Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

গোলরক্ষক ইয়াসিন অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় ৩০/০৭/২০২১--------------আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগের কথা। ইউসুফ মিঞা তখন সাত ছেলেমেয়ের বাপ। আট নম্বর হবে হবে করছে। তখন সে তোতন মন্ডলের চায়ের দোকানে কাজ করে। কতরকম লোকজন আসে রোজ চা খেতে। আর সন্ধ্…

 


গোলরক্ষক ইয়াসিন 

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় 

৩০/০৭/২০২১

--------------

আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগের কথা। ইউসুফ মিঞা তখন সাত ছেলেমেয়ের বাপ। আট নম্বর হবে হবে করছে। তখন সে তোতন মন্ডলের চায়ের দোকানে কাজ করে। কতরকম লোকজন আসে রোজ চা খেতে। আর সন্ধ্যেবেলায় আসে পাড়ার মাথারা। তাদের আড্ডায় কতরকম আলোচনা হয়। এইরকমই এক আড্ডার সময় তার কানে এসেছিল -- লেভ ইয়াসিন নামে এক বিখ্যাত গোলরক্ষক আছে যাকে গোল দেওয়া প্রায় অসম্ভব। ফুটবল খুব একটা না বুঝলেও ইয়াসিন নামটা বেশ পছন্দ হয়েছিল ইউসুফ মিঞার। তাই আট নম্বর যখন পৃথিবীর আলো দেখলো, ইউসুফ তার নাম রেখেছিল ইয়াসিন।

চরম দারিদ্র্যের মধ্যে আধপেটা খেয়ে ভাইবোনদের সঙ্গে মারামারি করতে করতে বড় হচ্ছিল ইয়াসিন। এই ঘরে পড়াশোনার প্রবেশ নিষেধ, কারণ ইউসুফের মতে তা হল বড়লোকের বিলাসিতা। বরং সেইসময়ে ছেলেমেয়েগুলো ছোটখাটো কাজ করলে ঘরে দু-পয়সা আসে। সবাই বাপের কথা মেনে কিংবা মারের ভয়ে সেইসব কাজে লেগে থাকলেও ইয়াসিন সেইসবের ধারে-কাছেও ঘেঁষতো না। পাশের মাঠে জুতো-জার্সি পরে বড়লোকের ছেলেরা ফুটবল খেলতে এলে ইয়াসিন হাঁ করে দেখতো। খেলতে খেলতে বল মাঠের বাইরে গেলেই ইয়াসিন দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসতো। রোজ খেলার সময় এক ঝামেলা -- কেউ গোলরক্ষক হবে না। গোল খাওয়ার থেকে গোল দেওয়ার গৌরব অনেক বেশি। তাই হঠাৎ একদিন ছেঁড়া হাফপ্যান্ট পরা খালি পায়ের ইয়াসিন এদের সঙ্গে গোলরক্ষক হয়ে খেলার সুযোগ পেলো।  

ঠিক সেইদিনই কি এক কারণে নেতাজী সংঘের ফুটবল কোচ পাঁচুদা মাঠের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ওদের খেলা দেখতে দাঁড়িয়ে পড়লো। প্রায় এক ঘণ্টার ওপর খেলা দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে পাঁচুদা দেখলো যে বুট-পরা হৃষ্টপুষ্ট ছেলেদের লাথি ধাক্কা খেয়েও একটা খালি পায়ের লম্বা রোগাটে ছেলে একটা বলও গোলে ঢুকতে দিচ্ছে না। অদ্ভুতভাবে চিলের মতো ছোঁ মেরে ছেলেটা বলটা গোলে ঢোকার আগেই ধরে নিচ্ছে। খেলা শেষ হলে পাঁচুদা ছেলেটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো --তোর নাম কী? ছেলেটা চোখে চোখ রেখে বললো -- ইয়াসিন। পাঁচুদার প্রশ্ন -- বাপের নাম কী? ছোট্ট উত্তর -- ইউসুফ মিঞা।

