✍️সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭-র ১৫ই অগস্ট। এ বছর তার গৌরবময় ৭৫ বছর পূর্তি উদযাপিত হতে চলেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কত স্বার্থত্যাগ, কত রক্ত ঝরানোর বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে দেশ। রক্ষা করে চলেছে তার সার্বভৌমত্ব। এঁ…
রাসবিহারী বসু |
✍️সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭-র ১৫ই অগস্ট। এ বছর তার গৌরবময় ৭৫ বছর পূর্তি উদযাপিত হতে চলেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কত স্বার্থত্যাগ, কত রক্ত ঝরানোর বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে দেশ। রক্ষা করে চলেছে তার সার্বভৌমত্ব। এঁরা সকলেই শ্রদ্ধেয়, প্রণম্য। কিন্তু সকলের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলা যেতেই পারে, সশস্ত্র সংগ্রামের বীর সেনানীদের অন্যতম রাসবিহারী বসু উপেক্ষিত, অবহেলিত, হয়তো ব্রাত্যই! এক বছর আগে এই মহান বিপ্লবীর ৭৫তম প্রয়াণবার্ষিকী বিস্মৃতির অন্তরালে বয়ে গিয়েছে! সেই কোন কালে ১৯৬৭ তে ভারত সরকার তাঁর স্মৃতিতে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। কিন্তু তারপর? শহর কলকাতার দক্ষিণে ব্যস্ত রাজপথ রাসবিহারী এভিনিউ আদতে প্রখ্যাত আইনজীবী রাসবিহারী ঘোষের নামাঙ্কিত। বিপ্লবী রাসবিহারীর নামে নয়। আজকের বাঙালি তথা ভারতবাসী সম্ভবতঃ ভুলেই গিয়েছে এই মহান বিপ্লবীকে!
চন্দননগরের ভূমিপুত্র রাসবিহারী প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অনেকেরই ধারণা, তাঁর জীবন ও সংগ্রামকে উপজীব্য করেই অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র লিখেছেন কালজয়ী উপন্যাস 'পথের দাবী', যা নিষিদ্ধ করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক। কারণ এই বইটি ছিল বিপ্লবীদের কাছে অনুপ্রেরণার আকরগ্রন্থ।
সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজের ভিত্তি আদতে রাসবিহারীর তৈরি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেস লিগের হাত ধরেই। রাসবিহারী বসু ছিলেন এমনই একজন বিপ্লবী যিনি দেশকে স্বাধীন করতে গলাবাজির রাজনীতি করেননি। আবেদন নিবেদনের রাজনীতিকেও দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। বদলে দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে বেছে নিয়ছিলেন 'আর্মড রেভোল্যুশন' বা সশস্ত্র বিপ্লবের কাঁটা বিছানো পথ।
কী এমন ঘটিয়ে ফেলেছিলেন রাসবিহারী বসু, যা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করবে? জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে ১৯১২-র ২৩শে ডিসেম্বর। দিল্লিতে বড়োলাট লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন নারীর ছদ্মবেশে থাকা বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস। নেপথ্য পরিকল্পনায় রাসবিহারী। পরের বছর ১৯১৩-র ১৭ই মে লাহোরে লরেন্স গার্ডেন পুলিশ ক্লাবে কমিশনার গর্ডনকে হত্যার পিছনেও তাঁর মাথা। সারা দেশে ব্যাপক পুলিশি ধরপাকড়ের মধ্যেও গণ অভ্যুত্থানের মারাত্মক পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি। বিনায়ক রাও কাপ্লেকে সঙ্গে নিয়ে লাহোরে ঘাঁটি গাড়লেন রাসবিহারী। তারপর একসঙ্গে সারা দেশে সিভিল-মিলিটারিতে বিদ্রোহ। ১৯১৫-র ১৯শে ফেব্রুয়ারি সেই দিন। ওদিকে ফিরোজপুর, আম্বালা, মীরাটের মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট। এদিকে ব্যারাকপুর থেকে সুদূর সিঙ্গাপুরের নৌঘাঁটি পর্যন্ত অবরুদ্ধ হয়ছিল ওই দুঃসাহসী মানুষটির জন্য।
ছদ্মবেশ ধারণে অসামান্য ক্ষমতার অধিকারী রাসবিহারী। কখনো রান্নার ঠাকুর, কখনো মেথর, পুরোহিত, পাদ্রি কী নয়! একাধিক দেশি বিদেশি ভাষায় কথা বলতে পারা মানুষটিকে ব্রিটিশ ধরতেই পারেনি কোনোদিন। রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় পি এন ঠাকুর সেজে ছদ্মবেশে ধারণ করে পাড়ি দিলেন জাপান। সেখান থেকে পরিচালনা করেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম। জাপানের সামরিক সাহায্যে দেশের বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বিপুল অস্ত্র সম্ভার।
জাপানে সাংবাদিকতাও করেছেন রাসবিহারী বসু। সশস্ত্র বিপ্লবের সমর্থনে লেখালেখি করেছেন প্রচুর। লিগের ব্যাঙ্কক সন্মেলনে সংগ্রামের মূল দায়িত্বভারের বেটন তুলে দিয়েছেন সর্বাধিনায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে। লিগের অসামরিক ও সামরিক বিভাগের আদলে গড়ে উঠেছিল আজাদ হিন্দ সরকার ও ফৌজ। বাকিটা ইতিহাস।
আজকাল অজ্ঞাত কারণে দেশে সরকারি তরফে তাঁর স্মৃতিচারণ হয় না। অথচ জাপান সরকার তাঁকে 'অর্ডার অফ দ্য রাইজিং সান' সম্মাননা দিয়েছে। এলিজাবেথ এস্টন ও লেক্সি কাওয়াবে 'ফাদার অফ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি' শীর্ষক বই লিখেছেন রাসবিহারীকে নিয়ে। বইটি এক গবেষণাধর্মী প্রামাণ্য দলিল। স্বদেশে রাসবিহারী থাকলেন বিস্মৃতির অন্তরালে। অবশ্য তাতে কী বা এসে গেল! স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আত্মবিস্মৃত জাতির টুপিতে নতুন পালক যোগ হল মাত্র!