হচ্ছে এবং মরণের পরে স্বর্গবাসী হচ্ছে।


০৭। ‘ধূর’ শব্দের অর্থ জটাভার বা ত্রিলোকের চিন্তাভার। মহাদেব চন্দ্রনাথই শিরে জটাভার ধারণ করেন অথবা ত্রিলোকের চিন্তাভার ধারণ ও বহন করেন। এসকল ভার বহন ও ধারণের কারণে তারই নাম ধূর্জটি।


০৮। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে-‘কোন গুণ নাই তার কপালে আগুন’। এখানে ‘গুণ নাই’-এর অর্থ সত্ত্বঃ, রজ ও তম গুণের অতীত। মহাদেব ত্রিগুণাতীত। তিনটি নেত্র বা লোচন তার। একারণে দেব ত্রিলোচনও বলা হয় তাকে। তার ললাটের তৃতীয় নয়ন দিয়ে সর্বদাই ধক্‌ ধক্‌ করে আগুন জ্বলতে থাকে। ‘কপালে আগুন’ বলতে অন্নপূর্ণা দেবী ইঙ্গিতে মহাদেবের ললাট নেত্রের কথাই বলেছেন। আগুন আলোর প্রতীক। অন্ধকার দূর করতে আলোরই প্রয়োজন। তার ত্রিনেত্রের অগ্নি জ্ঞানরূপে আলো জ্বালানোর প্রতীক। অর্থাৎ মানুষকে জ্ঞান-চর্চা করতে হবে।


০৯। ত্রিগুণাতীত বলে শিব সর্বদাই নির্বিকার নির্বিকল্প। তাই শবরূপে তিনি শ্রীকালী মাতার চরণতলে শায়িত। শবরূপে শিব মানুষকেও বিকার রহিত হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ শবেরইতো কোন বিকার নেই। তার ত্রিশূলও ত্রিগুণের প্রতীক। তিনি নিজে ত্রিগুণাতীত হয়ে মানুষকেও তার হস্তধৃত ত্রিশূল দেখিয়ে ত্রিগুণাতীত হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।


১০। শিব ‘হর’ এবং ‘শম্ভু’ নামেও খ্যাত। তিনি জীবের চিত্তকে, তাদের পাপকে হরণ করেন এবং কালপূর্ণ হলে জীবের জীবনকেও হরণ করেন। এসকল হরণ করার কারণে তার নাম ‘হর’। আবার তিনিই জীবের যম-ভয় অর্থাৎ শঙ্কা হরণ করে তাদের কল্যাণ সাধন করেন। তার নাম গ্রহণ করলেই আর কোন শঙ্কাই থাকে না। এ কারণে শংকর তার নাম। আবার ‘শম্‌’ শব্দের অর্থও কল্যাণ। যেহেতু তিনি কল্যাণ দান করেন, সেহেতু ‘শম্ভু’ নামেও তিনি বিশ্বখ্যাত।


১১। ত্রিপুর নামক অসুরের অত্যাচারে ত্রিপুরাবাসী অর্থাৎ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালবাসী দেবতা, মানব  এবং  যক্ষকুল অতীষ্ট হয়ে উঠেছিলেন তখন শিব শরাসন থেকে শর নিক্ষেপ করে ত্রিপুরাসুরকে নিধন করেন। আর এই ত্রিপুরাসুরকে নাশ করে নাম ধরেছেন দেব ত্রিপুরারি।


১২। শিব অল্পেই বা শীঘ্রই সন্তুষ্ট হন। এ কারণে তাঁর এক নাম আশুতোষ।


১৩। শিব দেবগণ কতৃক বন্দিত, তাই তাঁর নাম মহাদেব।


১৪। শিব সকল জীবের প্রভু, তাই তিনি ঈশান।


১৫। শিবের জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী কেউ নেই, তাই তিনি স্বয়ম্ভু।


১৬। পশু ও জীবের কর্মবন্ধন মোচন করেন বলে তিনি পশুপতি।


১৭। প্রতিকল্পে আপন লীলা মহিমায় তিনি ব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংস সাধন করেন, তাই তিনি মহাকাল।


সত্যই জগতের প্রতিটি বস্তুকণায় শিবের অস্তিত্ব বর্তমান। “যত্র জীব-তত্র শিব”-পরমপুরূষ শ্রীরামকৃষ্ণ কঠোর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে এ সত্যই উপলব্ধি করেছেন। সুতরাং আমাদের সকলের উচিৎ জীব সেবার মাধ্যমে শিব সেবায় ব্রতী হওয়া। সেই পরমেশ্বর শিবের উদ্দেশ্যে প্রণাম-


ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয়হেতবে।

নিবেদয়ামি চাত্মানং ত্বং গতিঃ পরমেশ্বর।।


প্রশ্ন : শিব লিঙ্গ কি? সর্বত্র মূর্তিতেই দেবতাদের পুজো করা হয় (লিঙ্গে নয় ), কিন্তু শিবের পুজো লিঙ্গেতে এবং মূর্তিতে কেন করা হয়?


উত্তর:আক্ষরিক বিশ্লেষণে দেখা যায়- ‘শিব’ শব্দের অর্থ ‘মঙ্গল’ আর ‘লিঙ্গ’ শব্দের অর্থ প্রতীক বা চিহ্ন। শাস্ত্র ‘শিব’ বলতে নিরাকার সর্বব্যাপি পরমাত্মা বা পরমব্রহ্মকে বোঝায়। তাই ‘শিবলিঙ্গ’ হচ্ছে মঙ্গলময় পরমাত্মার প্রতীক।


[* শিবপুরাণ ও অন্যান্য সকল শাস্ত্রেই ‘শিবলিঙ্গ’ বলতে ‘পরমব্রহ্মের প্রতীক’-ই বোঝানো হয়েছে।]


শিবপুরাণ অনুসারে ভগবান শিবই একমাত্র ব্রহ্মরূপ হওয়ায় তাঁকে ‘নিষ্কল’ (নিরাকার) বলা হয়। যেহেতু তিনি ‘সর্বশক্তিমান’ তাই তিনি জগতকল্যাণের জন্য রূপধারণও করতে পারেন। রূপবান হওয়ায় তাঁকে ‘সকল’ বলা হয়। তাই তিনি ‘সকল’ এবং ‘নিষ্কল’-দুইই। শিব নিষ্কল-নিরাকার হওয়ায় তাঁর পূজার আধারভূত লিঙ্গও নিরাকার অর্থাৎ লিবলিঙ্গ শিবের নিরাকার স্বরূপের প্রতীক। তেমনই শিব সকল বা সাকার হওয়ায় তাঁর পূজার আধারভূত বিগ্রহ সাকাররূপ।


‘সকল’ (সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসহ সাকার) এবং ‘অকল’ (হস্তপদমুখচক্ষু ইত্যাদি অঙ্গ-আকার থেকে সর্বতোভাবে রহিত নিরাকার) রূপ হওয়াতেই শিব ‘ব্রহ্ম’ শব্দ দ্বারা কথিত পরমাত্মা। এইজন্যই সকলে লিঙ্গ (নিরাকার স্বরূপ) এবং মূর্তি (সাকার স্বরূপ)-দুয়েতেই পরমেশ্বর শিবের পূজা করে থাকেন। শিব ব্যতীত অন্য যেসকল দেবতা আছেন, তাঁরা সাক্ষাৎ ব্রহ্ম নন, তাই কোথাও তাঁদের নিরাকার লিঙ্গ দেখা যায় না। লিঙ্গ সাক্ষাৎ ব্রহ্মের প্রতীক।


আসলে হাজার বছরের বিদেশি শাসনে পরাধীন থাকায় বিদেশী শাসকগন সনাতন ধর্মকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করেছে। শুধু উপাসনালয় ভেঙ্গেই ক্ষান্ত থাকেনি, নানা কুৎসা রটাতেও পিছপা হয়নি। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মুসলিম শাসকরা মন্দির ধ্বংসে মনযোগী ছিল আর ইংরেজরা মন্দির ভাঙ্গেনি ঠিক তবে বুদ্ধিমান পাদ্রীরা আমাদের ধর্মকে আঘাত করেছে অন্যভাবে। ১৮১৫ সালে আ ভিউ অফ দ্য হিস্ট্রি, লিটারেচার, অ্যান্ড মিথোলজি অফ দ্য হিন্দুজ গ্রন্থে লেখক ব্রিটিশ মিশনারি উইলিয়াম ওয়ার্ড হিন্দুদের অন্যান্য ধর্মীয় প্রথার সঙ্গে লিঙ্গপূজারও নিন্দা করেছিলেন। তাঁর মতে লিঙ্গপূজা ছিল, “মানুষের চারিত্রিক অবনতির সর্বনিম্ন পর্যায়”। শিবলিঙ্গের প্রতীকবাদটি তাঁর কাছে ছিল “অত্যন্ত অশালীন; সে সাধারণের রুচির সঙ্গে মেলানোর জন্য এর যতই পরিমার্জনা করা হোক না কেন”। ব্রায়ান পেনিংটনের মতে, ওয়ার্ডের বইখানা “ব্রিটিশদের হিন্দুধর্ম সম্পর্কে ধারণা ও উপমহাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের মূল ভিত্তিতে পরিণত হয়েছিল।” ব্রিটিশরা মনে করত, শিবলিঙ্গ পুরুষ যৌনাঙ্গে আদলে নির্মিত এবং শিবলিঙ্গের পূজা ভক্তদের মধ্যে কামুকতা বৃদ্ধি করে।প্রতীক।”ডেভিড জেমস স্মিথ প্রমুখ গবেষকেরা মনে করেন, শিবলিঙ্গ চিরকালই পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গটি বহন করছে।জেনেন ফলারের মতে, লিঙ্গ “পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গে নির্মিত এবং এটি মহাবিশ্ব-রূপী এক প্রবল শক্তি।


আবার ইউরোপের সব বুদ্ধিজীবী হিন্দু বিদ্বেষী ছিল এটা বলা অন্যায় হবে।কারন অনেকেই শিব লিঙ্গ সম্পর্কে উপরোক্ত মতবাদকে গ্রহণ না করে সত্য অনুসন্ধান করেছেন। যেমন ১৮২৫ সালে হোরাস হেম্যান উইলসন দক্ষিণ ভারতের লিঙ্গায়েত সম্প্রদায় সম্পর্কে একটি বই লিখে এই ধারণা খণ্ডানোর চেষ্টা করেছিলেন।


নৃতাত্ত্বিক ক্রিস্টোফার জন ফুলারের মতে, হিন্দু দেবতাদের মূর্তি সাধারণত মানুষ বা পশুর অনুষঙ্গে নির্মিত হয়। সেক্ষেত্রে প্রতীকরূপী শিবলিঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম।কেউ কেউ মনে করেন, লিঙ্গপূজা ভারতীয় আদিবাসী ধর্মগুলি থেকে হিন্দুধর্মে গৃহীত হয়েছে।


এবার আমরা জানব শিবলিঙ্গ আসলে কিঃ


শিবলিঙ্গ বা লিঙ্গম্‌ দেবতা শিবের একটি প্রতীক।আমি যদি এক কথায় বলি তাহলে,শিব শব্দের শাব্দিক অর্থ মঙ্গল; আর লিঙ্গ মানে চিহ্ন।অর্থাৎ শিবলিঙ্গ মানে মঙ্গলময় চিহ্ন। হিন্দু মন্দিরগুলিতে সাধারণত শিবলিঙ্গে শিবপূজা করা হয়ে থাকে।একটি সাধারণ তত্ত্ব অনুযায়ী, শিবলিঙ্গ শিবের আদি-অন্তহীন সত্ত্বার প্রতীক এক আদি ও অন্তহীন স্তম্ভের রূপবিশেষ।


শিব এক অনাদি অনন্ত লিঙ্গস্তম্ভের রূপে আবির্ভূত, বিষ্ণু বরাহ বেশে স্তম্ভের নিম্নতল ও ব্রহ্মা ঊর্ধ্বতল সন্ধানে রত। এই অনাদি অনন্ত স্তম্ভটি শিবের অনাদি অনন্ত সত্ত্বার প্রতীক মনে করা হয়।


শিবলিঙ্গ একটি গোল কিম্বা উপবৃত্তাকার যা কোন বৃত্তাকার ভূমি (base ) কে কেন্দ্র করে স্থাপিত । এই গোল ভূমি কে আদি পরশক্তি বা চূড়ান্ত শক্তি ।আর সেই গোল কিম্বা বৃত্তাকার অংশ দ্বারা অসীম কে বোঝান হয় যার কোন আদি অন্ত নেই অর্থাৎ যা সর্ববিরাজমান । সর্ববিরাজমান অর্থ হল যা সব জায়গায় অবস্থিত ।


শিবলিঙ্গ ধরনাটি সাধারণত infinity বোঝাতে কিম্বা জীবনের continuation বোঝাতে অবতারণা করা হয়।


ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় অথর্ববেদে একটি স্তম্ভের স্তব করা হয়েছে। এটিই সম্ভবত শিব লিঙ্গ পূজার উৎস। কারোর কারোর মতে যূপস্তম্ভ বা হাঁড়িকাঠের সঙ্গে শিবলিঙ্গের যোগ রয়েছে। উক্ত স্তবটিকে আদি-অন্তহীন এক স্তম্ভ বা স্কম্ভ-এর কথা বলা হয়েছে; এই স্কম্ভ চিরন্তন ব্রহ্মের স্থলে স্থাপিত। যজ্ঞের আগুন, ধোঁয়া, ছাই, সোমরস ও যজ্ঞের কাঠ বহন করার ষাঁড় ইত্যাদির সঙ্গে শিবের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির যোগ লক্ষিত হয়। মনে করা হয়, কালক্রমে যূপস্তম্ভ শিবলিঙ্গের রূপ নিয়েছিল। লিঙ্গপুরাণে এই স্তোত্রটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটি কাহিনির অবতারণা করা হয়। এই কাহিনিতে উক্ত স্তম্ভটিকে শুধু মহানই বলা হয়নি বরং মহাদেব শিবের সর্বোচ্চ সত্ত্বা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ভারত ও কম্বোডিয়ায় প্রচলিত প্রধান শৈব সম্প্রদায় ও অনুশাসন গ্রন্থ শৈবসিদ্ধান্ত মতে, উক্ত শৈব সম্প্রদায়ের প্রধান উপাস্য দেবতা পঞ্চানন (পাঁচ মাথা-বিশিষ্ট) ও দশভূজ (দশ হাত-বিশিষ্ট) সদাশিব প্রতিষ্ঠা ও পূজার আদর্শ উপাদান হল শিবলিঙ্গ।


মনিয়ার উইলিয়ামস তাঁর ব্রাহ্মণইজম্‌ অ্যান্ড হিন্দুইজম্‌ বইয়ে লিখেছেন, “লিঙ্গ” প্রতীকটি “শৈবদের মনে কোনো অশালীন ধারণা বা যৌন প্রণয়াকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয় না। অন্যদিকে এন. রামচন্দ্র ভট্ট প্রমুখ গবেষকেরা মনে করেন, পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গটি অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের রচনা।এম. কে. ভি. নারায়ণ শিবলিঙ্গকে শিবের মানবসদৃশ মূর্তিগুলি থেকে পৃথক করেছেন। তিনি বৈদিক সাহিত্যে লিঙ্গপূজার অনুপস্থিতির কথা বলেছেন এবং এর যৌনাঙ্গের অনুষঙ্গটিকে তান্ত্রিকসূত্র থেকে আগত বলে মত প্রকাশ করেছেন।


১৯০০ সালে প্যারিস ধর্মীয় ইতিহাস কংগ্রেসে ভারত সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, শিবলিঙ্গ ধারণাটি এসেছে বৈদিক যূপস্তম্ভ বা  স্কম্ভ   ধারণা থেকে। ১৯০০ সালে প্যরিসে হয়ে যাওয়া ধর্মসমূহের ঐতিহাসিক মূল শীর্ষক সম্মেলনে বিশ্ববাসীর সামনে অথর্ববেদের স্কম্ভসুক্তের সাহায্যে তুলে ধরেন যে শিবলিঙ্গ মূলত বিশ্বব্রহ্মান্ডের ই প্রতীক।যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ হল বলিদানের হাঁড়িকাঠ। এটিকে অনন্ত ব্রহ্মের একটি প্রতীক মনে করা হত।জার্মান প্রাচ্যতত্ত্ববিদ গুস্তাভ ওপার্ট শালগ্রাম শিলা ও শিবলিঙ্গের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে তাঁর গবেষণাপত্রে এগুলিকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গে সৃষ্ট প্রতীক বলে উল্লেখ করে তা পাঠ করলে, তারই প্রতিক্রিয়ায় বিবেকানন্দ এই কথা বলেছিলেন।বিবেকানন্দ বলেছিলেন, শালগ্রাম শিলাকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গ বলাটা এক কাল্পনিক আবিষ্কার মাত্র। তিনি আরও বলেছিলেন, শিবলিঙ্গর সঙ্গে পুরুষাঙ্গের যোগ বৌদ্ধধর্মের পতনের পর আগত ভারতের অন্ধকার যুগে কিছু অশাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির মস্তিস্কপ্রসূত গল্প।


স্বামী শিবানন্দও শিবলিঙ্গকে যৌনাঙ্গের প্রতীক বলে স্বীকার করেননি।স্বামী শিবানন্দ বলেন,”এটি শুধু ভূল ই নয় বরং অন্ধ অভিযোগ ও বটে যে শিবলিঙ্গ পুরুষলিঙ্গের প্রতিনিধিত্বকারী।”তিনি লিঙ্গপুরানের নিম্নলিখিত শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন-

“প্রধানাম প্রকৃতির যদাধুর লিঙ্গমুত্তমম গান্ধবর্নরসাহৃনম শব্দ স্পর্শাদি বর্জিতম”

অর্থাত্‍ লিঙ্গ হল প্রকৃতির সর্বোচ্চ প্রকাশক যা স্পর্শ, বর্ণ,গন্ধহীন।


১৮৪০ সালে এইচ. এইচ. উইলসন একই কথা বলেছিলেন।ঔপন্যাসিক ক্রিস্টোফার ইসারউড লিঙ্গকে যৌন প্রতীক মানতে চাননি।ব্রিটানিকা এনসাইক্লোপিডিয়ায় “Lingam” ভুক্তিতেও শিবলিঙ্গকে যৌন প্রতীক বলা হয়নি।


মার্কিন ধর্মীয় ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ওয়েনডি ডনিগার

তাঁর দ্য হিন্দুজ: অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি বইতে লিখেছেন, কোনো কোনো ধর্মশাস্ত্রে শিবলিঙ্গকে ঈশ্বরের বিমূর্ত প্রতীক বা দিব্য আলোকস্তম্ভ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সব বইতে লিঙ্গের কোনো যৌন অনুষঙ্গ নেই।


হেলেন ব্রুনারের মতে, লিঙ্গের সামনে যে রেখাটি আঁকা হয়, তা পুরুষাঙ্গের গ্ল্যান্স অংশের একটি শৈল্পিক অনুকল্প। এই রেখাটি আঁকার পদ্ধতি মধ্যযুগে লেখা মন্দির প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত অনুশাসন এবং আধুনিক ধর্মগ্রন্থেও পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠাপদ্ধতির কিছু কিছু প্রথার সঙ্গে যৌন মিলনের অনুষঙ্গ লক্ষ্য করা যায়। যদিও গবেষক এস. এন. বালগঙ্গাধর লিঙ্গের যৌন অর্থটি সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।


লিঙ্গাষ্টকম


ব্রহ্মমুরারি সুরার্চিত লিঙ্গম 

নির্মলভাসিত শোভিত লিঙ্গম  |

জন্মজ দুঃখ বিনাশক লিঙ্গম 

তত্প্রণমামি সদাশিব লিঙ্গম  ‖ 1 ‖


দেবমুনি প্রবরার্চিত লিঙ্গম 

কামদহন করুণাকর লিঙ্গম  |

রাবণ দর্প বিনাশন লিঙ্গম 

তত্প্রণমামি সদাশিব লিঙ্গম  ‖ 2 ‖


সর্ব সুগংধ সুলেপিত লিঙ্গম 

বুদ্ধি বিবর্ধন কারণ লিঙ্গম  |

সিদ্ধ সুরাসুর বংদিত লিঙ্গম 

তত্প্রণমামি সদাশিব লিঙ্গম  ‖ 3 ‖


কনক মহামণি ভূষিত লিঙ্গম 

ফণিপতি বেষ্টিত শোভিত লিঙ্গম  |

দক্ষসুযজ্ঞ বিনাশন লিঙ্গং

তত্প্রণমামি সদাশিব লিঙ্গম্ ‖ 4 ‖


কুংকুম চংদন লেপিত লিঙ্গম 

পংকজ হার সুশোভিত লিঙ্গম  |

সংচিত পাপ বিনাশন লিঙ্গং

তত্প্রণমামি সদাশিব লিঙ্গম্ ‖ 5 ‖


দেবগণার্চিত সেবিত লিঙ্গং

ভাবৈ-র্ভক্তিভিরেব চ লিঙ্গম  |

দিনকর কোটি প্রভাকর লিঙ্গং

তত্প্রণমামি সদাশিব লিঙ্গম্ ‖ 6 ‖


অষ্টদ঳োপরিবেষ্টিত লিঙ্গং

সর্বসমুদ্ভব কারণ লিঙ্গম্ |

অষ্টদরিদ্র বিনাশন লিঙ্গং

তত্প্রণমামি সদাশিব লিঙ্গম্ ‖ 7 ‖


সুরগুরু সুরবর পূজিত লিঙ্গং

সুরবন পুষ্প সদার্চিত লিঙ্গম্ |

পরাত্পরং (পরমপদং) পরমাত্মক লিঙ্গং

তত্প্রণমামি সদাশিব লিঙ্গম্ ‖ 8 ‖


লিঙ্গাষ্টকমিদং পুণ্যং যঃ পঠেশ্শিব সন্নিধৌ |

শিবলোকমবাপ্নোতি শিবেন সহ মোদতে ‖


রামেশ্বরম

**********

দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত শৈব তীর্থক্ষেত্রের মানে  রামেশ্বরম। এই শিব লিঙ্গ শ্রীরামনাথস্বামী হিসাবে পরিচিত। এটা তামিলনাড়ু রাজ্যে অবস্থিত। ভারতের মহাপবিত্র বিখ্যাত চারধাম যথাক্রমে – উত্তরে বদ্রীনাথ, পূর্বে পুরীর শ্রীজগন্নাথ, পশ্চিমে দ্বারকা ও দক্ষিণে রামেশ্বরম। এছাড়াও এই তীর্থ দ্বাদশ জ্যোতিলিঙ্গের মধ্যে অন্যতম। বলা হয় বারাণসীর অর্থাৎ কাশীর বিশ্বনাথজির দর্শনে ও পূজায় যে পূণ্য লাভ হয় শ্রীরামেশ্বরের দর্শন ও পূজায় সমপরিমাণ পূণ্য লাভ হয়। কাশীযাত্রার পূর্ণতা লাভ হয় তখনই যখন রামেশ্বর যাত্রা সম্পূর্ণ হয়। এ এক এমন জাগ্রত তীর্থ যার খ্যাতি বিশ্বজোড়া কারণ এই লিঙ্গ ভগবান শ্রীরামচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত এবং পূজিত। যার জন্যে এই তীর্থ রামভক্ত, বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব সবার কাছে পরম পবিত্র। মহাশিবরাত্রি উপলক্ষে এখানে বিশাল উৎসব হয়। তখন শিবপূজো এর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল শ্রীরামনাথস্বামী ও মাতা পার্বতীর রথপরিক্রমা। এখানেই আছে ইতিহাস বিখ্যাত শ্রীরামের বানর সেনাদের দ্বারা তৈরি বিখ্যাত সেতু যাতে করে তিনি লঙ্কায় গিয়েছিলেন সীতাকে উদ্ধারে। বাল্মীকি রামায়ণের যুদ্ধকানণ্ডে বর্ণিত আছে মহাবীর নল বানরগণের সাহায্যে পিতা বিশ্বকর্মার ন্যায় নিপুনতার সহিত সমুদ্রের পরপার পর্যন্ত সেতু প্রস্তুত করিলেন। তৎকালে ওই সুদীর্ঘ সেতু অন্তরীক্ষে ছায়াপথের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। এই বর্ণনা আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে NASA র স্যাটেলাইটে তোলা ছবিতে প্রমানিত হয়েছে। ১৯৮০ সালের আগে কিছুদূর এতে হাটাও যেত কিন্তু ১৯৮০ সালের সামুদ্রিক ঝড়ে এটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়। স্যাটেলাইটের থেকে পাওয়া তথ্যনুযায়ী ভারতের মহাকাশ গবেষনা কেন্দ্রের(ISRO)মেরিন আ্যান্ড ওয়াটার রিসোর্সেস গ্রুপ অফ স্পেস আ্যাপলিকেশন সেন্টার (SAC)অনুসন্ধান অনুসারে ১০৩ টি শীলা প্রাচীর জলের তলে লক্ষ করা যায়।


