# দুগ্গাপুজোর গল্প# কলমে মনীষা পলমল8/10/21
সে অনেককাল আগের কথা রাঙা নদীর কূলে এক প্রত্যন্ত গ্রাম কুসুমডিঙা। কয়েক ঘর হিন্দু মুসলমানের বসবাস সেখানে।" সবাই সেটা সহজ সুখী বাধা বাঁধনহারা আবাদ করে বিবাদ করে সুবাদ করে তারা।"…
# দুগ্গাপুজোর গল্প
# কলমে মনীষা পলমল
8/10/21
সে অনেককাল আগের কথা রাঙা নদীর কূলে এক প্রত্যন্ত গ্রাম কুসুমডিঙা। কয়েক ঘর হিন্দু মুসলমানের বসবাস সেখানে।" সবাই সেটা সহজ সুখী বাধা বাঁধনহারা
আবাদ করে বিবাদ করে সুবাদ করে তারা।"
এমনই এক সুখি গ্রামের দুর্গা পূজার গল্প শোনাই। আব্দুল সাকিনা ফরিদার সাথে রতন চাঁপা কানাই একসাথে বড় হচ্ছে। খুশির ঈদ এর ফিরনি সিমাই এর সাথে বিজয়ের পরমান্ন ও নাড়ু একসাথেই ভাগাভাগি করে খায়। অশ্বিনের পেঁজা তুলোমেঘ যখন নীল আকাশে ভেসে বেড়ায়, রাঙা নদী র চর কাশের দোলায় মেতে ওঠে তখন ওরা ঠানদির কাছে দুর্গা ঠাকুরের গল্প শোনে। কিভাবে দুগ্গা ঠাকুর মহিষাসুরকে বধ করে দেবতাদের স্বর্গরাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তার গল্প।
এমনই এক শরৎ সন্ধ্যায় আব্দুল সাকিনারা এসে জুটেছে ঠানদির ঘরে। তাদের আবদার --তুমি আমাদের দুর্গা ঠাকুরের গল্প বলো! ঠানদি বলে--- দাঁড়া, এবার তোদের দুগ্গা ঠাকুর দেখার ব্যবস্থা করছি! তখন তো এখনকার মত বারোয়ারি পুজোর চল ছিলনা। কোন কোন সম্পন্ন জমিদার বাড়িতে দুর্গাপূজা হতো। কুসুম ডিঙ্গা থেকে দুটি গ্রাম পরে এক জোতদারের বাড়িতে দুর্গাপূজা হয়। ঠানদি লোকজন জোগাড় করে গরুর গাড়িতে করে বাচ্চাগুলোকে পুজো দেখতে পাঠান। কচিকাঁচা গুলোর আনন্দ আর ধরে না। সবাই ঠাকুর দেখে ফিরেছে--- ভীষণ উত্তেজিত সবাই! ঠানদির বারান্দায় বসে সবাই ঠাকুর দেখার উত্তেজিত আলোচনা করছে----
ঠানদি এসে কেমন ঠাকুর দেখলো এটা জানতে চাই তেই---- উত্তেজিত আব্দুলরা শুরু করল দুগ্গা ঠাকুর দেখার বর্ণনা--------
আব্দুল---" বলদে চড়িয়া শিবে শিঙ্গায় দিলা হাঁক
শিঙ্গা শুনি মর্ত্যেতে বাজিয়া উঠিল ঢাক ।
শিবের সনে কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী
আশ্বিন মাসে বাপের বাড়ি আসেন ভগবতী।"
সাকিনা---" গৌরী এলো দেখে যা লো
ভবের ভবানী আমার ভবন করিল আলো।"
কানাই আব্দুল একসঙ্গে হাত পা ছুঁড়ে বলতে লাগলো----" ও দেখি সিংহের উপর উইঠা ছুঁডি
অসুরের টিক্কি ধরি , গলায় দিছে সাপ জরাইয়া
বুকে মারছে খুচা
কি দুগ্গি দেখলাম চাচা কি ঠাকুর দেখলাম চাচী।"
এবার চাঁপা ও সাকিনা চোখ গোল গোল করে দু হাত নেডে বলতে লাগলো---" ওই যে এক তুম্বা বদন, দাঁত দুইটা তার মুলার মতন, কান দুইটা তার কুলার মতন -- মাথা লেপাপোঁছা
কি ঠাকুর দেখলাম চাচা, কি দুগ্গি দেখলাম চাচী।"
রতন ও কানাই এবার শুরু করলো ---
" আসে ডাইনে বামে দুইটা ছেমরি
পইরা আসে ঢাকাই শাড়ি
ঘুরতে দেখছি বাড়ি বাড়ি
ঠমক দেহায় ভারী ।"
চাঁপা সাকিনা সাথে সাথে বলতে লাগলো--
" ময়ুরের উপর বৈঠেন যিনি
উনার বড় ছিকছিকানি
ধুতি পরসেন কোঁচা
কি দুগ্গি দেখলাম চাচা, কি ঠাকুর দেখলাম নানী!"
