Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#আমাদের_কাহিনীটা#মধুপর্ণা_ব্যানার্জী
Madhuparna Banerjee 
অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার দিনগুলো ছিল ভীষণ কঠিন, সবসময়ই মনে হতো ফিরতে পারবোনা আমি। শুধু একটা মুখ,যার দিকে তাকালেই মনে হতো ।নাহ্ হারলে চলবে না।
এই পর্যন্ত লিখে ল্যাপটপটা বন্ধ …

 


#আমাদের_কাহিনীটা

#মধুপর্ণা_ব্যানার্জী


Madhuparna Banerjee 


অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার দিনগুলো ছিল ভীষণ কঠিন, সবসময়ই মনে হতো ফিরতে পারবোনা আমি। শুধু একটা মুখ,যার দিকে তাকালেই মনে হতো ।নাহ্ হারলে চলবে না।


এই পর্যন্ত লিখে ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিলাম, এক একটা দিন এরকম হয় জানেন,যখন মনটা শুধু ভাবতে চায়... আপনারা ভাবছেন আমি কে, চলুন পরিচয়টা হয়ে যাক।


আমি রুদ্র সান্যাল,বয়স সাতাশ। রসায়ন নিয়ে স্নাতক হয়েছিলাম এককালে। তবে বিখ্যাত চিকিৎসকের ছেলে হয়ে জন্মেছিলাম বলে হাতে ওড়ানোর মতো প্রচুর টাকা-পয়সা ছিল।মা ছিলেন বড়ো অভিনেত্রী। বাবা-মায়ের ব্যস্ত‌ জীবনে আমার জন্য সময় বিশেষ ছিল না। ঠাকুমা যতোদিন ছিলেন আদর-যত্নের অভাব বোধ করিনি। কিন্তু বারো ক্লাসের শেষের দিকে তিনিও চলে গেলেন।


কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়েছিল, মনে হয়েছিল বিশ্ব সংসারে আমি একদম একা। রেজাল্ট ভালো হয়নি, বাবার পরিচিতির জন্য একটা নামী কলেজে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হলাম। সেখানে নিজের একাকিত্ব দূর করতে নেশার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম।


তারপর ... বুঝতেই পারছেন ,ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিলাম। বাড়িতে খেয়াল রাখার কেউই ছিল না। বাবা-মায়ের সম্পর্কটাও তখন খুব বেশি জটিল হয়ে গিয়েছিল। ওনাদের দুজনেরই পরকীয়া সম্পর্কের কথা কানে আসতে শুরু হয়েছিল। আমার চারপাশে চাপ চাপ অন্ধকার দেখতে পেতাম।হয়তো এভাবেই সব শেষ হয়ে যেত, কিন্তু কিছু পুরোনো ঋণ বোধহয় বাকি ছিল।


স্কুলের পুরোনো বন্ধুরা একদিন দল বেঁধে বাড়িতে এসে হাজির হয়, আমাকে দেখে ওরা বোধহয় আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিল। নেশার কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য ওদের সেই প্রচেষ্টায়, আমি কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।


যদিও আমার পারিপার্শ্বিক অবস্থার কিছুই পরিবর্তন হয়নি। বাবা মায়ের কাছে ভালোবাসা বা সহানুভূতির প্রত্যাশা ছিলো না কোনোদিনই। তাই ওনাদের আলাদা হয়ে যাওয়াটাও কোনো বিশেষ অনুভূতি দিয়ে যায়নি।


তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম সেরকম পড়াশোনা না করেও পাশ করে গিয়ে। বিবাহবিচ্ছেদের উপহার স্বরূপ একটা বড়ো ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু একাকীত্বের সাথে আবার সেই মনখারাপিয়া অনুভূতিটা ফিরে এসেছিল।


কিভাবে জানি না নেশার জগতটা আবারও টানতে শুরু করেছিল। একদিন বর্ষার রাতে নেশাগ্রস্ত হয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম ...জ্ঞান ফিরলে একটা হসপিটালে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম।


সেখানেই দেখেছিলাম তাকে,কি অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়েছিল তার চোখের দিকে তাকিয়ে, দিনের পর দিন রোগীদের সেবা করে চলেছে, আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম ,সে মিষ্টি করে হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। কিছু মনে না থাকলেও নেশার কুফলটা তো আর শরীর ছেড়ে যায়নি। মাঝে মাঝেই ঝাঁকুনি দিয়ে সে নিজের অভ্যাসে ফিরতে চাইতো।সে এক অসহ্য যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতা। মনে হতো গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করতে চাইছে আমাকে, শুধু ওই চোখের দৃষ্টি আমাকে আবারও ফিরে আসার আলো দেখাতো। 


