Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

রথে হারিয়ে যাওয়া রাধারানী

নৈহাটির কাঁঠাল  পাড়ার রথে হারিয়ে যাওয়া  বালিকাটি  মাহেশের রথে হারিয়ে যাওয়া রাধারানী ।মায়ের তখন জ্বর একটু কমেছে।কিন্তু অসুস্থ মাকে পথ্য তো দিতে হবে।কিন্তু সে পয়সা কোথায় ।তাই বন ফুলের মালা গেঁথে মাহেশের মেলায় এসেছিলেন তিনি।কিন্তু র…

 


নৈহাটির কাঁঠাল  পাড়ার রথে হারিয়ে যাওয়া  বালিকাটি  মাহেশের রথে হারিয়ে যাওয়া রাধারানী ।

তরুণ চট্টোপাধ্যায় 

মায়ের তখন জ্বর একটু কমেছে।কিন্তু অসুস্থ মাকে পথ্য তো দিতে হবে।কিন্তু সে পয়সা কোথায় ।তাই বন ফুলের মালা গেঁথে মাহেশের মেলায় এসেছিলেন তিনি।কিন্তু রথের টান অর্ধেক হতে না হতেই ঝড় বৃষ্টি তে ভেঙে গেল মেলা।মালা বিক্রি হলো না।তবুও আশায় সেদিনের বালিকা ভেবেছিলেন বৃষ্টি কমলে লোক জড়ো হবে।তাঁর মালাও বিক্রি হবে।তাই বৃষ্টি তে ভিজেও এতটুকু সরলেন না ।ক্রমে রাত গাঢ হলো।কিন্তু কেউ এলেন না মালা কিনতে।কান্না নেমে এলো বালিকার চোখ জুড়ে ।

বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর অমর প্রেম কাহিনী রাধারানী উপন্যাস টির প্রেক্ষাপট মাহেশের রথ কে দেখালেও সেই বালিকা হারিয়ে গিসলেন নৈহাটির কাঁঠাল পাড়ার চ্যাটার্জি পরিবারের রথের মেলাতেই।আর তার যথেষ্ট প্রমান ও পাওয়া গেছে নানা সূত্র থেকেই।আর সেদিন ঝড় ও বৃষ্টি হয়তো ছিল না।তবে রথ টানতে টানতে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা তো রয়েছে।আর সেদিন সেই মেলায় হারিয়ে যাওয়ার গল্প তো ছিলই। আর সেই বালিকা ই সাহিত্য সম্রাটের কলমে রাধারানী। 

ইংরেজির 1875 সালের বঙ্গ দর্শনের কার্তিক ও অগ্রাহায়ন সংখ্যা তে প্রকাশিত হয় রাধারানী উপন্যাস ।আর ঠিক তার কয়েক মাস আগেই ছিল রথের মেলা।বঙ্কিমচন্দ্র তখন দেশের বাড়ি কাঁঠালতলাতে।আর সেই রথ টিও ছিল বঙ্কিমচন্দ্র দের নিজ বাটির রথ।লেখকের ভাইপো শচীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সূত্রে জানা যায়  সেদিন রথে একটি বালিকা ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যায়।আর তাঁকে অনেক খোঁজাখুঁজি ও করেন কাকা বঙ্কিম।আর এর কিছু দিন পরেই তিনি বঙ্গ দর্শনে রাধারানী উপন্যাস টিও লেখেন।সে সময় রথের মেলাতে অনেকেই হারিয়ে যেতেন।কিন্তু সেই বালিকা ফিরে আসে লেখকের কলমে মাহেশের প্রেক্ষাপটে।সৃষ্টি হয় এক অনন্য সুন্দর প্রেম কাহিনী ।যা আজও উজ্জ্বল পাঠকের মনে।

