সৃষ্টি সাহিত্য যাপনকবিতা : মরণই ছিল ভালোকলমে : শক্তিপদ ঘোষতারিখ : ২৬ , ০৬ , ২০২১
পথে বিপথে যে যেখানে পারি--যেমন পারিশুধুই পাওনার তরেযে যার কথায়--যে যার সুরে মরি গাওনা করে ।অর্থাৎ আমরা যে যেখানে যেমন পাচ্ছিপ্রকাশ্যে…
সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
কবিতা : মরণই ছিল ভালো
কলমে : শক্তিপদ ঘোষ
তারিখ : ২৬ , ০৬ , ২০২১
পথে বিপথে যে যেখানে পারি--যেমন পারি
শুধুই পাওনার তরে
যে যার কথায়--যে যার সুরে মরি গাওনা করে ।
অর্থাৎ আমরা যে যেখানে যেমন পাচ্ছি
প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে-- টেবিলের নিচে হাত পেতে
আলোয় অন্ধকরে--রবে ও নীরবে
গান ঠিক গেয়ে যাচ্ছি ।
অন্যদিকে , মনে মনে নির্বিঘ্ন অমরত্বের
একটা ছাড়পত্র চেয়ে ,
অথবা স্থায়ী স্বর্গবাসের একটা টিকিট হাতে চেয়ে
স্ব-ভাবে দিবারাত্র মরছি সব চেঁচিয়ে ।
হাতপাতা ছাড়া যাদের ভিন্ন পথ নাই ,
ভিক্ষাছাড়া যাদের গত্যন্তর নাই ,
সেই তাদের কথা বাদ থাক ,
বাসে-ট্রেনে-স্টেশনে ও পীঠস্থানের সর্বত্র
যে অন্ধ ও খঞ্জেরা গান গেয়ে পাতে হাত ,
নিত্য আসা যাওয়ার পথে এমন অনেক দেখেছি ;
শুধু দেখি না কেউ--রাত্রির নিঃশব্দ প্রহরে
কত তারা খসে যায় ,
কত বুক ভাঙে অন্ধকারে কত সুনামির ঢেউ ।
দেখি না বুক তাদের কতটা সাহারা--কতটা শ্মশান ,
শুনিও না কান পেতে--দিনান্ত ঘামে ভিজে
তারা গায় বা কেমন ভজনের গান ।
সেই নগণ্যদের কথা বলছি না ,
বলছি রাজভিখারীদের কথা ;
ভিক্ষা করলেও যাদের ভিখারী বলা যাবে না ,
স্ব-ভাবে যারা প্রত্যেকে স্বর্গের দূত ;
নামাবলীর নিচে স্বভাবটাকে ঢেকে রেখে
গায় যারা রাজভাবে অবহেলে অবিশ্বাস্য অদ্ভুত ।
মানুষের সুপ্ত বাসনাকে হাওয়া দিয়ে
বহুকালের যাদুকরী মোহিনী বাঁশির সুরে
আকাশের থেকে চাঁদ ধরে আনার
এক সৌখীন মিথ্যের গান ধরে ।
আমরা সেই তাদের গল্পে গানে খুব সহজেই
গলে জল হয়ে যাই ;
তাদের তালে তাল দিয়ে মহানন্দে নাচি ,
তাদের সুরে সুর মিলিয়ে ভজনের গান গাই ।
কেউ নিজের গান গাই না ,
নিজের গান বাঁধি না কেউ নিজের কথাতে ।
তারাও ঠিক সেই ফাঁকে
নিঃশব্দ শোষণের অদৃশ্য জাল পাতে ।
আমরা ভাবী সেই স্বর্গপ্রাপ্তির মহাসুখে মগ্ন থেকে
অনুৎপাদক একটা খাতে মহানন্দেই
মাথার ঘাম মাটিতে ঝরাই ;
বিড়ালকে মাছ পাহারায় রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাই ।
হে দয়ার ঠাকুর , তুমিও কি কম যাও ?