ওদের দুগ্গা ঠাকুর দেখার বর্ণনা সারা আকাশ বাতাস ছড়িয়ে পড়তে লাগলো--- গৌরী এলো দেখে যা লো----
ঠানদি বললেন-- শোন রে---
সপ্তমী তে মা জননী মন্ডপে মন্ডপে
অষ্টমীতে মা জননী ফুলে ফলে ধুপে!
নবমীতে মা জননী নিশি পোহাইলা
দশমীতে পাগলা ভোলা নাচিতে লাগিলা।
শিবে দুর্গা রে লইয়া যাবে কৈলাস ভুবন
বিসর্জনের বাজনা বাজে বিজয়া গমন ।
নীলকন্ঠ পাখির ডানায় ভর করে আসে বিষাদ বিধুর বিজয়াদশমী। মা আবার ফিরে যান কৈলাসে। মর্তবাসী প্রতীক্ষা করে পরের বছরের।
🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷
# আপন -যাপন
# কলমে- মনীষা পলমল(সুকান্ত নগর , তালবাগিচা , পশ্চিমমেদিনীপুর)
3/11/20
কাঁসাই থেকে সুবর্ণরেখা--- এ এক আনন্দ যাপন। কাঁসাই কুলের মেয়ে আমি । আমার শৈশব কৈশোরের সাথী এই কাঁসাই নদী। কাঁসাই চরের ধুধু বালিতে শিউলি দের অস্থায়ী ছাউনি---শীতে। গুড কারিগরএরা। খেজুর গুড় পাটালি তৈরি করে। নদীর দুকুল ছাপিয়ে বিস্তীর্ণ শস্য ক্ষেত। সর্ষের হলুদে সোহাগী মৌমাছির গুঞ্জন। মটরশুঁটির সিমের লতার বেগুনি ফুলে কিশোরীর প্রথম প্রেমের পেলবতা। নদীর ঘাটের একলা বটগাছের একাকীত্ব বড্ড মনপোডায়। নদীর কত রূপ কত ঐশ্বর্য। এই নদীর প্রবাহ পথের পরান কথার অনুসরণে আমার যাপন। নদী কুলের আদিবাসী গ্রাম, মনসাথান, শতাব্দী প্রাচীন শিব মন্দির আমায় গল্প শোনায় অতীতের! বিশাল কাকচক্ষু দিঘির উত্তর পাড়ে মা বিষহরির আটন। মনসার ভাসানে এই মেলা খেলায় লোক উথলে পডে। বাউরি দেহুরী চিডেগুড়ের নৈবেদ্য উৎসর্গ করে দেবীকে। বিষম ঢাকির ধুমূলে জেগে ওঠে গ্রাম, নদীর চর দিগন্তবিস্তৃত শস্যখেত! মনসার ভাসান এর মেলায় বেদেদের সাপের খেলা দেখলে বুক হিম হয়ে আসে! বিষধর মা মনসার বাহন দের অক্লেশে গলায় জড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা। তুমডি বাঁশির সুরে, বেদেনীর সুরেলা গানেমেলা সরগরম হয়ে ওঠে! বিষহরির আটনের পাশের বিরাট দিঘিতে মন্থন ষষ্ঠী জিতাষ্টমী তে গোঁসাই পাড়ার লোকজন ভিড় করে। শাঁখ কাঁসি ঘন্টার সুমধুর ধ্বনি ভেসে বেড়ায় বাউল বাতাসে। দূরে নদীর চরে বেনা ঘাসের জঙ্গল কেঁপে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে । গাঙশালিখের ঝাঁক মজলিস বসায় সেখানে। নদী যেখানে বামুনডিহা র পাশে বাঁক নিয়েছে পুবে সেখানেই এসে মিলেছে দুটি খাল--- কাদাখাল ও বালিখাল। এই মিলনস্থল এর পাশেই সাতবউনির