Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

# ক্যাসিওপিয়া সাহিত্য পরিবার # দৈনিক_প্রতিযোগিতা #বিভাগ _গল্প #তারিখ _২৬/৭/২১ 
#ওরা_হৃদয়ের_রং_জানে_না
কলমে: অচেনা লেখক " নীল "
আমার কলেজপড়ুয়া মেয়েকে কেউ বিয়ের কথা বললে ও একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। বিয়ে সে কিছুতেই করবে ন…

 


# ক্যাসিওপিয়া সাহিত্য পরিবার 

# দৈনিক_প্রতিযোগিতা 

#বিভাগ _গল্প 

#তারিখ _২৬/৭/২১ 


#ওরা_হৃদয়ের_রং_জানে_না


কলমে: অচেনা লেখক " নীল "


আমার কলেজপড়ুয়া মেয়েকে কেউ বিয়ের কথা বললে ও একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। বিয়ে সে কিছুতেই করবে না। বিয়ের নামেই যেন মেয়ের অ্যালার্জি।


প্রসঙ্গত জানাই যে মেয়ে দুই বছর আগে কোএড স্কুল থেকে পাশ করে এবার স্বাদ বদলের জন্য গার্লস কলেজে ভর্তি হয়েছে ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে। কোএড স্কুলে পড়ার সময় দেখতাম ওর বান্ধবীরা দিব্যি প্রেমিক জুটিয়ে নিয়েছে আর আমার মেয়ে তখন গল্পের বইতে ডুবে থাকে অবসর সময়ে। কেউ ঠাট্টা করেও যদি জিজ্ঞাসা করত কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা, আমার ডিটেকটিভ  ফিকশন আর ক্রাইম সিরিয়ালভক্ত মেয়ের জবাব ছিল "পাগল নাকি? এই করে পড়াশোনা লাটে উঠুক। আর এইসব চক্করে কে যাবে? কোনো নারীপাচারচক্রে জড়িয়ে গেলে?"


বলা বাহুল্য যে এই উত্তরের পর আর কেউ কিছু বলতে সাহস পেতেন না। কলেজে ওঠার পর অনেকেই ঠালে ঠারে খোঁচাতে শুরু করেছিলেন ওর বিয়ের জন্য। কিন্তু বিধি বাম। মেয়ে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে যে বিয়ে ও করবে না। আমি একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করলাম...


"হ্যাঁরে তুই কি বিয়ে করবিই না? এখন তো দেব না বিয়ে। আগে চাকরি পা, তারপর তো হবে।"


কিন্তু মেয়ের সেই এক গোঁ। বিয়ে ও করবেই না। আর কেন করবে না, সেটা ওর মুখেই শুনুন। 


"বিয়ে? বিয়েটা আর কিছুই না, স্বেচ্ছায় গিলোটিনে গলা দেওয়া। খবরের কাগজে পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনের শর্তগুলো দেখেছো? ফর্সা, উচ্চশিক্ষিতা, প্রকৃত সুন্দরী, গৃহকর্মনিপুণা ঘরোয়া পাত্রী চাই। কেন বস? উচ্চশিক্ষিতা মেয়েটা তোমার বাড়ি গিয়ে বরের পা টিপবে? আর দিনের শেষে শুনবে যে সারাদিন ঘরে বসে কী করো? চাইছে তো একটা আয়া প্লাস রাঁধুনি প্লাস কাজের লোক। তার আবার প্রকৃত সুন্দরী, ফর্সা, উচ্চশিক্ষিতা? নিকুচি করেছে অমন বিয়ের।"


এটা শুনে আমি বলতে গিয়েছিলাম, "অনেক বিজ্ঞাপনে চাকুরিরতা মেয়ে চায় দেখিস না?"