তখন আমার কোনো বোধ, কোনো স্মৃতি নেই। নিজের কথা কিছুই মনে পড়তো না। ভুলে গিয়েছিলাম সবকিছু। জানিনা কতোদিন এই অবস্থায় ছিলাম। ধীরে ধীরে খানিকটা সুস্থ হবার পর জেনেছিলাম, আমাকে নদীর পাড়ে পাওয়া গিয়েছিল, মাথায় এবং হাতেপায়ে গভীর ক্ষত ছিল।


খানিকটা সুস্থ হবার পর মনে হতে লাগল, আমি কে,কোথা থেকে এলাম। নিজের পরিচয় পাওয়ার জন্য কেমন যেন অদ্ভুত একটা ছটফটানি শুরু হয়েছিল। ওখানে সবাই আমাকে রুদ্রবাবু বলে সম্বোধন করতো।


তখন আমি অনেকটাই সুস্থ,তাই চারপাশে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলাম। বিহারের এক গ্রামে এই হাসপাতাল,ডাক্তার তিওয়ারি খুব ভালোমানুষ ছিলেন। তিনি গরীবদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা করতেন। ওখানকার মানুষদের দেখে বুঝতে পারতাম আমি ঠিক ওদের মত নয়।


একদিন একটি বাঙালি পরিবার সেখানে চিকিৎসা করাতে আসার পর। তাদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম আমি বাঙালি, কিন্তু আমার পরিচয় তখনও অজ্ঞাত।


ততদিনে অহল্যার সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ বন্ধুর মত হয়ে গিয়েছিল। অহল্যা ওই হাসপাতালে সেবিকার কাজ করত,ওর নিষ্ঠা দেখে আমার অবাক লাগতো।কি নিঃস্বার্থ সেবা দিয়ে সবাইকে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা। আমি নিজেও তো ওর সেবায় সুস্থ হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু আমার মনে ওর প্রতি যে শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছিল সেটা বলার সাহস হয়নি। কি করেই বা বলতাম।যার নিজের কোনো পরিচয় জানা নেই…..


একদিন ডাক্তারবাবুকে নিজের মনের কথা বলেই ফেললাম...


“ আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আমি আমার নিজের অতীতের কিছুই মনে করতে পারছি না কেন। আমার শরীরের সব অসুখ সেরে গেছে কিন্তু মনের মধ্যে একটা অশান্তি রয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাবো না তো।“


ডাক্তারবাবু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে, তারপর মুচকি হেসে বললেন...


“ রুদ্রবাবু, আমার কি মনে হয় জানেন। অতীতের পাতায় অনেক সময় এমন কিছু থাকে,যা হয়তো ভুলে গেলেই শান্তি পাওয়া যায়। তবে মানুষ তো শান্তি চায়না,তাই সবসময় অশান্তির পিছনে ছুটে বেড়ায়। যাইহোক আপনি যখন ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় এখানে আসেন, আপনার পোশাকের সাথে একটা মানিব্যাগ ছিল তাতে পয়সা না থাকলেও দুচাকার গাড়ীর একটি লাইসেন্স ছিল।যাতে নাম ছিল রুদ্র সান্যাল।“


আমি বললাম


“তাহলে আমি বাঙালি সেটা সত্যি। কিন্তু আর কিছু জানা যায়নি।“


ডাক্তারবাবু বললেন...


“ আপনি উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে এটা বুঝতে পেরেছিলাম। কলকাতায় বাড়ি, নেশায় ডুবে থাকতেন,যেটা পয়সা না থাকলে সম্ভব নয়। কিন্তু এখানে কিভাবে এলেন সেটাই রহস্য। “


 আমি নেশায় আসক্ত ছিলাম, কথাটা শুনে ভীষণ খারাপ লাগে। নিজেকে জানার জন্য আগ্রহটা তখন কেমন যেন কমে যায়।


ডাক্তারবাবু আশ্বাস দিয়ে বলেন,


“ আমি বুঝতে পারছি, নিজের পরিচয় প্রত্যেকের জানার ইচ্ছা থাকে।আর সেটাই তো স্বাভাবিক। আমি আপনার জন্য কিছু ওষুধ আনতে দিয়েছি। অহল্যা কে বলেছি রোজ ব্রাহ্মিশাক দিয়ে  ভাত দিতে।সময় লাগবে, কিন্তু আপনার স্মৃতি ফিরে আসবে এটাই আমার বিশ্বাস।“


আমার মনে তখন একটা শঙ্কা দেখা দিয়েছিল, আমি সত্যিই কি কোনো ভালো মানুষ, নাকি কোনো খারাপ লোক।


অহল্যাকে নিজের মনের কথা বলতে,ও তো হেসে উঠে বলে...