নৈহাটির কাঁঠাল পাড়ার সে দিনের রথে ঠিক কি ঘটেছিল সে দিকে একটু নজর ফেরানো যাক। 

সেদিন ছিল উল্টোরথ।কাঁঠাল পাড়ার চ্যাটার্জি পরিবারের গৃহ দেবতা রাধা বল্লভের পূন্য যাত্রা ।গৃহকর্তা ও বঙ্কিমচন্দ্রের পিতা রায় বাহাদুর যাদব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে রথ চলতে শুরু করেছিল যথা সময়ে পঞ্জিকা মতেই।আর তখনই খবর এলো বঙ্কিম চন্দ্র সেই রথ টানা বন্ধ করতে বলেছেন।বঙ্কিমচন্দ্র তখন বারাসাত মহকুমার ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্টেট ।ম্যাজিস্টেট ছেলের আদেশে পিতা যাদব চন্দ্র রথের টান বন্ধ করলেন।খোঁজ নিয়ে দেখা গেল রথের নয়টি চাকার একটি চাকা  বেঁকে গিয়েছে।আরো দুটি বাঁকার উপক্রম ।

কাঁসর,ঘন্টা, ঢাঁক ও জগঝম্পের আওয়াজ এতো বেশি ছিল যে লোহার ঘরঘরানি কেউ শুনতে পেলেন না।অথচ সেজ ছেলে বঙ্কিম ঘরে বসেই তা টের পেয়েছেন।আর তারি নির্দেশে থেমে গেল চাটুজ্জে পরিবারের রথ।ম্যাজিস্টেট বলে তো কথা।থেমে গেল নাম সঙ্কীতন।আরো নানা তথ্য পাওয়া যায় লেখকের ভাইপো জোতিষ চন্দ্রের নানা লেখায়।

আর সেদিন থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র সেই বালিকা কে নিয়েই গল্পের প্লট শুরু করেন।তবে তখন কাঁঠাল পাড়ার রথের এতো নাম ডাক হয়নি।ফলে রাধারানী উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসাবে মাহেশের রথ ই ছিল তাঁর পছন্দের জায়গা ।বাকি টা তো ইতিহাস ।বাঙলা সাহিত্যের এক অনন্য প্রেম কাহিনী এই রাধারানী ।আর সেই গল্পের আঁতুড়ঘর টি হলো নৈহাটির কাঁঠাল পাড়ার চাটুজ্জে পরিবারের রথ।লেখার মাল মশলা সবটুকুই এখানকার।তবুও লেখক বেছে নেন উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসাবে হুগলীর শ্রীরামপুরের মাহেশকেই।কারন আজও ভারতবর্ষের রথের ইতিহাসে মাহেশের রথ সর্বজন খ্যাত।প্রাচীনতা ও ঐতিহ্যের দিক থেকে পুরীর জগন্নাথের পরেই মাহেশের স্হান ।আর বঙ্কিমচন্দ্র ও নিজেও গেছেন সেই রথের মেলায়।

মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ও রথের উৎসবের পিছনে নানা কিংবদন্তি আজও আছে।ফিরে যাই চতুর্দশ শতকে।ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু গিসলেন পুরীতে জগন্নাথ দর্শনে ।সেখানে তাঁর ইচ্ছে জাগে নিজ হাতে জগন্নাথের ভোগ রান্না করে তা নিবেদন করবেন জগন্নাথ দেবকে।কিন্তু পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পান্ডারা তা মানতে নারাজ।কিন্তু ধ্রুবানন্দ ও অনড়।ভোগ রান্না না করে তিনি ফিরবেন না।কিন্তু এদিকে পান্ডারাও এক কাট্টা ।ভোগ তাঁরা রাঁধতে দেবেন না।শেষে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ধ্রুবানন্দ অন্ন জল ত্যাগ করলেন।আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন ভোগ রান্না না করে তিনি ফিরবেন না।

ঠিক তিনদিনের মাথায় জগন্নাথ দেব স্বপ্নাদেশ দিলেন ধ্রুবানন্দ কে।বললেন তুমি ফিরে যাও।ভাগিরথী নদীর ধারে মাহেশ গ্রামে।আমি সেখানেই যাব।তোমার হাতে তৈরি ভোগ খেতে।আর যথা সময়ে নিম কাঠ পাঠিয়ে দেব।এই কাঠ দিয়েই তৈরি করবে বলরাম, সুভদ্রা আর আমার মূর্তি ।