"মাম্মি ডার্লিং! তাহলে তো আরোই গন্ডগোল। অফিসের  কাজ তো করতেই হবে প্লাস বাড়ির কাজ। আর মাসের মাইনেটা তো ফ্রি। অফিস যাওয়ার আগে রেঁধেবেড়ে মুখের সামনে ধরতে হবে আবার অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত হলেও রাতের রান্না করতে হবে। আর কিছু গন্ডগোল হলেই শুনতে হবে চাকরি করে কি মাথা কিনে নিয়েছো? অথচ দেখো, ছেলেদের কিন্তু এই সমস্যাগুলো নেই। অফিস থেকে ফিরে, টিভি চ্যানেল ঘোরাবে আর হুকুম করবে। রোববার দিন বেলা করে উঠে সুখাদ্য চাইবে। পারব না আমি এসব। চাকরিটা দুজনে করব তত কাজগুলোও দুজনকেই করতে হবে। আমি একা কেন করব? কী দায় আমার? আমার একার সংসার?"


মেয়ের অকাট্য যুক্তিগুলোতে আমার মাথা ঘুরছিল। কিন্তু মেয়ে থামার পাত্রী না। বলেই চলেছে, "সবাই বলে মেয়েদের মানিয়ে নিতে। কেন বস? বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো আমি,  মা বাবাকে ছেড়ে যাবো আমি, কমফর্ট জোন ছাড়বো আমি আবার পুরোটা অ্যাডজাস্টমেন্টও আমিই করবো? কী দায় পড়েছে? আমার মতামত, আমার প্রাইভেসির সন্মান না করলে আমিই বা কেন সন্মান করবো?ওরা যদি কাছে টানতে না চায়, আমিই তাহলে যেতে যাবো কেন? বিয়েটা তো দুজনে করছে। অ্যাডজাস্টমেন্টও দুতরফা হওয়া উচিত। তাহলে এই একচোখামি কেন?"


বাপরে! একি সাংঘাতিক মেয়ে! আবার বলে কিনা, "বিয়ের সময়ে পণ চাইলে আমাকে আবার লুকিয়ে দিও না যেন।"


আমার মনে হলো একটু যেন আশা দেখলাম। বললাম, "তুই তাহলে বিয়ে করবি?"


"আমার বাবা মায়ের মতো শ্বশুর শাশুড়ি পেলে আর বেস্ট ফ্রেন্ডের মতো বর পেলে করব, তবে পণ চাইলে আমাকে জানিও।"


"কেন? পুলিশকে জানাবি?"


"আরে না! পুলিশকে জানিয়ে কী লাভ? বিয়েটা ভাঙ্গবে। ওরা জেলে যাবে আর তোমরাও। কী লাভ। কয়েক বছর পর বেড়িয়ে এসে আবার নতুন মুরগী খুঁজবে। পণ চাইলে দিও। বিয়েও করব। কিন্তু বিয়ের পর এমন অবস্থা করব যে পরের সাতজন্মেও পণ চাইবে না কারোর কাছে।"


"কী করবি শুনি?"


"বিশেষ কিছুই না। একজন কাস্টমার একটা ম্যালফাংশন্ড প্রডাক্টের সাথে যা করে তাই করবো। সোজা বাংলায় বললে দুর্ব্যবহার। কারণ টাকা যখন দিয়েছি তখন ছেলেকে কিনে নিয়েছি। বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও- র বিজ্ঞাপনে শোনোনি? দহেজ দিয়া মতলব খরিদ লিয়া হে আপকি বেটেকো। যেকোনো লেনদেনের ক্ষেত্রে দাতা গ্রহীতার চেয়ে বড় হয়। কাস্টমারের কাছে সেলাররা বিনম্র থাকে। টাকাও দেব, মুখও শুনব তা তো হবে না। পয়সা দিয়েছি আমি। আমার সামনে মাথা নীচু করে রাখতে হবে। লাই দিলে বাঁদর মাথায় ওঠে। মিউমিউ করব না আমি।"


"শোন তুই যা বলছিস, সব এতোটা সোজা নয় বুঝলি।"


"সোজা করে নিলেই সোজা মা। আমি সিরিয়ালের বউমাদের মতো একদমই হবো না। ল্যাজে পা দিলে ছোবল তো দিতেই হবে নইলে সবাই ল্যাজ মাড়াতে মাড়াতে কখন মাথাটা পা দিয়ে পিষে দেবে জানতেও পারব না। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ব্যবহার না করাটা বোকামি।"


