খণ্ডিতা( ছোটগল্প )-শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীরকোরবান আলীর নিরন্তর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আমিরন গলায় ফাঁস দিয়ে মরার সিদ্ধান্ত নেয়। কি হবে বেঁচে থেকে ? পুরুষ মানুষকে সে আর বিশ্বাস করেনা। পর পর দুই খসমের কাছ থেকে বিতারিত হয়ে কোরবা…
খণ্ডিতা
( ছোটগল্প )
-শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর
কোরবান আলীর নিরন্তর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আমিরন গলায় ফাঁস দিয়ে মরার সিদ্ধান্ত নেয়। কি হবে বেঁচে থেকে ? পুরুষ মানুষকে সে আর বিশ্বাস করেনা। পর পর দুই খসমের কাছ থেকে বিতারিত হয়ে কোরবান আলীকে নিকাহ করে মনের গহীনে জমে থাকা কষ্টগুলোকে মাটি চাপা দিয়ে সংসার করতে চেয়েছিলো আমিরন। সেই কোরবান আলীও যখন নিজের কলমা পড়া স্ত্রী আমিরনকে ছেড়ে বেগানা নারী ফুলভানুর রূপের আগুনে ঝলসে যায়, তখন নিজের ওপর প্রচণ্ড ঘেন্নায় অভিমানে জীবনের সব থেকে কঠিন পথটিই বেছে নেয় সে।
আমিরনের প্রথম বিয়ে হয়েছিলো শমসেরের সাথে। লাল মুলার মতন দেখতে ছিলো শমসের। গ্রামের সবাই বলতো, শমসের আস্তা একটা সাহেবের ব্যাটা ! নিদারুণ মন্বন্তরে নিঃস্ব কপর্দকহীন শমসেরের বাবা শমসেরকে অল্প বয়সে পেটে ভাতে কাজে লাগিয়ে দেয় বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের বিত্তশালী দলিল উদ্দীনের বাড়িতে। দলিল উদ্দীনের ছোট মেয়ে আমিরন তখন ষোড়শী। শমসেরকে আমিরনের ভালোলাগে। মন দেয়া-নেয়াও চলতে থাকে বেশ কিছুদিন। একদিন রাতে মেটে জোসনায় পুকুরঘাটে শমসেরের সাথে আমিরনকে নির্জনে কথা বলতে দেখে দলিল উদ্দীন রাগে টগবগ করতে থাকে। তারপর চেলা কাঠ দিয়ে বেদম পিটিয়ে গালিগালাজ করে বাড়ি থেকে বের করে দেয় শমসেরকে-
বিশ্যার ছাওয়াল ! চোখ খুঁইচে তুইলে ফেলবো, বেরো আমার বাড়ি থেইকে ! তোক যেনো আর এ গিরামে না দেখি। ফের আমার বিটির দিকে নজর দিলি তোক আমি বস্তায় ভইরে বিলের কাঁদায় পুঁইতে ফেলবানে !
শমসের হাতে পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইলেও দলিল উদ্দীনের মন গলেনি। মারতে মারতে খালপাড় অবধি রেখে আসে শমসেরকে। দলিল উদ্দীনের এরূপ নির্দয় আচরণে খুব কষ্ট পায় আমিরন। আর তাই বাবার ওপর রাগ করে এক রাতে শমসেরের হাত ধরে নিরুদ্দেশ হয় সে। শমসেরকে নিয়ে বালিয়াডাঙ্গা গ্রাম ছেড়ে ট্রেনে করে চলে আসে খুলনার মোংলা ঘাটে। দূরসম্পর্কের এক মামাকে ধরে শমসের জাহাজের খালাসির কাজ নেয়। জেটির কাছেই আমিরন আর শমসের ছোট একটা হোগলার ঘর ভাড়া নিয়ে সুখের নীড় রচনা করে।
সারাদিন শমসের হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে সন্ধ্যায় ঘাট থেকে ঘরে ফিরতো। ঘরে ফিরেই আমিরনকে না দেখতে পেয়ে ডাকাডাকি জোরে দিতো। পাশের ঘরের ঘাট শ্রমিক আক্কাছের স্ত্রী জোছনা এ নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতো। রঙ্গ করে বলতো-
ঐ মিয়া, বউ পাগলা হইছ বুঝি ? বউরে ছাড়া দেখি কিচছু বুঝনা। আহ্ হা রে, সাধের যইবন ভাটায় গেলো তোমার মতন রসিক একখান নাগর পাইলাম না !
শমসের হাসতে হাসতে প্রত্যুত্তরে বলতো-
পাইলে কী করতা, ভাবি ?
-গলায় ঝুইলে পইড়তাম !
-বোষ্টমী হইয়ে তাক নিয়ে দেশান্তর যাইতাম !
কথাগুলো বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়তো জোছনা। আমিরন এসে একগাল হেসে বলতো-
বুবু, পুরুষ মাইনষেরে এতো বিশ্বাস করন ঠিক না। হেগোর ভালোবাসা হইলো গিয়া কচু পাতার পানি !
