Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#গানের_সুর  #জয়ন্ত #ছোটগল্প 
হংকংয়ে অফিসের কাজে আসার পরে কেটে গেছে সপ্তাহখানেক। থাকতে হবে আরও দু সপ্তাহ। তারপরে - ফিরে যাওয়া নিজের শহরে। অফিসে অডিটের কাজ সেরে প্রতিদিন সন্ধেতে আমি ঘুরতে বেরোই। সেভাবেই আজ ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি স্ট্…

 




#গানের_সুর  

#জয়ন্ত 

#ছোটগল্প 


হংকংয়ে অফিসের কাজে আসার পরে কেটে গেছে সপ্তাহখানেক। থাকতে হবে আরও দু সপ্তাহ। তারপরে - ফিরে যাওয়া নিজের শহরে। অফিসে অডিটের কাজ সেরে প্রতিদিন সন্ধেতে আমি ঘুরতে বেরোই। সেভাবেই আজ ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি স্ট্যানলি মিলিটারি সেমেটারি'তে। ১৮৪১ সালে তৈরি হওয়া এই সেমেটারি রয়েছে সেন্ট স্টেফান বিচে। ত্রিভুজাকৃতি এই সেমেটারিতে শুয়ে রয়েছে সাড়ে চারশো মানুষের মৃতদেহ, সাথে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস। এখানেই শুয়ে রয়েছে হংকংয়ের রাজ পরিবারের সদস্যরাও। সেমেটারির নিস্তব্ধতা, নির্জনতা, সামনের সমুদ্র থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা হাওয়া যেন বার বার পুরনো ইতিহাস এসে বলার চেষ্টা করে চলেছে। 


একটা গোল মত বসার জায়গা দেখে আমি বসে পড়ি। শহরের ব্যস্ততা, অফিসের নানান ফাইলের হিসেব মেলানোর দীর্ঘায়িত ক্লান্তি, গাড়ির আওয়াজ, সবকিছু দূরে সরে গেছে এখন। শুধুই এক অপার শান্তি আর মাঝে মাঝে সমুদ্র থেকে ভেসে আসা হু হু হাওয়া - কবরের পাথরগুলোর সাথে ধাক্কা খেয়ে শরীর স্পর্শ করে বেরিয়ে যাচ্ছে বাইরের দিকে। বা হয়ত এখানেই, এই মৃতদের সাথে ওদের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে ঘুরপাক খাচ্ছে ! 

সন্ধে নেমে এসেছে। কুয়াশার পুরু চাদর হঠাৎ করে ঘিরে ধরে আমাকে। ঠান্ডাও লাগতে শুরু করে আমার। ঠান্ডা যেন হঠাৎ করেই নেমে এসেছে অন্ধকারের হাত ধরে। গা ছমছম করে ওঠে আমার। এইজায়গাটায় রাস্তায় এমনিতেই লোকজন কম। কে আর মৃতদের মাঝে সময় কাটাতে চায় এভাবে ?  দিনের বেলায় তবুও একটুআধটু লোকজন দেখা যায়, কিন্তু এখন...


নাঃ ! এবার আমাকেও উঠতে হবে। ভয় পাই না আমি। কিন্তু কেন কে জানে আমার সারা শরীর শিউরে ওঠে হঠাৎ করে। উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে পেছন থেকে একটা গানের সুর ভেসে আসে। অচেনা অজানা একটা গান, অন্য কোনও ভাষাতে, তবুও যেন ভীষণ চেনা। বুঝতে পারলাম না আমি। ঘুরে তাকালাম। এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা আর একটা কোণায় বসে করছেন। দেখে বেশ অভিজাত বংশের মনে হল। চেহারার মধ্যে চাকচিক্য আছে, কিন্তু মুখটা অস্পষ্ট। কে জানে কখন এসে বসেছেন। তবুও এই জায়গাতে আর একজনকে দেখে ভাল লাগল আমার। 

সাহস করে এগিয়ে গেলাম আমি। গাছের পেছন থেকে হঠাৎ এগিয়ে আসেন এক ভদ্রলোক। হেসে ভদ্রমহিলার সামনে দাঁড়ান উনি। ভদ্রমহিলাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে কিছু একটা বলেন উনি। 


ভদ্রমহিলা কাঁদতে শুরু করেন। ভদ্রলোকের হাত টেনে ধরেন উনি। ভদ্রলোক কিছু একটা বলতে চাইলেন, কিন্তু ভদ্রমহিলা ওনাকে ছাড়ছেন না। ভদ্রলোক অবশেষে ওনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ভদ্রমহিলার পেটের ওপরে মাথা রেখে আদর করে একটা লাল গোলাপ পকেট থেকে বের করে ভদ্রমহিলার হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আর তখনই, তখনই হঠাৎ করে একটা জোরালো হাওয়া ভেসে আসে পেছন থেকে। জোরে জোরে শব্দ করে আমার চারদিকে পড়তে থাকে গোলাগুলি। মাটি কেঁপে ওঠে , মাটির ঢেলা, ধুলো উড়তে শুরু করে এদিক ওদিক। আমার চোখের সামনে সব কিছু অস্পষ্ট হয়ে যায় হঠাৎ করে। আমার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় গুলি...