“ কি যে বলো তুমি, তোমার সাথে আমার পরিচয় কয়েক মাস হয়ে গেছে। তুমি যদি খারাপ লোক হতে তাহলে কি আমি বুঝতে পারতাম না। মেয়েরা এসব ভালো বোঝে, তোমার নেশা করার পিছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। এতো ঘাবড়ে গেলে নিজের পরিচয় খুঁজে পাবে কিকরে।“


অহল্যাকে হাসতে দেখে আমার মনের সব দ্বন্দ্ব দূর হয়ে যেত। মেয়েটা যেন যাদু জানে,ওর উচ্ছল প্রাণবন্ত হাসি আমার মনে আবারও উৎসাহ ফিরিয়ে দিয়েছিল। অহল্যা ছিল এক ঝর্ণাধারার মতো, যে  শুষ্ক পাহাড়ের বুকেও সবুজের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম।


আমার মনের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে কিছুদিন পর কলকাতায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম, তখন আমার আবছা স্মৃতি ফিরে এসেছিল। ডাক্তারবাবুর চেনাজানা একজনের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক ভীষণ ভালো মানুষ, তিনিই থানায় যোগাযোগ করে আমার পরিচয় সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।প্রায় দেড় মাস পর আমার নিজের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছিল।


আমার বাবার সাথে দেখা করতে, তিনি যে খুব খুশি হয়েছিলেন বলে মনে হলো না। বোধহয় আমার বেঁচে থাকার খবরে বেশ অবাকই হয়েছিলেন।


ওনাকে দেখার পর আমার অতীতের আরও খানিকটা স্মৃতি ফিরে এসেছিল, যদিও সেই স্মৃতি আমাকে কষ্ট ছাড়া তেমন কিছুই দিতে পারেনি। মায়ের সাথেও দেখা হয়, বুঝতে পেরেছিলাম আমাকে ছাড়া ওনাদের কোনো অসুবিধা হয়নি, আমি ফিরে আসায়  কোনো খুশিও হয়নি। বুঝতে পেরেছিলাম নেশা করার পিছনে এটা কিছু কম কারণ নয়।


বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে, নিজের পরিচয় পেয়ে, ওনাদের আশ্বস্ত করেছিলাম , আমার কিছুই চাইনা। আসলে ওনাদের সাথে কোনো সম্পর্কই রাখার ইচ্ছা ছিলনা।তাই সব সমস্যার সমাধান করে ফিরে এসেছিলাম ডাক্তারবাবুর কাছে। সেখানে আমার জন্য আরও কিছু বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।


ফিরে এসেছিলাম অহল্যার কাছে, আমার মনটা একটা আশ্রয় খুঁজছিল। কিন্তু সেখানে পৌঁছে জানতে পারি অহল্যাকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ধরে নিয়ে গিয়েছিল। অহল্যা যে বিবাহিত ছিল, সেটাও তো জানতাম না!


ডাক্তারবাবু জানিয়েছিলেন...


“রুদ্রবাবু, অহল্যার একটা খুব কষ্টের অতীত আছে। বাপ-মা মরা মেয়েটাকে পনের বছর বয়সে, একটা আধবুড়ো লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় ওর মামা। লোকটার দ্বিতীয় বিয়ে, আগের বৌ বাচ্চারা খুব অত্যাচার করতো। মেয়েটা মুখবুজে সহ্য করতো, কিন্তু একদিন ওর ঘরে অন্যলোক ঢুকিয়ে দিয়ে বদনাম দিয়ে তাড়িয়ে দেয়।মেয়েটা আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। কিন্তু আমার চোখে পড়ে গেল,তাই আমি ওকে এখানে নিয়ে এলাম,নাম দিলাম অহল্যা।“


আমি একমনে সবটা শুনে, জিজ্ঞাসা করেছিলাম...


“ অহল্যা তাহলে ওর আসল নাম নয়, কিন্তু ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন তো ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, তাহলে ধরে নিয়ে যাবে কেন।ওর কোনো বিপদ হবে না তো?”


ডাক্তারবাবু বলেছিলেন...


“ওর আসল নাম ছিল লছমি , আমিই ওকে অহল্যা বলতাম। ভেবেছিলাম একদিন কোনো রামচন্দ্র এসে ওকে ওর অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দেবে। কিন্তু মানুষ যা ভাবে তা কি আর হয়।ওর শ্বশুরবাড়ির কেউ এখানে চিকিৎসা করাতে এসে ওকে চিনতে পারে। তারপর দলবল নিয়ে এসে খুব হাঙ্গামা করে ধরে নিয়ে যায়। আমি চেষ্টা করেছিলাম, পুলিশ সেভাবে সাহায্য করলো না।“


আমি বলেছিলাম...