যাই হোক বিভিন্ন পুরানে এই তীর্থ প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। সব জায়গায় এটা শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও পূজিত হলেও কাহিনীর কিছু বিভেদ আছে। রামায়ণ, শিবপুরান, পদ্মপুরান অনুসারে দুটি কাহিনী আমরা পাই যথাক্রমে-


১। লঙ্কা পাড়ি দেয়ার জন্যে শ্রীরাম যখন সেতু নির্মান করতে চাইলেন তখন এই বিশাল কার্য সঠিক ভাবে সম্পাদনের জন্যে তিনি বালুকা দ্বারা একটি শিবলিঙ্গ তৈরি করে পূজো করে মহাদেব কে প্রসন্ন করেন। তিনি লঙ্কা থেকে সীতা কে নিয়ে ফিরবার সময় তাকেও সেটা দেখান।


২। অন্যমতে মহর্ষি পুলস্তের বংশধর রাবণ তাই তাকে হত্যা করে শ্রীরাম ব্রহ্ম হত্যার পাপ করেছেন। তাই লঙ্কা ত্যাগ করে সীতা রাম যখন রামেশ্বর দ্বীপে আসলে তখন ঋষি অগস্ত্য তাকে শিব পূজোর বিধান দেন। শ্রীরাম হনুমানকে কৈলাশে পাঠান শিবলিঙ্গ আনতে। কিন্তু তার দেরী দেখে সীতা বালির শিবলিঙ্গ তৈরি করেন এবং সেই লিঙ্গেই পূজা শুরু করে দেন রামচন্দ্র। ইতিমধ্যে হনুমান শিবলিঙ্গ নিয়ে আসেন। তার মন খারাপ হল কারণ তার আনিত বিগ্রহে পূজো হল না। তখন প্রভু শ্রীরাম ভক্তের ইচ্ছ বুঝতে পেরে সেই বিগ্রহে আবার পুজো করেন। তার পর পুজো শেষে মাতা সীতা সেই বিগ্রহ সরাতে বললে সেটা সরানো গেল না। পরে সীতা যে লিঙ্গটি গড়েছিলেন সেটার নাম হল রামলিঙ্গম আর তার ভক্ত হনুমান আনিত বিগ্রহের নাম হল বিশ্বলিঙ্গম। এবং এই নিয়ম করেন আগে বিশ্বলিঙ্গমের পুজো পরে রামলিঙ্গম। এটা মন্দিরে আজও অনুসৃত হয়ে থাকে। এই হনুমান আনিত বিশ্বলিঙ্গম বিগ্রহ আজ এই মন্দিরে বিশ্বনথ নামে পরিচিত। এই মন্দিরের প্রধান দেবতা রামনাথস্বামী হলেও ভক্ত হনুমানের সন্তুষ্টির জন্যে এই লিঙ্গ প্রথম পূজিত হয়।


স্বামী বিবেকানন্দ এই তীর্থকে খুব ভালবাসতেন। তিনি দুবার এসেছিলেন এখানে প্রথমবার ১৮৯২ সালে দক্ষিণ ভারত পরিভ্রমণের সময়। দ্বিতীয়বার ১৮৯৭ সালের ২৭ জানুয়ারী শিকাগোর বিশ্বধর্মমহাসভায় হিন্দু ধর্মের বিজয় পতাকা উড়িয়ে এসে এই মন্দিরে তখন তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এখানকার সেতুপতি রাজারা ছিল স্বামীজির ভক্ত। তাছাড়া তার খ্যাতি তখন আসমুদ্রহিমাচল। এখানে স্বামী বিবেকানন্দ ইংরেজীতে ভাষণ দেন যেটা পুরোটা পাথরে খোদাই করে শ্রীরামনাস্বামী মন্দিরের মূল প্রবেশ পথের দুই দিকের দেয়ালে স্থাপন করা। এই মন্দিরের ভিজিটার্স বুকে মন্দিরের পূজারী ও কর্মীদের সম্পর্কে লেখা তার মূল্যবান মন্তব্যটিও একটি পাথরে খোদাই করে টানানো আছে। সেখানে তিনি লিখেন নিজ হাতে-I have great pleasure in testifying to the politeness and ready service of the priests and supervisors of this temple.


যাই হোক এই মন্দিরে নানা দেবদেবী প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সারা বছর তাদের পূজো হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে মহাশিরাত্রী অন্যতম। এছাড়া প্রায় সকল উৎসবই হয়। এই মন্দির বহিঃআক্রমনের স্বীকার তেমন হয় নি তাই এর ঐতিহ্য সবসময় সমুন্নত থেকেছে। এই মন্দিরের কয়েক লক্ষ একর জমি রয়েছে।বাৎসরিক ব্যায় প্রায় ৭ কোটি টাকা। মন্দিরে বিশাল রত্ন ভান্ডার রয়েছে যা কালে কালে সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রতিদিন ৩০০ দুস্থ মানুষকে এখানে ভোজন করানো হয়।


শিব পুরাণ অনুসারে ভগবান শিব সর্বত্র বিরাজমান হলেও ১২টি স্থানে তিনি জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে বিরাজমান। নিন্মে সে সকল স্থানের বর্ণনা দেয়া হল-


১. সোমনাথঃ বিশ্ব বিখ্যাত মন্দির এটি। এই মন্দির যেমন পবিত্র তেমনি ছিল ঐশ্বর্যশালী। অনেক বার এটা লুন্ঠনকারিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু বারবার বাবা সোমনাথের কৃপায় নতুন করে সে সব তৈরি হয়েছে। ভারতের গুজরাটের কাঠিয়াবাড়িক্ষেত্রে সমুদ্রের কিনারায় এই মন্দির অবস্থিত। এটি প্রাচীনকালে প্রভাসক্ষেত্র নামে পরিচিত ছিল। এই স্থানেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নরলীলা সংবরণ করেন। মন্দিরের অধিষ্ঠিত শিবলিঙ্গের নাম সোমনাথ।


২. মল্লিকার্জুনঃ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে কৃষ্ণানদীর তীরে শ্রীশৈল পর্বতের উপর এই জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির অবস্থিত। এই পর্বত দক্ষিণের কৈলাশ নামেও পরিচিত। মন্দিরের অধিষ্ঠিত শিবলিঙ্গের নাম মল্লিকার্জুন। পৌরাণিক তথ্য থেকে জানা যায় প্রথম মল্লিকা ফুল দিয়ে পুজো হয়েছিল তাই এর নাম মল্লিকার্জুন।


৩. মহাকালেশ্বরঃ এটি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। ভারতের মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী নগরীতে এই শিবলিঙ্গ অবস্থিত। এখানে রয়েছে পূণ্যসলিলা শিপ্রা নদী।


৪. শ্রীওঙ্কারেশ্বর/অমলেশ্বরঃ এই জ্যোতির্লিঙ্গ ভারতের মধ্যপ্রদেশে মহাপবিত্র নদী নর্মদার তীরে অবস্থিত। এই নদী দুই ধারায় বিভক্ত হওয়ায় মধ্যেখানে একটি ঢিপির সৃষ্টি হয়েছে।এই ঢিপিকেই মান্ধাতা পর্বত বা শিবপুরী বলা হয়। পুরাকালে এই পর্বতে কিংবদন্তি মহারাজা মান্ধাতা তপস্যা করে ভগবান শিবকে সন্তুষ্ট করেন। তার নাম অনুসারে এই পর্বতের নাম। এই মন্দিরে সারক্ষণ অন্ধকার থাকে তাই সবসময় আলো জ্বালানোর দরকার হয়। এটা প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট শিবলিঙ্গ। এই শিব লিঙ্গের দুই রূপ। এক ওঙ্কারেশ্বর, দুই অমলেশ্বর। অমলেশ্বর ওঙ্কারেশ্বর থেকে কিছুটা দূরে নর্মদার দক্ষিণ তটে অবস্থিত। দুই শিব লিঙ্গকে এক হিসাবে গণনা করা হয়।


৫. কেদারনাথঃ কেদারনাথ এক জগৎ বিখ্যাত তীর্থ। এটা হিমালয়ের কেদার শৃঙ্গে অবস্থিত। এর পশ্চিমপাশে রয়েছে পবিত্র মন্দাকিনী নদী। কেদার শৃঙ্গের পূর্বদিকে অলকনন্দা নদীর তীর রয়েছে আরেক বিখ্যাত তীর্থ বদ্রীনাথ ধাম।


৬. ভীমেশ্বরঃ আসামের গৌহাটির কাছে ব্রহ্মপুর পাহাড়ে এই জ্যোর্তিলিঙ্গ অবস্থিত। রাবণের ছোট ভাই কুম্ভকর্ণের পুত্র ছিল ভীম, সে কামরূপে থাকত। তিনি তার পিতার হত্যার প্রতিশোধের জন্যে তপস্যা করে দিগ্বিবিজয়ের বর নিলেন। সব সময় শ্রীহরির বিরুদ্ধে চিন্তা তার। এসময় কামরূপের পরম শিবভক্ত রাজা সুদক্ষিণকে সে আক্রমণ করে। তাকে বন্দি করে। এদিকে দেবতাদের শিব কথা দিয়েছেন এই অত্যাচারীকে বধ করবেন। অন্যদিকে শিবভক্ত রাজা সুদক্ষিণ বন্দি অবস্থায় একটি শিবলিঙ্গে পুজো করতেন। এটা দেখে ভীম সেটা ভাঙতে আসলে স্বয়ং দেবাদিদেব প্রকটিত হয়ে তাকে ধ্বংস করেন। সেই থেকে এখানে বাবা জ্যোর্তিলিঙ্গ রূপে বিরাজিত।


৭. বিশ্বেশ্বরঃ এই জ্যোর্তিলিঙ্গ ভারতের উত্তর প্রদেশের বারাণসী বা কাশি নগরীতে অবস্থিত। এ এক মন্দিরের শহর। এখানে ভগবান শিব বিশ্বেশ্বর বা বিশ্বনাথ নামে পরিচিত।


৮. শ্রীত্র্যম্বকেশ্বরঃ এটি ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশে অবস্থিত। এই প্রদেশের নাসিক থেকে ৩০ কিঃমিঃ পশ্চিমে এর অবস্থান।


৯. বৈদ্যনাথঃ বাবা বৈদ্যনাথ নামে পরিচিত এই জ্যোর্তিলিঙ্গ ভারতের বিহারের সাওতাল পরগণাতে অবস্থিত। এই জ্যোতির্লিঙ্গের কৃপাতে মানবের রোগ মুক্তি হয় বলে বিশ্বাস আছে। এটিই একমাত্র তীর্থ যা একাধারে জ্যোতির্লিঙ্গ ও শক্তিপীঠ।


১০. নাগেশ্বরঃ এই জ্যোতির্লিঙ্গটিও গুজরাটে অবস্থিত। দ্বারকা থেকে কিছু দূরে এর অবস্থান।


১১. সেতুবন্ধ রামেশ্বরঃ এটি দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশে অবস্থিত। বিস্তারিত জানতে ১৯০ নং প্রশ্ন দেখুন।


১২. শ্রীঘুশ্মেশ্বর/ঘৃষ্ণেশ্বরঃ এটি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের শেষ জ্যোতিলিঙ্গ। এটা মহারাষ্ট্র প্রদেশের দৌলতবাদ থেকে বার মাইল দূরে বেরুল গ্রামের কাছে অবস্থিত। মন্দিরটি ইলোরার গুহামন্দিরের কাছে অবস্থিত।


সুদর্শন চক্র দ্বারা খন্ডনকৃত সতীর ডান হাত পড়ে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ ধামে। গবেষকদের মতে সতীর স্মৃতি বিজড়িত চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ ধামের নাম প্রথমে ছিল সতীকুন্ড কালের বিবর্তনে তা সীতাকুন্ড হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।তবে বিষয়টি বির্তকিত। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী(শিব চতুর্দশী) তিথিতে মানুষের মেলা বসে চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩৭ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সীতাকুন্ড পাহাড়ে। ৩৫০ কিলোমিটারের এক বিশাল অংশের পাহাড় এলাকা ঘিরেই আবর্তিত এ তীর্থক্ষেত্র। এ অংশের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। পাশাপাশি এখানে দুই পাহাড়ের শীর্ষস্থানে আছে দুটি মন্দিরের অবস্থান। একটি বিরুপাক্ষ মন্দির অন্যটি চন্দ্রনাথ মন্দির। চন্দ্রনাথ মন্দিরটি সমতল ভূমি থেকে ১৩০০ ফুট উচ্চে পাহাড়ের শীর্ষদেশে অবস্থিত।এ মন্দির তথা পাহাড় একে অন্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে চন্দ্রনাথ ধাম হিসাবে পরিচিতি লাভ করে । প্রতি বছর শ্রীশ্রী শিবরাত্রি ব্রত উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রধান তীর্থস্থান হিসাবে খ্যাত চন্দ্রনাথ ধামে বসে মানুষের মিলন মেলা।


তীর্থস্থান পবিত্র স্থান। তীর্থের জল, মাটি বাতাস সবই পবিত্র ।তাইতো তীর্থ স্থানে গেলে মন পবিত্র হয়। মনে ধর্ম ভাব জাগে। ধর্মভাব জাগরনে মনের কলুষতা দূর হয়। পাপ কাজ থেকে মনকে সরিয়ে আনা সম্ভব হয়। তীর্থস্থান মানুষের মিলন মেলার স্থান। সেখানে গেলে কোন হিংসা-বিদ্বেষ, উচু নীচু ভেদ বৈষম্য কিংবা জাগতিক লোকসানের চিন্তাবোধ থাকেনা। তীর্থস্থান ভ্রমনের ফলে মনের ময়লা দূর হয়,পূর্ন্য আসে,মন জুড়ায়,অশান্তি দুর হয়।তাইতো কবি বলেছেন-

‘‘তীর্থের মহিমা না করা যায় বর্ণন ,

করিলে ভ্রমন হয় মনের পবিত্রতায় পুণ্য সঞ্চালন’’।


সীতা মন্দির নামে পাহাড়ের পাদদেশে আছে একটি মন্দির। এ মন্দিরটির অবস্থান আকর্ষনীয়। ধর্মীয় গাম্ভীর্যের ভাব আর প্রকৃতির নির্ঝরনী শব্দ দুয়ে মিলে মনোরম দূশ্য মুগ্ধ করে আগন্তুক ভক্তদের। উক্ত মন্দির অভ্যন্তরে আছে চতুর্ভূজা সীতাদেবীর মূর্তি। ত্রিপুরার ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী সম্ভুনাথ মন্দিরের প্রথম কাজ হয়েছিল ১৫০১ খ্রিষ্ঠাব্দে ।১৯২০/১৯২৪ সালে এ মন্দিরটি সংস্কার করেন ত্রিপুরার মহারানী রত্নমঞ্জরী। এ ছাড়াও মধ্যবর্তী পাহাড়ে আছে আরও বেশ কয়েকটি মন্দির। স্বয়ম্ভুনাথ, রামকুন্ড, লক্ষনকুন্ড মন্দিরের নাম বিশেষভাবে উল্যেখযোগ্য।উল্লেখিত মন্দির গুলোর মধ্যে এই তিথিতে ভক্ত সমাগম ?

: গোস্বামী তুলসীদাসজী সংক্ষিপ্ত জীবনী 

***********************************

দ্বিতীয় পর্ব

**********

সম্বৎ ১৫৮৬ (বঙ্গাব্দ ৯৩৭ সাল) জ্যৈষ্ঠ শুক্লা ত্রয়ােদশী বৃহস্পতিবারে ভরদ্বাজগােত্রীয় এক সুন্দরী কন্যার সাথে তার বিবাহ হয় এবং তিনি নববধূর সাথে সুখে দিনাতিপাত করতে থাকেন। একবার তার স্ত্রী তার ভাই-এর সাথে নিজের মায়ের কাছে যান। তুলসীদাসজীও পেছন পেছন সেখানে গিয়ে পৌঁছলেন। ওঁর স্ত্রী এর জন্য তাকে অত্যন্ত

ভৎসনা করেন এবং বলেন, “আমার এই রক্তমাংসের শরীরে তােমার যে আসক্তি এর অর্ধেকও যদি তুমি ভগবানকে দিতে তাহলে তােমার বন্ধন মুক্তি হয়ে যেত"। কথাটা তুলসীদাসের মনে লেগে গেল। একমুহূর্তও বিলম্ব না করে তিনি তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে চলে গেলেন।

সেখান থেকে তুলসীদাস প্রয়াগে আসেন। সেখানে তিনি গৃহস্থবেশত্যাগ করে সাধুবেশ ধারণ করেন। তারপর নানা তীর্থ পর্যটন করে আবার কাশী এসে পৌঁছান। মানস সরােবরের তীরে তিনি কাকভূশণ্ডীর

দর্শন লাভ করেন।


 কাশীতে তুলসীদাসজী রামকথা গান করতে লাগলেন। সেখানে একদিন এক প্রেতের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়, সে তাকে হনুমানজীর

সন্ধান দিয়ে দেয়। হনুমানজীকে দর্শন করে তুলসীদাস তার কাছে রঘুনাথের দর্শন প্রার্থনা করেন। হনুমানজী বলেন, “চিত্রকূটে তােমার

সঙ্গে তার দেখা হবে। তখন তুলসীদাস চিত্রকূট যাত্রা করেন। চিত্রকূট পৌঁছে তিনি রামঘাটে তাঁর আসর বসালেন। একদিন তিনি পরিক্রমা করতে বেরুলেন। পথে তার শ্রীরামের দর্শন হয়। তিনি দেখেন যে অতি সুন্দর দুই রাজকুমার ধনুর্বাণ হাতে ঘােড়ায় চড়ে যাচ্ছেন। তিনি তাদের দেখে মুগ্ধ হয়ে যান কিন্তু তাদের চিনতে পারেননি। পেছন থেকে

হনুমানজী এসে তাকে সব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন, তখন তার আর অনুতাপের সীমা রইল না। হনুমান তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন যে

প্রাতঃকালে তার আবার দর্শন হবে।।


১৬০৭ সম্বৎ (৯৫৮ বঙ্গাব্দ) মৌনী অমাবস্যা বুধবার ভগবান শ্রীরাম আবার তুলসীদাসের সামনে আবির্ভূত হন। তিনি বালকরূপে তুলসীদাসকে বললেন, বাবাজী ! আমায় একটু চন্দন দাও তাে ! হনুমান ভাবলেন যে তুলসীদাস এবারও যেন আর ভুল না করে ! তােতাপাখির রূপ ধরে তিনি তখন এই দোহাটি বললেন-

চিত্রকূট কে ঘাট পর ভই সন্তন কে ভীর।।

তুলসীদাস চন্দন ঘির্সে তিলক দেত রঘুবীর।।।


তুলসীদাস সেই মনােহর মূর্তি দেখে আত্মবিস্মৃত হয়ে গেলেন।ভগবান শ্রীরাম নিজের হাতে চন্দন নিয়ে নিজের কপালে এবং পরে তুলসীদাসের কপালে ফোটা দিয়ে অন্তর্ধান করলেন।


 ১৬২৮ সম্বতে (৯৭৯ বঙ্গাব্দ) হনুমানজীর নির্দেশে তিনি অযােধ্যায় পাড়ি দেন। তখন প্রয়াগে মাঘমেলা হচ্ছিল। তিনি কয়েকদিন সেখানে থেকে গেলেন। উৎসবের ছয় দিন পরে একটি বটগাছের

নীচে তিনি ভরদ্বাজ ও যাজ্ঞবল্ক্য মুনির দর্শন পান। শূকরক্ষেত্রে তিনি নিজের গুরুর মুখে যে কাহিনী শুনেছেন সেদিন সেইসময় সেই রামচরিতমানসেরই আলােচনা হচ্ছিল। সেখান থেকে তিনি কাশী চলে যান এবং প্রহ্লাদঘাটে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে থাকতে লাগলেন। সেখানে

তার ভেতরকার কবিশক্তির প্রকাশ হয় এবং তিনি সংস্কৃত ভাষায় পদ্য লিখতে থাকেন। কিন্তু দিনেরবেলা তিনি যেসব কবিতা লিখতেন।

রাত্রিবেলা সেগুলি মুছে যেত। এই ঘটনা রােজ ঘটত। অষ্টমদিনে তুলসীদাস এক স্বপ্ন দেখেন যে দেবাদিদেব মহাদেব তাকে নিজের ভাষায়

কাব্য রচনার নির্দেশ দিচ্ছেন, তার স্বপ্ন ভেঙে গেল তিনি উঠে বসলেন।সেই মুহূর্তে হর-পার্বতী তার সামনে আবির্ভূত হলেন। তিনি তাদের

সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। মহাদেব বললেন ‘তুমি অযােধ্যায় গিয়ে বাস করাে এবং হিন্দীভাষায় কাব্য রচনা করাে। আমার আশীর্বাদে তােমার কাব্য সামবেদের সমান ফলবতী হবে। এই কথা বলে গৌরী ও শংকর ভগবান অন্তর্ধান করলেন। এই নির্দেশ অনুসারে তুলসীদাস কাশী থেকে অযােধ্যায় চলে আসেন।


চলবে.......


