Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

ছোটগল্প --যেও না উৎসব   কলমে----অর্পিতা  বিশ্বাস         টবের গাছগুলোর পরিচর্যা করছিলেন  সোমেশ্বর সান্যাল । বয়স পঁচাত্তর হবে দুমাস বাদে । তবে বয়স মোটেই কব্জা করতে পারেনি তাকে । মর্নিং ওয়াক আর একটু আধটু ব্যায়ামের ফলে এখনও যথেষ্ট স…

 


ছোটগল্প --যেও না উৎসব 

  কলমে----অর্পিতা  বিশ্বাস 

        টবের গাছগুলোর পরিচর্যা করছিলেন  সোমেশ্বর সান্যাল । বয়স পঁচাত্তর হবে দুমাস বাদে । তবে বয়স মোটেই কব্জা করতে পারেনি তাকে । মর্নিং ওয়াক আর একটু আধটু ব্যায়ামের ফলে এখনও যথেষ্ট সক্ষম তিনি । তাছাড়া নিজস্ব কাজ আর একটু আধটু লেখালেখি করে বেশ খুশ মেজাজেই দিনগুলো কেটে যায়  । কখনো বা আবার কমলাকে নিয়ে সারাদিনের জন্য কোথাও বেড়িয়ে পড়েন । সুতরাং বলতে গেলে  বেশ ভালোই  আছেন সোমেশ্বর । অবশ্য এই 'বেশ ভালো থাকার' চেষ্টাটাই করে গেছেন চিরকাল । যখন টাকা -পয়সা তেমন ছিল না তখনো আবার আজ যখন সবকিছু অঢেল আছে তখনও । তবে  এই ভাল থাকাটা শিখেছিলেন মনিদার কাছ থেকে । মনিময় সেনগুপ্ত । আশ্চর্য মানুষ ছিলেন  এই মনিদা । হাজার কষ্ট থাকলেও কখনো কাউকে বুঝতে দিতেন না । বরং কেমন আছ, কেউ জিজ্ঞেস করলেই একগাল হেসে উত্তর দিতেন ----বেশ আছি । হয়তো তখন মনিদার হাতে একশোটা টাকাও থাকতো না । একদিন পাড়ার নীরু জ্যাঠাকে এরকম  উত্তর দিতেই রেগে গিয়েছিলেন সোমেশ্বর । তারপর  মনিদাকে বলেছিলেন-- আচ্ছা মনিদা, আমি তো জানি তুমি ভাল নেই । তাহলে ওরকম বললে কেন ? এবার মনিদার মুখটা একটু উদাস হয়ে গেল।  নীলাভ সুন্দর মাথার ওপরের আকাশটাকে দেখলেন একবার । তারপর বললেন----পুজো বোধহয় এসে গেল ,তাই না রে ? 

 মনিদার কথা শুনে সোমেশ্বরও দেখলেন আকাশের দিকে । তারপর বললেন---কথা ঘোরাবে না মনিদা । ওই নীরু জ্যাঠার ছেলেকে তো তুমি গান শেখাও । কিন্তু  মাস পেরিয়ে যাবার পর আরও দশ-বারো দিন না গেলে নীরু জ্যাঠা টাকা যে কখনো হাতছাড়া করে না, সেটা তুমি যেমন জানো তেমনি আমিও জানি । তাহলে মিথ্যে বললে কেন ? 

মনিদা এবার আর আকাশ নয় , সরাসরি সোমেশ্বরের চোখের দিকে তাকালেন । তারপর বললেন----কেউ কখনো সত্যি সত্যি তুই কেমন আছিস তা জানতে চায় না সোমেশ্বর    । ওটা একটা কথার কথা । তাছাড়া টাকার কথা যদি আমি সরাসরিও বলতাম, তাহলেও নীরু জেঠা টাকাটা দিত না ।  কিন্তু যদি তুই আপন ভেবে কাউকে তোর ভাল না থাকার কথা বলিস, অথবা কেন ভাল নেই সেটা বলিস ,তাহলে দেখবি হয় তোকে তারা করুনা করছে নাহলে দ্বিতীয় দিন থেকে তোকে দেখেও না চেনার ভান করছে । 

