শিরোনাম - মায়া মমতা
তারিখ - ১/১০/২১
আকাশ দত্ত .............
- খোকা এলো নাকি, ও খোকা তুই এলি নাকি রে, একটাবার তোর মায়ের কাছে আয়।
ঘরের ভেতরে ক্রমাগত নিজের ছেলে মিহিরকে ডেকে চলেছেন কৃষ্ণাদেবী। ঘরের ভেতরে একজন নার্স চুপচাপ মুখে দাঁড়িয়ে …
শিরোনাম - মায়া মমতা
তারিখ - ১/১০/২১
আকাশ দত্ত
.............
- খোকা এলো নাকি, ও খোকা তুই এলি নাকি রে, একটাবার তোর মায়ের কাছে আয়।
ঘরের ভেতরে ক্রমাগত নিজের ছেলে মিহিরকে ডেকে চলেছেন কৃষ্ণাদেবী। ঘরের ভেতরে একজন নার্স চুপচাপ মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওনার সামনে আর আস্তে আস্তে ওনাকে সকালের জলখাবার খাওয়াবার চেষ্টা করছে।
- মাসিমা আপনি একটু চুপ করে খেয়ে নিন , এইতো আপনি খাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নিন , দেখবেন ওই বেলা আপনার ছেলে চলে আসবে আপনার কাছে।
কৃষ্ণাদেবীর চোখটা ছলছল করে উঠলো , কতদিন খোকার সঙ্গে দেখা হয়না , আজ কতো বছর বাদে দেখবে নিজের আত্মজকে প্রাণ ভরে তাই যেন আর একটা মুহূর্তের তর সইছে না। নার্সের কথায় উনি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন ,
- আচ্ছা মা তুমি আমায় খাইয়ে দাও কিন্ত সত্যি তুমি আমার খোকা এলে আমায় বলবে তো , আচ্ছা তোমরা ঠিক বলছো আমার খোকা আমায় চিনতে পেরেছে , ও আমার কাছে আসবে বলেছে?
নার্স - হ্যাঁ আপনার ছেলে আসবে , সে যে কেবল আপনাকে একটাবার দেখার জন্য ছুটে আসছে , নিজের মায়ের কাছে তার নিজের সন্তান কি না এসে থাকতে পারে! আপনার সন্তান আসছে আপনার কাছে।
- আচ্ছা ও আমায় মা বলে ডাকবে , আচ্ছা ওকে আমি দেখলে চিনতে পারবো তো , আচ্ছা ও আমায় দেখে চিনতে পারবে , আজ কতগুলো বছর হয়েছে আমি খোকাকে দেখিনা । আমি জানিনা এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পর আজ ও কেমন দেখতে , আমার যে খোকাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে।
নার্স আরও এগিয়ে এলো কৃষ্ণাদেবীর কাছে আর তারপর তার চোখের কোণে গড়িয়ে পরা জল মুছিয়ে দিয়ে তার হাতে হাত রেখে বললো ,
- আজ আপনার এই অপেক্ষা পূর্ণ হবে মাসিমা , আজ আপনি আপনার সন্তানকে ফিরে পাবেন নিজের কাছে আর উনিও ফিরে পাবেন নিজের মাকে।
আচ্ছা নিন তো এবার লক্ষী মেয়ের মতো চটপট খাওয়া শেষ করুন আর তারপর এই ওষুধগুলো খেয়ে একটু বিশ্রাম নিন।
কৃষ্ণাদেবী নিঃশব্দে বাকি খাবারটা খেয়ে নিয়ে তারপর রাখা ওষুধগুলো খেয়ে নিলো। এরপর নার্স ওনাকে শুইয়ে দিয়ে বললো ,
- নিন এবার একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করুন , আপনার ছেলে এলে আমি ডেকে দেবো আপনাকে।
কৃষ্ণাদেবী নীরবে শুধু মাথা নাড়লেন। নার্স ধীর পায়ে হাতে ফাঁকা খাবারের ট্রেটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘরের থেকে।
ঘরে রয়ে গেলো একরাশ নীরবতা।
******
বিকেল হচ্ছে ধীরে ধীরে। সূর্য ধীরে ধীরে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে আকাশের ওই পশ্চিম বুকে। শেষ বেলার একটা ম্লান কমলা আভা ছড়িয়ে রয়েছে আকাশের গায়ে। বিকেলের শেষ রোদ্দুর এসে পরেছে ত্রিনয়নী মানসিক হাসপাতালের গায়ে। নিজেদের নীড়ে ফেরার প্রস্তুতি করবার ফাঁকে ডেকে চলেছে পাখির দল , সেই পাখিদের ডাক ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে।
কৃষ্ণাদেবীর ঘরে এসে দাঁড়ালো একজন। খুব ধীর গলায় ডেকে উঠলো ,
-মা। এই দেখো মা আমি তোমার কাছে এসেছি , চোখ খোলো মা।
কৃষ্ণাদেবী চুপচাপ শুয়ে চোখ বন্ধ করে আনমোনা হয়ে কি ভাবছিলেন যেন , এই ডাকে উনি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সামনে তাকালেন এবং সামনে তাকিয়েই মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করে বললেন ,
- খোকা , তুই আমার খোকা? খোকা এসেছিস?