ফিরে এলেন ধ্রুবানন্দ ।ভাগীরথীর তীরে শুরু করলেন সাধনা।আর ঠিক কিছুদিন বাদে বর্ষার একদিনে মাহেশের ঘাটে ভেসে এলো দারু বৃক্ষের কান্ড।যা থেকে তৈরি হলো মাহেশের জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি যুগল।আর এই কিংবদন্তি তখন মানুষের মুখে মুখে।আর এই সব নানা কারনেই বঙ্কিমচন্দ্র কাঁঠাল পাড়া ছেড়ে মাহেশের রথ কেই তার গল্পের প্রেক্ষাপট নির্বাচন করেছিলেন বলেই জানা যায় ।

কার পদধূলি পড়েনি পূন্য তীর্থ এই মাহেশের বুকে।লেখক তো নিজেই গেছেন বেশ কয়েকবার ।এছাড়া শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা দেবী ও এই তীর্থ ক্ষেত্রে পা রেখেছেন।নাট্যকার গিরীশ চন্দ্র ঘোষ সহ নানা জ্ঞানী গুনী মানুষের আগমন হয়েছে এই জগন্নাথ ধামে।

নবদ্বীপ ধাম ছেড়ে শ্রীচৈতন্য নীলাচলে যাবার পথে এই মাহেশে আসেন জগন্নাথ দেবের দর্শন পেতে।মাহেশ কে আখ্যা দেন নব নীলাচল নামেই।তারপর পুরীর সমুদ্রের জলে তার ঝাঁপ দেওয়া নিয়ে নানা গল্প গাঁথা তো আছেই।

বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনের নানা উপন্যাসের নানা প্রেক্ষাপটের সন্ধান আমরা আগেই পেয়েছি।কিন্তু তাঁর রাধারানী উপন্যাসের এই নায়িকা কিন্তু মাহেশের আশপাশের কোন গ্রামের বালিকা নয়।বরং নৈহাটির কাঁঠাল পাড়ার আশে পাশের কোন গ্রাম থেকে এসে তিনি হারিয়ে ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র দের পারিবারিক রথের মেলাতেই।আর সেই কাহিনীর সূত্র ধরেই সাহিত্য সম্রাটের অমর প্রেম কাহিনী এই রাধারানী ।

রথের মেলায় হারিয়ে যাওয়া কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।প্রতি বছর এই ভিড়ে কোন না কোন মেয়ে হারায় রথের মেলাতে।তবে রাধারানির হারিয়ে যাওয়া কে বঙ্কিমচন্দ্র অমর করে তোলেন তাঁর এই প্রেম কাহিনী উপন্যাসের মাধ্যমেই ।

বঙ্কিম সমালোচক ও তাঁর আত্মীয় স্বজনেরা অনেকেই জানেন কাঁঠাল পাড়ার এই রথে হারিয়ে যাওয়া বালিকা টির কথা।আর সেই বালিকা ক মাস বাদে লেখকের কলমে রাধারানী হয়ে বঙ্গ দর্শনের পাতায়।

ভাগ্যি সেদিন রথের চাকা ভেঙেছিল।আর হারিয়ে গিসলো সেই বালিকা টি।তাই তো আজ আমরা রাধারানী কে পাই বঙ্কিম সাহিত্যের প্রেমের দলিল হিসাবে।প্রেক্ষাপট সে যেখানেই হোক না কেন।কাঁঠাল পাড়া বা মাহেশে কি আর এসে যায় ।

অমর স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র আজও বেঁচে সকলের হ্রদয়ে ।আর রাধারানী তো আইকন।

এবার কোভিড পরিস্থিতিতে সব জায়গায় রথের দড়ি তে টান পড়ুক আর না পড়ুক তাতে কিছু যায় আসে না।সোসাল ডিসটেন্ট কে মান্যতা দিতে গিয়ে ভিড় যে হবে না তাতো সত্যি ।

তাই রাধারানীরাও আর হারাবে না।আমরাও পাবো না আজকের সাহিত্যিক দের কাছে রথের মেলায় হারিয়ে যাওয়ার কোন প্রেম কাহিনী ।রাধারানী থাকবে যেমন আছে আজও ।আজ থেকে শত বর্ষ পরেও রাধারানী ম্লান হবে না।

কাঁঠাল পাড়ার না মাহেশের এ প্রশ্ন অবান্তর ।রাধারানী আছে পাঠকের হিদি ভরেই।এ যে প্রেমের মহাভারত ।

তরুণ চট্টোপাধ্যায় ।