সত্যিই আমিরনের প্রতি শমসেরের ভালোবাসাও যে কচু পাতার পানির মতোই ক্ষণস্থায়ী হবে আমিরন তা গুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। যখন বুঝতে পারলো, তখন আর আমিরনের করার কিছু ছিলোনা। আমিরনের বিশ্বাস আর ভালোবাসাকে ক্ষত-বিক্ষত করে শমসের একদিন আক্কাছের স্ত্রী জোছনাকে নিয়ে পালিয়ে গেলো। শমসেরের এমন নেমক হারামিতে বাক্-রুদ্ধ আমিরন বালিয়াডাঙ্গায় ফিরে যাবে বলে মনঃস্থ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর আমিরনের ফেরা হয়না। কারণ সে তার বাবা দলিল উদ্দীনকে চেনে। কেটে টুকরো করে গাঙের সোঁতে ভাসিয়ে দেবে, তবু তার মতো কুলত্যাগিনীকে ঘরে তুলবে না।
বেঁচে থাকার তাগিদে আমিরন কাজ খুঁজতে থাকে মোংলা শহরের পথে পথে। সারাদিন ঘুরেও সে কোনো কাজের হদিস পায়না। কে তাকে কাজ দেবে ? এ শহর তার অপরিচিত। এ শহরে জানা শোনা কিংবা আত্মীয় পরিজন বলতেও তেমন কেউ নেই তার। তবে ঢাকায় আজগর নামে আমিরনের গ্রামের এক পড়শী আছে। তার কাছে গেলে নিশ্চই ফেলে দেবে না সে। অনেক ভেবেচিন্তে ভাতের লড়াইয়ে পরাজিত আমিরন জীবন-জীবিকার খোঁজে ভাসতে ভাসতে শেষ পর্যন্ত আজগরের দুয়ারে এসে নোঙর ফেলে। আমিরনকে দেখে আজগর প্রথমে বিরক্ত হলেও পরক্ষণেই কিনা কি ভেবে আমিরনকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়। আজগর তার স্ত্রী কুসুমকে ডেকে মোলায়েম স্বরে বলে-
বউ, আমিরন গিরামের মানি ঘরের বিটি। বিপদে পইড়ে আমার কাছে আইছে। বিপদের দিনে একটা কুত্তেরেও কেউ তাড়ায়ে দেয়না। তাক থাইকবার না দিয়ে কি করি বউ, ক দিখিনে ?
কুসুম আজগরের কথার কোনো উত্তর দেয় না। কেবল নিরুত্তাপ শ্যেনদৃষ্টিতে আজগরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আজগর আর কুসুম গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করে। দুজনের বোঝাপড়ার সংসার, কিন্তু সংসারে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত সোমত্ত আমিরনের উপস্থিতি কুসুম মেনে নিতে পারেনা। তাছাড়া আমিরন আসার পর থেকেই আজগরের চলাফেরাও খুব সুবিধার মনে হয়না কুসুমের। ইদানিং আজগর নানা ছুতোয় অফিস কামাই দেয়। আমিরনের জন্য চাকরি খোঁজার নাম করে সারা দিন আমিরনকে নিয়ে টই টই করে শহরময় ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ পেলেই আজগর আমিরনের কাছে ভেড়ার চেষ্টা করে। আমিরনের কচি লাউয়ের ডগার মতন নয়ালি যৌবন আজগরকে অন্ধ করে দিয়েছে। আর তাই আজগর সমাজ-সংসারের সকল রীতি-নীতিকে তোয়াক্কা না করে আমিরনকে একান্ত করে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। মাঝে-মধ্যে রাত-বিরাতে কুসুম ঘুমিয়ে পড়লে আজগর ক্ষুধার্ত বাঘের মতন আমিরনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দিন গড়াতে থাকে। আজগর আমিরনকে সারা জীবন সুখে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। আমিরনের সাথে আজগরের অদৃশ্যসম্পর্ক বিশ্বাস আর ভালোবাসার বাঁধনে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। একসময় আমিরন টের পায় সে অন্তঃসত্ত্ব। সন্তান নষ্ট করতে আমিরনকে চাপ দেয় আজগর। আমিরন তাতে রাজি হয় না। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে আমিরনকে নিয়ে পালিয়ে যায় আজগর। বিয়ে করে ঘর বাঁধে। কিছুদিন না যেতেই ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জন্মদেয় আমিরন। সন্তানের নাম রাখে অশ্রু। নিদারুণ দুঃসময়ে তার জন্ম। তাই অশ্রু নামটি মন্দ হয়নি। আজগর আবার নতুন করে কারখানায় কাজ শুরু করে। আমিরন সারাদিন সংসার সামলায়। কোনো রকমে নিরুৎসব নিরানন্দভাবেই তাদের দিন কেটে যায়। এভাবে বেশ কয়েক বছর পার হয়। একদিন কোনো কিছু না বলেই আজগর আমিরনকে ফেলে রেখে নিরুদ্দেশ হয়। অনেক চেষ্টাতেও আজগরকে আর খুঁজে পাওয়া যায়না।
আমিরন নির্দয় ঢাকা শহরে কচুরি পানার মতন ভাসতে থাকে। সে তার নিজের জন্য ভাবে না। তার সকল ভাবনা কেবল মেয়ে অশ্রুর জন্য। আমিরনের দুঃখ দেখে প্রতিবেশি ফুলভানু তাকে পরামর্শ দেয় কিছু করার, কিন্তু কি করবে সে ভেবে পায় না। অবশেষে ফুলভানু একদিন আমিরনকে বলে-
ভাউজ, চলো তোমারে এক যায়গায় লইয়া যাই। কামে লাগাইয়া দেই, মেলা টেহা পাইবা। তোমার সংসারে আর অভাব থাকবো না।
আমিরন আগ্রহভরা কণ্ঠে বলে-
কোনঠে নিয়ে যাবে, বোন ? কী কাজ, কও দিখিনে ?