“ আমার কিন্তু ভীষণ চিন্তা হচ্ছে, কোনো উপায়ে যদি অহল্যার কাছে পৌঁছাতে পারতাম।“


ডাক্তারবাবু আমাকে দেখে আমার মনের কথা কিছুটা হলেও আন্দাজ করেছিলেন। উনি  ওদের গ্রামের ঠিকানা দিলেন, যদিও সেখানে বিপদের সম্মুখীন হতে হবে, সেটা জানিয়ে সাবধান থাকতে বললেন।


পরদিন ভোরে বেরিয়ে পড়েছিলাম, পথে একভাঁড় চা আর দুটো বিস্কুট খেয়েছিলাম। ওদের গ্রামে তখন পৌঁছলাম তখন সূর্য মধ্যগগনে।


 নিজেকে আড়াল করতে ক্ষেতের পাশদিয়ে জঙ্গলে গিয়ে লুকিয়ে রইলাম, আমার কাছে একটা টর্চ, একটা ছুরি আর সামান্য কিছু টাকা ছিল। জঙ্গলটা খুব ঘন নয়,কপাল ভালো দু-একটি ফলের গাছ চোখে পড়ে গেল। পেটের জ্বালা শান্ত করে, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হতো।


সন্ধ্যা নামার পর গ্রামে ঢুকেছিলাম,অজ পাড়াগাঁয়ে বৈদ্যুতিক লাইন এসেছিল কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়নি। বেশ অন্ধকার, একটা গা ছমছমে ভাব ছিল।


একটা বটগাছের নিচে বেশকিছু লোক দাঁড়িয়ে জটলা করছিল। আমি যথাসম্ভব নিজেকে লুকিয়ে কথাবার্তা শুনছিলাম। যা শুনেছিলাম তাতে তো আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়। ওদের গাঁয়ের বহুবেটিরা যদি কুপথে চলে যায়,ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বেলাগাম হয়ে যায়, তাহলে গাঁয়ের সর্বনাশ হয়ে যাবে। সেই জন্যই লছমিকে উচিত শিক্ষা দিতে , ওকে গাঁয়ের শেষপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে গাছে বেঁধে আগুন দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে শাস্তি দেওয়া হবে, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।


আমি শিউরে উঠেছিলাম,অহল্যার জীবনে কঠিন সংকট ঘনিয়ে এসেছিল । কিন্তু আমি যেভাবেই হোক ওকে রক্ষা করতে চাইছিলাম। হঠাৎ করেই ঘাড়ের ওপর কারোর নিঃশ্বাস টের পেয়েছিলাম। চেঁচিয়ে ওঠার আগেই একটা হাত আমার মুখটা চেপে ধরে চাপাস্বরে বলেছিল...


“তুই কে, এখানে কি করছিস?”


উপায় নেই দেখে সত্যি কথা বলেছিলাম,সে আবার বলেছিল..


“বাবু তুই লছমিকে খুঁজতে এসেছিস, আমার তোকেই দরকার, তুই আমার সাথে চল, আমি ওর ‘মু-বোলা’ ভাই আছি। আমি চাইনা ওকে এভাবে মেরে ফেলা হোক। কিন্তু আমি যদি বাঁচাতে তাই তাহলে গাঁয়ের লোক আমার বাড়ির লোকজনকে মেরে ফেলবে।“


আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওর থেকে  ভয়ের কোনো কারণ নেই কিন্তু তখন কথা বলার সময় নয়।তাই চুপচাপ সম্মতি জানিয়েছিলাম।


ও আমাকে একটা ঘরের কাছে নিয়ে এসে বলেছিল,


“শোন বাবু, লছমি ওখানে বন্দী আছে। কিন্তু ঘরের বাইরে দুজন পাহারা দিচ্ছে, তাই লছমির কাছে যাওয়া সহজ হবে না। ওই লোকগুলোর খাবারে আমি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছি। তুই না এলেও আমি ওকে পালানোর ব্যবস্থা করে দিতাম। কিছুক্ষণ পরেই ওদের ঘুম আসবে।  তুই লছমিকে নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাবি। সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমি পথের দিকে নজর রাখবো, বিপদ বুঝলে ইশারা করে দেবো।“


ছেলেটির কথামত কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকদুটো ঘুমিয়ে পড়েছিল। তখন ছেলেটি ওদের একজনের পকেট থেকে চাবি নিয়ে ঘরের দরজা খুলে দিতে, আমি ঘরে ঢুকে দেখেছিলাম,অহল্যা নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে।


ছেলেটি তো বাইরে নজর রাখছিল, আমি কোনোরকমে অহল্যাকে তুলে দাঁড় করিয়ে বলেছিলাম...


