Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

বর্ষায় পুরুলিয়া ভ্রমণকলমেঃ- তপন কুমার রায়তারিখঃ- ১৯/০৮/২১
ঘরের মধ্যে বন্দী থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠছিলাম।শুধু বন্দী থাকা তো নয়, সঙ্গে ক্রমবর্ধমান মানসিক  চাপ। আজ খবর আসে ওই পরিচিত লোকটা চলে গেলো। কাল খবর আসে আরেক জনের। মনের মধ্যে কে…

 


বর্ষায় পুরুলিয়া ভ্রমণ

কলমেঃ- তপন কুমার রায়

তারিখঃ- ১৯/০৮/২১


ঘরের মধ্যে বন্দী থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠছিলাম।শুধু বন্দী থাকা তো নয়, সঙ্গে ক্রমবর্ধমান মানসিক  চাপ। আজ খবর আসে ওই পরিচিত লোকটা চলে গেলো। কাল খবর আসে আরেক জনের। মনের মধ্যে কেমন একটা ভয় চেপে বসছিলো।সব মিডিয়ার একযোগে প্রচার ঘরে থাকুন।একটা ফোন করলেও দু মিনিট লেকচার শুনতে হয় এটা করুন, ওটা করুন। এসবের মধ্যে যেন জীবন অতিষ্ঠ  হয়ে উঠছিলো। তারওপর শুরু হল দুটো ভ্যাকসিন কমপ্লিট না হলে কোন স্টেট ঢুকতে দেবে না। কোন হোটেল থাকতে দেবে না।

          তাই দু ডোজ ভ্যাকসিন কমপ্লিট হতেই যথাসম্ভব মেজারস নিয়ে গাড়ীতে বেরিয়ে পড়লাম কাছাকাছি পুরুলিয়া, অযোধ্যাপাহাড়। শুভানুধ্যায়ী দের মান রাখতে বেশীদূর নয়, কাছেই ঘুরতে যাওয়া। 

             সকালবেলা আমি আর আমার স্ত্রী  এবং এক বন্ধু ও তার স্ত্রী  মিলে বেরিয়ে পড়লাম গাড়ীতে।খাবার সঙ্গে নেওয়াই ছিলো, তাও শক্তিগড় এলে রাস্তার পাশের সারি সারি দোকান গুলো কেমন টানতে থাকে। গাড়ী থামিয়ে গরম সিঙ্গারা চা খেয়ে আবার গাড়ী ছাড়লাম। আবহাওয়া ফোরকাস্টে প্রবল বৃষ্টি  হওয়ার ঘোষনা ছিলোই।  বৃষ্টি না হলে আকাশ মেঘলা রয়ে গেছে। রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ  সবুজ ধানক্ষেত আর রাস্তার দুধারে বৃষ্টি ধোওয়া সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে চললাম।  এখন রাস্তাঘাট খুব  ভালো।  গলসি,পানাগড়,দূর্গাপূর,রানীগঞ্জ  সব ফ্লাইওভার দিয়ে চলে যাওয়ার ফলে চারঘন্টায় আসানসোল পেরিয়ে নিয়ামতপুর। নিয়ামতপুর থেকে  বাঁদিকে ট্রার্ন নিয়ে  রঘুনাথপুরের রাস্তা।রাস্তায় দামোদর, আর বরাকরকে নদীকে পার করে পুরুলিয়া জেলায় ঢুকলাম। নদীগুলোয় এখন বর্ষার বেশ জল। গাছপালা নুয়ে নুয়ে পরছে অন্য রকম একটা  বন্য সৌন্দর্য। ঢুকতে গিয়ে ডানদিকে ঘুরে পাঞ্চেত ড্যামে উঠে পড়লাম। বিস্তৃর্ণ জলাধার পাহাড়ের কোলে। ছবির মতো সাজানো। একদিকে বিশাল জলরাশি আর একদিকে  শীর্ণজলস্রোত আর জঙ্গলঘেরা  নীচু নদী খাত। পাশে ই গাছপালা দিয়ে সাজানো ডিভিসির বাংলো গুলো। নেমে ছবি তুলছিলাম পুলিশ এসে বলে গেলো ব্রীজ ক্রশ করবেন না। ওপারটা ঝাড়খন্ড ওরা ওখানে টেস্ট করছে। ভ্যাক্সিন নেওয়ার  সার্টিফিকেট  আছে সঙ্গে তাও ও সাহস করলাম না। ফিরে এসে  গড় পঞ্চকোট ঢুকলাম। একসময় এখানে প্রাচীর ঘেরা রাজপ্রাসাদ, মন্দির,  আস্তাবল সব ছিলো। বহিশত্রু  আর কালের আক্রমণে সব ধুলিস্যাত এখন। কিছু কিছু ধ্বংসাবশেষ গভীর জঙ্গলে ঢাকা পড়ে আছে। দুটো মন্দির  সংস্কার হয়ে তার প্রাচীনত্ব হারিয়েছে।  পাশে টুরিজমের বাংলো খুব সুন্দর। এছাড়াও বেশগভীর জঙ্গলের  মধ্যে মধ্যে সুন্দর  সব রিসর্ট, আর রাস্তাগুলো দুপাশ থেকে নুয়ে পড়া গাছে ঢাকা। প্রকৃতির নির্জনতা এখানে ফিসফিসিয়ে  কত পুরোনো গল্প বলে যায়।