✍️পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

 সৃষ্টি সাহিত্য যাপন

প্রবন্ধ


গোস্বামী তুলসীদাসজী সংক্ষিপ্ত জীবনী 

***********************************

চার  পর্বে সমাপ্ত


প্রথম পর্ব

***********


শ্রীগুরু চরণ সরোজ রজঃ নিজমন মুকুর সুধার

বরনউ রঘুবর বিমল যশ জো দায়ক ফল চার।

বুদ্ধিহীন তনু জানিকে সুমিরো পবন কুমার

বল বুদ্ধি বিদ্যা দেহু মোহে হরহু কলেস বিকার।


-গোস্বামী তুলসীদাস


অর্থ - গোস্বামী তুলসীদাসজী বলছেন শ্রীগুরুর চরণকমলের ধূলি দিয়ে নিজের মনের আয়নাকে মুছে রঘুবরের অর্থাৎ শ্রীরামচন্দ্রের মালিন্যবর্জিত যশ কীর্তন করছি যা চতুর্বর্গ ফল অর্থাৎ ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ, দান করে, আমি বুদ্ধিহীন জেনে আমার গুরু পবনকুমার হনুমানজির গুনগান করে প্রার্থনা করছি আমায় যেন তিনি বল, বিদ্যা, বুদ্ধি দিয়ে ক্লেশ ও বিকার হরণ করেন।


এটি আমরা সবাই জানি "হনুমান চালিসা"র শুরুর পদ যার রচয়িতা গোস্বামী তুলসীদাসজী। এছাড়া  রামচরিতমানস এমন একটি গ্রন্থ যা আপামর ভারতীয় জনজীবনে বিপুল প্রভাব ফেলেছে, আমার এই গ্রন্থ এতো প্ৰিয় যে ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে আমার এই গ্রন্থ আর স্বয়ং তুলসীদাসজী যিনি রামচরিতমানসের রচয়িতা তিনি এক অবতারকল্প মহাত্মা ছিলেন । তাই তাঁর জীবনের কিছু পুণ্যকথা একটু জানতে চেষ্টা করেছি মাত্র ।


গোস্বামী তুলসীদাসজী রামানন্দী বৈষ্ণব সাধক কবি,যিনি পরিচিত তাঁর ইষ্ট রামের প্রতি অটুট ভক্তির জন্য ।সংস্কৃত এবং আওয়াধি ভাষায় তাঁর অনেক রচনা থাকলেও তাঁকে আমরা চিনি মূলতঃ রামচরিতমানসের রচয়িতা হিসেবে যেটি সংস্কৃত বাল্মীকি রামায়ণের আওয়াধি রূপ হিসেবে মানা হয়, যদিও রামচরিতমানসে অধ্যাত্ম রামায়ণের প্রভাব স্পষ্ট ।


তুলসীদাসজীর রচনার মধ্যে রামচরিতমানস ছাড়া প্রসিদ্ধ বিনয় পত্রিকা, গীতাবলী, দোহাবলী,সাহিত্য রত্ন,হনুমান চালিসা,বৈরাগ্য সন্দীপনী,জানকী মঙ্গল, পার্বতী মঙ্গল ইত্যাদি।তুলসীদাসজীকে সন্ত, অভিনব বাল্মীকি, ভক্ত শিরোমনি প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করা হয় ।


"আমি সমগ্র জগতকে প্রণতি জানাচ্ছি করজোড়ে এই মনে করে যে সর্ব জগৎ শ্রীরামচন্দ্র ও সীতামায়েরই প্রতিরূপ"- তুলসীদাসজী তাঁর জীবনের বেশিরভাগটা অতিবাহিত করেনর বারাণসী ও ফয়জাবাদে । বারাণসীর গঙ্গার তুলসী ঘাটের নামকরণ তাঁরই নামে হয়েছে ।বারাণসীর সংকটমোচন হনুমানজীর মন্দির তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে তাঁর ইষ্টের দর্শন হয়েছিল ।তিনি রামলীলা নাটকের প্রবর্তক,যেটি রামায়ণের লৌকিক যাত্ৰা রূপে অভিনীত হয়ে থাকে ।


তুলসীদাসজীকে মানা হয় হিন্দী, ভারতীয় এবং বিশ্ব সাহিত্যে একজন অন্যতম প্রসিদ্ধ কবি হিসাবে ।তুলসীদাসজী ও তুলসীদাসজীর রচনার অসীম বিস্তারিত প্রভাব রয়েছে ভারতীয় সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে  ও সমাজে  এবং লক্ষ্যণীয় ভাবে প্রভাবিত হয়েছে রামলীলা,ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত,জনপ্রিয় সঙ্গীত এবং দূরদর্শনের ধারাবাহিক।


তুলসীদাস নামটি এসেছে দুটি সংস্কৃত শব্দ জুড়ে, 'তুলসী' যা ভগবানের বিষ্ণু ও বৈষ্ণবদের প্রিয় বৃক্ষ আর 'দাস' অর্থে সেবক ।তুলসীদাসজী নিজের জীবন সম্পর্কে খুবই অল্প ঘটনা ও তথ্য বিবৃত করেছেন ।উনবিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত তুলসীদাসজীর জীবন সম্পর্কে দুটি প্রামান্য উৎস ছিল নবদাসজীর 1583 থেকে 1639 এর মধ্যে লেখা ভক্তমাল গ্রন্থখানি আর প্রিয়দাসের 1712 সালে লেখা  ভক্তমালের ওপরে ভাষ্য ভক্তিরসবোধিনী ।নবদাসজী ছিলেন তুলসীদাসজীর সমসাময়িক এবং ছয় লাইনে বর্ণনা করেছেন তুলসীদাসজীকে বাল্মীকির জন্মান্তর হিসেবে ।


প্রয়াগের কাছে বান্দা জেলায় রাজাপুর নামে একটি গ্রাম আছে।সেখানে আত্মারাম দুবে নামে একজন বিখ্যাত সরযূতীরবাসী ব্রাহ্মণ

ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল হুলসী। ১৫৫৪ সম্বৎ (বঙ্গাব্দ ৯০৫ সাল)।এর শ্রাবণ শুক্লা সপ্তমীতে মূলা নক্ষত্রে এই ভাগ্যবান দম্পতির জীবনে বারো  মাস গর্ভে থাকার পর গােস্বামী তুলসীদাস জন্মগ্রহণ করেন। ভূমিষ্ঠ হয়ে বালক তুলসীদাস কাঁদেননি, কিন্তু তার মুখ দিয়ে ‘রাম’ শব্দ বেরিয়েছিল। তার মুখে বত্রিশটি দাঁত ছিল। তাঁর গঠনসৌষ্ঠব পাঁচ

বছরের বালকের মতাে ছিল। এই অদ্ভুত বালককে দেখে পিতা অমঙ্গলের আশঙ্কায় ভীত হয়ে এর সম্বন্ধে নানারকম চিন্তাভাবনা করতে

লাগলেন। এই সব দেখে মা হুলসীর বড়ই দুশ্চিন্তা হল। তিনি বালকের অনিষ্টের আশঙ্কায় দশমীর রাতে নবজাত শিশুকে নিজের দাসীর সাথে

তার শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন এবং পরের দিন তিনি অসার সংসার ত্যাগ করলেন। দাসীর নাম ছিল ‘চুনিয়া’। সে অত্যন্ত আদর যত্নের সাথে

বালকের পরিচর্যা করল। তুলসীদাসের বয়স যখন প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর,তখন চুনিয়ারও মৃত্যু হল এবং বালক তুলসীদাস অনাথ হয়ে গেল।


সে এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সে এ-বাড়ি ও-বাড়ির দরজায় দরজায় তিরস্কৃত হতে লাগল। এইসময় জগজ্জননী পার্বতী দেবীর এই প্রতিভাবান বালকের ওপর দয়া হল। তিনি ব্রাহ্মণীর বেশ ধারণ করে প্রতিদিন এই বালকের কাছে এসে তাকে নিজের হাতে ভােজন করিয়ে যেতেন।


চলবে......

তথ্য সূত্র ও ছবি : শ্রীরামচরিতমানস ও অন্তর্জাল

✍️পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়


: কাশীতে পুলু মানিকের মুখোমুখি

******************************


সেটা ১৯৭৮ সালের জুন মাস, আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি ।আমাদের প্রথমবার কাশ্মীরে যাওয়া হয়েছে, শ্রীনগরে সেবারে আমরা ছিলাম হাউস বোটে টানা দশ দিন। সেবারে গুলমার্গ দেখতে গিয়ে গুলমার্গের গল্ফ ক্লাবে বিগ বি অমিতাভ বচ্চন আর রেখা অভিনীত 'মিস্টার নটবরলাল' সিনেমার শুটিং হচ্ছে দেখা গেল । 'পরদেশিয়া য়ে সাচ হ্যায় পিয়া' গানের লিপ দিয়ে দুবার নেচে রেখা আর অমিতজি এসে বসে পড়লেন দুটো চেয়ারে, সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপরে তাঁদের দুটো বড়ো ছাতা খুলে গেল আর ফ্রুট জুস চলে এলো মুখের সামনে, অনেকখানি হিল দেওয়া জুতো পরা রেখাজি রীতিমতো হাঁফাচ্ছেন তখন, অমিতজিও বেশ ঘর্মাক্ত।  মা এগিয়ে গিয়ে  অমিতাভজির কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিলেন একটা এক টাকার নোটের ওপরে তাঁকে বাংলার জামাই বলে । খুশি হয়ে দেন তিনি অটোগ্রাফ।সোনমার্গ, গুলমার্গ, পাহেলগাঁও, চশমাশাহী, শালিমার গার্ডেন্স, রওজা বল, ক্ষীর ভবানী সব দেখে প্রচুর আখরোট, কাঠবাদাম আর কেশর কিনে ফেলা হল কাশ্মিরী শাল আর কোটের সঙ্গে । ফেরবার সময়ে মায়ের ইচ্ছেতে ঠিক হল আমরা কাশীর বিশ্বনাথকে দর্শন করে ফিরব। আমরা এলাম কাশীতে, উঠলাম ভোলাগিরি ধর্মশালাতে। ওখানে আমরা দিন পাঁচেক ছিলাম সেবারে।কাশীতে আমরা আগেও বার কয়েক এসেছি। এবারে বিন্ধ্যাচল আর সারনাথ দেখে আমরা ঠিক করলাম দাদুর এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আসবো সকালের দিকে । সেই মতো ব্রেকফাস্ট সেরে বেড়িয়েছি ।


কাশীর বাঙ্গালীটোলায় ঢোকার রাস্তাতে দেখি একটা জায়গা ঘেরা আর কিছু লোকজন ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু দেখছে। ওটা পেরিয়ে আমাদের এগোতে হবে, তাই আমরাও দাঁড়ালাম । দেখি ওই ঘেরা জায়গার ঠিক মাঝখানে খুব লম্বা একজন লোক, তাঁর পাশে প্রিন্টেড শার্ট পড়া একজন খুব ফর্সা ভদ্রলোক, বড়ো চোখের মাঝারি উচ্চতার একজন লোক আর টাক মাথা একজন লোক দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন । শুনলাম জায়গাটা শুটিঙয়ের জন্য ঘেরা রয়েছে । মা উত্তেজিত হয়ে বাবাকে বললেন, "দেখো, দেখো, সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চ্যাটার্জী, উৎপল দত্ত আর সন্তোষ দত্ত"। যেখানে দাঁড়িয়ে মা কথাগুলো বলছেন বাবাকে, ওঁরা তার শ্রবণসীমার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন । ওঁরা ঘুরে মাকে দেখলেন ।মা বাবাকে বললেন,"শিগগির আমাকে একটু কাগজ দাও, অটোগ্রাফ নেব"। বাবা পকেট  হাতড়ে কটা এক টাকার নীল নীল নোট বার করে মায়ের হাতে দিলেন। যারা ঘিরে রেখেছিল জায়গাটা তারা তখন ঘেরাটা খুলছে। মা জিজ্ঞেস করলেন,"শুটিং হয়ে গেছে?" তাঁরা বললেন, "হ্যাঁ, ক্যামেরা খুলছি এখন।"


মা ছুটলেন স্বনামধন্যদের দিকে, আমি তখন এতো কিছু বুঝি না, তবু আমাকে নিয়েই ছুটলেন মা । গিয়ে অটোগ্রাফের জন্য সেই টাকাগুলো বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কোন সিনেমার শুটিং এটা"? সত্যজিৎ বাবু তাঁর বিখ্যাত ব্যারিটোনে জবাব দিলেন,"জয় বাবা ফেলুনাথ"। সৌমিত্র চ্যাটার্জী জানতে চাইলেন," আপনারা কোথা থেকে এসেছেন ? কোথায় উঠেছেন "? মা উত্তর দিলেন,"দুর্গাপুর থেকে এসেছি, ভোলাগিরি ধর্মশালায় উঠেছি "। সৌমিত্রবাবু বললেন,"ও আপনারা তাহলে বাংলাতেই আছেন ।"বলে আমার গালটা টিপে বললেন,"জয় বাবা ফেলুনাথ তোমাদের খুব ভালো লাগবে। কোন ক্লাস তোমার"?বললাম "ক্লাস ফাইভ ".। পাশ থেকে সত্যজিৎ বাবু জিজ্ঞেস করলেন,"সন্দেশ পড়ো?" মা আমার হয়ে জবাব দিলেন, "ওখানে পাওয়া যায় না "। উনি বললেন,"ডাকে নিয়ে নিন "। ওঁরা সকলে মিলে বললেন মাকে,"এখানে কেউ তেমন চেনে না এখনো, তাই কাজটা এগোচ্ছে । কলকাতা হলে আর দেখতে হত না "। বলে হাসতে লাগলেন । সত্যি খুব আশ্চর্যের যে ওখানে কেউ সেই সময় খুব একটা কৌতূহলী দেখলাম না। আমরা অটোগ্রাফ নিয়ে আর সেই দাদুর বন্ধুর বাড়িতে যাইনি। মা ভীষণ উত্তেজিত আর একেবারে আপ্লুত ছিলেন। সেদিনই আমাদের ফেরার ট্রেন ছিল সন্ধেবেলায় । আমরা ফিরে এলাম । মা জনে জনে খুব গর্ব করে দেখালেন সেই অমিতজি, সত্যজিৎ রায়, উৎপল দত্ত, সৌমিত্র চ্যাটার্জী আর সন্তোষ দত্তের সই করা নোটগুলো । যথাসময়ে 'জয় বাবা ফেলুদা' রিলিজ করল, আমরা সিনেমা দেখে সনাক্ত করলাম সেই জায়গাটা যেখানে আমাদের সঙ্গে ওঁদের দেখা হয়েছিল ।


এরপরে বেশ কিছু বছর পরে সৌমিত্র চ্যাটার্জী অভিনীত 'নামজীবন' দেখতে গেছি Calcutta  Tramways এর অফিস রিক্রিয়েশন ক্লাবের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামে । মামা ছিলেন ওই ক্লাবের কালচারাল সেক্রেটারি । নাটক শেষ হবার পরে মাকে মামা নিয়ে গেলেন গ্রিনরুমে, আমিও গেলাম সঙ্গে। মাকে মামা আলাপ করাচ্ছেন যখন মা তখন কাশীর ঘটনাটা বলতেই উনি একবারেই চিনলেন এবং নিতান্ত পরিচিতের মতো মায়ের, আমার কুশল জানতে চাইলেন। মহতের মহত্বের আরো একবার পরিচয় পেলাম । যতদিন বেঁচে ছিলেন মা, মায়ের খুব priced possession ছিল ওই অটোগ্রাফ সম্বলিত নোটগুলো ।


আমাদের CMC অফিসের আমার কতিপয় কলিগের পুলুদা ছিলেন নিতান্ত কাছের জন, কারণ তাঁরা সকলেই নাটকের লোকজন।অফিসের পরে ওটাই ছিল তাঁদের বেঁচে থাকার রসদ।সেই সূত্রে আমাদের অফিসের প্রোগ্রামেও উনি এসেছেন উত্তমমঞ্চে, তরুণকুমারের সঙ্গে গল্প করতে করতে উঠেছেন স্টেজে আবৃত্তি করতে। প্রতিবার শুধু মনে হয়েছে উনি আমাদেরই লোক, কিন্তু আমাদের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র যাঁকে দেখি, অনুভব করি আর মননে, চিন্তনে অপার শ্রদ্ধাতে যাঁকে পুজো করি । রবীন্দ্র কবিতায়, সুকুমার রায়ের কবিতায়, শঙ্খ সুনীলের কবিতায় বার বার দেখি ওঁর বাচিক সত্তা, চলচ্চিত্রে দেখি ওঁর নায়ক ও অভিনেতা সত্তা,ওঁর লেখায় দেখি ওঁর কবি সত্তা, নাটকে দেখি ওঁর নাট্যকার সত্তা,আর এতো বছর ক্যান্সার নিয়ে কাজ করে যাওয়ার মধ্যে দেখি ওঁর ভেতরের যোদ্ধাকে । আদ্যন্ত বাঙ্গালী আইকন সৌমিত্র চ্যাটার্জী চিরকাল থেকে যাবেন আমাদের মননে, চিন্তনে, ধ্যানে তাঁর অপরিমেয় বহুমুখী কাজের মধ্যে। পঁচাশি বছর তিনি রইলেন আমাদের মধ্যে বেঁচে, আজ শেষযাত্রাতে তিনি অমরত্ব প্রাপ্ত হলেন ।পরিশেষে একটু বলি কাব্যে ছন্দে :


"শোকস্তব্ধ বাঙ্গালী আজ ফেলুদার প্রয়াণ

কে আছে করবে ময়ূরবাহন,সন্দীপ, উদয়ন?

বহু বছরের অমর চরিত্র ভরা তোমার ঝুলিতে,

কত যে বৈচিত্র্য তাদের শেষ হয় না বলিতে,

বেঁচে থাকবে তুমি সকল বাঙালির মননে,

পুলু আসবে ফিরে ফিরে তুমি স্বপ্নে শয়নে"।


পম্পার লেখনীতে

ছবি সৌজন্য :অন্তর্জাল

 সৃষ্টি সাহিত্য যাপন

আধ্যাত্মিক বিষয়


ওঁ বা ওঁ-কারতত্ত্ব বা প্রণবতত্ত্ব

**************************

দ্বিতীয়  পর্ব

**********

★ ওঁ-কারের মাহাত্ম্য  সনাতন শাস্ত্রের সর্বত্রই কীর্তিত হয়েছে। কিন্তু অধিকতর বিস্তারিত ওঁ-কার তত্ত্ব বেদান্তেই উত্তমরূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অতএব আমি সেই বেদান্ত অনুসরণ করেই সমগ্র তত্ত্বের ভিত্তি করছি । এই লেখার মধ্যে কোথাও আমার কোন নিজস্ব উক্তি নাই। সমস্তই শাস্ত্রের আনুকুল্যে উপস্থাপন করছি । পাঠক যদি মনে করেন কোন অংশে আমার নিজস্ব হস্তক্ষেপ রয়েছে তা হলে দয়া করে মন্তব্য করবেন। ★


★কঠোপনিষৎ ১/২/১৫-১৭ :- বেদসমূহ একবাক্যে যে ঈপ্সিত বস্তুর প্রতিপাদন করেন, সমস্ত তপস্যাদি কর্মরাশি যাঁর প্রাপ্তির সহায় এবং যাঁর কামনায় লোকে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করেন, সেই প্রাপ্যবস্তু হইল ওঁ। ইঁহা ওম্ শব্দবাচ্য এবং ওঁ-কার ইহার প্রতীক। অতএব এই ওঁ-কার অপরব্রহ্ম এবং পরব্রহ্ম উভয়াত্মক। এই ওঁ-কারকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করে  যিনি যা ইচ্ছা করেন তাঁর তাই প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ পরব্রহ্ম জ্ঞান কিংবা অপরব্রহ্ম জ্ঞান উভয়ই প্রাপ্ত হয়। ওঁ-কার অবলম্বনই শ্রেষ্ঠ। কঠোপনিষদ মতে, ওঁ-কার পরব্রহ্ম।এই অবলম্বনকে জেনে  সাধক ব্রহ্মলোকে মহীয়ান্ হন।


[পরব্রহ্ম অর্থাৎ নির্বিশেষ ব্রহ্ম। অপরব্রহ্ম অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভ তথা কার্য্যব্রহ্ম। ওঁ-কার অবলম্বনে পরব্রহ্মের ধ্যান করলে সাধক ক্রমে পরব্রহ্ম জ্ঞাত হন। কিন্তু অপরব্রহ্মের ধ্যান করলে অপরব্রহ্ম প্রাপ্ত হন। পরব্রহ্ম প্রাপ্তব্য নয়  কেননা সাধকের আত্ম স্বরূপ উপাধিবিনাশে পরব্রহ্মের সঙ্গে  ঐক্যপ্রাপ্তিকেই ব্রহ্মজ্ঞান বলা হয়।]


প্রশ্ন উপনিষৎ ৫/১-৭ :- শিবিপুত্র সত্যকাম প্রশ্ন করলেন -হে ভগবন্, মনুষ্যগণের মধ্যে যে কেউ যাবজ্জীবন অনন্যসাধারণরূপে প্রণবের অভিধ্যান করেন, তিনি সেই ধ্যানসহায়ে কোন লোকটি জয় করেন?