পরের দিন সকালে তোতন মন্ডলের চায়ের দোকানে পাঁচুদা হাজির হল। ইউসুফকে দেখে চেঁচিয়ে ডাকলো -- চাচা, একটু এদিকে এসো; ইয়াসিনকে নিয়ে কথা আছে। ইউসুফ আসতে আসতে বললো -- হারামজাদা আবার কী করেছে? ওকে আর সামলাতে পারছিনা বাবু। পাঁচুদা হেসে বললো -- তোমাকে আর সামলাতে হবে না, আমি ওকে সামলাবো। ওর খাওয়া-পরার দায়িত্ব আমার। ও শুধু মন দিয়ে ফুটবল খেলবে। প্রস্তাবটা অদ্ভুত হলেও খাওয়া-পরার সংস্থান হবে শুনে ইউসুফ সায় দিলো।

পরের দিন সকালে ইয়াসিন হাজির হল পাঁচুদার বাড়িতে। রীতিমতো জমিদার বাড়ির মত বড়লোক পাঁচুদারা। পাঁচুদা ওকে বললো -- আজ থেকে তুই বাড়ির ফাইফরমাশ খাটবি, এক ঘন্টা করে বৌদির কাছে পড়বি আর সকালে -বিকেলে আমার সঙ্গে ফুটবল খেলবি। পড়াশোনার ব্যাপারটা ইয়াসিনের পছন্দ না হলেও ফুটবলের নেশায় ও হ্যাঁ বলে দিলো।

তারপরের দশ বছরে ইয়াসিনের জগতটা  একদম বদলে গেল।  নিঃসন্তান পাঁচুদা আর বৌদি অপত্যস্নেহে ইয়াসিনকে বড় করে তুললো।  যদিও পড়াশোনাটা দশম শ্রেণীর বেশি এগোলো না।, কিন্তু ফুটবলে ইয়াসিন ছোট্ট মফঃস্বল শহরে আলোড়ন ফেলে দিলো।  সবাই জেনে গেল -- গোলরক্ষক ইয়াসিন থাকলে গোল দেওয়া অসম্ভব।  মুর্শিদাবাদ জেলা দলে সুযোগ পেয়ে সেই একই চমক দেখালো ইয়াসিন।   কিন্তু নাম করতে হলে কলকাতা যেতে হবে যেখানে পাঁচুদাকেও  লোকে চেনে না। অনেক চেষ্টা-চরিত্রের পর প্রথম ডিভিশনের একদম ছোট্ট একটা দলের তৃতীয় গোলরক্ষক হিসেবে সুযোগ পেল ইয়াসিন। পাঁচুদা বললো -- আমি মাঝে মাঝেই তোকে দেখতে যাবো।  হার মানবি না ইয়াসিন।  কলকাতা যেন জানতে পারে --ইয়াসিনকে গোল দেওয়া যায় না।

কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তব যে এক নয় -- তা কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলো ইয়াসিন। মফঃস্বলের ছেলেকে যে দলে জায়গা পেতে হলে খেলা ছাড়াও অন্য কিছুতে দক্ষ হতে হয়, অল্পশিক্ষিত ইয়াসিনের তা বোঝারও ক্ষমতা ছিল না। তাই দিনের পর দিন রিজার্ভ বেঞ্চে অতিরিক্ত গোলরক্ষক হয়ে কাটাতে হল ইয়াসিনকে। খেলাপাগল ইয়াসিন আস্তে আস্তে হতাশ হতে থাকলো।

সেদিন ছিল লিগ চ্যাম্পিয়ন মোহনবেঙ্গলের সঙ্গে তাদের খেলা। যথারীতি মুখ শুকনো করে ইয়াসিন রিজার্ভ বেঞ্চে বসেছিল। দ্বিতীয় গোলরক্ষক কোনো অজ্ঞাত কারণে অনুপস্থিত। প্রথমার্ধেই মোহনবেঙ্গল পাঁচ গোলে এগিয়ে গেল। বিরতিতে দলের প্রথম গোলরক্ষক হঠাৎ পেটে হাত দিয়ে বললো -- প্রচন্ড ব্যথা, আর খেলতে পারবে না। কোচ হঠাৎ ইয়াসিনকে এসে বললো -- এবার তোমাকে খেলতে হবে। অপ্রস্তুত ইয়াসিন ভালো করে কিছু বোঝার আগেই মাঠে নেমে পড়লো।

