Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

জামাইষষ্ঠী হলো- দেবী ষষ্ঠী পুজোর রূপান্তরিত প্রথা

জামাইষষ্ঠী হলো- দেবী ষষ্ঠী পুজোর রূপান্তরিত প্রথা - নরসিংহ দাস।
রবীন্দ্রনগর, মেদিনীপুর শহর।       কথায় আছে বাঙালির 'বারো মাসে তেরো পার্বণ'। সত্যিই তাই, বাঙালি সমাজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ পুজো-পার্বণ। যুগ যুগ ধরে নানান …

 


জামাইষষ্ঠী হলো- দেবী ষষ্ঠী পুজোর রূপান্তরিত প্রথা 

- নরসিংহ দাস।


রবীন্দ্রনগর, মেদিনীপুর শহর।

       কথায় আছে বাঙালির 'বারো মাসে তেরো পার্বণ'। সত্যিই তাই, বাঙালি সমাজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ পুজো-পার্বণ। যুগ যুগ ধরে নানান উৎসব ও আনন্দে মেতে থাকতে দেখা যায় বাঙালিদের। এমন‌ই এক প্রথা হলো 'জামাইষষ্ঠী'। জৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে এই সামাজিক পার্বণ পালিত হয়ে আসছে বৈদিক যুগ থেকে। যদিও চান্দ্র বছরের গননা অনুযায়ী এই পার্বণ কোনো কোনো বছর জৈষ্ঠ্য মাস ছাড়িয়ে আষাঢ় মাসে ঢুকে পড়ে। চলতি বছরের ১ আষাঢ় এই তিথি পালন‌ করা হবে প্রত্যেক বাঙালির ঘরে ঘরে। সাধারণত এই দিনে জামাইদের প্রতি একটু বেশী খাতির যত্ন থাকে শ্বশুরবাড়িতে। কোথা থেকে এলো এমন সামাজিক প্রথা? জেনে নেওয়া যাক!

     ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলোর হিন্দু সমাজে একসময় সংস্কার ছিলো- বিবাহিতা কন্যা যতদিন না পুত্রবতী হয়, ততদিন কন্যার পিতা মাতা কন্যার বাড়িতে পদার্পন করবেন‌ না। এই প্রথায় সমস্যা দেখা দিলো- সন্তান ধারনে সমস্যা বা শিশুমৃত্যু জনিত কারণে কন্যা পুত্রবতী না হ‌ওয়ায় দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয় কন্যার বাড়িতে যাওয়ার ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে বিবাহিতা কন্যার মুখদর্শন ঘটবে কিভাবে? এমন অবস্থায় সমাজের বিধানদাতা নিয়ম করেন জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা তিথিতে মেয়ে জামাই কে নিমন্ত্রণ করা হবে এবং জামাই ষষ্ঠী হিসেবে ঐ দিনটি পালন করে মেয়ে জামাইকে সমাদর করার পাশাপাশি মেয়ের মুখ দর্শন করা হবে। সেই সঙ্গে মা ষষ্ঠীর পুজো করে তাঁকে খুশি করা, যাতে খুব শীঘ্রই মেয়ে সন্তান ধারন করতে পারে। বর্তমান এই প্রথার অবশ্য অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। সাধারণত বিবাহের সময় কন্যার পিতা মাতা ছাড়া অন্য যে ব্যক্তি কন্যাকে সম্প্রদান করেন তিনি একবছর কন্যার বাড়িতে যাবেন‌ না বা গেলেও অন্নগ্রহন করবেন‌ না। 