ভগবান পিপ্পলাদ তাঁকে উত্তর দিলেন- হে সত্যকাম, এই যে প্রসিদ্ধ পরব্রহ্ম এবং অপরব্রহ্ম আছেন, তদুভয়ই ওঁ-কার স্বরূপ ; এই হেতুই ওঁ-কার ব্রহ্মপ্রতীক অবলম্বনে পরব্রহ্ম বা অপরব্রহ্মের অনুগমন করেন। সেই উপাসক যদি কেবল অ-কার মাত্রার ধ্যান করেন, তবে তিনি উক্ত ধ্যান দ্বারা অ-কার মাত্রাকে সাক্ষাৎ করে শীঘ্রই পৃথিবীতে জাত হন কারণ, এই অ-কার মাত্রা তাকে মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত করায়। অ-কার হইল ঋগবেদাত্মক প্রথম মাত্রা। মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত হয়ে তপস্যা, ব্রহ্মচর্য ও শ্রদ্ধা-সমন্বিত হয়ে  জগতে মহিমা অনুভব করেন। আর যদি সাধক উ-কার মাত্রার প্রণবকে নিরন্তর ধ্যান করেন, তবে তিনি আত্মভাব প্রাপ্ত হন কেননা উ-কার হল যজুর্বেদাত্মক দ্বিতীয় মাত্রা। তিনি দেহান্তে যজুঃসমূহের দ্বারা চন্দ্রলোক প্রাপ্ত হন এবং চন্দ্রলোকে ঐশ্বর্য ভোগ করে  পুনরায় মনুষ্যলোকে প্রত্যাগমণ করেন।


কিন্তু যে ব্যক্তি অ, উ, ম এই ত্রিমাত্রাত্মক ওঁ এই অক্ষররূপ প্রতীকে সূর্যমণ্ডলস্থ সেই পরম পুরুষকে নিরন্তর ধ্যান করেন তিনি তৃতীয় মাত্রার স্বরূপ প্রাপ্ত হয়ে  জ্যোতির্ময় সূর্যে বিলীন হন। সর্প যেমন জীর্ণ খোলস ত্যাগ করে তদ্রুপ এই সাধকও সমস্ত পাপ হতে মুক্ত হয়ে  হিরণ্যলোক প্রাপ্ত হন। কালক্রমে তিনি হিরণ্যলোক হতেও উত্তম পরম পুরুষকে দর্শন করেন। ওঁ-কারের তিনটি মাত্রা মৃত্যুর অধীনে। কিন্তু এরা যদি একই ব্রহ্মে নিবিষ্টভাবে সম্বন্ধযুক্ত হন এবং বাহ্যিক, মধ্যম এবং আভ্যন্তরিন স্থানের অধীশ্বরের প্রকৃষ্ট ধ্যান সহায়ে যোগক্রিয়া সমূহে  নিযুক্ত থাকেন তবে সেই যোগী আর বিচলিত হন না। ঋকসমূহের দ্বারা প্রাপ্য মনুষ্যলোক, যজুঃসমূহের দ্বারা প্রাপ্য চন্দ্রলোক এবং সামসমূহের দ্বারা মেধাবীদের অবগম্য ব্রহ্মলোক এই ত্রিবিধ লোককেই উপাসক ওঁ-কার অবলম্বনে প্রাপ্ত হন। এবং যা শান্ত, অজর, অমৃত, অভয় ও সর্বোত্তম তাহাও এই ওঁ-কার প্রতীক অবলম্বনেই প্রাপ্ত হন।


মুণ্ডক উপনিষৎ ২/২/৩-৬ :- উপনিষদে প্রসিদ্ধ মহাস্ত্র ধনু হস্তে নিয়ে সতত চিত্ত নিবিষ্ট করে  সেই অক্ষরকে লক্ষ্যভেদ করতে হবে। ওঁ-কারই ধনু। জীব হল শর, ব্রহ্ম উক্ত শরের লক্ষ্য বলে  কথিত হন। নিষ্কাম হয়ে লক্ষ্যভেদ করতে হবে। অতঃপর সেই লক্ষ্যের সঙ্গে  অভিন্ন হবে। উহা অদ্বিতীয় আত্মা। সেই আত্মাকে অবগত হও। উক্ত আত্মাকে ওঁ-কার অবলম্বনপূর্বক ধ্যান করতে হবে। উক্ত পুরুষ এই হৃদয় মধ্যেই নানারূপে বর্তমান। তাকেই বিবেকীরা ওঁ-কার সহায়ে সর্বতোভাবে দর্শন করে  থাকেন।মুণ্ডক উপনিষদে ওঁ-কার অবলম্বনে ঈশ্বরোপাসনার কথা বলা হয়েছে।


মাণ্ডুক্য উপনিষৎ :- এই সমস্ত কিছুই ‘ওঁ’ অক্ষরাত্মক। ব্রহ্মের সমীপবর্তীরূপে সেই ওঁ-কারের সুস্পষ্ট নির্দেশ কথিত হচ্ছে ।-ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান এই সমস্তই ওঁ-কার। এবং যা কিছু এই ত্রিকালের অতীত তাও ওঁ-কারই। এই ওঁ-কার আত্মার সঙ্গে  অভিন্ন। এই প্রণব ওঁ-কার মাত্রারূপেও বর্তমান। আত্মার পাদসমূহই প্রণবের মাত্রা এবং প্রণবের মাত্রাসমূহই আত্মার পাদ। অ-কার, উ-কার ও ম-কার এরই  মাত্রা। বৈশ্বানর ও অ-কার উভয়েই ব্যাপক অথবা উভয়ই আদি বলে  জাগরিত-স্থান বৈশ্বানরই প্রণবের প্রথম মাত্রা অ-কার। যে উপাসক এইরূপ জানেন, তিনি সমুদয় কাম্য বিষয় লাভ করেন এবং সর্বাগ্রণী হয়ে  থাকেন।


তৈজস এবং উ-কার উভয়ই উৎকৃষ্ট বলে  অথবা উভয়ই মধ্যবর্তী বলে স্বপ্ন-স্থান তৈজসই প্রণবের দ্বিতীয় মাত্রা উ-কার। যিনি এরূপ জানেন তিনি বিজ্ঞান-প্রবাহকে বর্ধিত করেন। তিনি শত্রু-মিত্রে তুল্যজ্ঞান করেন। তার কুলে অব্রহ্মজ্ঞ জাত হন না।


প্রাজ্ঞ ও ম-কার উভয়ই বিলীয়মান আধার বলে সুষুপ্ত-স্থান প্রাজ্ঞই প্রণবের তৃতীয় মাত্রা ম-কার। যে উপাসক এইরূপ জানেন তিনি উপাসনা দ্বারা সমস্ত জগতের আশ্রয়স্বরূপ এবং কারণসমূহ হন।


এইরূপে যথোক্ত জ্ঞানবানের দ্বারা প্রযুক্ত হয়ে  অবশেষে মাত্রাহীন ওঁ-কার তুরীয়, ব্যবহারাতীত, জগতের পরিসমাপ্তিস্থল, শিবময়, অদ্বৈত আত্মরূপেই পর্যবসিত হয়। যিনি এই সত্যস্বরূপ জানেন, তিনি স্বয়ং পরমাত্মায় বিলীন হয়ে  যান। আমরা এই সত্য জানলাম যে ওঁ-কারের তিন মাত্রার ভিন্ন ভিন্ন উপাসনায় সাধক উত্তম লোকসকল প্রাপ্ত হন এবং পুণর্জন্ম হয় কিন্তু মাত্রাহীন ওঁ-কারের উপাসনাতেই কেবল মোক্ষপ্রাপ্ত হয়।


তৈত্তিরীয় উপনিষৎ ১/৮ :- সর্ববেদের সার ওঁ। ওঁ শব্দটিকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করবে। শব্দরূপ ওঁ-কারের দ্বারা পরিব্যাপ্ত বলে  এই সমস্তই ওঁ-কারস্বরূপ। ওঁ শব্দটি সম্মতিজ্ঞাপক বলিয়া প্রসিদ্ধ। অধিকন্তু “ওঁ দেবগণকে মন্ত্র শ্রবণ করাও”- এই কথা বললে ঋত্বিকগণ শ্রবণ করিয়ে  থাকেন। ওঁ উচ্চারণপূর্বক সামগান সমূহ গান করে  থাকেন। ” ওঁ শোম্”- এই বলিয়া শস্ত্রনামক স্ত্রোত্রসমূহ পাঠ করেন। ওঁ উচ্চারণ করিয়া অধ্বর্যু প্রতিগর উচ্চারণ করেন। ওঁ উচ্চারণ করিয়া ব্রহ্মা অনুজ্ঞা প্রকাশ করেন। ওঁ বলিয়া অগ্নিহোত্র অনুমতি প্রদান করা হয়। বেদ বা ব্রহ্ম লাভ করব মনে করে  বেদপাঠক বা ব্রহ্মজিজ্ঞাসু ওঁ উচ্চারণ করেন, এবং তজ্জন্য তিনি অবশ্যই বেদ বা ব্রহ্ম লাভ করেন।


ছান্দ্যোগ্য উপনিষৎ ১ম অধ্যায় :- উদগীথ্ শব্দ-বাচ্য “ওঁ” এই অক্ষরকে উপাসনা করবে; কারণ “ওঁ” এই শব্দ হতে আরম্ভ করে উদগীথ্ গান করা হয়। সেই অক্ষরের উপাসনা, ফল, মহিমা প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাখ্যা করছি। ওঁ পরমাত্মার প্রিয় নাম। মন্ত্রের আদিতে ও অন্তে ওঁ উচ্চারণ করতে হয়। এই শ্রেষ্ঠ অক্ষরই আবার পরমাত্মার প্রতীক। ব্রহ্মের প্রতীকরূপে বা উপাসনার অবলম্বনরূপে গ্রহণ করা হয়। পৃথিবী চরাচর ভূতবর্গের রস, জলরাশি, ঔষধিসমূহ, মানবদেহের ঔষধিরস, বাক রস, ঋক্ মন্ত্রের রস, সাম মন্ত্রের রস, উদগীথ্ ওঁ-কার সামমন্ত্রের রস। সেই যে উদগীথ্ ওঁ-কার, উহাই রসসমূহের মধ্যে রসতম, সর্বোত্তম, পরমাত্মার স্থানীয় এবং অষ্টম। বাক্ই ঋক্, প্রাণই সাম এবং ওঁ। যখন নর-নারী যুগলের মিলন হয় তখন উভয়েরই কাম চরিতার্থ হয়। এতাদৃশ উক্ত যুগলটি ওঁ এই বর্ণাত্মক অক্ষরে সম্মিলিত হয়। উক্ত এই ওঁ-কার সম্মতিজ্ঞাপক। যখন কিছুর অনুমোদন করা হয় তখন ওঁ উচ্চারণ করা হয়। যিনি এই অক্ষর ওঁ-কারকে জানেন কিংবা জানেন না তথাপি উভয়েই এই ওঁ-কার দ্বারাই কর্ম করে  থাকেন। ওঁ-কার অবলম্বনে বেদবিদ্যাবিহিত কর্ম প্রবৃত্ত হয়ে  থাকে। যখন কেউ  ঋক্ কে আয়ত্ত করেন, তখনই তিনি ওঁ এই অক্ষরটি সাদরে উচ্চারণ করেন; যজুঃ ও সাম সম্বন্ধেও একইরূপ। অতএব এই যে ওঁ অক্ষর, এই ‘স্বর’ এই অমর ও অভয়। এতে প্রবেশ করিয়া দেবগণ অমর ও অভয় হইলেন। অনন্তর যা উদগীথ্ তাই প্রণব, যা প্রণব তাই উদগীথ্। ঐ আদিত্যই উদগীথ্, ইনিই আবার প্রণব; কারণ এই সূর্য ওঁ উচ্চারণ করে আকাশমার্গকে ভ্রমণ করান। সূর্যের উদয় হলেই লোক কর্মে প্রবৃত্ত হন। অতএব আবর্তনকালে সূর্যই যেন ওঁ উচ্চারণ করে  তাদের কার্যে অনুমতি ও অনুমোদন প্রকাশ করেন।


ওঁ-ই সমস্ত কিছু। আমরা যা ভোজন করি তাও ওঁ। ওঁ পান করি। ওঁ জ্যোতির্ময়, বর্ষণকারী, প্রজাগণের পতি, জগৎ প্রসবিতা সূর্য এই স্থানে অন্ন আহরণ করেন। এতেও ওঁ উচ্চারণে অন্ন আহরিত হয়।


ছান্দ্যোগ্য উপনিষৎ ২য় অধ্যায় :- প্রজাপতির ধ্যানে যে প্রথম স্বর প্রাদুর্ভূত হল তা ওঁ। সেই ওঁ হতেই সমস্ত শব্দরাশি হল। কেননা অ-কারই সমস্ত শব্দের কারণ। অ- কারই সকল শব্দে ব্যাপ্ত। অতএব ‘এবেদং সর্বমোঙ্কার এবেদং সর্বম্’ ওঁ-কারই এই সমস্ত।


ছান্দ্যোগ্য উপনিষৎ ৮/৬/৫ :- যখন জীবের দেহান্ত হয় তখন তিনি বিদ্বান হলে ওঁ উচ্চারণ হেতু দেহত্যাগ করে উর্ধ্বেই গমন করেন। অবিদ্বান হলে এমন করেন না।


অতএব বিদ্বান হওয়া আবশ্যক। যিনি এই ওঁ-কার তত্ত্ব জানেন তিনিই বিদ্বান। যিনি ওঁ উচ্চারণ করে  কার্য আরম্ভ করেন তিনিই বিদ্বান। যিনি ওঁ উচ্চারণ করে কার্য সমাপ্ত করেন তিনিই বিদ্বান। যিনি জানেন সমস্ত কিছুই ওঁ তিনিই বিদ্বান। যিনি ওঁ-কার তত্ত্ব জেনে  কিংবা না জেনে  উপাসনা করছেন তিনি ওঁ-কারকেই অবলম্বন করছেন। ওঁ-কার মাহাত্ম্য  জেনে যিনি ওঁ-কারকেই একমাত্র অবলম্বন মনে করেন কেবল তিনিই মোক্ষলাভ করেন।


 এই সম্পর্কে গীতায় (৭ অধ্যায় /৮ নং শ্লোক) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “আমি জলের রস, চন্দ্র-সূর্যের কিরণ, বেদের ওঁ(প্রণব), আকাশে শব্দ ও মানুষের মধ্য পুরুষত্ব রূপে বিরাজ করি।”শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, তিনি সকল অক্ষরের মধ্যে ওঁ-কার।

যোগদর্শনের শ্রেষ্ঠ আচার্য পতঞ্জলি যোগসূত্রে সমাধিপাদে(১ম, ২৭-২৮) বলেছেন, “তস্য বাচকঃ প্রণবঃ। তজ্জপস্তুদর্থভাবনম্।”- প্রণব ঈশ্বরের নাম। তাঁর জপ ও চিন্তা করনীয়।


ওঁ বা প্রণব হচ্ছে মন্ত্রের প্রাণ। পূজা বা ধ্যানের সময় মন্ত্র উচ্চারণে “প্রণব” না থাকলে মন্ত্রের ক্রিয়া হয় না, প্রাণশক্তি নেই বলে।


"ওঁ অসতো মা সদ্গময়।


তমসো মা জ্যোতির্গময়।


মৃত্যোর্মামৃতং গময়।


আবিরাবীর্ম এধি।।


রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং,


তেন মাং পাহি নিত্যম্।''


(অর্থাৎ ,--"আমাকে অসত্য হইতে সত্যে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে আমাকে জ্যোতিতে /আলোতে লইয়া যাও, হে স্বপ্রকাশ ,আমার নিকট প্রকাশিত হও। রুদ্র, তোমার যে প্রসন্ন মুখ তাহার দ্বারা আমাকে সর্বদা রক্ষা করো"। )


(From ignorance, lead me to truth;


From darkness, lead me to light;


From death, lead me to immortality


Aum peace, peace, peace " -)


‘ওঁ’. ওঁ-কার.ওঙ্কার, ॐ----


"ওঁ"- নিয়ে করবো চিন্তা,  সাধ্য কি আমার,


তবুও মন চাইলো তাই লিখলাম একটু এবার।


ওঁ-কার ধর্মীয় চিহ্ন হলেও ব্যবহারিক জীবনে ওঁ-কারের প্রয়োগ আরও ব্যাপক।প্রত্যেকটি মন্ত্র ওঁ-কার দিয়েই হয় শুরু যাকে বলে সম্পূটিত করা ।


"ওঁ "শব্দ তিনটি অক্ষরে ( অ ,উ ,ম )মিলিত শব্দ। তবুও আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে কি এমন শক্তি লুকিয়ের আছে এই "ওঁ " শব্দের মধ্যে। যা কিনা আমরা আমাদের ধর্মের প্রতীক রূপে মান্য করি। অসংখ শব্দ  ও চিহ্নের মধ্যে কেবল ওই "ওঁ "/ওম শব্দ কে কেন এত মান্যতা। একটু দেখা যাক এই ওঁ উচ্চারনে কি পরিবর্তন হয়। 


©পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

01.03.2021

: সৃষ্টি সাহিত্য যাপন

গল্প

কলমে : পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

07.05.21


ঈশ্বরের মার 


বেশ বড়ো করে সাইকোলজির হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট ম্যাডাম প্রিয়া চৌধুরীর স্মরণ সভার আয়োজন করেছে কলেজ থেকে আজকে। ঠিক দশদিন আগে মারা গেছেন ম্যাডাম প্রিয়া কোভিডে। উফফফফ.... কী কষ্টই না পেয়েছেন তিনি, প্রথমে কোভিড হলো, তারপর শ্বাসকষ্ট বলে হাসপাতালে দিল, সেখান থেকে আই সি ইউতে। সেখানে থাকতে থাকতে থাকতে তিনি কোমায় চলে গেলেন, শেষ কয়েকদিন লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে রেখেও কিছু করা গেল না যখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শেষে তাঁকে মৃত ঘোষণা করল কিন্তু দেহ দেয়নি বাড়ির লোকেদের হাতে, সেই ধাপার মাঠে গণচিতায় তাঁর দেহও দাহ হলো।বাড়ীতে যার মদের সেলারে দেশী বিদেশী সুরায় ভর্তি তাঁর মৃতদেহ দাহ হলো ঐভাবে..... ভাবা যায়!  শেষের পাঁচ বছর প্রিয়া ম্যাম মোটামুটি অনেকেরই হাতে রেখে মাথা কেটেছেন, যথেচ্ছ দুর্ব্যবহার করেছেন লোকের সঙ্গে।বাড়াবাড়ি রকমের লাগামছাড়া অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করেছেন, কোনো মাংস বাদ দেননি, কোনো খাবার কমসম খাননি আর কেউ যদি বলেছে যে সে এসব খায়না, তাকে সস্তা মধ্যবিত্ত মানসিকতা বলে অপমান করেছেন সর্বসমক্ষে।আজকে স্মরণ সভায় উপস্থিত রয়েছেন ইউনিভার্সিটির হেড এক্সামিনার, কন্ট্রোলার, কলেজের প্রিন্সিপাল, ডিপার্টমেন্টের এক্টিং হেড, ডিপার্টমেন্টের অন্য সব প্রফেসররা, লেকচারাররা, ল্যাব এসিস্টেন্ট হানিফ আর গ্ৰুপ ডি রীতা।এই রীতা যাকে রীতাদি বলা উচিৎ কারণ বয়সে সে অনেকটাই সিনিয়র, উঠতে বসতে তাকে কী না কী বলেছেন তিনি, কিন্তু রীতাদি কখনো ফিরেও একটা জবাব দেয় নি বছর চল্লিশের প্রিয়া ম্যামকে। আর আছে উপস্থিত বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীরা যাদের তোষামোদ আর অন্যায়ভাবে পাইয়ে দেওয়া সুযোগের জন্য প্রিয়া ম্যাম বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তাদের কাছে ।


একপাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন প্রিয়া ম্যাম, কত ভালো ভালো কথা বলছে সবাই তাঁর সম্পর্কে। ওই যে সামনের সারিতে বসে আছে সুমন, দিব্যঙ্গনা, অত্রি এরা তো পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় ফেল করেছিল, ধর্ণা দিয়েছিলো গিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেড এক্সামিনারের আর কন্ট্রোলারের কাছে, এদের ওখানে গিয়ে ধর্ণা দেওয়ার পরামর্শটা তো উনিই দিয়েছিলেন। ওরা ওখানে ধর্ণা দিতে ওদের নাম লিখে নিয়েছিলেন হেড এক্সামিনার আর শিক্ষামন্ত্রীর অনুমোদনে ওদের একসঙ্গে সত্তর জনকে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওদের সেই পাশের আনন্দে উনি বাড়িতে ওদের নিয়ে মদের ফোয়ারা ছুটিয়েছিলেন, সঙ্গে অনুসঙ্গ হিসেবে ছিল গরুর মাংসের গোস্ত কাবাব, পর্ক ভিন্দালু। আসলে এই ছেলেমেয়েরা সবাই ধনী বিত্তবান পরিবারের সন্তান, ওদের বাবা মায়েরা টিউশনের পয়সা আর গিফ্ট ছাড়া প্রায়ই যে তাঁকে নানান সামগ্রী দিয়ে বছরের পুরো সময় তুষ্ট করে রাখে। উনিই বা কী করতেন ওদের পাশ করানোর কৌশল না বলে দিয়ে?