      কথাগুলো যে কতখানি সত্যি বলেছিলেন মনিদা সেটা  জীবনে অনেক বার টের পেয়েছেন সোমেশ্বর ।  যখনই কাউকে বন্ধু ভেবে, আপনজন ভেবে নিজের কষ্ট টুকু শেয়ার করতে গেছেন, তক্ষুনি তাদের চোখের ভাষা পালটে যেতে দেখেছেন । প্রত্যেকের কাছেই নিজের দামটা কমে যেতে দেখেছেন । একটা সময় গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে । মনিদার মতোই বলতে শিখে গেছেন, ভাল আছি -বেশ আছি ।

   তবে এ ক'দিন ধরে সত্যিই ভাল আছেন সোমেশ্বর । ছেলে কুশল,  বউ আর মেয়েকে নিয়ে পুজোর ছুটি কাটাতে বাড়িতে এসেছে  । সোমেশ্বরের আনন্দ তাই আর ধরছে না । ব্যাগ ভর্তি করে বাজার করছেন । ওরা কি কি খেতে ভালবাসে বাজারে যাবার আগে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন । আবার রান্না করার মেয়েটাকেও পরামর্শ দিচ্ছেন ভাল করে রাঁধার জন্য । সোমেশ্বরের কান্ড দেখে কুশল রাগ করে মাকে কমপ্লেন করছে প্রায়ই । কমলাও মিষ্টি হেসে পাল্টা অভিযোগ করছেন ---তা কি করবে , সারাটা বছর তো বাইরে বাইরেই কাটাস তোরা । ছোটবেলা খেতে কত ভালবাসতিস তুই । মাছ -মাংস থেকে পিঠে-পুলি সবটাতেই সমান ভালোবাসা ছিল তোর । 

     কথাটা সত্যি । কুশল তাই আর কথা বাড়ায় না ।  কুশলের বউ নন্দিনী অবশ্য এসব নিয়ে মোটেই  মাথা ঘামায় না । এখানে এসেও পুজোর বাজার -সাজগোজ-পার্লারে যাওয়া  এগুলো নিয়েই ব্যস্ত ও । যদিও সোমেশ্বর জানেন, এখানকার পুজো মোটেও ভাল লাগবে না ওদের । কলকাতায় কত জাঁক জমকের পুজো দেখে ওরা । সেদিন তো শালুক বলেই ফেলল ---- কি করে যে পুজোটা কাটবে এখানে ? ইস, বাপি যে কি করে না ! 

       কুশল অবশ্য থামাবার চেষ্টা করেছে মেয়েকে । কিন্তু নন্দিনী মেয়ের পক্ষ নিয়ে বলেছে --- তোমার আর কি । নিজের জায়গায় এসেছো, কত বন্ধু-বান্ধব পাবে, দিব্যি কাটবে দিনগুলো তোমার  । শালুকটাই যা একা হয়ে গেল ।

সোমেশ্বর চুপ করে থেকেছেন । মুখের হাসিটুকু বজায় রেখেই । ছেলে--বউর মাঝে কোন কথা বলেননি । তবে মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল । তার মানে কমলার কান্নাকাটির জন্য,  কুশল এবার ওদের জোর  করে নিয়ে এসেছে ।  আচ্ছা নন্দিনী যদি আজ নিজের মেয়ে হত, তাহলে কি বলত এমন কথা ? বলত না । বরং শালুকের কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে ঘর -  দুয়ার সাজিয়ে তুলত, মা-বাবাকে  সারা শহরের পুজো  দেখাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত । 