লোকটা কৃষ্ণাদেবীর আরও সামনে এসে তার হাতে হাত রেখে বললো ,
- হ্যাঁ গো মা এই তো আমি এসেছি, তোমার মিহির তোমার কাছে এসেছে মা।
কৃষ্ণাদেবী - দাঁড়া খোকা আগে তোকে প্রাণ ভরে একটু দেখে নেই , কোথায় ছিলি এতগুলো বছর খোকা , তোকে কতো খুঁজেছি আমি কিন্ত কেন তুই আমার কাছে একটাবারের জন্যেও এলি না! খোকা সত্যি করে বল না তোর আমার কথা মনে পড়ে না , আমার যে তুই ছাড়া জীবনের সব মানে হারিয়ে গেছে রে খোকা।
লোকটা বললো ,
- ভুলিনি মা , এই যে এবার তো অপেক্ষার শেষ। আমি তোমার কাছে এসে গেছি মা এবার দেখো আর তোমায় ছেড়ে যাবো না , এবার আমার সাথে তোমায় নিয়ে যাবো আমাদের নিজের বাড়িতে , তখন শুধু তুমি আর আমি আর আমাদের মাঝে কেউ থাকবে না মা কথা দিলাম।
কৃষ্ণাদেবী শক্ত করে আঁকড়ে ধরলেন খোকার হাতদুটো আর বললেন ,
-সত্যি তুই আমায় নিয়ে যাবি খোকা , কবে নিয়ে যাবি রে?
- এইতো মা তুমি আরেকটু সুস্থ হয়ে উঠলেই তোমায় নিয়ে যাবো , তুমি আগে সুস্থ হয়ে নাও তাড়াতাড়ি। এখন অনেকক্ষন কথা বলেছ এবার একটু বিশ্রাম নাও মা , আমি আবার কাল আসবো তোমার কাছে।
কৃষ্ণাদেবী - সত্যি আসবি তো খোকা , কথা দে আমায়।
- আসবো মা কথা দিলাম।
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন মৃদু কৃষ্ণাদেবী। লোকটা তার কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
কৃষ্ণাদেবী আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পরলেন।
*******
হাসপাতালের রুম নাম্বার ২০৭ থেকে বেরিয়ে এলো ডাক্তার রণধীর। কৃষ্ণাদেবীকে ঘুম পাড়িয়ে উনি বেরিয়ে এলেন বাকি রাউন্ডে যাবার জন্য। আজকের মতো আবার কালকে তার ছেলে হয় আসতে হবে এই রুমে। সন্ধ্যের নীরবতা চারিদিক জুড়ে।
কৃষ্ণাদেবী আজ এই হাসপাতালে রয়েছেন ১৫টা বছর। উনি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন আজ আর তাই কাউকে চিনতে পারেন না তবে প্রতি মুহূর্তে খুঁজে চলেন নিজের সন্তানকে একটাবার দেখার জন্য। কৃষ্ণাদেবীর সন্তান মিহির যে আজ কোথায় তা কারুর জানা নেই। সেই ১০ বছর বয়সে হটাৎ করে সে নিখোঁজ হয়ে যায় বাড়ির থেকে , এরপর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে। সে আজ নিখোঁজ তবু কৃষ্ণাদেবী খুঁজে চলে তার মিহিরকে। আগের দিনের কোনো কথা মনে রাখতে পারেন না তিনি শুধু ছেলেকে খোঁজা ছাড়া।
মিহির যখন নিখোঁজ হলো সেই যে তিনি স্মৃতিশক্তি নিজের চেতনা সব হারালেন তা আজও ফিরে পাননি , জানা নেই উনি কবে ফিরে পাবেন নিজের আসল সন্তানকে। ডক্টর রণধীর ওনার কেসটা দেখছেন সেই প্রথম থেকে তবে এখন কৃষ্ণাদেবী তার কাছে কোনো পেশেন্ট নয় শুধু , কৃষ্ণাদেবীকে নিজের মায়ের রূপেই দেখে সে। সে মাকে হারিয়েছে সেই কোন ছোটবেলায় তাই কৃষ্ণাদেবীর মধ্যেই খুঁজে নেবার চেষ্টা করে মায়ের মমতা। এই কেসটা নেবার পর মিহিরকে সে নিজেও অনেক করে অনেক ভাবে খোঁজার চেষ্টা করেছে কিন্ত কোনো লাভ হয়নি , মিহিরকে পাওয়া যায়নি।
কৃষ্ণাদেবীর কষ্ট যন্ত্রনা দূর করতে হটাৎ করেই ঠিক করেন ডক্টর রণধীর তার সামনে ছেলে হয়ে দাঁড়াবে এবং এইভাবে একটু হলেও যদি সন্তানকে দেখে মায়ের মুখে যদি একটু হাসি ফুটে ওঠে। এরপর মিহির হয়ে শুরু হয় নতুন ভাবে কৃষ্ণাদেবীর সামনে গিয়ে দাঁড়ানো এবং তা আজও একভাবে চলছে।
ডক্টর রণধীর কৃষ্ণাদেবীর মধ্যে খুঁজে পেয়েছে মায়ের ভালোবাসা মায়ের স্পর্শ মায়ের মমতা তাই সে ঠিক করেছে কৃষ্ণাদেবীকে সুস্থ করে নিজের কাছে নিয়ে যাবে বাড়িতে। তার মায়ের জায়গায় সে বসাবে কৃষ্ণাদেবীকে আর সারাজীবন থেকে যাবে তার হারানো মিহির হয়ে।
ডক্টর রণধীর জানে না কৃষ্ণাদেবীর আসল সন্তান মিহিরকে আদৌ পাওয়া যাবে কিনা আর পাওয়া গেলে কবে সেটা জানা নেই, তবু আসল মিহিরের খোঁজ না পেলেও সে কৃষ্ণাদেবীর কোনো কষ্ট হতে দেবে না , সে থাকবে তার মিহির হয়ে আজীবন।
ডক্টর রণধীরের চোখেও জমেছে জল , মায়া মমতা ভালোবাসার বন্ধন যে এরকমই হয়।