অথচ যে মেয়েটা সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিল, সিরিয়াস ছিল তাকে খুবই তুচ্ছ কারণে একটা বছর পিছিয়ে দিয়ে ছিলেন,তিনদিনের মধ্যে একুশটা প্রাকটিক্যাল করিয়ে ঠিক জমা দেবার দিন বলেছিলেন যে না জমা নেওয়া যাবে না, তারপরেও যখন দেখলেন যে সে প্রাকটিক্যালের ওই পেপারটা ছাড়া বাকী সব পেপারে এবং পাশের সাবজেক্টও সেভেন্টি পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত নম্বরের ব্যাপারে কিপটে জায়গায়,তখন নিষ্ঠুর এক আনন্দে সে যখন আবার পরে ক্লাস করতে এলো পার্ট ওয়ানের তাকে " ক্যাজুয়াল ক্যান্ডিডেট" বলে উঠতে বসতে বিদ্রুপ করে অতিষ্ট করে ভীষণ আত্মপ্রসাদ পেয়েছেন। মেয়েটা বড্ড বেশি ভালো যে, তাকে ঘিরে ছেলেরা প্রপোজ করছে, তার আশেপাশে ঘুরছে আর সেই মেয়েটা শুধুই তার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে,সেটাই তাঁর বুকে জ্বালা ধরাতো। নিজে তিনি গ্রাজুয়েট হতে মোট আট বছর নিয়েছিলেন, তিন বছর তিনটে পরীক্ষার আর বাকী পাঁচ বছর ঘষটে ঘষটে তৈরী হতে, তাই একচান্সে কেউ ভালো ভাবে বেরিয়ে যাবে ভাবলেই গায়ের জ্বালা হত তাঁর। নিজের বিবাহিত জীবন টেকেনি তাই, আর কারো কোনো সম্পর্ক টিকুক উনি চাইতেন না।ডিপার্টমেন্টের অন্যদের উনি বলে দিয়েছিলেন ওই মেয়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে, তিনি ভয়ও পেতেন একদিন যদি ও এসে তাঁর হেড অফ দি ডিপার্টমেন্টের মসনদটা কেড়ে নেয়? তাই তাকে পাশ করতেই দিলেন না।


না আজকে ওই মেয়েটাকে মনে পড়ার কথাই নয় প্রিয়া ম্যামের, মনে পড়েছে একটাই কারণে। মৃত্যুর সাত মিনিট আগে সারা জীবনের কৃত ভালো খারাপ কাজগুলো যখন তিনি দেখছিলেন মহাকালের ইচ্ছেয়, তখন বার বার তাঁর সামনে ভেসে উঠেছে এই নিষ্পাপ ( সত্যিই নিষ্পাপ, কোনো ভান নেই ওর আচরণে সেটা উনি এখন জেনে গেছেন ) মেয়েটার সঙ্গে করা তাঁর দুর্ব্যবহারগুলো। এই মেয়েটা যার নাম অপরাজিতা, সে ছাড়াও আরো কিছু কিছু ছেলেমেয়েরাও তাঁর এই নেতিবাচক মনোভাবের শিকার। যেমন দিশানী, বনিতা, কৌশানি, অনিক, সায়ক, তারা খুব স্বাভাবিক কারণেই কেউ উপস্থিত নেই তাঁর স্মরণসভায়। আস্তে আস্তে ওখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে হাজির হলেন তিনি অপরাজিতার বাড়িতে।


অপরাজিতা বহু কষ্টে গত বছরে অক্টোবরে কোভিডের কারণে অনলাইনে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে, ইচ্ছে করে উনি ওকে এমন ভাবে নম্বর দিয়েছিলেন যাতে ও ফার্স্ট ক্লাস না পায়, পায়ওনি ও। কিন্তু সব কটা এম এর এন্ট্রান্সে চান্স পেয়েছিলো একদম ফার্স্ট লিস্টে, এখন একটা ভালো ইউনিভার্সিটিতে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে এম এ পড়ছে। সেটার ফার্স্ট সেমিস্টারে পঁচাশি শতাংশ নম্বর পেয়েছে, এখন সেকেন্ড সেমেস্টারের প্রস্তুতি চলছে তার। প্রিয়া ম্যামের হাতে আবার পড়তে হবে এই ভয়ে সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এর ফর্মই তোলেনি। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটিতেও ঢোকেনি পাছে আবার প্রিয়া ম্যামের গ্রিপে চলে আসতে হয়। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যেটা লাগলো প্রিয়া ম্যামের যে অপরাজিতা কিন্তু ভীষণ কষ্ট পেয়েছে প্রিয়া ম্যামের অকাল প্রয়াণে।সেটা সে আর তার বাবা মা বার বার আলোচনা করছে বাড়ীতে বসে।এই ব্যাপারটা দেখে শুনে প্রিয়া ম্যামেরও খারাপ লাগছে, বিশেষ করে অপরাজিতার বাবা মা দুজনেই কোভিড আক্রান্ত তা সত্ত্বেও তাদের এই মনোভাব। ওদের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে প্রিয়া ম্যামের নিজেকে বড্ড ছোট মনে হলো, যে তিনি নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য একটা ভালো মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর এবার মনে হলো সত্যিই ঈশ্বর তাঁকে ঠিক শাস্তি দিয়েছেন, তিনি বেঁচে থাকলে এমন আরো কিছু ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন ভাবেই ছিনিমিনি খেলতেন, সেই সুযোগটাই আর ঈশ্বর তাঁকে দিলেন না। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর অশীতিপর বৃদ্ধা মায়ের দুর্দশার শেষ থাকবে না হয়তো, কিন্তু তবুও কিছু নির্দোষ প্রাণ তো রেহাই পাবে।ভগবানের লাঠি যখন পড়ে তখন তাতে শব্দ হয় না বটে, কিন্তু তার অভিঘাত সামলাতে পারে না সবাই, তিনিও পারলেন না। 

বেশ বড়ো করে সাইকোলজির হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট ম্যাডাম প্রিয়া চৌধুরীর স্মরণ সভার আয়োজন করেছে কলেজ থেকে আজকে। ঠিক দশদিন আগে মারা গেছেন ম্যাডাম প্রিয়া কোভিডে। উফফফফ.... কী কষ্টই না পেয়েছেন তিনি, প্রথমে কোভিড হলো, তারপর শ্বাসকষ্ট বলে হাসপাতালে দিল, সেখান থেকে আই সি ইউতে। সেখানে থাকতে থাকতে থাকতে তিনি কোমায় চলে গেলেন, শেষ কয়েকদিন লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে রেখেও কিছু করা গেল না যখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শেষে তাঁকে মৃত ঘোষণা করল কিন্তু দেহ দেয়নি বাড়ির লোকেদের হাতে, সেই ধাপার মাঠে গণচিতায় তাঁর দেহও দাহ হলো।বাড়ীতে যার মদের সেলারে দেশী বিদেশী সুরায় ভর্তি তাঁর মৃতদেহ দাহ হলো ঐভাবে..... ভাবা যায়!  শেষের পাঁচ বছর প্রিয়া ম্যাম মোটামুটি অনেকেরই হাতে রেখে মাথা কেটেছেন, যথেচ্ছ দুর্ব্যবহার করেছেন লোকের সঙ্গে।আজকে স্মরণ সভায় উপস্থিত রয়েছেন ইউনিভার্সিটির হেড এক্সামিনার, কন্ট্রোলার, কলেজের প্রিন্সিপাল, ডিপার্টমেন্টের এক্টিং হেড, ডিপার্টমেন্টের অন্য সব প্রফেসররা, লেকচারাররা, ল্যাব এসিস্টেন্ট হানিফ আর গ্ৰুপ ডি রীতা, এই রীতা যাকে রীতাদি বলা উচিৎ, উঠতে বসতে তাকে কী না কী বলেছেন তিনি, কিন্তু রীতাদি কখনো ফিরেও একটা জবাব দেয় নি । আর আছে উপস্থিত বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীরা যাদের তোষামোদ আর অন্যায়ভাবে পাইয়ে দেওয়া সুযোগের জন্য প্রিয়া ম্যাম বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। একপাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন প্রিয়া ম্যাম, কত ভালো ভালো কথা বলছে সবাই তাঁর সম্পর্কে। ওই যে সামনের সারিতে বসে আছে সুমন, দিব্যঙ্গনা, অত্রি এরা তো পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় ফেল করেছিল, ধর্ণা দিয়েছিলো গিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেড এক্সামিনারের আর কন্ট্রোলারের কাছে, এদের ওখানে গিয়ে ধর্ণা দেওয়ার পরামর্শটা তো উনিই দিয়েছিলেন। ওরা ওখানে ধর্ণা দিতে ওদের নাম লিখে নিয়েছিলেন হেড এক্সামিনার আর শিক্ষামন্ত্রীর অনুমোদনে ওদের একসঙ্গে সত্তর জনকে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওদের সেই পাশের আনন্দে উনি বাড়িতে ওদের নিয়ে মদের ফোয়ারা ছুটিয়েছিলেন, সঙ্গে অনুসঙ্গ হিসেবে ছিল গরুর মাংসের গোস্ত কাবাব, পর্ক ভিন্দালু। আসলে এই ছেলেমেয়েরা সবাই ধনী বিত্তবান পরিবারের সন্তান, ওদের বাবা মায়েরা টিউশনের পয়সা আর গিফ্ট ছাড়া প্রায়ই যে তাঁকে নানান সামগ্রী দিয়ে বছরের পুরো সময় তুষ্ট করে রাখে। উনিই বা কী করতেন ওদের পাশ করানোর কৌশল না বলে দিয়ে?


অথচ যে মেয়েটা সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিল, সিরিয়াস ছিল তাকে খুবই তুচ্ছ কারণে একটা বছর পিছিয়ে দিয়ে ছিলেন,তিনদিনের মধ্যে একুশটা প্রাকটিক্যাল করিয়ে ঠিক জমা দেবার দিন বলেছিলেন যে না জমা নেওয়া যাবে না, তারপরেও যখন দেখলেন যে সে প্রাকটিক্যালের ওই পেপারটা ছাড়া বাকী সব পেপারে এবং পাশের সাবজেক্টও সেভেন্টি পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত নম্বরের ব্যাপারে কিপটে জায়গায়,তখন নিষ্ঠুর এক আনন্দে সে যখন আবার পরে ক্লাস করতে এলো পার্ট ওয়ানের তাকে " ক্যাজুয়াল ক্যান্ডিডেট" বলে উঠতে বসতে বিদ্রুপ করে অতিষ্ট করে ভীষণ আত্মপ্রসাদ পেয়েছেন। মেয়েটা বড্ড বেশি ভালো যে, তাকে ঘিরে ছেলেরা প্রপোজ করছে, তার আশেপাশে ঘুরছে আর সেই মেয়েটা শুধুই তার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে,সেটাই তাঁর বুকে জ্বালা ধরাতো। নিজে তিনি গ্রাজুয়েট হতে মোট আট বছর নিয়েছিলেন, তিন বছর তিনটে পরীক্ষার আর বাকী পাঁচ বছর ঘষটে ঘষটে তৈরী হতে, তাই একচান্সে কেউ ভালো ভাবে বেরিয়ে যাবে ভাবলেই গায়ের জ্বালা হত তাঁর, নিজের বিবাহিত জীবন টেকেনি তাই, আর কারো কোনো সম্পর্ক টিকুক উনি চাইতেন না।ডিপার্টমেন্টের অন্যদের উনি বলে দিয়েছিলেন ওই মেয়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে, তিনি ভয়ও পেতেন একদিন যদি ও এসে তাঁর হেড অফ দি ডিপার্টমেন্টের মসনদটা কেড়ে নেয়? তাই তাকে পাশ করতেই দিলেন না। না আজকে ওই মেয়েটাকে মনে পড়ার কথাই নয় প্রিয়া ম্যামের, মনে পড়েছে একটাই কারণে। মৃত্যুর সাত মিনিট আগে সারা জীবনের কৃত ভালো খারাপ কাজগুলো যখন তিনি দেখছিলেন মহাকালের ইচ্ছেয়, তখন বার বার তাঁর সামনে ভেসে উঠেছে এই নিষ্পাপ ( সত্যিই নিষ্পাপ, কোনো ভান নেই ওর আচরণে সেটা উনি এখন জেনে গেছেন ) মেয়েটার সঙ্গে করা তাঁর দুর্ব্যবহারগুলো। এই মেয়েটা যার নাম অপরাজিতা, সে ছাড়াও আরো কিছু কিছু ছেলেমেয়েরাও তাঁর এই নেতিবাচক মনোভাবের শিকার। যেমন দিশানী, বনিতা, কৌশানি, অনিক, সায়ক, তারা খুব স্বাভাবিক কারণেই কেউ উপস্থিত নেই তাঁর স্মরণসভায়। আস্তে আস্তে ওখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে হাজির হলেন তিনি অপরাজিতার বাড়িতে।


অপরাজিতা বহু কষ্টে গত বছরে অক্টোবরে কোভিদের কারণে অনলাইনে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে, ইচ্ছে করে উনি ওকে এমন ভাবে নম্বর দিয়েছিলেন যাতে ও ফার্স্ট ক্লাস না পায়, পায়ওনি ও। কিন্তু সব কটা এম এর এন্ট্রান্সে চান্স পেয়েছিলো একদম ফার্স্ট লিস্টে, এখন একটা ভালো ইউনিভার্সিটিতে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে এম এ পড়ছে। সেটার ফার্স্ট সেমিস্টারে পঁচাশি শতাংশ নম্বর পেয়েছে, এখন সেকেন্ড সেমেস্টারের প্রস্তুতি চলছে তার। প্রিয়া ম্যামের হাতে আবার পড়তে হবে এই ভয়ে সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এর ফর্মই তোলেনি। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটিতেও ঢোকেনি পাছে আবার প্রিয়া ম্যামের গ্রিপে চলে আসতে হয়। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যেটা লাগলো প্রিয়া ম্যামের যে অপরাজিতা কিন্তু ভীষণ কষ্ট পেয়েছে প্রিয়া ম্যামের অকাল প্রয়াণে।সেটা সে আর তার বাবা মা বার বার আলোচনা করছে বাড়ীতে বসে।এই ব্যাপারটা দেখে শুনে প্রিয়া ম্যামেরও খারাপ লাগছে, বিশেষ করে অপরাজিতার বাবা মা দুজনেই কোভিড আক্রান্ত তা সত্ত্বেও তাদের এই মনোভাব। ওদের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে প্রিয়া ম্যামের নিজেকে বড্ড ছোট মনে হলো, যে তিনি নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য একটা ভালো মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর এবার মনে হলো সত্যিই ঈশ্বর তাঁকে ঠিক শাস্তি দিয়েছেন, তিনি বেঁচে থাকলে এমন আরো কিছু ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন ভাবেই ছিনিমিনি খেলতেন, সেই সুযোগটাই আর ঈশ্বর তাঁকে দিলেন না। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর অশীতিপর বৃদ্ধা মায়ের দুর্দশার শেষ থাকবে না হয়তো, কিন্তু তবুও কিছু নির্দোষ প্রাণ রেহাই পাবে।

: সৃষ্টি সাহিত্য যাপন

ভ্রমণ বৃত্তান্ত


ঈশ্বরের নিজদেশে -তৃতীয় ও শেষ পর্ব

✍️পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

29.01.2021


তারপরের দিন আমরা সকালে দশটার সময় বেরিয়ে পড়লাম মুন্নার থেকে 365 কিমি দূরে তামিলনাড়ুর  কন্যাকুমারীর উদ্দেশ্যে। মুন্নার সিটিতে এসে লোকাল চকোলেট, কেক আর কাজু বাদাম কিনে বেরিয়ে পড়লাম কন্যাকুমারীর জন্য।দীর্ঘ নয় ঘন্টা গাড়িতে যাত্রা বেশ কষ্টকর হয়তো, কিন্তু পথের অপরূপ সৌন্দর্য আর যাত্রাপথের বৈচিত্র্য, কখনো পাহাড়, কখনো জঙ্গল, কখনো সবুজ উপত্যকা, পথের মাঝে মাঝে বিভিন্ন মন্দির, গির্জা, সুসজ্জিত হর্ম্য, কন্যাকুমারীর দু'ঘন্টা আগে থেকে উইন্ডমিলের চাকা ঘোরা এইসব দেখতে দেখতে কখন যে পৌঁছে গেলাম নিজেরাই বুঝতে পারলাম না। আসার পথে আমাদের সারথী একটি রাস্তা ছেড়ে আসার সময় দেখাল ওটি মাদুরাই যাবার রাস্তা। মনে পড়ল ছোট বেলায় পড়া বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই কথা, "সে হিসেবে দেখতে গেলে তুমিও একজন দেশ আবিস্কারক "।নারকেল গাছের সারি, ব্যাকওয়াটার আর তার ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যে দৃশ্যমান সমুদ্র দেখতে দেখতে ৩৬৫ কিমি. পথ গাড়িতে যেতে কিছুটা কষ্ট হলেও সেই জার্নি ছিল খুবই উপভোগ্য।


ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল ৬টা বাজতে যায়, আমাদের গাড়ি “হোটেল ট্রাই সি” র সামনে এসে থামল। মুনিয়ান্ডির সঙ্গে সফরের এইখানেই পরিসমাপ্তি, এখান থেকে সে আবার ফেরত যাবে মুন্নারে, সামনে তার বিয়ে, তাকে অনেক শুভেচ্ছা জানালাম আমরা, তারও দেখলাম একটু মনখারাপ, এই কদিনে তার সঙ্গে আমাদের এক অদ্ভুত বোঝাপড়া হয়ে গেছিল যে। হোটেলের রিসেপশনে কথা বলে আমাদের জন্য বরাদ্দ ঘরে লিফ্টের সাহায্যে চারতলায় উঠে লিফ্ট থেকে নেমে যাবার  জন্য ঢুকেই সোজা চলে গেলাম ব্যালকনিতে, সেখান থেকে তিন সমুদ্রের সঙ্গম ও বিবেকানন্দ রক – ১৩৩ ফুট উঁচু বিখ্যাত তামিল সন্ত কবি থিরুভাল্লুভারের মূর্তি যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে ।অপলক দৃষ্টিতে বিকেলের পড়ন্ত রৌদ্রে সেই দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম। অপূর্ব রঙের সমাহারে দিগন্ত আর সাগরকে রাঙিয়ে সূর্যদেব তখন অস্তাচলগামী।আকাশে নানা রঙের আবিরের সমাহার, সামনে তামিলনাড়ু ট্যুরিজমের হোটেলে দেখলাম তিন চারটি পোষা ময়ূর তাদের ছাদের চিলেকোঠাতে বসে আছে, মাঝে মাঝে ডাকছে। তাদের দেহের রাজকীয় ভঙ্গিমা আর বিচিত্র বর্ণের সমাহার এতো কাছ থেকে দেখে মুগ্ধ হলাম, যে কদিন আমরা ছিলাম তারা তাদের উপস্থিতি আর দর্শন দানে আমাদের ধন্য করে রেখেছিল।এটা আমার দ্বিতীয়বার কন্যাকুমারী আসা, প্রথম বার এসেছিলাম ১৯৮০ সালে, তখন কন্যাকুমারী ছিল একদম ফাঁকা এক মফঃস্বল জায়গা। এখন পুরোপুরি শহর।


একটু পরে রাতের খাবারের জন্য বেরিয়ে খাবার খেয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম সমুদ্রের ধারে, সমুদ্রের নোনা হাওয়ার সাথে জলের ছিটেতে সারাদিনের ক্লান্তি যেন ধুয়ে গেল। আমরা দাঁড়িয়ে আছি ভারতের দক্ষিণতম শেষ স্থলবিন্দুতে, এই ভাবনা মনকে রোমাঞ্চিত করল।কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়ার চাঁদের আলোয় তখন উদ্ভাসিত কন্যাকুমারির সঙ্গম।কি সেই অপূর্ব দৃশ্য!!!“আহা! কি দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না”। বঙ্কিমচন্দ্রের এই অবিস্মরণীয় উক্তিটি এখানে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল।

ঘন্টাখানেক সেখানে থাকার পর ফিরে এলাম হোটেলে।


পরদিন সকাল ৫:৩০টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে চলে এলাম সেই ব্যালকনিতে সূর্যোদয় দেখব বলে।লক্ষ্য করলাম আরো বহু মানুষ সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার জন্য সমুদ্র সৈকতে ভীড় করেছেন। কিন্তু সবার আশা ব্যর্থ করে দিয়ে আরো বেশ কিছুক্ষণ পর সূর্যদেব দেখা দিলেন দিগন্তরেখার অনেক ওপর থেকে।


মেঘের ফাঁক দিয়ে তাঁর কিরণ বিবেকানন্দ রকের ওপর পড়তে লাগল,যেন তিনি তাঁর সব তেজ, শৌর্য, দীপ্তি দিয়ে ওই স্থানকে অভয় প্রদান করছেন।একশো ছাব্বিশ বছর আগে (১৮৯২ সাল) যিনি নাকি ওই উত্তাল সমুদ্রে সাঁতার কেটে পৌঁছে গেছিলেন সেই প্রস্তরখন্ডে এবং ২৫ শে ডিসেম্বর থেকে ২৭ শে ডিসেম্বর, টানা তিন দিন ওই শিলাখণ্ডে বসে ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন যেখানে মাতা কন্যাকুমারী তপস্যা করেছিলেন,সেই বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের নামেই সেই স্থান আজ নামাঙ্কিত – ‘বিবেকানন্দ রক’।


স্নান সেরে ফেরিঘাটে গেলাম বিবেকানন্দ রকে যাবার লঞ্চ (মঙ্গলবার বাদে প্রতি দিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টে পর্যন্ত লঞ্চ চলে) ধরতে । ৫০ টাকা দিয়ে সাধারণ টিকিট কাটার বিশাল লাইনে টিকিট  কেটে লঞ্চটায় চেপে বসলাম লাইফ জ্যাকেট পরে এবং ঢেউয়ের দোলায়  দুলতে দুলতে ৫ মিনিট পর পৌঁছেও গেলাম। রক টেম্পলের প্রবেশমূল্য ২০ টাকা। জুতো খুলে প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে যেখানে উঠলাম সেটা মন্দিরের সামনে দালান বিশেষ। দালানের অপর দিকে আছে শ্রীপদমণ্ডপম মন্দির। এখানে কাঁচের আধারে রক্ষিত আছে দেবী কন্যাকুমারীর পদচিহ্ন।তা দর্শন করে মূল মন্দিরে ঢুকলাম।


ভিতরে বেদির ওপর স্বামী বিবেকানন্দের দণ্ডায়মান মূর্তি। দেখে মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের সেই গান, "বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়, একী গো বিস্ময় ",মূল মন্দির থেকে নেমে এসে গেলাম নীচের মেডিটেশন হলে। শব্দহীন আলো আঁধারিতে ধ্যানগম্ভীর পরিবেশে শুধু ওঁ চিহ্ন থেকে ওঙ্কারধ্বণি বেজে চলেছে। অদ্ভুত সেই অনুভূতিকে যেন ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।সেই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে প্রশস্ত চাতালে দাঁড়ালাম।সমুদ্রের প্রবল হাওয়া যেন মনের সব দীর্ণতাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।সামনেই তিন মহাসমুদ্রের মিলনস্থল,তিনটে জলের তিনটে আলাদা রঙ।  আদি শঙ্করাচার্যের পরে বিশ্বের দরবারে হিন্দু ধর্ম ও ভারতভূমির সম্মানের জয়পতাকা যে আজ সসম্মানে উড্ডীন, তার কৃতিত্ব তো এই যোগীশ্রেষ্ঠ রামকৃষ্ণ মানসপুত্রের।


কত শান্ত, কত উদার, অথচ কত গভীর। যুগ যুগ ধরে এভাবেই যেন ধর্ম,পুরাণ,ইতিহাস,প্রকৃতি,দর্শন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ওই তিন মহাসমুদ্রের মত,যার আভাস আমরা পেলেও নাগাল পাইনা ,যে নাগাল ওই ‘বীর সন্ন্যাসী’ পেয়েছিলেন। শ্রদ্ধায়,ভক্তিতে মাথাটা নত হয়ে গেল।


জায়গাটা থেকে ফিরতে ইচ্ছা করছিল না,তবুও ফিরতি লঞ্চ ধরে ফিরে এলাম ‘ভারতের মূল ভূখন্ডে’।  ঠিক হল পরেরদিন আমরা আবার যাব বিবেকানন্দ রকে।


পরেরদিন সকালে প্রথমে যাওয়া হল ৩০০০ বছর পূর্বে ভগবান পরশুরাম কর্তৃক নির্মিত কন্যাকুমারী মাতার (এখানকার স্থানীয় লোকদের ভাষায় ‘আম্মান’) মন্দিরের উদ্দেশ্যে,এবার অবশ্য পায়ে হেঁটে। কেউ কেউ বলেন এই মন্দির নাকি ৫১ সতী পীঠের একটি, যেখানে সতীর মেরুদন্ড পড়েছিল, এখানে মায়ের নাম সর্বাণী।কথিত আছে এক কুমারি বালিকা তথা দেবী কন্যাকুমারী সমুদ্রের উপর প্রস্তরখন্ডে একপায়ে দাঁড়িয়ে ভগবান শিবকে বিবাহ করার জন্য তপস্যা করলে তাতে শিব খুশি হন এবং বিবাহ করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন সুচিন্দ্রম থেকে কিন্তু দৈব উদ্দেশ্যে জন্ম যে কন্যা কুমারিকার তিনি কুমারী না থাকলে যে অসুরনিধন হবে না, তাই নারদ কাকের ডাক ডেকে শিবের বিবাহযাত্রা রোধ করলেন ফলে মাতা কন্যাকুমারী লগ্নভ্রষ্টা হন এবং রাগে-অভিমানে রান্না করা সমস্ত খাবার ফেলে দেন।আজও দেবী কন্যাকুমারী সেখানে অপেক্ষমান হাতে মালা নিয়ে।