       ওখান থেকে বেরিয়ে জয়চন্ডী পাহাড় দেখতে গেলাম রঘুনাথপুর। ঘিঞ্জি জনপদটা পেরিয়েই উন্মুক্ত  বিস্তীর্ন  উষর প্রান্তর, আর তার পাশে হঠাৎ করে দেখা মেলে বিশাল বিশাল নেড়া পাথরে গড়া জয়চন্ডী পাহাড়। অদ্ভুত দর্শন,সমীহ নয় অপরূপ সৌন্দর্য  নিয়ে চোখে ধরা পড়ে জয়চন্ডী। ওপরে ওঠার সিঁড়ি  আছে। মনটা নেচে  ওঠে ওঠার জন্য, আমাদের বয়স্ক হাঁঠুর কথা ভেবে নিরস্ত হই। এই পাহাড়ের  ওপরে সত্যজিৎ রায়ের  ভূতের রাজা দিলো বরের স্যুটিং। এই পাহাড়ের ওপর থেকে গুপী- বাঘা হাতে তালি মেরে যেখানে খুশী যেতে পেরেছিল। আমাদের খিদে পেয়েছিলো। এখানটায় ইউথ হোস্টেল, পথ সাথী থাকা সত্ত্বেও  একটি রিসোর্টে খেয়ে নিলাম। তারপরে আজকের ডেস্টিনেশন বড়ন্তি। গাড়ী ঘুরিয়ে পাহাড়ের কোল বেয়ে রাস্তা ধরে পুরো বড়ন্তি লেক ঘুরে ওপাড়ে লেকের ধারে একটি রিসোর্টে বুকিং  ছিলো।সুন্দর জায়গাটা সামনেই অনন্ত জলরাশি তার ওপারে লাল সূর্য  অস্ত যাচ্ছে।  আকাশের মেঘে অপরূপ রঙের খেলা।  কি রঙ নেই সেখানে? শুধু চেয়ে থাকা। এদিকে পাশের নিবিড়  পলাশের বনে ছায়া ঘনিয়ে সন্ধ্যা নামছে ধীরে। ওয়েটার চিকেন পকোড়া আর চা দিয়ে গেল। কিন্তু লেকের ধারে বসে প্রকৃতির নিরাবরণ  রূপের দিকে চেয়ে চায়ে চুমুক দিতে ভুলে যাই।


        পরেরদিন সকালে পুরুলিয়া শহর ঘুরে  ট্যামনা মোড় হয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের হিলটপ। দলমা পাহাড়েরই রেঞ্জ।রাস্তায় গভীর জঙ্গল আর দিগন্ত বিস্তৃত নিশ্চুপ পাহাড়ের ধূসর সারি। দূরে  দেখা যায় গোরগাবুরুর শৃঙ্গ। দুপাশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ী  বাঁকে ভুলে যাই এ দার্জিলিং, না হিমাচলের  পথে আমরা। বরং এই বর্ষায় অযোধ্যা পাহাড় আরো সবুজ আরো মোহময়ী। সারি সারি শাল,সেগুন,মহুয়া,আর কেন্দু পাতার জঙ্গল।সেগুনের ডালে ডালে থোকা থোকা মিহি সবুজ ফুল। ঘনসবুজ ঘেরা পাহাড়ী পথে বোধহয় নিশির ডাক থাকে! এগিয়ে যেতে হয় এক খিদে ভোলানো মাদকতায়।

        আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে একবার এসেছিলাম এই অযোধ্যা পাহাড়ে। উঠেছিলাম নিহারীকা সরকারী গেস্ট হাউসেই। অনেক পাল্টে গেছে।দোকান বাজার, হোটেল রিসর্ট অনেক কিছু  হয়েছে।নীহারিকায় ও আট- নটা বিল্ডিং  হয়েছে। ভিতরটা অনেক গাছপালা দিয়ে সাজানো। বিশাল ফার্মে সব রকম সব্জির চাষ হচ্ছে। সেই সব্জিতেই অতিথি  সেবা। আমরা এসি ঘর নিয়েছিলাম বটে কিন্তু আবহাওয়ার কল্যানে তা চালাতে হয়নি।  নীচের দিকে অনেক নামী দামী রিসর্ট রয়েছে বটে সে গুলোতে থাকার সাধ হয়নি সাধ্যেও টান পড়তো।খেয়ে নিয়ে বেরলাম রাস্তার উল্টোদিকে মাঠটা তেমনি আছে। এই মাঠেই আগের বার এসে বসন্তে মুরগী লড়াই দেখেছিলাম। সেময় আদিবাসীদের  জঙ্গলে শিকার করার মরসুম ছিল।  সে কি উদ্দীপনা। শিকার করে আনলে আদিবাসী যুবক বিয়ে করতে পারবে।

         গাড়ী নিয়ে এগিয়ে যেতে ডান দিকে পড়লো মুরগুমা ড্যামের রাস্তা। এমনি রাস্তা এখানে খুবই  ভালো। তবে প্রথম দিকে একটা ছবির মতো আদিবাসী  গ্রাম পড়লেও ক্রমশ  জন মানব হীন গভীর জঙ্গলের পথে এগিয়ে চলেছি। যাচ্ছি তো যাচ্ছি,ঠিক  রাস্তায় না ভুল রাস্তায় তা বলার জন্য না কোন গাড়ী না মানুষের দেখা মেলে। অন্ধের মত গাড়ী এগোচ্ছে।  অনেকক্ষন পরে একটা মোটর বাইক আসতে দেখে হাত দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে  মুরুগুমার কথা জানতে চাইলাম। আরোহী  বলে --"ইয়াই রাস্তা বটেক।অল্পই দূর। কিন্তু  যাইবেন কি করি! হাতি বেরোনচ্ছো তো।"

--- হাতি?  কোথায়? দেখলে রাস্তায়?

---- আমি এখুন দেখি নাই।তবে যান বটে-- এই বলে চলে গেলো।

এতদূর চলে এসেছি,  ফিরবো না। দেখেই যাবো। এগুতে এগুতে জঙ্গল ফাঁকা  হয়ে এলো  সামনেই দিগন্ত ছোঁওয়া লেক- মুরুগুমা। সুন্দর। মাটির বাঁধানো  পাড়( বাঁধ)। তা ধরেই অনেকদূর এগিয়ে নামলাম। আরো খানিক এগিয়ে গেলে গুপ্তযুগের এক প্রাচীন ভগ্নদশা  মন্দির  রয়েছে।তার প্রাচীনত্ব  সম্বন্ধে সংশয় নাই, তবে গুপ্ত যুগের কিনা পন্ডিতরাই বলতে পারবেন।কে বলে পুরুলিয়া  জলশূন্য- রুক্ষ! বাঁধের এপাশেই জনবসতি কিছু। মাছ ধরা বা চাষবাসই জীবিকা। ড্যামের উল্টোপারে বনবিতান রিসর্ট।  সন্ধ্যে হয়ে এলো আমদের সেই গভীর জঙ্গলটার মধ্যে দিয়ে ফিরতে হবে। তাই গাড়ীতে উঠে ফিরে এলাম সেই গভীর জঙ্গলের ভয় ভয় করা পথ ধরে।  হোটেলের একটু আগে একটা আদিবাসী বাড়ী সংলগ্ন দোকান থেকে বড় দেখে দেশী মোরগ কিনে আনলাম।  

           এদের রান্নাঘরটা বিশাল। সেখানে বিশাল বিশাল উনুনে কাঠের  জ্বালে মাটির হাঁড়িতে  রান্না।  সোলাঙ্কি নামে একজন রাঁধুনি  আছে।গল্প করে জানলাম অনেক পুরুষ আগে তার পূর্বপুরুষ রাজস্থান- গুজরাট থেকে এসেছিল বাংলায়। আজ আর এই টাইটেলটা ছাড়া কিছু অবশিষ্ট  নেই। খুব সুন্দর হাতের রান্না সোলাঙ্কীর। রাত্রি বেলা দেশী মুরগীর মাংস সহকারে দারুন খাওয়া হলো। 