আমার মনে হয় সবার থেকে তুমিই বেশি গাও ।
তোমার যা আছে তাতে তোমার প্রসন্ন নয় চিত্ত ,
চেয়েছো তুমি মনে মনে--থাকুক মানুষ
চিরকাল তোমার বিনিপয়সার ভৃত্য ।
তুমিও চাও অদৃশ্য হাত পেতে
অচপল দাসত্ব-অকপট আনুগত্য ও
নির্ভেজাল ভক্তি ইত্যাদি--রাজা উজিরেরা
ঠিক যেমনটা চায় মানুষের থেকে ।
মজা এই যে ,তোমার হাতপাতাকে কিছুতেই
ভিক্ষা বলা যাবে না--বলতে হবে অনুগ্রহ ;
সম্মুখে রাঙায় চোখ বিগ্রহ ।
আবার নিজে গাও যত না
গাওয়াও তার চেয়ে ঢের ;
প্রাকৃতিক নিয়মে জগৎ সৃষ্ট--ধ্বংস হলে
প্রাকৃতিক নিয়মেই ধ্বংস হবে ফের ,
এই সহজ সত্যিটা কিছুতেই মানতে দাও না তুমি ।
পরিবর্তে শুনে শুনে সব জেনে আছি
না যদি থাকি তোমার চরণ চুমি' ,
তোমার ভীষণই গোসা হয়ে যাবে ।
কার ভাগ্য কখন যে তুমি মুড়িয়ে খাবে ,
দিবারাত্র এই ভয়েই থাকি সব্বাই ;
এই ভয়েই রাজার নামে যেমন জয়ধ্বনি করি ,
তোমার নামেও তেমনি ভজনের গান গাই ।
কারণ , জ্ন্ম থেকে জেনে আছি
অনেক ক্ষমতা তোমার-- তুমি অনেক পারো ।
তুমি চাইলে আগুনে পোড়াতে পারো ,
প্লাবনে ভাসাতে পারো
মাঝসাগরে ডোবাতে পারো ,
মাথা নেড়ে সব ধসাতেও পারো ;
অনেক যাদু আছে তোমার হাতে ,
তবে এত পারলেও তুমি পারো না শুধু বাঁচাতে ।
আশ্চর্য , এতসব অন্যায়ের
কখনো কোন কৈফিয়ত দিতে হয় না তোমাকে ;
যেহেতু তোমার কোন প্রতিপক্ষ নাই ,
তরবারিটা তাই তোমার ইচ্ছামতো
যেমন তেমন করে ঘুরিয়ে চলেছো একতরফাই ।
বলতে দ্বিধা নাই--তোমার এই ধারাই
বহন করে চলেছে পৃথিবীর শাসকেরা ;
তোমার মতোই চোখ রাঙিয়ে
যে যার এলাকা দিচ্ছে পাহারা ।
ভোটের মতো একটা বড় ভিক্ষার আশায়
শাসকেরা পৃথিবীর সর্বত্রই--আমাদের শাসায় ,
তোমারই মতো অনুগ্রহের দাস করে রাখতে চায় ।
সব মিলিয়ে উঠেছে নাভিশ্বাস ;
আমার মনে হয়--তুমি যদি থাকতে তোমার স্থানে ,
প্রতিষ্ঠা চেয়ে হাত না বাড়াতে এই মর্তধামে ,
তবে এই মর্তলোকেই হতো স্বর্গবাস ।
দুইয়ের মাঝে এমন হিমালয় উঠতো না ,
অযথা এত রক্তক্ষয় হতো না ,
সইতেও হতো না পিঠ পেতে
অকারণ মরীচিকার এত লাঞ্ছনা ।
মাঝে মাঝে ভাবি--অন্ধ এই চোখের তারায়
না যদি জ্বলবে আলো ,
ভৃত্য হয়ে এমন বাঁচার থেকে মরণই ছিল ভালো ।
---------------------------------------------------------------------