মন্দিরের সামনের প্রস্তরখন্ডগুলি নাকি সেই খাবারের অংশ বলা হয়।যাই হোক জুতো  খুলে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু একি!!!!জনপ্রতি ২০ টাকা প্রণামী (টিকিট বলা ভালো) না দিলে নাকি মন্দিরে ঢোকা যাবেনা,কি আর করা যাবে তাই দিয়ে মন্দিরে ঢুকলাম। সূউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মন্দিরটি যে বেশ পুরোনো তা দেখেই বোঝা যায়,আর মন্দিরের গায়ের ভাস্কর্যের কোন তুলনা নেই। মাতা কন্যাকুমারীকে ভক্তি ভরে পুজো দিয়ে আমরা এসে বসলাম সমুদ্রের পাড়ে। সেখানে ফটো তুলে ত্রিসাগর সঙ্গমের জল ভরলাম। তারপরে স্থানীয় দোকানে ইডলি, দোসা, উত্তাপম আর কফি খেলাম জলখাবারে। দোকানটি স্থানীয় শ্রমিকদের জন্য খাবার বানায়, কিন্তু তাদের খাবারের মান অতুলনীয়।


হোটেলে ফিরে পোশাক পরিবর্তন করে চললাম আরেকবার বিবেকানন্দ রক দর্শনে, আমি অনিচ্ছুক ছিলাম যেতে কারণ মুন্নারের ওই শীতল আবহের পরে কন্যাকুমারীর গরমে বেশ কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু আবার কবে আসা হবে, এজীবনে আর আদৌ আসা হবে কিনা এইসব ভেবে গেলাম। প্রচন্ড রোদ্দুরে আর গরমে কষ্ট হলেও কিছুক্ষন ওখানে রইলাম, ওখানে জলাধারে ঘুরে বেড়ানো প্রচুর মাছ আর তাদের জন্য অপেক্ষায় বসে থাকা পানকৌড়ি আমাদের দেখা দিয়ে গেল বেশ কয়েকবার। ভাবছিলাম দাঁড়িয়ে "বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, ভুলি নাই তব দান "। সেখান থেকে আমরা গেলাম বিখ্যাত তামিল সন্ত কবি থিরুভাল্লুভারের সমাধি ক্ষেত্রে, উথাল পাথাল হাওয়া আর নির্জনতা আর সন্ত কবির দেয়ালে লেখা উপদেশগুলো পড়লাম, চারতলায় উঠে কিছুক্ষন বসে নেমে এলাম নিচে, সেখানে লঞ্চে উঠে শুনলাম এক বাঙালি মা তার মেয়েকে কবি থিরুভাল্লুভারের মূর্তিটি দেখিয়ে বলছেন যে ওটি শ্রী অরবিন্দের মূর্তি। মূল ভূখণ্ডে ফেরত এসে কন্যাকুমারীর সারাভানা ফুড প্লাজাতে স্থানীয় বাটার দোসা, সাম্বার দিয়ে ভোজন করে টুকিটাকি কেনাকাটা সেরে হোটেলে ফেরত এলাম। কিন্তু মন পড়ে রইল ওই প্রস্তরখন্ডে। পরেরদিন একুশে অক্টোবর আমাদের ফেরার বিমান ত্রিবান্দ্রাম থেকে বেলা চারটেতে।


পরেরদিন ভোরে উঠে আরেকবার চেষ্টা করলাম সূর্যোদয় দেখার কিন্তু বিধি বাম, আকাশ কালো করে মেঘে ঢেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমরা তৈরী হতে হতে রিসেপশন থেকে জানাল গাড়ি এসে গেছে, নিচে নেমে দেখি শ্রীমান রাজা নামে নতুন সারথি অপেক্ষায় রয়েছে, সে এক বর্ণ ইংরেজি বোঝে না, হিন্দীও তথৈবচ। কিন্তু আমাদের হোটেলের ম্যানেজার ভদ্রলোক তাকে আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিল, সব মালপত্র সহ গাড়ি ছাড়ল বেলা আটটায়। মসৃণ পিচঢালা রাস্তা দিয়ে নারকোলগাছের ফাঁকে ফাঁকে সমুদ্রকে সাথে নিয়ে, আবার কিছু মন্দির, গির্জা, বেকারি, দোকানপাট, ঘর, বাড়ি, নারকোলবাগান পেরিয়ে ঘন্টা দুয়েক পরে গাড়ি এসে দাঁড়াল কোভালাম বীচের সামনে। আরব সাগরের নীল জলরাশির সঙ্গে সোনালী বালির আর স্লেট রঙা পাথরের সমুদ্রতট, নারকোলগাছের সারি আর সবুজ ঘাস দিয়ে ঘেরা কোভালাম সারা পৃথিবীর মানুষের অন্যতম স্বপ্নের জায়গা। আমাদের হাতে সময় কম কিন্তু এই জায়গা ছেড়ে যাই কি করে? শেষে বেশ কিছু দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করে চরৈবেতি। এবার গন্তব্য ত্রিবান্দ্রামের পদ্মনাভস্বামী মন্দির। প্রথম যখন ট্যুর প্ল্যান হচ্ছিল তখন ত্রিবান্দ্রাম হয়ে ফেরা হবে শুনেই অরিজিৎবাবুকে বলেছিলাম পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে যাবার কথা, কিন্তু তখন তিনি পাত্তা দেননি, কন্যাকুমারীর হোটেলের ম্যানেজার যখন বললেন একই কথা আর দেখা গেল এক যাত্রাতেই সেটা সম্ভব, তখন তিনি রাজি হলেন। কিন্তু নারায়ণ আরো কিছু ভেবে রেখেছিলেন আমাদের জন্য, সেদিন সকালে বেরোনোর জন্য আমরা সকাল থেকে অভুক্ত ছিলাম, মন্দিরে পৌঁছলাম বেলা এগারোটা নাগাদ। মন্দিরে ঢুকতে গেলে মেয়েদের শাড়ি পরে, আর ছেলেদের ধুতি আর উত্তমাঙ্গ অনাবৃত করে ঢোকার নিয়ম। সেই মত আমার আর মেয়ের শাড়ি আর অরিজিৎবাবুর ধুতি কিনে পরে মন্দিরে ঢুকলাম। বেশ বড়ো লাইন পড়েছে, আমরা তুলসী মালা, পদ্ম ফুল, ওখানকার পুজোর জিনিস কিনে লাইনে দাঁড়িয়েছি, মেয়ে মন্দিরে দেয়ালগুলো তার বাবাকে দেখিয়ে বলছে, "দেখো কেমন পেতলে মোড়া দেয়ালগুলো", পাশে দাঁড়ানো একজন স্থানীয় ভদ্রলোক ওকে সংশোধন করে দিয়ে বললেন, "No, no, it is made of gold. He is now the richest God of India "। শুনে মেয়ের তো বটেই, আমরাও স্তম্ভিত, আশে পাশের লাইনের অন্য সকলে সেটা সমর্থন করলেন। এবার বিষ্ণুর অনন্তশয্যায় শায়িত স্বর্ণ বিগ্রহ দর্শন করে পুজো দিলাম, পুজো দিয়ে প্রসাদের জিনিস নিয়ে বেরোনোর সময় দেখি নারায়ণের দুপুরের ভোগ প্রসাদ পাবার লাইন পড়েছে, আমরা জিজ্ঞাসা করে সেখানে দাঁড়ালাম এবং ভোগ গ্রহণ করলাম। সুশৃঙ্খল ভাবে লাইন দিয়ে থালা, গেলাস নিয়ে আরেক জায়গা থেকে ভাত, সাম্বার, সবজি নিয়ে চেয়ার টেবিলে বসে খেয়ে সেই বাসনগুলো সাবান দিয়ে ধুয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হাতে দিলে তারা পরখ করে দেখে নিলেন ঠিকভাবে ধোয়া হল কিনা। ওখান থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে ঢুকে গেলাম দুটোর মধ্যে, তারপরে বৃষ্টি শুরু হল সাড়ে তিনটে থেকে, ফলে চারটের ফ্লাইট ছাড়ল পাঁচটায়। সারারাস্তা আবহাওয়া খারাপ থাকায় প্লেন খুব ঝাঁকুনি দিতে দিতে এলো, এখানে পৌঁছলাম রাত্রি নটায়। নভেম্বর মাস থেকে কোচি এয়ারপোর্ট সারাবার জন্য সকালের সব ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেল আগামী তিন মাসের জন্য। ঈশ্বরের ইচ্ছার সঙ্গে আমাদের স্বপ্ন সার্থক করে এক অনির্বচনীয় সফরে ঈশ্বর তার নিজদেশে ঘুরিয়ে দিলেন আমাদের সুষ্ঠু, সুন্দর ও সুচারুভাবে।


"বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার,

সেইখানেই যোগ তোমার সাথে আমারো"।


শুভমস্তু



: মহাশ্রমণ চরিত কথা -অংশ বিশেষ-৩


পিতৃধন, মহাজনপদ, ভার, জেতবন ও গন্ধকুটির, অঙ্গুলিমাল দমন কাহিনী,মূল্যপ্রাপ্তি, শহীদ শামুক ও অন্নদান

--------------------------------------------------------------------

কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

@কপিরাইট সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত


পিতৃধন

******

বুদ্ধত্ব লাভের এক বছর পরে শুদ্ধোধন তার পুত্র সিদ্ধার্থ গৌতমকে কপিলাবস্তু শহরে আমন্ত্রণ জানান। বোধিলাভের পরে তথাগত বুদ্ধের তাঁর পিতা শুদ্ধোধনের আমন্ত্রণে এখন কপিলাবস্তুতে আগমন। একদা রাজপুত্র গৌতম রাজধানীতে সংঘের সাথে ভিক্ষা করে খাদ্য সংগ্রহ করেন। কপিলাবস্তুতে অবস্থানকালে সিদ্ধার্থ পত্নী যশোধরা তাঁর শিশুপুত্র রাহুলকে তথাগত বুদ্ধের দর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কিন্তু তথাগত যশোধরাকে দর্শন দিতে অসম্মত হন। ব্যথিত যশোধরা অশ্রু বিসর্জন করে শেষে পুত্র রাহুলকে তথাগতের নিকট প্রেরণ করার সিদ্ধান্তে উপনীত হন। রাহুলকে তিনি বলেন তথাগতের কাছে পিতৃধন প্রার্থনা করতে। সেই মতো তথাগতের কাছে রাহুলকে নিয়ে উপস্থিত হন সিদ্ধার্থের পিতা শুদ্ধোধন। তার আগে আনন্দ ও অনুরুদ্ধ নামক তার দুইজন আত্মীয় তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।রাহুল তার জননীর ইচ্ছানুসারে পিতার কাছে পিতৃধন প্রার্থনা করলে  বুদ্ধদেব তার পুত্র রাহুলকে তার নিকট বৌদ্ধ শ্রমণের দীক্ষাদান করেন এবং শিষ্য আনন্দ আর সারিপুত্তের হাতে রাহুলকে সমর্পন করেন এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে কপিলাবস্তু ত্যাগ করেন। যশোধরা রাহুলের মাধ্যমে সিদ্ধার্থকে গৃহাভিমুখী না করতে পেরে আর দুধের শিশু রাহুলকে হারিয়ে ভীষণ ভেঙে পড়েন এবং সিদ্ধার্থের পিতাও সেই শোকে শয্যা নেন এবং কিছুদিনের মধ্যে দেহত্যাগ করেন। বুদ্ধদেব তাঁর অন্যান্য শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত হন বিম্বিসারের আমন্ত্রণে মগধে।


মহাজনপদ

**********

মগধ প্রাচীন ভারতে ষোলটি মহাজনপদ বা অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম।  এই ষোড়শ মহাজনপদগুলি হল: 'কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, বজ্জি, মল্ল, চেদি, বৎস, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস, সুরসেনা, অস্মক, অবন্তী, গান্ধার এবং কম্বোজ'।ষোলটি মহাজনপদের মধ্যে মগধ বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই রাজ্য বর্তমানের বিহারের  পাটনা,  গয়া আর বাংলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল।রাজগৃহ ছিল মগধের রাজধানী।তারপর  পাটলিপুত্রকে রাজধানি করা হয়েছিল। রাজা বিম্বসার ছিলেন মগধের প্রথম ঐতিহাসিক রাজা।বুদ্ধদেবের আনন্দ, অনুরুদ্ধ, মহাকশ্যপ,  সারিপুত্ত,  মৌদ্গল্যায়ন ও রাহুল ছাড়াও উপলি, পুণ্ণ,সুভূতি ও মহাকাত্যায়ন প্রভৃতি বুদ্ধের দশজন প্রধান শিষ্য ছিলেন। এঁদের সকলকে নিয়ে বুদ্ধদেব রাজগৃহের বাইরে আম্রকুঞ্জে অবস্থান করছেন বেশ কিছুদিন, মহারাজ বিম্বিসার তাঁর পত্নীসহ রোজ আসেন বুদ্ধদেবের দর্শনে। একদিন নগরীর বেশ কিছু লোকজন নিয়ে এক শ্ৰেষ্ঠী এলেন বুদ্ধদেবের কাছে এবং তাঁরা বিনাশ্রমে মহারাজকে সম্মোহিত করে নিজেদের অন্নসংস্থান করছেন বলে প্রভূত অপমান করতে থাকেন বৌদ্ধসংঘের সকলকে। বুদ্ধশিষ্য মহাকাশ্যপ আর সারিপুত্ত তো তেড়ে মারতে গেছেন তাঁদের। বুদ্ধদেব সকলকে নিরস্ত করেন এবং সেই শ্রেষ্ঠীকে বোঝান যে তাঁরা শান্তি ও অহিংসার বাণী প্রচারের জন্য আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন, শ্রেষ্ঠী কিছু সময় পরে ক্লান্ত, ক্ষুব্ধ হয়ে সঙ্গের অন্য লোকেদের নিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। বুদ্ধদেব যাত্রা করেন শ্রাবস্তীর দিকে।


ভার

*****

গঙ্গার উত্তরে ছিল কোশল রাজ্য। এই রাজ্যেরই এক সমৃদ্ধশালী নগরী ছিল শ্রাবস্তী।গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে শ্রাবস্তী নগরীর সম্পর্ক ছিল নিবিড়।  সুদত্ত  ছিলেন শ্রাবস্তী নগরীর একজন ধনী শ্রেষ্ঠী। সুদত্ত ব্যবসায়ের কাজে মগধের রাজধানী রাজগৃহ নগরীতে গিয়েছিলেন। ওই রাজগৃহে নগরীতেই সুদত্ত প্রথম বুদ্ধকে দেখেছিলেন। বুদ্ধের সঙ্গে কথা বলে সুদত্ত বুদ্ধের এক পরম ভক্তে পরিণত হয়। বুদ্ধকে একবার শ্রাবস্তী যাওয়ার অনুরোধ করেন সুদত্ত। বুদ্ধ রাজী হন। শ্রাবস্তীর কাছে এসে গিয়েও সারিপুত্ত ভুলতে পারছেন না মগধের সেই শ্রেষ্ঠীর অপমানের কথা,সেই প্রসঙ্গে তিনি যখন বুদ্ধদেবকে তাঁর উষ্মা প্রদর্শন করলেন বুদ্ধদেব তাঁকে বললেন, "ও, তুমি সেই অপমানের বোঝা বা ভার এখনো বয়ে বেড়াচ্ছ, আমি তো সেটা পরের মুহূর্তেই নামিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হয়ে গেছি কখন"। হতবাক সারিপুত্তকে বুদ্ধদেব বোঝালেন মান, অপমান, অভিমান, ক্রোধ প্রভৃতি আবেগতাড়িত অনুভূতি সকল মনের ভার বা বোঝা বই আর কিছু নয়, যত শীঘ্র সেটি পরিত্যাগ করা যায়, ততো তাড়াতাড়ি ভারমুক্ত হওয়া যায়।


জেতবন ও গন্ধ কুটির

*******************

কিছুকাল পরের কথা। বুদ্ধ শ্রাবস্তী আসছেন; সঙ্গে কয়েক হাজার শিষ্য।  এত লোককে কোথায় থাকবার আয়োজন করা যায়। সুদত্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শ্রাবস্তী নগরীর বাইরে যুবরাজ জেত এর বিশাল একটি বাগান ছিল। সুদত্ত বাগানটি কিনতে চাইলে জেত প্রথমে রাজী হননি। পরে অবশ্য শর্তসাপেক্ষে রাজী হলেন—স্বর্ণমুদ্রায় সম্পূর্ণ বাগান ঢেকে দিতে হবে। সদুত্ত সম্মত হলেন। সুদত্ত গোশকট করে স্বর্ণমুদ্রা এনে বাগান ঢেকে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। সুদত্তর পরম বুদ্ধভক্তি দেখে জেত অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি সুদত্তকে বাগানখানি দান করলেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সুদত্ত জেত এর নামে বাগানে নাম রাখেন জেতবন।


বুদ্ধ শ্রাবস্তী এলেন। ধ্যান করলেন, দান করলেন; শ্রাবস্তী নগরীকে অমর করে রাখলেন। রাজকুমার জেত অসম্ভব ধনাঢ্য ছিলেন; তিনি বুদ্ধকে আঠারো কোটি স্বর্ণ মুদ্রা দান করেন।সুদত্ত বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সুদত্ত অনাথদেরকে অন্ন (পিণ্ডক) দিতেন বলে তাঁকে অনাথপিণ্ডিক বলা হত। অনাথপিণ্ডিক নামটি বুদ্ধই দিয়েছিলেন।গৌতম বুদ্ধের ব্যবহারের জন্য সুদত্ত গন্ধকাষ্ঠ দিয়ে একটি কুটির নির্মাণ করেন, যা বৌদ্ধসাহিত্যে গন্ধকুটির নামে সুবিখ্যাত।


প্রাচীন শ্রাবস্তীর নগরীর দেয়াল এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে তিনটি প্রাচীন স্থাপত্য দেখার জন্য আজও দেশবিদেশের পর্যটকেরা ভিড় করে—আঙ্গুলিমালা স্তুপ, অনাথপিণ্ডিক স্তুপ আর একজন জৈন তীর্থঙ্করের উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রাচীন জৈন চৈত্যগৃহ। আর রয়েছে জেতবন, গৌতম বুদ্ধের নিবাস গন্ধকুটির। জেতবনে রয়েছে আনন্দবোধি বৃক্ষ।


অঙ্গুলিমাল দমন কাহিনী :

************************

বুদ্ধ সমকালীন কোশল জনপদের রাজধানী ছিল শ্রাবস্তী। ঐ কোশল জনপদের রাজা ছিলেন কোশলরাজ প্রসেনজিৎ। তাঁর রাজপুরোহিতের নাম ছিল ব্রাহ্মণ ভার্গব। চৌর-নক্ষত্রে তাঁদের প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়।


তাঁর জন্মের সময় রাজার অস্ত্রাগারে হঠাৎ অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটে, ব্রাহ্মণ ভার্গব ছিলেন শাস্ত্রে পারদর্শী অশুভ নক্ষত্রে ছেলের জন্ম হওয়াতে তিনি গণনা করে জানতে পারলেন তাঁর ছেলে বড় হলে মানুষ হত্যা করবে। এবং রাজ্যে এক ভয়ানক পরিস্থিতিরর সৃষ্টি করবে। রাজ্যের মঙ্গল কামনায় ভার্গব ছেলেকে হত্যা করতে চাইলে, কোশলরাজ প্রসেনজিৎতের হস্তক্ষেপে নবজাতক শিশুর জীবন রক্ষা পায়।


এবং কোশলরাজ ভার্গবকে বললেন, "অমঙ্গল আসলে কেউ ঠেকাতে পারবে না, এতে এই নবজাকের কি দোষ। বিপদ যখনি আসবে তখনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাকে উপযুক্ত বিদ্যা শিক্ষা দিয়ে বড় করা হোক।"


সম্ভাব্য দোষমুক্তি অবলম্বন করে তারা সন্তানের নামকরণ করেন " অহিংসক "। এ নামকরণের পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল এ শুভ নামের প্রভাবে এ সন্তান কারো প্রতি হিংসাভাব পোষণ করবে না। আবার তার প্রতিও কেউ হিংসা পোষণ করবে না। এ উপায়ে নরসংহার ও কোশল জনপদবাসীকে রক্ষা করা যাবে।


দিনে দিনে মাতাপিতা ও পাড়া-প্রতিবেশীদের স্নেহআদরে বড় হতে থাকে অহিংসক। তার স্বাভাবিক আচরণে চৌর-লগ্নে যে তার জন্ম সে কথা গণকদের ভবিষ্যবাণীর কথা সবাই ভুলে যেতে থাকে। বন্ধু-বান্ধব সকলের কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠতে থাকে অহিংসক। বাল্যকাল কাটিয়ে উঠলে তার মাতাপিতা তাদের সন্তানকে শাস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী করতে তৎকালীন বিখ্যাত আচার্যের নিকট শিক্ষা-দীক্ষাদানের উদ্দেশ্যে অন্যান্য বাল্য-বন্ধুদের সাথে তক্ষশীলায় পাঠালেন। অল্প সময়ের মধ্যে অহিংসক লেখা-পড়ায়, খেলা-ধূলায়, তার বিনম্র চাল-চলনে, আচার-ব্যবহারে শিক্ষকগণের বিশেষত আচার্য ও গুরুমাতার মনে স্থান নিয়ে নেয়। অন্যান্য সহপাঠীদের তুলনায় সে অধিক প্রিয়ভাজন হতে থাকে। আচার্যের ভালবাসায় শ্রাবস্তীর রাজপরিবারস্থ বন্ধু-বান্ধবরা অপেক্ষাকৃতভাবে অহিংসকের প্রতি ঈর্ষাভাব পোষণ করতে লাগলো। কোন কিছুতেই তাকে পরাজিত করতে না পেরে নিজেরাই তাদের ঈর্ষানলে জ্বলতে থাকে।