“ আমি এসেছি তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য, তুমি আমার কাঁধে ভর দিয়ে যেতে পারবে তো? “


অহল্যা আমার কথায় নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, আমি তো ওর মনোবল দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম !


সে বলল...


“ তোমার সাথে ছুটতেও পারবো, অনাহারে থাকার অভ্যাস আমার ছোটবেলা থেকে।এসব আমাকে কাবু করতে পারে না। মুন্নাভাইয়া তোমাকে এখানে পৌঁছে দিয়েছে বুঝতে পারছি। এখন আর কথা না বলে চলো তাড়াতাড়ি।“


মেয়েটার মানসিক শক্তি ছিল অসীম, আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়েছিলাম ।মুন্নাভাইয়া একটা সাইকেল দিয়েছিল, সারাদিনের ক্লান্তিকে ঝেড়ে ফেলে সাইকেলে এগিয়ে চলেছিলাম...


গ্রামের কাঁচা রাস্তায় রাতের অন্ধকারে সাইকেল চালাতে প্রাণ বেরিয়ে যাবার উপক্রম, কিন্তু মৃত্যুভয় মানুষকে দিয়ে অনেক কঠিন কাজ করিয়ে নেয়। তাই আমিও  সেই অসাধ্যসাধন করে ফেলেছিলাম।


ভোরের আলো ফোটার আগেই অনেকটা পথ পেরিয়ে স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিলাম, ঠিক করেছিলাম প্রথমেই যে ট্রেন আসবে তাতেই চড়ে বসবো, কোনো পিছুটান না রেখে, ভবিষ্যতে কি হবে সেই ভাবনাটা পিছনে ফেলে রেখে ট্রেনে চড়তে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বিধি বাম...


 গ্রামের প্রায় জনা বিশেক লোক আমাদের ঘিরে ফেলেছিল। ওদের সাথে লড়াই করার মতো অস্ত্র বা শারীরিক সামর্থ্য আমাদের ছিল না। আমার হাতে একটা ছুরি ছিল। অহল্যা সেই ছুরিটা নিজের হাতে নিয়ে। সবাইকে বলেছিল...


“তোমরা সবাই আমার গাঁয়ের লোক, আমার সাথে তোমাদের শত্রুতা ।এই মানুষটির সাথে তো কিছু নয়, ওকে তোমরা যেতে দাও। আমি কথা দিচ্ছি আমি তোমাদের দেওয়া শাস্তি মাথা পেতে নেব। উনি শহরের মানুষ ওনার গায়ে হাত দিলে তোমাদেরও বিপদ হতে পারে।“


অহল্যার কথা শুনে ওরা নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে আমাকে প্রায় জোর করেই ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে, দুজন মিলে ধরে রেখেছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে মুক্ত করতে পারছিলাম না।


ট্রেনটা চলতে শুরু করে দেয়, ততক্ষণে ওরা আমাকে বেঁধে, মুখটাও বন্ধ করে ট্রেনেই ফেলে রেখে নেমে যায়।  আমি অসহায় ভাবে দেখছিলাম ওদের। অহল্যার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম ওর দৃঢ়প্রত্যয়ের হাসি... ট্রেনটা গতি বাড়িয়ে দিতেই ও মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল।


ছুরিটা ছোট হলেও ধারালো ছিল, জানতাম অহল্যা নিজেকে ওদের হাতে তুলে দেবে না।সে নিজের জীবন দিয়ে আমাকে রক্ষা করেছিল।


আমিও সেদিন জীবনের মূল্য বুঝতে পেরেছিলাম। ট্রেনের লোকজনের সহায়তায় বন্ধনমুক্ত হয়েছিলাম। পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ করা হয়নি। অহল্যাকে তো ফিরে পেতাম না।


শহরে ফিরতে পারিনি,ডাক্তারবাবুর কাছেও নয়। আমার এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে দেওঘরে ওদের জানাশোনা একটি আশ্রমে গিয়ে সেবাকার্য করতে থাকি।


ঘুমের মধ্যে অহল্যা রোজ আসে দেখা করতে।ওই বলেছিল জানেন একটা গল্প লিখতে... তাই একটা পুরনো ল্যাপটপ জোগাড় করে, লিখতে শুরু করেছি আমাদের কাহিনীটা‌।


#সমাপ্ত