ভয়ে আমি বসে পড়ি কোনও রকমে। আমার পাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে সৈন্যরা , তাদের মাথায় হেলমেট, গায়ে খাকী উর্দি, পায়ে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কালো ধূসর জুতো। হাতে উঁচিয়ে রাখা রাইফেল, আর সেই রাইফেল থেকে মুহুর্মুহু বেরোতে থাকা গুলি আর আগুন। কেউ, কেউ একজন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল মাটিতে। আমার কাঁধের ওপর দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। সবার মুখে গর্জন। পেছনে রাস্তার ওপর দিয়ে একটা ভারী ট্যাঙ্কের ঘড়ঘড় শব্দ...আর তারপরেই জোরালো একটা গোলার আওয়াজ। প্রায় দশ ফিট দূরে মাটিতে এসে পড়ে সেই গোলাটা। প্রচন্ড জোরে কেঁপে ওঠে মাটি আর তার সাথে ছিটকে পড়ে কয়েকজন সৈন্য। একটা শরীর এসে পড়ে আমার চোখের সামনে। সাদা ফ্যাকাশে দুটো চোখ, রক্তাক্ত মুখ তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে, শরীরটা সাড়হীন। চমকে উঠি আমি প্রচন্ড ভয়ে। এই, এই ভদ্রলোক তো একটু আগে...আর কোথায় গেলেন ওই ভদ্রমহিলা ? কোথায় ? এদিক ওদিক তাকালাম আমি। পেছনে, পেছনে ওই তো আমি দেখতে পাচ্ছি। বেশ কয়েকজন মিলে ভদ্রমহিলাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। আর ভদ্রমহিলা চেঁচিয়ে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে...


আমি, আমি আর পারলাম না নিজেকে আটকে রাখতে। আমি দৌড়ে গেলাম সেদিকে। আমার চারদিকে ঘন ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধ। কিছু দেখতে পাচ্ছি না আমি। ওপরে আকাশে গর্জন। কয়েকটা এরোপ্লেন এগিয়ে আসছে, আর সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসছে গুলি...

আর তারপরেই হঠাৎ জোরালো একটা আলো এসে পড়ে আমার চোখের সামনে, সাথে গাড়ির হর্নের আওয়াজ। গভীর রাতে আমার ঘুম ভাঙে অবশেষে। সাদা চাদর, সাদা একটা রুম। আমি শুয়ে আছি। চারদিকে দেখে বুঝতে পারলাম আমি হসপিটালে। তাহলে, তাহলে ওটা কি স্বপ্ন ছিল ? 

হঠাৎ আবার সেই গানের সুর। আবার। ভাল করে শোনার চেষ্টা করলাম আমি। 


আমার পায়ের কাছে বসে সেই ভদ্রমহিলা। উনি ধীরে ধীরে আমার দিকে তাকালেন। ওনার মুখ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। সেই অবস্থাতে উনি বলে উঠলেন, "ও আর আসবে না ! তাই না ? আর কোনও দিন আসবে না ? "


আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তবুও আমি কোনও রকমে জিজ্ঞেস করলাম, "ককক কে ? কার কথা বলছেন আপনি ? "


"ও ওই যে ! আমার রিচার্ড। ও, ও এসেছিল। তারপর যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধে ও চলে গিয়েছিল। আমাকে একটা ফুল দিয়ে, ও চলে গিয়েছিল। কিন্তু, তারপর আমি আর কিছু জানি না। আমাকে ওই, ওই শত্রুরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল জোর করে। আমার রিচার্ড যদি থাকত..."    

   

বাইরে হঠাৎ কোথাও জোরে বজ্রপাত হয়। সেই আলোতে ভেতরের ঘর ও আলোকিত হয় কিছুটা সময়ের জন্য। আর তখন আমি দেখতে পাই ভদ্রমহিলাকে। সারা শরীর কেউ যেন খুবলে খুবলে খেয়েছে ওনার। পরে থাকা জামা কাপড় কর্দমাক্ত, নানান জায়গায় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। আমি, আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। ধীরে ধীরে ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ান। চোখ দুটো জলে ভর্তি। 


"আমি আসি। ও, ও নাহলে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। " চলে গেলেন উনি। হারিয়ে গেলেন আমার চোখের সামনে থেকে। 


সেই ঘটনার পরে আমি হংকংয়ে ছিলাম আর ও কয়েকটা দিন।  যাওয়ার আগে আমি আর ও একবার গিয়েছিলাম ওই স্ট্যানলি মিলিটারি সেমেটারি'তে। কিন্তু আর দেখতে পাই নি ওনাকে। 


হয়ত, উনি ওনার রিচার্ডকে খুঁজে পেয়েছেন। হয়ত, সেদিন রিচার্ড আর জোর করে চলে না গিয়ে থেকে গিয়েছিলেন ওনার সাথে। হয়ত, এই জায়গাতে...যুদ্ধটা আর হয় নি...


হয়ত - এখানে বসে সেদিন আমি সবকিছু কল্পনা করেছিলাম...


সমাপ্ত