দিন যত যায় অহিংসক বুঝতে পারে তার বাল্য-বন্ধুরা সেই আগের মত নেই। আগের মত তাকে ভালভাবে খোলামেলা ভাবে গ্রহন করছে না। এদের এমন আচরণ দেখেও অহিংসক তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ঈর্ষাপরায়ণ না হয়ে নিজের লেখা-পড়ায় আরো অধিকতর মন দেয়। তার পরিপেক্ষিতে অহিংসকের প্রতি তার বন্ধুরা আরো অনেক বেশি ঈর্ষাপরায়ণ হতে থাকে। ঈর্ষানলের আগুনে থাকতে না পেরে এবার তারা অহিংসকের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে শুরু করে। তার চাল-চলনের ব্যাপারে কুৎসা রটানো শুরু করে। শিক্ষকদের তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করতে থাকে। কিন্তু শিক্ষকরা অহিংসকের চাল-চলনে খুব খুশি। তাই তারা এগুলা মাথায় রাখেন না। এত কিছুর করার পরেও যখন কিছু করতে পারছে না তখন তারা নাছোড়-বান্দা হয়ে মাঠে নামে। এবার তারা দুরাচারী হবার অস্ত্র প্রয়োগ করেন। শেষ চালের অংশ হিসেবে তারা একে একে কয়েকবার গুরুমায়ের সাথে অহিংসকের অনৈতিক দৈহিক সম্বন্ধের কথা শুনিয়ে শুনিয়ে আচার্যের কান ভারী করতে শুরু করে। গুরু প্রথমে এগুলো পাত্তা না দিলেও ক্রমশ তা দিনকে দিন বাড়তে থাকে। এদিকে আচার্য তার স্ত্রীর প্রতি দূর্বল ছিলেন। সবার মুখে এ কথা শুনে আচার্যের বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে ক্ষুদ্ধ হন আর অহিংসকে কিভাবে আশ্রম হতে বিতাড়িত করা যায়, তার ফন্দি করতে থাকেন।


একদিন হঠাৎ আচার্য নির্দেশ প্রদান করলেন অহিংসক যেন এ আশ্রম থেকে চলে যায়। এ খবর পেয়ে মাতৃস্নেহে গুরুমাতাও খুবই  কষ্ট পান। গুরুর অপ্রত্যাশিত নির্দেশে অহিংসক বড়ই ব্যথিত হয়। এ নির্দেশ প্রত্যাখান করার মানসে গুরুর কাছে কাকুতি মিনতি করতে থাকে অহিংসক। এত কিছুর পরেও আচার্যের পাষাণ হৃদয় গলে নি। আচার্য ঈর্ষানলে এতটায় বশীভূত ছিলেন যে শুধু আশ্রম থেকে নয়, এমনকি তক্ষশীলা হতে আজীবন নির্বাসন হয় তার ব্যবস্থা  করেন। অহিংসকের পীড়াপীড়িতে শেষমেষ আচার্য বলেন- ঠিক আছে এক শর্তে আমি তোমাকে রাখতে পারি। তখন অহিংসক স্ব-আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে ফেলে- যে শর্তই হোক না কেন আমি তা পূর্ণ করবো। আমায় আপনাদের স্নেহ-আদর হতে বঞ্চিত করবেন না গুরুদেব।


আচার্য বললেন- তোমাকে এর জন্য গুরু দক্ষিণা দিতে হবে ।


অহিংসক বলে- কি রকম দক্ষিণা বলুন, আমি দিতে রাজি আছি।


আচার্য- আমাকে এক হাজার মানুষের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল এনে দাও।


আচার্যের মুখে এমন বর্বর শর্ত শুনে হতবাক। এ সব শুনে অহিংসক বলে উঠলেন- গুরুদেব মানুষ হত্যা, এ তো মহাপাপ। আপনি আর অন্য যে কোন দক্ষিণার কথা বলুন! মনুষ্য হত্যা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমাকে ক্ষমা করুন।


অহিংসকের এমন কথা শুনে আচার্য বললেন- হ্যাঁ, এটা যে পাপ তা আমি মানি, কিন্তু গুরুর আদেশ অমান্য করা এটা কি পাপ নয়? যদি আমাকে সত্যিকারের গুরুদক্ষিণা দিতে চাও, তাহলে ঐ একহাজার বৃদ্ধাঙ্গুলি আমাকে উপহার দাও। যদি আমাকে ঐ একহাজার আঙ্গুলি এনে দাও তাহলে বিদ্যা-শিক্ষার বাকিটুকু শিক্ষাদান করবো। যাও এ মূহুর্তে এখান হতে বের হয়ে আমাকে গুরুদক্ষিণা দাও।


অহিংসক আর কোন কথা না বলে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আশ্রম থেকে বেরিয়ে পড়ে।


তক্ষশীলার সীমানা পার হয়ে কোশল জনপদের সীমানায় পা রাখতেই চিন্তাই ভেঙ্গে পড়ে , এখন এ অবস্থায় কি করবে সে। গুরুকুল হতে বিতাড়িত  হবার অপমান আর গুরু কর্তৃক এক হাজার মানুষের আঙ্গুল দক্ষিণা, এ সব কিছু ভাবতেই সে কষ্টের আগুনে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এভাবে কয়েকদিন চললেও বিতাড়িত হবার অপমান এবং গুরুদক্ষিণা দেবার আদেশ তার সুন্দর কোমল মনকে দূষিত করে ফেলে। অহিংসকের হৃদয়ে হিংসার আগুন সঞ্চার হতে লাগলো। মানবের আর মানব সমাজের প্রতি তার হিংসার দাবানলের আগুন তীব্র হতে তীব্রতর হতে থাকে। আর অহিংসক হিংসকে রূপান্তরিত হয়ে সংকল্পবদ্ধ হলেন যে, গুরুদক্ষিণা দিয়ে অপমানের বদলা নেবে।


আঙ্গুল নিতে তো হত্যা করতে হবে। কিন্তু শ্রাবস্তীর লোকালয়ে থেকে ঐ ভয়ানক সংকল্প কখনোই পূরণ করা সম্ভব নয়। সেজন্যে অহিংসক লোকালয় ছেড়ে দিয়ে গভীর অরণ্যে অবস্থান গ্রহন করে। কিভাবে এই অপমানের বদলা, কিভাবে আবার গুরুকুলে গিয়ে তার বাকি শিক্ষা অর্জন, কিভাবে বাবা-মায়ের কাছে যোগ্য সন্তান হয়ে ঘরে ফিরে যাবে, সে চিন্তায়-দিনে একটা দুইটা করে মানুষ হত্যা করে তাদের আঙ্গুল মালা বানিয়ে গলায় ধারণ করতে লাগলো। ছেলে, বুড়া, নর-নারী কেউ আর তার হাত হতে রক্ষা পেত না। কেউ যদি পালিয়ে জীবন বাঁচাতে চাইতো তড়িৎ  গতিতে ছুটে তাকে হত্যা করে আঙ্গুল কেঁটে নিত। সেই হতেই অহিংসক নাম পরিবর্তিত হয়ে অঙ্গুলিমাল রূপে পরিচিত লাভ করে। সবাই তার ভয়ে অন্যপথ দিয়ে যাতায়াত করতে থাকে। বণিকেরাও তার ভয়ে অন্য রাস্তা ব্যবহার করতে থাকে। মানুষ যতই কমতে থাকে অঙ্গুলিমালও তার অবস্থান বদলাতে থাকে।


লোকমুখে শুধু একটিই নাম অঙ্গুলিমাল। তার কারনে কোশল রাজ্যে যাবার সব পথ অবরুদ্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়ে পড়ে। এভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়াতে রাজ দরবারে গিয়ে সবাই বিক্ষোভ করতে লাগলো।


রাজা প্রসেনজিৎ ব্রাহ্মন ভার্গবকে তলব  করেন, সে যেন অঙ্গুলিমালকে বুঝিয়ে নিয়ে আসেন। সবাই তার ভয়ে অস্থির। অঙ্গুলিমালের পিতা ভর্গব রাজাকে সরাসরি জবাব দেন---- এমন কুলাঙ্গার, কলঙ্কিত পুত্র আমাদের প্রয়োজন নেই। রাজার যেমন ইচ্ছা তেমন করা হোক।


এদিকে কোশলবাসীর ক্ষোভের মুখে রাজা প্রসেনজিৎ তাঁর রজ্যের সেনাবাহিনীকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়োজিত করেন। এবং তাদের নির্দেশ প্রদান করা হয়, যে কোন ভাবেই হোক, অঙ্গুলিমালকে জীবিত অথবা মৃত তার সামনে আনতে হবে। আর যদি তা সম্ভব না হয়, অঙ্গুলিমালের মাথা কেটে আনা হোক।


এদিকে রাজা এ আদেশ রাজ্যের সমস্ত প্রান্তে ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণাতেও অঙ্গুলিমালের কাজের মাত্রার কমতি নেই, বরং দিনকে দিন বাড়তে থাকে। এতদিনে তার গলায় আঙ্গুলের সংখ্যাও বেড়ে গিয়ে নয়শত নিরানব্বই। আর মাত্র একটি আঙ্গুল সংগ্রহ করতে পারলেই লক্ষ্য পূরণ। এদিকে মানুষের যাতায়াত কমে যাওয়াতে অঙ্গুলিমালের দুচিন্তার শেষ নাই, সে প্রলাপ বকতে থাকে-- আর মাত্র একটি আঙ্গুল, আর মাত্র একটি আঙ্গুল যদি সংগ্রহ করতে পারি তাহলে আমার মন বাসনার পাশাপাশি গুরুদক্ষিণা দিয়ে গুরুর উপযুক্ত জবাব ও গুরুমায়ের স্নেহ-ভালবাসায় পুনঃ সিক্ত হব! যে কোন ভাবেই হোক আমার আঙ্গুল চাই চাই চাই।


অন্যদিকে অহিংসকের মা রাজার এ ঘোষনা শুনে ভয়ে তটস্থ। মায়ের মন ছেলের জন্য কাঁদতে থাকে, পুত্রের জীবন বাঁচাতে বৃদ্ধা মা ছুটে চললেন ছেলের সন্ধানে, পথে পথে তাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সেনাবাহিনীর সেনারা তাকে আটকে রাখতে চাইলেও পারলো না। ছেলেকে খুঁজতে অরণ্যে ছুটেই চললেন। জনশূন্য হওয়াতে অঙ্গুলিমাল কোশল জনপদের বেশ কাছেই অবস্থান করছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে আবারো গভীর অরণ্যে চলে যায়। মা, বনের ভেতর প্রবেশ করতেই ডাকতে লাগলেন--- অহিংসক, অহিংসক, আমার অহিংসক, তুমি কোথায় বাবা, একবার এ বৃদ্ধা মায়ের কাছে এসো, কতদিন দেখিনি তোমায়, তুমি কেমন আছ, কি খেয়েছ, কেমন দেখতে হয়েছ, এসো বাবা আমার কাছে এসো।

এভাবে যোজন, যোজন পথ অতিক্রম করতে করতে শ্রাবস্তী হতে তিন যোজন দূরে, জালিনী (জালি) বনে পৌঁছান।


এদিকে হঠাৎ মানুষের অবস্থান আর শব্দ শুনে অট্টহাসি হাসতে লাগলো---উ, হা,হা, হা,। মায়ের মুখে অহিংসক নাম শুনে অঙ্গুলিমালের হৃদয় কিছুটা ব্যাকুল হলেও বহুদিনের পাওয়া থেকে বঞ্চিত আঙ্গুলের তীব্রপীড়া তাকে বিদারিত করে। এবং বলতে থাকে আজকে তার গর্ভধারণীকে হত্যা করে হলেও গুরু দক্ষিণা আমি দেবোই দেবো। আর বলতে লাগলো-- কোথায় অহিংসক, এখানে কোন অহিংসক থাকে না, এখানে শুধু একমাত্র অঙ্গুলিমাল, সবাই আমাকে এই নামেই ডাকে। দেখছ না, আমার গলায় আঙ্গুলের মালা, এখানে নয়শত নিরানব্বইটি আঙ্গুল, আর মাত্র একটি আঙ্গুল দরকার। আবারো সেই ভয়ানক অট্টহাসি। তখন করুণা ঘন আবেগের কন্ঠে বৃদ্ধা মা বললেন-- বাছা, অহিংসক, আমি তোমার মা, আমাকে চিনতে পারছিস না বাবা অহিংসক। অঙ্গুলিমাল অট্টহাসি দিয়ে উত্তর দেয়, কে মা, কার মা, আমি কাউকে চিনি না। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার আঙ্গুল। এই বলে খড়গ উঁচিয়ে দৌড়াতে থাকে অঙ্গুলিমাল।


তথাগত বুদ্ধ তখন জেতবনে বিংশতম বর্ষাবাস যাপন করতেছিলেন। প্রতিদিনকার নিয়ম অনুসারে প্রত্যূষকালে শ্রাবস্তীর জেতবন-আরামে দিব্যদৃষ্টি বিস্তার করে ত্রিলোক অবলোকন করতে থাকেন।

তখনি দেখতে পেলেন অঙ্গুলিমাল ও তার বৃদ্ধা মাকে। বুদ্ধ আরো জানতে পারলেন- এ জন্মে যদি অঙ্গুলিমাল তার মাকে হত্যা করে, তাহলে মাতৃহত্যাজনিত ঘৃণিত পাপের কারনে অবীচি নরকে গমন করবে। এবং সাথে সাথে বুদ্ধ জানতে পারলেন, অঙ্গুলিমালের অরহত্বফল প্রাপ্তির সম্ভাবনাও আছে। মাতৃহত্যাজনিত পাপের ফলে অঙ্গুলিমালের জীবন ধংস এবং অপায়ে গমন করা হতে বিরত করতে করুণাবশতঃ মহাকারুণিক বুদ্ধ তৎক্ষণাৎ ঋদ্ধিশক্তি প্রয়োগ করে জালিনী বনে বৃদ্ধা মা এবং আঙ্গুলিমালের মাঝে উপস্থিত হন। অঙ্গুলিমাল ঠিক যখনি তার খড়গ দিয়ে মাকে হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকে তৎ মুহুর্তে বুদ্ধকে দেখতে পেয়ে মাকে বাদ দিয়ে বুদ্ধকে হত্যার জন্যে ছুটে চলে।


অঙ্গুলিমালকে আসতে দেখে ভগবান বুদ্ধ তাঁর এমন ঋদ্ধি প্রয়োগ করলেন যাতে করে, অঙ্গুলিমাল দৌড়ালেও ভগবান বুদ্ধকে ধরতে না পারে। অঙ্গুলিমাল তার সমস্ত বল প্রয়োগ করেও বুদ্ধের কাছে পৌঁছাতে পারছিল না। শেষে ক্লান্ত হয়ে সে নুইয়ে পড়ে, এবং ভাবতে থাকে-- এ কেমন মানুষ, কে এই শ্রমণ, আমি ধাবমান হরিণকে তৎক্ষনাৎ ধরতে পারি, অথচ এই শ্রমণকে কেন ধরতে পারছি না! শেষে আঙ্গুলিমাল দূর্বল হয়ে বলে--- হে শ্রামণ, থামো, (কঠিন গলায়) থামো বলছি, আর এক পাও দৌড়াবে না !

বুদ্ধ-- বৎস, আমি দৌড়াচ্ছি না, আমি তো স্থির; বরং তুমিই দৌড়াচ্ছো, তুমিই অস্থির। তুমিই থামো !

অঙ্গুলিমাল ভাবতে থাকে, এ আবার কেমন কথা, আমি এত দৌড় দিয়েও তাকে ধরতে পারলাম না আর শ্রমণ বলে কিনা সে স্থির। এটা কিভাবে সম্ভব, তখন আঙ্গুলিমাল বললো-- হে শ্রামণ, আমার জানা মতে, শাক্য পুত্রগণ কখনো মিথ্যা কথা বলেন না। তুমি দৌড়াচ্ছো অথচ আমাকে বলছো তুমি স্থির। এর মানে কি?

বু্দ্ধ-- হে অঙ্গুলিমাল, সত্ত্বের কৃত কর্মের সংযোজনের দন্ড ত্যাগ করেছি। আমি স্থির আছি, কিন্তু আবাগমনের দন্ড নিয়ে তুমিই ধাবমান। আমি শান্ত আছি এবং স্থির। তুমিও স্থির হও। আমার ন্যায় শান্ত হও। তাই তোমাকে শান্ত এবং স্থির হতে পরামর্শ দিয়েছি।


অঙ্গুলিমাল এবার চিন্তা করলো কে এই শ্রমণ! এমন মধুর শব্দ আমি তো জীবনেও শুনি নাই, বুদ্ধের অমৃত বাণী শোনা  মাত্রই তার সারা মন-মানসিক, মস্তিস্কে এক অদ্ভুত তরঙ্গ বয়ে যেতে লাগলো। বোধশক্তি ফিরে পেয়ে ভাবতে লাগলো এ শ্রমণ কোন সাধারণ শ্রমণ নন। নিশ্চয়ই আমার কল্যাণে এই জনশূণ্য মহাঅরণ্যে আগমন করেছেন। তার হৃদয়ে জ্ঞানের সঞ্চার হয়। প্রাণী হত্যার কারণ সম্পর্কে অবগত হয়ে উৎসুক হয়ে বলে উঠে-- হে শ্রামণ, আপনি কে?

বুদ্ধ-- আমি তথাগত গৌতম বুদ্ধ।

বুদ্ধের মুখে বুদ্ধ শব্দ উচ্চারিত হতেই খড়গ ফেলে দিয়ে বুদ্ধের পায়ে লুটিয়ে পড়ে মাথা নত করে আর্তনাদ করতে থাকে.. এবং বলতে থাকে --- ভগবান আমাকে রক্ষা করতে আপনার এখানে আগমন। আমাকে রক্ষা করুন। তখন বুদ্ধ "এস ভিক্ষু" বলতেই পূর্বজন্মের কর্মের প্রভাবে ঋদ্ধিবলে পাত্র-চীবর দিয়ে অঙ্গুলিমালের উপসম্পদা সম্পন্ন হয়।


এরপর অঙ্গুলিমাল চীবর ধারন করে বুদ্ধের অনুগামী হন। উভয়ে শ্রাবস্তী ফিরে আসেন। ভগবান বুদ্ধ একে একে সব বিনয় কর্ম অঙ্গুলিমালকে অবহিত করেন। বুদ্ধের নির্দেশে ধ্যান-সমাধি ও বিনয় ধর্মে ব্রত হয়ে খুব অল্পদিনের মধ্যে অরহত্ব-ফল লাভ করেন।


এদিকে রাজা প্রসেনজিৎ তাঁর দূতের মাধ্যেমে জানতে পারলেন যে অঙ্গুলিমাল শ্রাবস্তীতে প্রবেশ করেছে। তখন রাজা প্রসেনজিৎ অঙ্গুলিমালকে দমন করার জন্য নিজে এবং সসৈন্য-সামন্ত নিয়ে রওনা হলেন। ঐ পথ দিয়ে যাবার সময় ভগবান বুদ্ধের দর্শন লাভ করার জন্য জেতবনে প্রবেশ করেন। বুদ্ধের পাশে তখন অঙ্গুলিমাল উপস্থিত আছেন। রাজাকে যুদ্ধের পোশাকে দেখে ভগবান বু্দ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন- মহারাজ এত হতাশাগ্রস্থ হয়ে সসৈন্য নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? কোথাও কোন যুদ্ধ আছে নাকি ? উত্তরে রাজা প্রসেনজিৎ বললেন- ভগবান, আমার রাজ্যে এখন শুধু একটায় দুশ্চিন্তা, আর সেটা হল অঙ্গুলিমাল। ঐ অঙ্গুলিমালকে যদি বশে আনতে পারতাম তাহলে আমি দুশ্চিন্তা মুক্ত হতাম। শুনলাম শ্রাবস্তীর আশেপাশে অঙ্গুলিমাল অবস্থান করছে, তাই নিজ হাতে থাকে দমন করার জন্যে আমি সশরীরে এসেছি।


মহারাজের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেবার জন্যে ভগবান বুদ্ধ আর্শীবাদ প্রসঙ্গে বলেন- মহারাজ, কোশলবাসীর হিতার্থে যদি ঐ অঙ্গুলিমাল আপনার নিকট এসে ধরা দেয়, তবে আপনার অনুভুতি কি হবে ?

রাজা প্রসেনজিৎ - যাকে আমার হাজার হাজার সৈন্য ধরে আনতে পারে নি, সে কি নিজে এসে ধরা দিবে ? এ অসম্ভব।


এবারে বুদ্ধ বললেন- মহারাজ যদি ঐ অঙ্গুলিমালকে সংসার ত্যাগ করা অবস্থায়, চীবর ধারন করা অবস্থায়, ভিক্ষু রূপে দেখেন তখন কি করবেন ?