     কথাগুলো মনের মাঝে উঁকি দিতেই  সোমেশ্বর সামলে নিলেন নিজেকে । অথবা বলা উচিত ব্রেক কষলেন ভাবনাগুলোর । সত্যিই তো নন্দিনীর কথাও ফেলার নয় ।  শালুক তো কাউকেই চেনে না -জানে না এখানে । কেনই বা ভাল লাগবে ওর । শালুকের বয়সে নিজে তো পুজো-পার্বন অথবা কোন উৎসব -অনুষ্ঠান বন্ধুদের ছাড়া ভাবতেই পারতেন না । তাছাড়া ততদিনে কমলাও তো এসে গিয়েছিল জীবনে । একঢাল কালো চুলের একটু চাপা রঙের  মেয়েটাকে কি মিষ্টি যে লাগত সোমেশ্বরের । কোন এক অষ্টমীর সকালে হলুদ তাঁতের শাড়ি পড়া কমলাকে দেখে প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন সোমেশ্বর । তারপর ওই বন্ধুদের দয়াতেই যোগাযোগ হয়েছিল কমলার সংগে ।  মনের কথা বলেছিলেন  । যদিও কমলা একটা কথাও বলেনি । বরং  একছুটে পালিয়ে গিয়েছিল  । তবে যাবার আগে এক ঝলক মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে গিয়েছিল সোমেশ্বরকে ।  সাত রাজার ধন খুঁজে পেয়েছিলেন সোমেশ্বর সেদিন কমলার ওই হাসিটুকুতে । প্রতিটা দুর্গাপুজা তাই স্পেশাল সোমেশ্বরের কাছে । এসময়টায় তাই 'কোন মন খারাপ করা কথা' মনের মাঝে  ঠাঁই দিতে চান না সোমেশ্বর । 

                     দুই

      একটা আইডিয়া ক'দিন ধরেই মনের মাঝে ঘুরছিল সোমেশ্বরের । কমলাকে বলতে চেয়েও বলতে পারেননি । জানেন ঠিক বকুনি খাবেন । তবুও কেন কে জানে কথাটা ভাবলেই একরাশ খুশি লুটোপুটি খাচ্ছিল বুকের ভেতর । সাহস করে একদিন বলেই ফেললেন ----আচ্ছা কমলা, হঠাৎ যদি দেখ তোমার ছেলে আর ছেলের বউ সব্বাই তোমার কাছে এসে থাকতে চাইছে তাহলে ? 

      সুপুরি কাটছিলেন কমলা । মুখ না তুলেই বললেন---দিবা স্বপ্ন দেখ না । এই যে পুজোর ক'দিন আগে থেকেই এসে থাকছে আমাদের কাছে, নন্দিনী আমার হাতে হাতে কাজ করছে, তাই অনেক । বসতে পেলে শুতে চাইতে নেই, বোকামি করা হয় তাতে । 

      কমলার আরও একটু কাছে এসে বসলেন সোমেশ্বর । আর গোপন কিছু শেয়ার করার মতো করে বললেন----যদি আমাদের শালুক এই হাউসিং কমপ্লেক্সে বউ হয়ে আসে, তাহলে ?

      তেতে উঠলেন এবার কমলা । সুপুরি কাটা বন্ধ করে বললেন ----তোমার কি মাথাটা একেবারেই গেছে? নাকি  কি বলছো বুঝতেই পারছো না ? 

  সোমেশ্বর হেসে উঠলেন এবার জোরে জোরে । প্রানখোলা হাসি যাকে বলে । তারপর আস্তে করে বললেন, সুধাকরের ছেলেটা ডাক্তারি পড়ছে, জানোই তো । সেও কিন্তু আসছে পুজোতে । দেখতেও বেশ হ্যান্ডসাম । আমাদের শালুকের নি‌শ্চয়ই অপছন্দ হবে না ।  আর তোমার ছেলে --ছেলের বউ ওরকম হীরের টুকরো ছেলেকে জামাই হিসেবে পেলে খুশিই হবে । মাঝখান থেকে লাভবান  হব আমরা । নিজের মেয়ের  টানে তোমার ছেলে দেখবে বউ নিয়ে সোজা এবাড়িতে এসে উঠবে ।  আচ্ছা,  আমরা তো ওদের  বয়সেই প্রেমে পড়েছিলাম, তাই না ? তুমি অবশ্য শালুকের থেকে একটু ছোটই ছিলে ।  সবে মাধ্যমিক দিয়েছিলে বোধহয় তখন । তা তোমার নাতনি হয়ে শালুক একটু প্রেম করতে পারবে না ?  আর না পারলে আমি ঘটকালি করব । সুধাকর এককালে আমার ছাত্র ছিল । আমি বললে শালুককে ছেলের বউ করতে মোটেও  অরাজি হবে  না । 