"মাম শোন, পাথরে কখনও ফুল ফোটে না। বিচার করতে গিয়ে ভালোবাসতেই তো পারবি না সোনা।"


"যারা আমাকে ভালোবাসে না আমি কেন তাদের ভালোবাসবো মা? এখন ভালোবাসা দিয়ে সবার মন পাওয়া যায় না। যে সম্পর্ক টাকা দিয়ে শুরু হয় সেটা বিজনেস ট্র্যানস্যাক্শন হতে পারে ভালোবাসা নয়। আর বেশি ভালো হতে গিয়ে আমি আমার অধিকার ছাড়তে পারবো না। যা আমার, যেটুকু আমার সেটুকু নেওয়ার পরই আমি কিছু দিতে পারবো। আমাকে স্বার্থপর বললে বলো, কিন্তু এখনকার যুগে এটাই ঠিক। অনেক বাড়িতেই দেখি যায় যে বাড়ির পোষ্যটা খেতে পায় কিন্তু বাড়ির বউকে আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়। কেন? আমি পারব না ওসব। খিদে যেমন অন্যের পায়, আমারও পায়। আর সবটুকু অন্যের জন্য বিলিয়ে দিলে আমি বাঁচব কী নিয়ে? কী লাভ অন্যের জন্য স্বার্থত্যাগ করে? যার জন্য করছি সেই হয়তো ঠকাবে। অল্প জীবন নিজের জন্যেও রাখতে হয় মা।"


"দেখ মা, তুই এইসব কারণের জন্য বিয়ে করতে চাস না বুঝতে পারছি, কিন্তু বিয়ে যদি নাও করিস, একা থাকতে গেলে তো এইসব ঘরের কাজ করতেই হবে। তাই না?"


"অন্যের জন্য ফ্রিতে খাটা আর নিজের জন্য কাজ করা একই নয় মা। আমি তো এখানেও তোমার হাতে হাতে সাহায্য করি। ভালো লাগে তাই করি। বাধ্যবাধকতা তো নেই। কিন্তু বিয়ের পর এগুলোই বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়াবে। বাধ্যবাধকতা থাকলে অন্যের বাড়িতে গিয়ে প্রফেশনালি কাজ করব। অ্যাট লিস্ট টু পাইস আমদানি তো হবে।"


আমি তবু তর্ক ছাড়ি না, "টাকা দিয়ে সব হয় না মাম। শেষ বয়সে তোকে দেখবে কে কেউ না থাকলে? আমরা তো চিরদিন বেঁচে থাকবো না।"


"মা কি গ্যারান্টি আছে যে বাবা যেমন দাদু দিদানের খেয়াল রাখতো, তোমাদের জামাইও রাখবে? আর পাশের ফ্ল্যাটের রেণুদিদাকে দেখো না কি কষ্টে আছে? ছেলেমেয়ে বাইরে থাকে, আয়াদের হাতে কি কষ্টে আছে? বিয়ে তো ওনারো হয়ে ছিল।"


"বিয়ের আগে কথা বলে নেব নাহয়  যে তোকে যেন আসতে দেয়।"


"আমার বাড়ি আমি আসবো, অনুমতি দেওয়ার ওনারা কে? আর মোস্ট ইম্পর্টেন্টলি, বিয়ের আগে অনেক কথাই হয়, কিন্তু বিয়ের পর কটা কথা রাখা হয়?"


"আর তোর বিয়ে না হলে, লোকে কী বলবে ভেবে দেখেছিস?"


"যা খুশি বলুক আড়ালে, তাতে আমার কাঁচকলা। সামনে বলে দেখুক, কী করি।"


"কী করবি শুনি?"


"আত্মীয়রা বললে বলবো এটা আমার পারসোনাল ব্যাপার, আপনার নাসিকা দূরে রাখুন। আর তেলটা নিজের চরকায় দিন। আর পাড়ার আন্টিরা বললে অন্য ওষুধ।"


"ওষুধ!!!!"