     অপর একটি প্রথা অনুযায়ী, ষষ্ঠী পুজো সাধারণত মেয়েরা করে থাকেন। তাঁদের কাছে এই পুজোর তাৎপর্য ভিন্ন। কথিত আছে- এক পরিবারে দুটি ব‌উ ছিল। ছোটব‌উ ছিল খুব লোভী। বাড়ির মাছ বা যে‌ কোন‌ ভালো খাবার রান্না হলেই সে লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে নিতো এবং শাশুড়িকে অভিযোগ করতো 'সব কালো বিড়ালে খেয়ে নিয়েছে'। এদিকে বিড়াল হলো মা ষষ্ঠী দেবীর বাহন। বিড়াল মা ষষ্ঠীর কাছে অভিযোগ জানাতে মা ষষ্ঠী ক্ষুব্ধ হলেন এবং ছোটব‌উ এর সাত পুত্র ও এক কন্যা সন্তানকে জন্মগ্রহণ করার পর তিনি ফিরিয়ে নেন। সেক্ষেত্রে ছোটব‌উ সন্তানহীনতার দুঃখে ভুগতে থাকে। অন্যদিকে স্বামী সহ শ্বশুরবাড়ির অন্য সদস্যরা ছোটব‌উকে 'অলক্ষনা' বলে গালিগালাজ করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। অথচ বড়ব‌উ স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করতে থাকে। এমন অবস্থায় ছোটব‌উ মনের দুঃখে বনে চলে যায় ও কাঁদতে থাকে। অবশেষে মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার ছদ্মবেশে এসে তার কান্নার কারন‌ জানতে চান। একে একে সব ঘটনা বলতে থাকে ছোটব‌উ। তখন মা ষষ্ঠী তার পূর্বের অন্যায় আচরণের কথা বললে ছোটব‌উ মা ষষ্ঠীর কাছে ক্ষমা চায়। ষষ্ঠী দেবী তাকে ক্ষমা করেন এবং বলেন ভক্তিভরে মা ষষ্ঠীর পুজো করলে সে তার সন্তান সন্ততীদের ফিরে পাবে। ছোটব‌উ সংসারে ফিরে এসে ঘটা করে মা ষষ্ঠী দেবীর পুজো করে এবং সাত পুত্র ও এক কন্যা সন্তানকে একে একে ফিরে পায়। এই মাহাত্ম্য দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তারপর থেকে ষষ্ঠীদেবীর পুজো শুরু হয়। যা অরন্যষষ্ঠী এবং পরে পরে জামাইষষ্ঠী তে রূপান্তরিত হয়।

       এদিকে যে সময় ষষ্ঠী পুজোর আয়োজন করা হয় অর্থাৎ জৈষ্ঠ্য মাসে প্রকৃতিতে আম কাঁঠাল ইত্যাদি ফলের সমারোহ। তাই খুব ঘটা করে শাশুড়িরা ষষ্ঠী পুজোর আয়োজন করে থাকেন। নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসা জামাইকে প্রথমে আসনে বসিয়ে কপালে দ‌ইয়ের ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করেন ও দীর্ঘ জীবন কামনায় মা ষষ্ঠীর স্মারক হিসেবে তেল-হলুদে চোবানো সুতো জামাইয়ের হাতের কব্জিতে বেঁধে দেন। নানান ফল মিষ্টান্ন খেতে দেওয়ার পাশাপাশি আশীর্বাদী নতুন বস্ত্রাদি জামাইয়ের হাতে তুলে দেন। এক্ষেত্রে শুধু জামাই নয় কন্যারাও নতুন বস্ত্রাদি পেয়ে থাকেন। তবে হ্যাঁ জামাই বাবাজিও শ্বশুরবাড়িতে ঢোকার সময় দ‌ই মিষ্টি ও শাশুড়ির জন্য নতুন বস্ত্রাদি আনতে ভোলেন না।

      বাঙালি হিন্দু সমাজে এই প্রথার গুরুত্ব রয়েছে অনেকখানি। বিশেষত যে পরিবারে সদ্য বিবাহিতা কন্যা রয়েছে সেই বাড়িতে ঘটা করে পালন করা হয়। পুজোর সময় পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য পৃথক মালসার মধ্যে নতুন বস্ত্র, ফল-ফলাদি, পান-সুপারি, ধান-দূর্বা ও তালপাতার পাখা রাখা হয়। ভক্তরা উপোস রেখে মা ষষ্ঠীর পুজো করেন। সাধারণত শুক্লা ষষ্ঠীর প্রথম প্রহরে মা ষষ্ঠী দেবীর পুজোর আয়োজন করা হয়। ষষ্ঠীর প্রতিমা বা আঁকা ছবিতে পুজো নিবেদন‌ করা হয়। কেউ কেউ ঘট প্রতিস্থাপন করেও এই পুজো করে থাকেন।

     তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথেই অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে এই প্রথার। খুবই কম পরিবারে এখন এই পুজোর আয়োজন করা হয়। তবে জামাই কে ফোঁটা বা নতুন বস্ত্রাদি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। ফলফলাদির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানান মাছের পদ। বিশেষত ইলিশ মাছের পদ থাকবেই সব শ্বশুরবাড়িতে। যদিও বর্ষা আসতে অনেকটাই দেরি, তবুও সাধ্যমতো শ্বশুরবাড়িতে অন্যান্য অনেক পদের সঙ্গে ইলিশ মাছের একটি পদ রাখতে চেষ্টা করেন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় তালপাতার পাখার ব্যবহার উঠেই গিয়েছে। তবুও বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে থেকে গিয়েছে এই জামাইষষ্ঠী নামক প্রথা। বাঙলার ঘরে ঘরে ঘটা করে পালন করা হয় এই দিনটি। বছরের অন্যান্য দিন অপেক্ষা জামাইষষ্ঠীর দিনটিতে সদ্য বিবাহিত জামাই থেকে শুরু করে বয়স্ক জামাইদের একটু বেশি খাতির যত্ন থাকে শ্বশুরবাড়িতে।