ব্যাপারটা পছন্দ হলেও, নিজের কিশোরীবেলার প্রেমের  উল্লেখ করায় একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরল  কমলার বলিরেখা পড়ে যাওয়া এখনও মোটামুটি সুন্দর মুখের ওপর। আর সেটা বুঝতে পেরে আরও  রেগে গেলেন কমলা । দুপ দাপ পা ফেলে উঠে গেলেন সামনে থেকে ।  হা হা করে আবারও হেসে উঠলেন সোমেশ্বর ।

তা শালুক কি প্রেমে পড়েছিল ? না, ঠিকঠাক বুঝতে পারেননি কর্তা-গিন্নি দুজনের কেউই । টানা চার-পাঁচটা দিন গোয়েন্দাগিরি করা সত্বেও । সপ্তমী দিন সোমেশ্বর নিজে উদ্যোগী হয়ে শালুকের সংগে সিদ্ধার্থর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন । বেশ কিছুক্ষন কথা বলেছিল  দুজনে । অষ্টমী  দিনের জন্য  তাই নতুন প্ল্যান করেছিলেন কমলা । শালুককে আরও সুন্দরী দেখাবার জন্য উপহার হিসেবে একটা  জামদানী শাড়ি  দিয়েছিলেন । প্রথমে  রাজি না হলেও কমলার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত  শাড়িটা পড়েছিল শালুক । অঞ্জলি দিতেও একসংগে গিয়েছিলেন কমলা স্রেফ সিদ্ধার্থর রিয়েকশনটুকু দেখবেন বলে। 

  বাড়ি ফিরে হাসি মুখে সোমেশ্বরকে রিপোর্ট দিয়েছিলেন ---আমার নাতনীকে দেখে তো  চোখের পলকই পড়ছিল না তোমার  ওই ডাক্তার ছেলের ।

কথাটা সত্যি । খেতে বসে শালুকও বলেছিল--- ইস, শাড়িতে যে কি আছে জানি না, এত কষ্ট হয় সামলাতে, দু'পা হাঁটার পরই মনে হয় এবার নির্ঘাৎ  পড়ে যাব । তাও আন্টি ওরা সব্বাই ডেকে ডেকে বলছিল, কি ভাল লাগছে তোমায় দেখতে শালুক, এমনকি সিদ্ধার্থও বলে কি না........ । কথা সম্পূর্ণ না করেই থেমে গিয়েছিল ।

সিদ্ধার্থ কি বলে সেটা জানার চেষ্টা না করে কমলা একটু হেসে বলেছিলেন --

---- সত্যি কথাই তো বলছিল সবাই । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোমারও নিজেকে নিশ্চয়  ভালো লাগছিল শালুক । তাই তো এতো মন দিয়ে সাজগোজ করছিলে । আর গয়নাগুলো পড়ার পর তো তোমায়  মা দুর্গার মতোই সুন্দর লাগছিল । 

আহা, সেতো তুমি জেদ ধরেছিলে তোমার অর্ণামেন্টস গুলো আমায় পড়াবে বলে । তবে ...

----তবে কি ? 