"ইয়েস! একেকজনকে একেকদিন বাড়িতে ডাকবো আর অন্যরা ওদের বিষয়ে অন্যরা আড়ালে কী আলোচনা করে সেটা বলে দেব। তারপর দেখো, আমার বিয়ের কথা ভুলে গিয়ে নিজেদের মধ্যেই চুলোচুলি লেগে যাবে।"


"আচ্ছা মাম, তুই কীভাবে ধলে নিচ্ছিস যে তোর শ্বশুরবাড়ি খারাপই হবে? ভালোও তো হতে পারে। তাই না? হয়তো তোকে ওরা মেয়ের মতোই ভালোবাসবে। এখন তো অনেক শ্বশুরবাড়িই ভালো হয়। ভালোবাসে।"


"মা, তুমি আর বাবা যখন বিয়ে দিতে চাইছ তখন ধরেই নিচ্ছ যে ভালো হবে। খারাপও তো হতে পারে। আমি সেটাই ভাবছি প্র্যাকটিক্যালি।"


"খারাপ হলে ডিভোর্স নিয়ে চলে আসবি। অসুবিধা কোথায়?"


"অসুবিধা আছে মাম্মি। তোমরা বিয়ে দিলে শুধু রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হতে দেবে না। অনুষ্ঠান করে ভূতের শ্রাদ্ধ করবে। এতো খরচ করে বিয়ে দেওয়ার পর, আমার নিজেরই খারাপ লাগবে ফিরে আসতে।"


আমি অবাক হলাম। বাবাঃ! এতোটাও ভাবে, এতোটা ভালোবাসে  মেয়ে আমাদের। উত্তরটাও নিজেই দিল, "কেন ভালোবাসবো না? তোমরাও তো আমাকে ভালোবাসো। তাই না? আমাকে ভালোবাসলে, ভালোবাসা দিতে তো আমারও আপত্তি নেই। আমার আপত্তিটা শুধু ভালোবাসা না দিয়ে অধিকার খাটানোতে। ইন ফ্যাক্ট শুধু আমি না, আমার কলেজেও অনেক মেয়েই এরকম ভাবে। তোমরা ভাবো, আমরা স্বার্থপর, কিন্তু ভালোবাসলে আমাদের চেয়ে আপন কেউ নয়। কিন্তু এখন যা অবস্থা একটু প্র্যাকটিক্যাল হতেই হবে। আমি পৃথিবীকে রঙিন দেখি না মা। আজকাল যা কিছু হচ্ছে তারপর কি কাউকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করলে চলে?"


আমি চুপ করে রইলাম। মেয়েকে আজ নতুন করে চিনছি। মেয়ে কতকটা নিজের মনেই বলে চলল, "সমাজ কী ভাববে, কী বলবে আমি ভাবি না মা। আমি ভাবি তোমাদের নিয়ে আর নিজের জীবনকে নিয়ে। কারণ আমি না খেয়ে থাকলে সমাজ আমাকে একমুঠো ভাত দেবে না। রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট করে পড়ে থাকলে হাসপাতালে ভর্তি করবে না, কিন্তু আমি একটু রাত করে বাড়ি ফিরলে প্রশ্ন করবে। বন্ধুর সাথে ঘুরতে গেলে প্রশ্ন করবে। তাহলে কেন ভাববো সমাজের কথা? আড়ালে যে যা বলে বলুক। মারধর তো করে না। আর বেশি খোঁচাতে এলে জবাব দেওয়ার মুখ তো আমাদেরও আছে। তাহলে?"


আমি আর কিছু বললাম না, বলা ভালো বলতে পারলাম না। মেয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মোবাইলে গান চালিয়ে পড়তে বসল। ছোটবেলা থেকেই এই অভ্যাস। 


দুনিয়া নে হমকো দিয়া কেয়া?

দুনিয়া সে হমনে লিয়া কেয়া?

হম সবকী পরবা করে কিঁউ?

সবনে হমারা কিয়া কেয়া?


ও কী খুব ভুল কিছু বলছে? সত্যিই কী কাউকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায় এখন?


সমাপ্ত