রাজা প্রসেনজিৎ - ভগবান, আমি নিজ হাতে থাকে চীবরাদি পূজা করবো।


ভগবান বুদ্ধ - তখন ভগবান বুদ্ধ অঙ্গুলিমালের দিকে আঙ্গুল দিয়ে সংকেত দিয়ে বললেন- মহারাজ, এনিই অঙ্গুলিমাল।


অঙ্গুলিমাল!! রাজা নাম শুনতেই বসা অবস্থায় দাঁড়িয়ে যান। রাজার গলার স্বর কেঁপে উঠল, কপাল দিয়ে ঘাম বেরোতে লাগলো। তখন রাজা মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো-- এ কি করে সম্ভব। যাকে আমার হাজার হাজার সেনাবাহিনী ধরতে পারে নি, তাকে কি করে ভগবান বুদ্ধ বিনা অস্ত্রে ধরে আনলেন, তাও আবার ভিক্ষু রূপে। এ ঘটনা রাজার নিজের চোখে বিশ্বাস হচ্ছে না, এদিকে আবার ভগবান বুদ্ধের কথাকেও তো অবিশ্বাস করা যায় না। শেষে নিজে গিয়ে নতমস্তকে বুদ্ধকে এবং বুদ্ধের অনুগামী শিষ্য অঙ্গুলিমালকে নতশিরে বন্দনা করলেন। আর নিবেদন করলেন-- ভন্তে, আজ হতে আপনার চতুর্প্রত্যয় দানের ভার আমার। প্রত্যুত্তরে অঙ্গুলিমাল বলেন--মহারাজ, আমি তথাগতের নির্দেশে ধুতাঙ্গ শীল পালন করছি, চতুর্প্রত্যয় দাতার প্রয়োজন নেই।


অঙ্গুলিমালের মুখে এ সব কথা শুনে এবং সুশীল ভিক্ষুরূপে দস্যু অঙ্গুলিমালকে পেয়ে তাকে হত্যা করে আনার দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে সমস্ত সৈন্যবাহিনীকে রাজ্যে ফিরে আসার অনুমতি প্রদান করেন । মহাকারুণিক বুদ্ধের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাজা রাজমহলে ফিরে যায়।


এ অল্প সময়ের মধ্যে শ্রাবস্তীবাসীর কাছে এ খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অঙ্গুলিমাল ভগবান বুদ্ধের শরণাপন্ন হয়েছেন। ধুতাঙ্গ-ব্রতধারী ভিক্ষু হয়ে তিনি শ্রাবস্তী-বাসীর দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করেন। যখন অঙ্গুলিমাল ভিক্ষায় বের হন, তখন কেউ কেউ ভয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন, আবার কেউ কেউ দরজা-জানালা আধ খোলা অবস্থায় অঙ্গুলিমালকে দেখতে চান। স্বাভাবিক ভাবে নয়শত নিরানব্বই মানুষ হত্যাকারিকে কে না দেখতে চায় !! নিরস্ত্র ভিক্ষুর বেশে অঙ্গুলিমালকে দেখে অনেকে চমকে যান, আবার যাদের স্বজন অঙ্গুলিমালের হাতে প্রাণ হারিয়েছে, তাদের স্বজনেরা ভিক্ষা দেওয়ার বদলে, ক্ষোভে ভিক্ষা না দিয়ে ইঁটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ইঁটের খন্ড অঙ্গুলিমালের মাথায়, শরীরে জখম করে তাকে রক্তাক্ত  করে দেয়। ভাঙ্গা ভিক্ষা পাত্র ও রক্তাক্ত শরীর নিয়ে জেতবনারামে চলে আসেন। বিহারে আসার পর ভগবান বুদ্ধকে বিস্তারিত বলেন।


ভগবান সব শুনে উপদেশ দিয়ে বললেন- হে অঙ্গুলিমাল, নয়শত নিরানব্বই জন নিরাপরাধ মানুষের হত্যাজনিত পাপের ভয়ানক নারকীয় যাতনার তুলনায় এ যাতনা অতি সাধারণ। সহনশীলতা বাড়িয়ে দিয়ে ক্ষমা দিয়ে মানবতার পরিচয় দেবার উপদেশ প্রদান করেন ভগবান বুদ্ধ।


ভগবান বুদ্ধের নির্দেশ মত অঙ্গুলিমাল ক্ষুদ্ধ জনতার ক্ষোভ-জনিত সব ধরনের অত্যাচার নীরবে সহ্য করতে থাকেন। এভাবে কিছুদিন গত করার পর ধীরে ধীরে মানুষের হৃদয়ে ভালবাসার সঞ্চার হতে থাকে।


অঙ্গুলিমালের এত সুন্দর পরিবর্তন দেখে নগরবাসী মুগ্ধ হয়ে ইঁটপাটকেল ছোঁড়ার পরিবর্তে ভিক্ষাপাত্রে পিন্ডপাত দান দিতে শুরু করেন।


এভাবে দিনে দিনে অঙ্গুলিমাল সবার ভালবাসায় সিক্ত হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন।

একদিন শ্রাবস্তীর এক কুটির হতে একজন নারীর করুণ আর্তনাদ শুনতে পান অঙ্গুলিমাল। কারন জানতে ভিতরে প্রবেশ করে অঙ্গুলিমাল। গিয়ে জানতে পারেন যে নারীটা গর্ভবতী। প্রসব বেদনায় চটপট করতেছে। নারীর এমন করুণ আর্তনাদ শুনে অঙ্গুলিমালের হৃদয়ে করুণাবশত ভালবাসার সঞ্চার হল, দৌড়ে ছুটে এলেন ভগবান বুদ্ধের কাছে, তারপর ভগবান বুদ্ধকে ঐ নারীর প্রসব বেদনা সম্পর্কে অবহিত করে বললেন যে কি উপায়ে ঐ নারীর প্রসব বেদনা দুর করা যায়।


তখন বুদ্ধ অঙ্গুলিমালকে সত্যক্রিয়া করতে বলেন- প্রতি উত্তরে অঙ্গুলিমাল জানতে চাই কি উপায়ে সত্যক্রিয়া করা যায় ?


ভগবান বুদ্ধ বললেন- কোন একটা ঘটনাকে নিয়ে অধিষ্ঠান করতে হয়।


অঙ্গুলিমাল- আমাকে শিখিয়ে দিন কিভাবে তা করতে হয়।


ভগবান বুদ্ধ- এ জীবনে আমি একটি প্রাণীরও জীবন হত্যা করি নি, একথা যদি সত্যে হয় তাহলে ঐ সত্যের প্রভাবে ঐ গর্ভবতী নারীর প্রসববেদন দূর হোক। এবং সুস্থ সুন্দর ভাবে বাচ্চা প্রসব হোক।


অঙ্গুলিমাল- আমি এ নিষ্ঠাবান সত্যক্রিয়া করতে পারবো না, অতীত জন্মের কথা বাদ দেন, এ জন্মে আমি নয় শত নিরানব্বই জন নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করেছি। এর দ্বারা আমার সত্যক্রিয়া হবে না।


তখন বুদ্ধ বললেন- তাহলে এভাবে বলতে পারো যে- আমি বুদ্ধের শরণনাপন্ন হবার পর থেকে একটি প্রাণীও হত্যা করিনি, এ সত্যের প্রভাবে ঐ গর্ভবতী নারীর প্রসববেদন দূর হোক। এবং সুস্থ সুন্দর ভাবে বাচ্চা প্রসব হোক।


উত্তরে অঙ্গুলিমাল বললেন- ভগবান বুদ্ধ, এ কথা বলতে আামর কোন আপত্তি নেই। কারন এই কথাটা অতীব সত্য।


বুদ্ধ- আয়ুষ্মান, যাও এবার ঐ নারীর কাছে গিয়ে তোমার এ সত্যক্রিয়া কর।


ভগবান বুদ্ধের আদেশে অঙ্গুলিমাল কালবিলম্ব না করে ঐ গর্ভবতী নারীর কুটিরের পাশে একটি পাথরে বসে বুদ্ধের নির্দেশ মত সত্যক্রিয়া করেন এই ভাবে--

" যতোহং ভগিনী, অরিয়ায় জাতিয়া জাতো,

নাভিজানামি সঞ্চিচ্চ পাণং জীবিতা বোরোপেতা,

তেন সচ্চেন সোথ্থি তে হোতু গব্ভস্স "


অনুবাদ : হে ভগিনী বুদ্ধের শরণাপন্ন হয়ে আর্যজাতিতে অহর্ৎ হবার পর থেকে সজ্ঞানে আমি একটি প্রাণীও হত্যা করি নি। যদি এ কথা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এ সত্যের প্রভাবে আপনার প্রসব-বেদনা অচিরেই দূর হোক।


অঙ্গুলিমাল অধিষ্ঠান শেষ করতেই ঐ গর্ভবতী নারীর প্রসব-বেদনা দূর হয়। এবং একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন। এ ঘটনার পর অঙ্গুলিমাল খুবই আনন্দিত হন। এবং সত্যক্রিয়ার যে মহৎফল সেটা ভাবতে ভাবতে আনন্দিত হয়ে বিহারে এসে ভগবান বুদ্ধকে প্রণাম জানিয়ে সব কথা খুলে বলেলেন।


এদিকে এ কথা শ্রাবস্তীর অলিতে-গলিতে লোক-জনের মুখে মুখে যে-অঙ্গুলিমালের সত্যক্রিয়ার প্রভাবে এক গর্ভবতী নারীর প্রসব-বেদনা দূর হয়ে ঐ মহিলা একটি পুত্র সন্তান জন্মদান করেন।

সবাই অঙ্গুলিমারে প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

এর পর হতেই এ সত্যক্রিয়া বৌদ্ধ সমাজে "অঙ্গুলিমাল-পরিত্তং" নামে খ্যাতি অর্জন করে।


মূল্যপ্রাপ্তি

**********

অঘ্রাণ মাসের এক হিমেল রাত্রি,বুদ্ধদেব অবস্থান করছেন গন্ধকুটিরে রাজা প্রসেনজিতের রাজ্যে। মালী সুদাসের কুটিরের সংলগ্ন সরোবরে বেশিরভাগ পদ্মপুষ্প মৃতবৎ, শুধু একটি পদ্ম পূর্ণ প্রস্ফুটিত। সুদাস সেটি তুলে নিয়ে বেশ কিছু অর্থলাভের আশায় চলেছে রাজা প্রসেনজিতের রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে। প্রাসাদ ঢোকার কিছু আগে এক পথিকের সঙ্গে সুদাসের দেখা হলো, সে বুদ্ধদেবের সেবায় নিবেদন করবে বলে সুদাসের কাছে পদ্মটি ক্রয় করবার জন্য তার মূল্য জানতে চাইলে সুদাস তাকে বলল যে সে এক স্বর্ণমুদ্রা মূল্য নেবে এটির যেহেতু এটি অসময়ের পদ্ম। পথিক সেটি নেবার আগেই সেস্থলে উপস্থিত হলেন মহারাজ প্রসেনজিৎ। তিনি পদ্মটি নিতে চাইলে সুদাস জানাল যে সেটি ঐ পথিক এক স্বর্ণমুদ্রায় নেবেন বলে স্বীকৃত হয়েছেন, শুনে মহারাজ প্রসেনজিৎ বললেন তিনি দশ স্বর্ণ মুদ্রা দেবেন, মহারাজ প্রসেনজিৎও পদ্মটি বুদ্ধদেবের চরণে নিবেদনের পিয়াসী। সেই পদ্মটির দাম নিয়ে পথিকের সঙ্গে যখন মহারাজ প্রসেনজিতের বচসা উপস্থিত হলো, তখন সুদাস ভাবল যাঁকে দেওয়ার জন্য দুজনেই এতো মূল্য দিতে আগ্রহী, না জানি তাঁকে দিলে আরো কত বেশি লাভ হবে, সে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে জানাল যে সে পদ্মটি বিক্রয় করবে না এবং ছুটলো জেতবন সংলগ্ন গন্ধকুটিরে যেখানে ভগবান তথাগত অবস্থান করছেন। নিরঞ্জন আনন্দমূর্তি তথাগত পদ্মাসনে বসে আছেন, দৃষ্টিতে তাঁর শান্তি ঝরে, স্মিত মুখে করুণার সুধাঝরা হাসি। অপলক নয়নে নির্বাক হয়ে বহুক্ষণ চেয়ে থেকে সুদাস সেই পদ্মটি তাঁর পাদপদ্মে রেখে দিল। ভগবান তথাগত তাঁর অমৃতবর্ষী হাসি হেসে সুদাসকে জিজ্ঞেস করলেন, "বৎস, তোমার প্রার্থনা কি "? সুদাস ব্যাকুল স্বরে জানাল, "আপনার চরণের এক কণা ধূলি ছাড়া আর কোনো প্রার্থনা আমার নেই, প্রভু"। বুদ্ধদেব তাকে আশ্রয় দান করলেন।


শহীদ শামুক ও তাদের ত্যাগ স্মরণ

*****************************--*

আমরা সাধারণত গৌতম বুদ্ধের যে মূর্তি/ ছবিগুলো দেখি, তাতে তাঁর মাথায় গোল গোল কোঁকড়ানো চুল/ চুলের মত বস্তু দেখতে পাই।সত্যি কি এগুলো তাঁর মাথার চুল, না অন্যকিছু?

সংসার ত্যাগের সময় তিনি মাথা মুড়িয়ে নেন। তাহলে এগুলো কি?

এর পিছনে একটি প্রচলিত কাহিনী রয়েছে.....


একদিন গৌতম বুদ্ধ গাছের নীচে বসে ধ্যান শুরু করলেন। তিনি চিন্তায় এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে সময় গড়িয়ে দুপুর হল সেটি তার নজরে পড়েনি। সময় যত গড়াচ্ছিল ততই সূর্যের রশ্মি তাঁর চুলহীন মাথায় পরতে থাকে।


সেই মুহুর্তে, একটি শামুক গৌতম বুদ্ধর সামেনে দিয়ে যাচ্ছিল। শামুক খেয়াল করল যে বুদ্ধ সেই প্রচণ্ড গরমে ধ্যান করছেন। যদিও তিনি গাছের নীচে বসে ছিলেন, তবুও সূর্যের রশ্মিগুলি তাঁর মাথার ওপর পরছিল। শামুক ভেবেছিল এই প্রচণ্ড গরমে ধ্যানে মনোনিবেশ করা তার পক্ষে কঠিন হবে।


দ্বিতীয় বার না ভেবেই শামুক বুদ্ধের মাথার উপরে উঠে বসে,  এই ভেবে যে তার ঠাণ্ডা শরীরটি বুদ্ধের মাথার মসৃণ ত্বককে ঠান্ডা রাখবে। অন্যান্য শামুকও প্রথম শামুক কে অনুসরণ করে বুদ্ধের মাথায় গিয়ে বসে। এই শামুক গুলি দেখে মনে হচ্ছিল যেন বুদ্ধের মাথায় কোন পেঁচানো খোলসের টুপি।


শামুকের শীতল এবং স্যাঁতসেঁতে দেহগুলি কয়েক ঘন্টা অবধি বুদ্ধের ধ্যান বজায় রাখতে সহায়তা করেছিল। শামুক গরম রশ্মির কারণে তাদের দেহ শুকিয়ে গেছিল। পরে সন্ধ্যায় বুদ্ধের যখন ধ্যান ভাঙ্গলো, তখন তিনি জানতে পারলেন যে ১০৮ টি শামুক তাঁর মাথায় ওপর ছিল, প্রত্যেকেই তাদের জীবন দিয়েছিলেন বুদ্ধের জ্ঞানার্জনের পথে বিঘ্ন মুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে।


শামুকগুলি যেহেতু বুদ্ধের জন্য তাদের জীবন দিয়েছিল তাই তারা এখানে শহীদ হিসাবে সম্মানিত। তাদের ত্যাগের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এগুলি বুদ্ধ মূর্তিতে প্রদর্শিত হয়।


অন্নদান

»»»»»»»»

প্রেক্ষাপট

*******


বৌদ্ধ সাহিত্যে বর্ণিত ষোড়শ জনপদের একটি ছিল মগধ, যার রাজা অজাতশত্রু ছিলেন হর্য্যঙ্ক রাজবংশের রাজা বিম্বিসার ও কোশল রাজকন্যা  চেলেনার পুত্র । ৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গৌতম বুদ্ধের  প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ বৌদ্ধ ভিক্ষু দেবদত্তের প্ররোচনায় অজাতশত্রু বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক বিম্বিসারকে হত্যার চেষ্টা করেন। বুদ্ধের মতাদর্শে বিশ্বাসী বিম্বিসার এই ঘটনায় তাঁর পুত্রকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু পুনরায় দেবদত্তের প্ররোচনায় অজাতশত্রু  বিম্বিসার ও তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীকে গৃহবন্দী করে নিজেকে মগধের শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ৪৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গৃহবন্দী অবস্থায় বিম্বিসারের মৃত্যু ঘটে। এই সময় দেবদত্তের প্ররোচনায় তিনি গৌতম বুদ্ধকে হত্যার চেষ্টা করেন। পিতার মৃত্যুর পর অনুশোচনায় দগ্ধ অজাতশত্রু শান্তিলাভের আশায় বিভিন্ন ধর্ম উপদেষ্টা ও দার্শনিকের শরণাপন্ন হন। কিন্তু তাঁদের উপদেশে শান্তিলাভে ব্যর্থ হয়ে রাজবৈদ্য  জীবকের  উপদেশে গৌতম বুদ্ধের শরণাপন্ন হলে বুদ্ধ তাঁকে  সাম্যফলসুত্ত  ব্যাখ্যা করেন।


কোশলের সঙ্গে যুদ্ধ

**************-**

বিম্বিসারের বন্দীত্ব ও মৃত্যুর ঘটনায় ক্রুদ্ধ  কোশলরাজ প্রসেনজিৎ একদা উপহার হিসেবে প্রদত্ত  কাশী রাজ্য পুনরায় নিজের অধীনে নিয়ে নিলে অজাতশত্রু কোশল রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। প্রথম যুদ্ধে তিনি বিজয়ী হলেও পরের যুদ্ধে পরাজিত হন। কিন্তু গৌতম বুদ্ধের মতাদর্শে বিশ্বাসী প্রসেনজিৎ তাঁকে মুক্ত করেন এবং তাঁর কন্যা বজিরাকে তাঁর সাথে বিবাহ দিয়ে যৌতুক হিসেবে  কাশী  রাজ্য  ফিরিয়ে দেন।


গঙ্গার উত্তরে ছিল কোশল রাজ্য, এটিও বৌদ্ধ সাহিত্যের ষোড়শ জনপদের আর একটি। এই রাজ্যেরই এক সমৃদ্ধশালী নগরী ছিল শ্রাবস্তী।গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে শ্রাবস্তী নগরীর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। সুদত্ত  ছিলেন শ্রাবস্তী নগরীর একজন ধনী শ্রেষ্ঠী যিনি ব্যবসায়ের কাজে মগধের রাজধানী রাজগৃহ নগরীতে গিয়েছিলেন। ওই রাজগৃহ নগরীতেই সুদত্ত প্রথম বুদ্ধকে দেখেছিলেন এবং বুদ্ধের সঙ্গে কথা বলে তাঁর এক পরম ভক্তে পরিণত হন। বুদ্ধকে একবার শ্রাবস্তী যাওয়ার অনুরোধ করেন সুদত্ত। বুদ্ধ রাজী হন। কিছুকাল পরের কথা। বুদ্ধ শ্রাবস্তী আসছেন; সঙ্গে কয়েক হাজার শিষ্য।  এত লোককে কোথায় থাকবার আয়োজন করা যায় ভেবে সুদত্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শ্রাবস্তী নগরীর বাইরে যুবরাজ জেত এর বিশাল একটি বাগান ছিল। সুদত্ত বাগানটি কিনতে চাইলে জেত প্রথমে রাজী হননি। পরে শর্তসাপেক্ষে রাজী হন—স্বর্ণমুদ্রায় সম্পূর্ণ বাগান ঢেকে দিতে হবে। সুদত্ত সম্মত হলেন। সুদত্ত গোশকট করে স্বর্ণমুদ্রা এনে বাগান ঢেকে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সুদত্তর পরম বুদ্ধভক্তি দেখে জেত অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি সুদত্তকে বাগানখানি দান করেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সুদত্ত জেত এর নামে বাগানের নাম রাখেন জেতবন।


বুদ্ধ শ্রাবস্তী এলেন। ধ্যান করলেন, দান করলেন; শ্রাবস্তী নগরীকে অমর করে রাখলেন। রাজকুমার জেত অসম্ভব ধনাঢ্য ছিলেন; তিনি বুদ্ধকে আঠারো কোটি স্বর্ণ মুদ্রা দান করেন।সুদত্ত বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সুদত্ত অনাথদেরকে অন্ন (পিণ্ডক) দিতেন বলে তাঁকে অনাথপিণ্ডিক বা অনাথপিণ্ডদ বলা হত। অনাথপিণ্ডিক বা  অনাথপিণ্ডদ নামটি বুদ্ধই দিয়েছিলেন।গৌতম বুদ্ধের ব্যবহারের জন্য সুদত্ত গন্ধকাষ্ঠ দিয়ে একটি কুটির নির্মাণ করে দেন  'গন্ধকুটির' নামে যেটিতে বুদ্ধদেব অবস্থান করতেন।


আখ্যান

********

অজাতশত্রুর সঙ্গে যুদ্ধের ফলস্বরূপ কোশলের রাজধানী শ্রাবস্তীতে খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয়। সেই দুর্ভিক্ষের কবল থেকে নগরীর জনগণকে রক্ষা করার অপরূপ ঘটনাটি এই আখ্যানের উপজীব্য। অনাথপিণ্ডদ সুদত্ত কন্যা সুপ্রিয়াও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বৌদ্ধ ভিক্ষুণী সংঘে যোগ দেন এবং তথাগতের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। সেই দুর্ভিক্ষ কবলিত শ্রাবস্তীর এক সন্ধ্যায় বুদ্ধদেব তাঁর প্রত্যেক ভক্তগণের কাছে গিয়ে জনে জনে জানতে চাইলেন যে কে ক্ষুধিতের অন্নদান সেবার ভার নিতে ইচ্ছুক। শ্রাবস্তীর ধনবান শ্ৰেষ্ঠী তথাগতের পরমভক্ত রত্নাকর শেঠ প্রথমে মাথা হেঁট করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে হাত জোড় করে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, "প্রভু, মার্জনা করুন, এই ক্ষুধার্ত বিশাল পুরীর ক্ষুধা মেটানোর ক্ষমতা আমার নেই"। শ্রাবস্তীর সামন্ত রাজা তথাগতভক্ত জয়সেন বললেন, "প্রভু আপনার আদেশ মাথা পেতে নিতাম যদি আমার বুক চিরে রক্ত দিলে সেটা কোনো কাজে আসত, আমি অপারগ, আমার ঘরে কোথায় অন্নের সংস্থান আছে আজ"? ধর্মপাল নামে আরেক সম্পন্ন কৃষক বুদ্ধভক্ত  বললেন, " কি আর বলব প্রভু, আমার এমন পোড়া কপাল যে আমার অমন সোনার খেত যেন অজন্মায় পালিত প্রেতের মত ধুঁকছে, রাজকর দেওয়াই কঠিন হয়ে গেছে, আমি অক্ষম, দীনহীন হয়ে গেছি "। সেই সভাঘরে সকলে একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে, কারো মুখে কোনো উত্তর নেই, ব্যথিত শ্রাবস্তী নগরীর নির্বাক সেই সভাগৃহে তথাগতের করুণ দুটি নয়ন সন্ধ্যার ম্রিয়মান তারার মত চেয়ে রইল সবার দিকে। তখন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো লজ্জারক্তিম আননে অনাথপিণ্ডদের কন্যা সুপ্রিয়া, যিনি বুদ্ধদেবের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে বুদ্ধদেবের পদস্পর্শ করে চরণধূলি মস্তকে নিয়ে বললেন, "আমি ভিক্ষুণীরও অধম সুপ্রিয়া, আমি প্রভুর আজ্ঞা মাথা পেতে নিলাম, খাদ্যহারা যারা কাঁদছে, তারা আমার সন্তান, নগরীতে অন্ন বিতরণ করার ভার আমি নিলাম "। সকলে বিস্মিত হয়ে বলল, "তুমি ভিক্ষুকন্যা, নিজেও তুমি ভিক্ষুণী, কোন অহংকারে মেতে মাথা পেতে এমন গুরু দায়িত্বের কাজ নিচ্ছ "? সুপ্রিয়া বলল, "আমি দীনহীন মেয়ে, সবার চেয়ে অক্ষম, তাই নিশ্চয় তোমাদের দয়া পাব, প্রভুর আজ্ঞা বিজয়ী হবে, ক্ষুধার্ত অন্ন পাবে।আমার ভান্ডার ভরে আছে তোমাদের সকলের ঘরে ঘরে, আমার শুধু এই ভিক্ষা পাত্র আছে, তোমরা চাইলে সেই ভিক্ষা পাত্র অক্ষয় হবে, ভিক্ষার অন্নে ধরণীকে বাঁচাব, দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা মেটাবো "। তথাগতের আশীর্বাদ নিয়ে অনাথপিণ্ডদ সুতা সুপ্রিয়া তাঁর মহৎ কার্যে প্রবৃত্ত হল এবং অন্নদানে ক্ষুধিতকে জীবনদান করল। সুযোগ্য পিতার সুযোগ্য পুত্রীর কর্মের মধ্যে দিয়ে মহৎ হৃদয়ের ধারাটি অব্যাহত রইল।


তথ্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার: অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.


ছবি : ইন্টারনেট

সমাপ্ত