দ্বিতীয়ার্ধে সমস্ত মাঠ এক অদ্ভুত খেলা দেখলো।  পাঁচ গোল খাওয়া একটা ছোট দলের গোলরক্ষক একা লড়ে যাচ্ছে মোহনবেঙ্গলের বিরুদ্ধে। মোহনবেঙ্গলের একের পর এক আক্রমণ এসে আছড়ে পড়ছে ইয়াসিন নামের এক দেওয়ালে। সেই  দেওয়াল ভাঙার ক্ষমতা কারোর নেই।  রেফারির অলক্ষ্যে নাকে গুঁতো  খেয়ে নাক ফেটে রক্ত ঝরছিল ইয়াসিনের।  তাতেও দমে না সে।  খেলা প্রায় শেষের মুখে। মোহনবেঙ্গলের বিখ্যাত বিদেশি খেলোয়াড় চিমা নাসিরি  তীব্র গতিতে গোলের দিকে এগিয়ে আসছিলো ।  চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতায়  তার পায়ের ওপর থেকে বল তুলে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো  ইয়াসিন।  তারপরেই পায়ে  তীব্র এক যন্ত্রণা।  অজ্ঞান হতে হতেও ইয়াসিন দেখতে পেলো চিমা নাসিরিকে রেফারি লাল কার্ড দেখালো।

ছোট দলের তৃতীয় গোলরক্ষকের মালাইচাকি ভেঙে গেলে তার চিকিৎসার দায়িত্ব কেউ নেয় না। তাই পাঁচুদার যথাসাধ্য চেষ্টা সত্ত্বেও মাঠে ফেরা আর হল না ইয়াসিনের। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতো সে। শেষমেশ পাঁচুদাই কাকে ধরে ওকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম-এর রক্ষ্মীর চাকরি যোগাড় করে দিল কলকাতায়। 

সেদিন রাত প্রায় একটা।  আশেপাশের ফ্ল্যাটগুলোর আলো নিভে গেছে।  আজ ইয়াসিনের নাইট ডিউটি।  টুলে বসে ইয়াসিন উদাস মনে পুরোনো দিনের কথা ভাবছিল।  হঠাৎ একটা গাড়ী এসে থামলো।  নেমে এল চার-পাঁচ জন মুখোশ পরা অস্ত্রধারী মানুষ।  জোর করে এটিএম-এ ঢোকার চেষ্টা করতেই ইয়াসিন আটকালো।  কিছু বোঝার আগেই ইয়াসিনের পেটে  দু-তিনবার ঢুকে গেল ছুরির ফলা।  চিৎকার করে উঠলো ইয়াসিন।  দু একটা ফ্ল্যাটবাড়ির আলো জ্বলে উঠলো।  ইয়াসিনকে ধাক্কা মেরে ফেলে ওরা এটিএম মেশিনটা ভেঙে তুলে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করলো।  রক্তাক্ত অবস্থায় হঠাৎ ইয়াসিন কানে যেন শুনতে পেল পাঁচুদার গলা --  হার মানবি না ইয়াসিন।  চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতায় ও ঝাঁপিয়ে পড়লো একজনের টুঁটি  চেপে ধরে।  ধাক্কাধাক্কি,চেঁচামেচি  ইত্যাদিতে আরো কয়েকটা বাড়ির আলো জ্বলে উঠলো।  একজন লোক হঠাৎ ইয়াসিনের পেটে পিস্তল ঠেকিয়ে ট্রিগারটা টিপে দিলো।  পৃথিবীটা  অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আগে ইয়াসিন শুনতে পেল পুলিশের চিৎকার আর ডাকাতদের পালিয়ে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা।  অপরাজিত গোলরক্ষক ইয়াসিন তারপর অন্ধকারে ডুবে গেল।