         পরদিন সকালে উঠেই ময়ূরপাহাড় গিয়ে সূর্যোদয়  দেখা। ফিরে এসে পরোটা সব্জীর সাথে আমাদের নিয়ে যাওয়া মিষ্টি সহকারে জমিয়ে ব্রেকফাস্ট। তারপর বেরিয়ে পড়লাম বেড়াতে, হিলটপ থেকে বাঘমুন্ডির রাস্তায়। একটু গিয়েই রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে।আগে এ রাস্তা ছিল না বাঁদিকের রাস্তা ধরলাম।বৃষ্টিধোয়া ঘন সবুজ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া। অদ্ভুত এক সুন্দর অনুভুতি। পাহাড়ি পথে অল্প নেমেই সুবর্নরেখা নদীর ওপর আপারড্যাম ও লোয়ার ড্যাম। বিশাল জলরাশির বুকে সবুজ পাহাড়ের ছায়া।চেয়ে দেখতেই ভালো লাগে।ওখান থেকে আরো নেমে লোয়ার ডাম।একই রকম সুন্দর।বিশাল জলরাশি ধরা আছে।আরো খানিক এগিয়ে টুর্গা  ড্যাম পাহাড়-জঙ্গল  ঘেরা একই রকম বিশাল জলাধার। সবকটা তে হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্ট আছে। এখন বুঝতে পারি পুরুলিয়াতে জল আর বিদ্যুৎ তের অভাব নেই,তাই ইন্ডাসট্রিয়াল ডেস্টিনেশন হয়ে গেছে পুরিলিয়া। একটু দূরেই টুর্গা ফলস।জঙ্গলের মধ্যে একটু নেমে দেখতে হয়, বর্ষাকাল বলেই হয়ত বেশ জোরে জল পড়ছে।  


            ওদিকে  নামলেই এখন আাধাশহর বাঘমুন্ডি। আগের বার দেখেছিলাম আদিবাসী লোকেরা জঙ্গল থেকে লাক্ষা বা গালা  সংগ্রহ করে এনে বেচছে। এখন দোকানপাঠ অনেক।অনেক হোটেল  রিসর্ট। বাঁদিকে এগিয়ে গেলে পাখি পাহাড়।শাল সেগুনের জঙ্গলের মধ্যে খাড়াই নেড়া পাথরের পাহাড় উঠে গেছে। এখানে ছেলেমেয়েরা রকক্লাইম্বিং এর প্রথম পাঠ নিতে আসে। এখন বর্ষা কালে কেউ নেই। তাই জঙ্গল বেশ শুনশান। আর সেগুন গাছের মাথায় মাথায় বিশাল থোকা থোকা সবুজ ফুল এসেছে। সেই গন্ধে সারা পাহাড় ম ম করছে।  এর পর উল্টো দিকের পথ ধরে চড়িদা গ্রাম। এগ্রামের লোক মুখোশ বানায়। রাস্তার দুধারে শুধু মুখোশের দোকান। বেশীর ভাগ পুরুলিয়ার ছৌ নাচের মুখোশ, তবে দেবদেবী থেকে আদিবাসী  বা জন্তু জানোয়ারের মুখোশও বিক্রি  হচ্ছে। আরো খানিক এগিয়ে খয়রাবেরা ড্যাম। আশ্চর্য  নিশ্চুপ জঙ্গলের ডাক যেন এ ড্যামকে গা ছমছমে করে তোলে। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, তাই ফেরার পথ ধরলাম।পথে বামনি ফলস, কিন্তু বন্ধ আছে কোন কারনে তাই ঢুকতে পারলাম না। ফিরে মার্বেল লেক গেলাম। শুধু পাহাড় কেটে এক কালো জলের লেক বেশ ভয় ভয় করে। মাটি একেবারেই নেই চারিদিকে  শুধুই কালো পাথর। মার্বেলসাদা না হোক কালো পাথরের সুন্দর লেক। সেটা দেখে  দেশী মুর্গী  কিনে হোটেলে ফিরলাম। না ক্যাম্প ফায়ার হলো না। কিন্তু রাতে জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হলো। তারপর দিন সকালে ফেরার পথ ধরলাম, মানবাজার, দূর্গাপুর হয়ে দামোদর,গন্ধেশ্বরী,ও বরাকর নদী পেরিয়ে ফিরে এলাম। একটা       'ঘরের কাছের আরশি নগর ' সুন্দর বেড়িয়ে এলাম।