----ওগুলোর ডিজাইন কিন্তু মোটেও পুরনোকালের নয় । বরং বেশ  সুন্দর কাজ গয়নাগুলোর ।  ফ্যাশনেবল যাকে বলে ।

    এবার আর কিছু বললেন না কমলা। শেষের বাক্যদুটো শালুকের নাকি ওই ডাক্তার ছেলের সেটাও জিজ্ঞেস করলেন না । বরং আরও একপিস মাছ তুলে দিলেন নাতনীর পাতে । কুশলের মতো ওর মেয়েটাও মাছের কালিয়া খেতে খুব ভালবাসে । ছেলে ছেলের বউ  পূজো মন্ডপেই ভোগের খিচুরী খাবে আজ । শালুক খিচুরী ভালবাসে না আর ওদের দুজনের তো পেটেই সহ্য হয় না । তিনজন তাই গল্প করে করে খেতে লাগলেন ।  

       পরদিন থেকে নজরদারি আরও  বেড়ে গেল । উত্তেজনায় টান টান দুজনে । উফ্ কি কঠিন কাজ ! কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না অথচ কাজটা ঠিকঠাক করতে হবে । পালা করে নজর রাখছেন দুজনে । এমনকি শালুকের ফোনেও আড়ি পেতেছেন কমলা, ব্যাপারটা এক্কেবারে আন এথিকেল জেনেও । কিন্তু  খুব একটা সুবিধে হয়নি । হবেই বা কি করে ? ফোনে যা কথা বলছে শালুক সে তো বেশির ভাগই  হিন্দি আর ইংরেজিতে মিশিয়ে । বাংলা দু চারটা শব্দ থাকলেও কমলার তাতে লাভ তেমন হয়নি। মনে মনে, দুর ছাই বলে চলে এসেছিলেন ওখান  থেকে । পরে এনিয়ে নালিশ করেছিলেন সোমেশ্বরকে । মুখটা গম্ভীর করে সোমেশ্বর বলেছিলেন----- দেখলে তো পড়াশোনায় মন না থাকলে কি হয় । ছোটবেলা মন দিয়ে একটু পড়লে আজ এই অবস্থা হত না । এই জন্যই কিচ্ছু করতে পারলে না জীবনে । 

----তা বিয়েটা করেছিলে কেন ? জানতেই তো টেনেটুনে কোন রকমে মাধ্যমিকটা পাশ করে ছিলাম । তোমার তুলনায় মূর্খ ছিলাম জানতে না ? 

     ঝাঁঝিয়ে উঠলেন কমলা । নিজের মানুষটার কাছে এত বছর বাদে  এভাবে কথা শোনাটা  মোটেই বরদাস্ত করতে পারলেন  না । 

----আহা, যা গেছে তা নিয়ে রাগ করে  লাভ কি ? তাছাড়া  তুমি যে হারে আজকাল রেগে যাচ্ছ তাতে শালুকের বিয়ের ব্যবস্থা করার আগে আমাদেরই না ডিভোর্স হয়ে যায় । 

      হেসে ফেললেন এবার দুজনেই । তবে কমলা চিন্তায় পড়ে গেলেন । শালুক দিব্যি ছেলেটার সংগে গল্প করছে, বাইকে করে ঘুড়ছে, অথচ প্রেমে পড়ার সেরকম কোন লক্ষন নেই । গতকাল  শালুকের সংগে কথা বলার সময় সুযোগ বুঝে একবার  জিজ্ঞেসও করেছিলেন ---আচ্ছা দিদিভাই, সিদ্ধার্থ ছেলেটাকে কেমন লাগে তোমার ?  বেশ ভালো কিন্তু ছেলেটা ,মানে ছোটবেলা থেকেই দেখছি তো ।

         হাতের ফোনটা  ঘাটতে ঘাটতেই উত্তর দিয়েছিল শালুক --ঠিকই আছে ।  আমার সংগে তো বেশ বন্ধুত্বই হয়ে গেছে ওর ।  তাছাড়া ওর বন্ধুগুলোও বেশ ভালো ।  ইনফ্যাক্ট ওদের জন্যই  ভালো কাটছে পুজোটা ।