ফুলবানু দুর্বিনীত হাসি হাসে। হাসি থামলে গলাকেশে বলে-
অহন কমু না, ভাউজ। আগে আমার লগে চলো। তোমার মাইয়্যারে নিয়া চিন্তা করন লাগবো না, ওরে আমার খালার কাছে রাইখ্যা যামু।
অভাবের তাড়নায় ফুলভানুর প্রস্তাবে রাজি হয় আমিরন। পরদিন সকালে ফুলভানু আমিরনকে একটা অচেনা যায়গায় নিয়ে আসে। সেখানকার লোকগুলোর চাহনি অসহ্য ঠ্যাকে আমিরনের। কিছু বুঝে ওঠবার আগেই মোটা মতন একটা লোক প্রায় জোর করে আমিরনকে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। প্রায় আধ-ঘণ্টা পর লোকটি চলে গেলে আরেকজন আসে আমিরনের কাছে। এভাবে সন্ধ্যা অবধি চলতে থাকে। শরীরে অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে আমিরন রাতে ঘরে ফিরে আসে। আমিরনের অন্তহীন উপদ্রুত জীবন এভাবেই চলতে থাকে।
বছরখানেক পর আমিরনের বেদনা ভারাক্রান্ত জীবনের যবনিকা দূর করতে আসে অন্য আরেক পুরুষ। তার পাশের গ্রামের আয়ুব ব্যাপারীর ছেলে কোরবান আলী। কোরবান আলী ঢাকায় অটোরিকসা চালায়। থাকে আমিরনের পাশের ঘরেই। আমিরনকে তার খুব ভালো লাগে। বিয়ে করার প্রলোভন দেখায়। টোপ ফেলে। আমিরনের খোয়াব বাসনা উষ্কে দেয়। কোরবান আলীর অল্প দিনের ব্যবধানে দুটি বউই চলে গেছে পরপারে। তাই ভগ্নহৃদয় কোরবান আলীর প্রস্তাব আমিরন ফেলতে পারেনা। কোরবান আলীকে বিশ্বাস করে পুনরায় নতুন জীবন শুরু করে আমিরন।
প্রথম প্রথম আমিরন ভেবেছিলো কোরবান আলী হয়তো তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। কোরবান আলী হয়তো তাকে মুক্তি দেবে নরকযন্ত্রণা থেকে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমিরনের ভুল ভাঙে। কোরবান আলীর আসল চেহেরা উন্মুক্ত হয় আমিরনের কাছে। বিয়ের কিছুদিন না যেতেই আমিরনের সাথে কোরবান আলী জানোয়ারের মতন আচরণ শুরু করে- যখন তখন গায়ে হাত তোলে। তালাক দেয়ার হুমকি দেয়। সময় অসময়ে মেয়ের সামনে আমিরনকে গরুর মতন পেটায়।
এদিকে আমিরনের সাথে টানাপড়েন চললেও ধীরে ধীরে ফুলভানুর সাথে কোরবান আলীর বাড়তে থাকে সখ্যতা। কাছে পেলেই কোরবান আলী ফুলভানুর সাথে রঙতামাশা জুড়ে দেয়। আকারে ইঙ্গিতে কদর্য ভাষায় জানান দেয় শরীরের ক্ষুধা।
আমিরনের কাছে দুনিয়াটা বিস্বাদ মনে হয়। তাই সে ফাঁস দিয়ে পাপ পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত জীবন থেকে মুক্তি পেতে চায়। ঘরে সিলিংফেনে উড়না পেঁচিয়ে গলায় বেঁধে যখন ঝুলতে যাবে আমিরন, তখন অশ্রুর শুষ্ক মলিন মুখ ভেসে ওঠে আমিরনের চোখের সামনে। সে আর আত্মঘাতিনী হতে পারেনা। গভীর জীবনাসক্তি তাকে ফিরিয়ে আনে সুনিশ্চিত মরণের গহীন গহ্বর থেকে। বিছানায় কান্নারত মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে থাকে আমিরন। কি আশ্চর্য ! মুহূর্তেই মেয়েটি যেন আমিরনের সমস্ত কষ্ট যন্ত্রণা মুছে দিয়ে তাকে নিয়ে যায় অলৌকিক মায়াবী দেশে।