      শালুকের কথা শুনে স্রেফ বোকা বনে গিয়েছিলেন কমলা । হচ্ছে সিদ্ধার্থর কথা, এর মাঝে ওর বন্ধুরা কোথা থেকে এল । তবু ভালো করে ওর মুখটা লক্ষ করছিলেন আর হতাশ হয়েছিলেন । না 'বন্ধুত্ব' শব্দটা উচ্চারন করার সময় চোখেমুখে এতটুকু আলো জ্বলে উঠল না । আর পাঁচটা বন্ধুর মতোই যেন সিদ্ধার্থ । মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন কমলা,  ছেলে মেয়েদের মাঝে এই নির্ভেজাল  বন্ধুত্বটাই যত নষ্টের গোড়া। না হলে এত চেষ্টার পরও মন গলে না ! না আর কোন আশাই নেই । 

----কি হল  চুপ করে গেলে যে ? 

-----এখনকার ছেলে--মেয়েগুলোকে না ঠিক বোঝা যায় না । কি যে চলে ওদের মনের ভেতর .......

     কথা পুরোটা শেষ করার আর ইচ্ছে হল না কমলার । শুয়ে পড়লেন । ছেলে--ছেলের বউকে কাছে পাবার আশায় এই বয়সে এসে কি না করছেন । কিন্তু আখেরে লাভ কিছু হবে কি না কে জানে ....

        পাশের ঘরে কুশল আর নন্দিনীও কথা বলছিল । তবে শালুককে নিয়ে নয় । শালুকের ওই  বন্ধু প্রীতির সংগে তারা পরিচিত । গা সওয়া হয়ে গেছে এসব তাদের । তারা কথা বলছিল নিজেদের নিয়ে । ফেসবুকে আপলোড করা এ ক'দিনের তোলা ছবিগুলো  দেখতে দেখতে কুশল বলে উঠেছিল----- এবারের পুজোটা বেশ ভালো  কাটল তাই না নন্দিনী  ? ভিড় ভাট্টা নেই , কিছু নেই ,এক্কেবারে  নিজেদের মতো করে কাটালাম পুজোটা । তাছাড়া মা-বাবাও কত খুশি হল ।

----হুম, নবমী দিন যা নাচ নাচলে । মনে যে খুব আনন্দ ছিল তা তো বোঝাই গেছে । কোন পুরনো প্রেমিকার দেখা হল কিনা সেটাই বুঝতে পারছি না । নাহলে......

----শোন, ওটাকে ধূনুচি নাচ বলে । আর আনন্দ হবে না কেন, ছোটবেলায় প্রতিবার এই আরতি  প্রতিযোগিতায়  আমি ফার্স্ট হতাম বুঝলে ।

---আচ্ছা, হঠাৎ করে এই বুড়ো বয়সে তুমি,  কি বলে ওই 'ধূনুচি নাচ' করতে চলে গেলে যে ? 

----এই শোনো নন্দিনী, বুড়ো বয়স মোটেই বলবে না । আমাদের এজের সবাই তো আরতি করলো। দেখলে না  ? আর আমাকে বলছো যে, ঠাকুর ভাসানে নিয়ে যাবার সময় সবার সাথে তুমিও তো  নেচেছিল  । তবে নাচলে কিন্তু এখনও তোমাকে দারুন লাগে ।

----হবে, আর প্রেম দেখাতে হবে না । এখানে আসার পর থেকে তো আমায় চিনতেই পারছো না ।

-------মোটেই তা নয় । তোমায় বরাবরই ভালোবাসি আমি । তবে অনেক বছর বাদে সবার সাথে দেখা হওয়াতে ....

 -------আচ্ছা এসব ছাড়ো, শোনো না, বাবার কথা বলছি না, বাবাতো বরাবরই অন্যরকম, নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করেন । কিন্তু মাও এবার  কেমন যেন পালটে গেছেন, জানো । সবসময় যেন কি ভাবছেন । তাছাড়া রান্নাঘরে আমি কাজে উল্টোপাল্টা করলেও কিছু বলছেন না । বরং হাসি মুখে শিখিয়ে দিচ্ছেন । সারপ্রাইজড একেবারে আমি । তাছাড়া শালুকের সংগে তো পাল্লা দিয়ে পুজো মন্ডপে বসে থেকেছেন এই ক'দিন । খুব এনজয় করেছেন পুজোটা এবার দুজনে । 

----ঠিক বলেছো ।  সেদিন শাড়ি পড়াতে শালুককে খুব  মিষ্টি দেখতে লাগছিল তাই না ?  

     এবার আর  কোন উত্তর পেল না কুশল । পাশ ফিরে তাকালো নন্দিনীর দিকে । কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছে । ঠোঁটের কোনে লেগে আছে একটুকরো হাসি । হয়তো কোন স্বপ্ন দেখছে । জাগাতে গিয়েও  জাগালো না কুশল । পাশ ফিরে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল ।

   সকালে ঘুম ভাঙালো অ্যালার্মের শব্দে । চোখ খুলতেই চট করে মনে পড়ে গেল, ছুটি শেষ এবার ফেবার পালা । মনটা খারাপ হয়ে গেল । কি সুন্দর কাটছিল দিনগুলো। মা বাবার জন্যই আরও বেশি খারাপ লাগছে । কাল থেকে তো আবার সেই একা । ফোন টিভি আর বইকে সংগী করে দিন কাটানো ।

          নিজের কষ্টটাকে আজ আবার কম করার  চেষ্টা  করছেন সোমেশ্বর । চেষ্টা করছেন ভালো থাকার । কুশলের ছুটি শেষ । আজই চলে যাচ্ছে ওরা । ব্যাপারটা তাহলে....কথাটা ভাবতে না ভাবতেই কুশল  ওরা এসে প্রনাম করল । কিছু বললেন না আশীর্বাদের ভঙ্গীতে হাতটা ওদের মাথায় রাখলেন শুধু । চোখের সামনে মেরুন রঙের  ট্রলি ব্যাগ দুটো নিয়ে এগিয়ে গেল  শালুক আর কুশল । একটু পিছে নন্দিনী । আজ শাড়ি নয় , লেগিংস -কুর্তিতে নিজের সাজে নন্দিনী । তবুও কি যে অপরূপা লাগছে ওকে । মুখটা যেন ঠিক দুর্গা প্রতিমার মতো  । এই প্রতিমাই তো উৎসবের রূপ নিয়ে ক'দিন আগে স্বামী -কন্যা সহ  সোমেশ্বরের ঘরে এসেছিল । এখন ঘর ফাঁকা করে চলে যাচ্ছে । মনে মনে চেঁচিয়ে উঠলেন সোমেশ্বর----যেও না নন্দিনী। তোমরা গেলে এবাড়ির উৎসবের রং যে মুছে যাবে । 

       নন্দিনীর চোখটাও কেমন ভিজে উঠল । অবাক হল একটু । আরও তো কতবার এসেছে । এমনটা তো হয়নি । পিছন ফিরে দেখল একবার, মনে হল, সোমেশ্বর আর কমলা যেন একসংগে বলে উঠলেন --নন্দিনী মানে কিন্তু কন্যা,  মনে থাকবে তো ? আবার এসো কিন্তু......। অজান্তেই মাথা নাড়ল নন্দিনী ।

       গাড়িতে ওঠার আগে   তিনতলার  একটা নির্দিষ্ট ব্যালকনির দিকে চোখ চলে গেল শালুকেরও । সিদ্ধার্থ দাঁড়িয়ে আছে । হাত নাড়ছে । হাত নেড়ে বিদায় জানালো শালুকও । কিছু একটা বলছে সিদ্ধার্থ । গতকালের কথাটাই কি ? এত দুর থেকে  শুনতে পেল না শালুক ......।

          -------------------------------