থান । পৌষ সংক্রান্তিতে বসে সাতবউনির মেলা । পুবে বামুনডিহা গ্রামের প্রথমেই মা শীতলার আটন। এই মায়ের ই সাত বোন "সাতবউনি"! বড় জাগ্রত দেবী এঁরা । বড় আপন এই গ্রামবাসীদের। এই লোক দেবদেবীদের আটন গাছগাছালি ঘেরা আচ্ছাদন বিহীন ,পথ প্রান্তরে ডুঙ্গরিটিলায় অবস্থিত। পোড়ামাটির হাতি ঘোড়া মনসার চালির ছলনে সাজানো প্রাকৃতিক অর্চনা বেদী। অ ব্রাহ্মণ দেহুরীর লৌকিক মতের ভক্তি মন্ত্রে আরাধনা । অনাড়ম্বর আন্তরিক পূজার্চনা। বড় মন ছোঁয়া। এইখানে লালগড়ে এক বিশেষ দুর্গা পুজো হয়। মা দুর্গার একার মূর্তি পুত্র-কন্যা বিহীন। কথিত যে এখানকার রাজা নিঃসন্তান ছিলেন। তার অভিমান মা কেন সসন্তান পুজো পাবেন যেখানে পূজক সন্তানহীন? তাই এই একক মাতৃ আরাধনা!
কাঁসাই কুলে কতনা দেবদেউল কতনা পরান কথায় মোডা সরজমিন । আমার শৈশব কৈশোরের সখী এই স্রোতস্বিনী। আমায় পরান কথা শোনায় সই। মনে পড়ে এই নদীর ঘাটে মকর স্নান করে "ফুল পাতানো"! মকর সই ফুল মনি আমার ঝিঙা ফুল! এক মকর সংক্রান্তিতে আমার ঠাম্মি আর ওর দাদী আমাদের মকর সই ঝিঙাফুল পাতিয়ে দিল । একসঙ্গে পুর পিঠা আশকা পিঠা গুড় পিঠা খেয়ে দুজনে মকর ডুব দিলাম। সেইশুরু। প্রতিবছর চেষ্টা করতাম মকর সংক্রান্তিতে বাড়ি যাবার। দেখতে দেখতে দন্ড পলের হিসেবে কেটে গেছে অনেকটা সময়। কাসাই কুলে থাকা মন বাউলের ঠাঁই পরিবর্তন হলো--- বিবাহসূত্রে সুবর্ণরেখা কেলেঘাই তীরে! এ এক আনন্দ সফর । স্রোতস্বিনীর প্রবাহ ধারা থেকে অপরের প্রবাহে মিলন। সুবর্ণরেখার বিশাল বিস্তৃত নদীর চর মনকে সম্পূর্ণ গ্রাস করল। সুবর্ণরেখার ভালোবাসায় মন বাউলের উত্তরণ ঘটলো। জঙ্গলমহলের লালমাটি শালমহুয়ার আবেশ আরো আরো নেশা ধরালো। আড়বাঁশি সারিন্দার মোহময়ী সুরে ভেসে গেল মন বাউল । পথিক মনের পরিযায়ী ডানায় লাগলো কাঁপন। ইচ্ছে ডানা মেলে সে শুরু করল তার পরিক্রমা--- সুবর্ণরেখার ঘাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে --- কখনো কুঠিঘাট , ফেকোঘাট ভসরাঘাট, রামেশ্বর ছুঁয়ে চলল উড়িষ্যার তালসারি--- সমুদ্র সঙ্গমে! পথে তার কত না সখা সখি এসে মিলেছে--- ডুলুং কেলেঘাই রাঙ্গা--- কতনা নাম ,কত তার ঐশ্বর্য! এই সুবর্ণরেখার গাংচিল হওয়া মন টানে উড়ান--- দুয়ারসিনির আটন ছুঁয়ে, রামেশ্বর দেব দেউলের ধ্বজায় কাঁপনলাগিয়ে তপোবন বাল্মিকী আশ্রমের গভীর অরণ্যের মহীরুহের ডালে । নজর মিনারের উচ্চতা ছোঁয়া পরিযায়ী ডানা বিশ্রাম খোঁজে জল-জঙ্গলের গভীরে। এই রাঙামাটির পথের বাঁকে ছড়িয়ে রয়েছে আমার আনন্দ যাপন--- দুহাতের অঞ্জলিতে তাকে কুড়িয়ে নিয়েছি। বেঁধে রেখেছি কালি কলমের বন্ধনে। আমার কাঁসাই কুল থেকে সুবর্ণরেখার কুলে আসার আনন্দ সফরের যাপন চিত্রলিপি ।
🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹
# ভ্রমণের বৃত্তান্ত
# মা সনকা -----এক অমোঘ বিশ্বাস
#কলমে- মনীষা পলমল( সুকান্তনগর ,তালবাগিচা, পশ্চিম মেদিনীপুর)
3/2/21
জঙ্গলমহলের শাল মহুয়ার জঙ্গল আর তমাল- পারাং- কুবাই ধোওয়া রাঙ্গা মাটির দেশ লোকদেব দেবীর পরান কথায় মোডা। এখানকার প্রান্তিক মানুষজনের বড় আদরের দেবী মা সনকা। গোয়ালতোড়ে তাঁর মন্দির ।লোকশ্রুতি মায়ের কাছে মানসিক করলে তা পূরণ হবেই। ম সনকার সাথে জঙ্গলমহলের মানুষের নাড়ির যোগ। যেকোনো কাজেই মায়ের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে এখানকার মানুষেরা---তা রোগ ব্যাধি থেকে মুক্তি সন্তান কামনা, চাকরি কিংবা পরীক্ষা যাই হোক না কেন! স্থানীয়রা যেকোন কাজে মায়ের অনুমতি কামনা করে। শনি মঙ্গলবারে মায়ের কাছে ভক্তদের ভিড় জমে। মায়ের কাছে মানসিক করার জন্য এক বিশেষ রীতি রয়েছে।
নিখুঁত শালপাতা তে দেহুরী গোলা সিঁদুর দিয়ে এক বিশেষ চিহ্ন এঁকে দেন। এবার ভক্ত গোলা সিঁদুরের কালিতে ওই পাতাতে নিজের কামনা সংক্ষেপে লেখে। দেহুরীওই পাতা মায়ের পায়ের স্পর্শ করিয়ে মাকে অনুরোধ করেন কামনা পুরনের। দেহুরীভক্তকে কামনা পূর্তির পর মায়ের পুজো দিয়ে মানসিক শোধ করার অঙ্গীকার করিয়ে নেন। এবার ওই কামনা পত্র মায়ের পায়ের ছুঁইয়ে দেওয়া হয়। একটি লালসালুর টুকরোয় মাটির ঘোড়ার ছলন সিঁদুর চর্চিত করে বেঁধে তেঁতুল গাছের পাশে যে ছলন বাঁধার জায়গা তাতে বেঁধে দিতে হয়। কামনা পূর্তির পর ছলন খুলে ফেলতে হয়।
মন্দির এর পেছনে বিরাট জলাশয় ।জলাশয়ে স্নান করে মানসিক করা হয় আবার কামনা পুরনের পর এখানে স্নান করতে হয়। পুকুর সম্পর্কে লোকশ্রুতি যে এর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে" অক্ষয় ঝোর" আছে তাই পুকুর কখনো শুকোয় না।
শাল মহুয়ার জঙ্গলে ঘেরা লালমাটির দেশের বড় আন্তরিকতা মোডা এই লোক দেবীর আটন। হাতি ঘোড়া ছলনের স্তুপে, মেটে সিঁন্দুরের লালিমায় ধূপধুনোর সুবাসে মানুষের আন্তরিক কামনায় সারা মন্দির চত্বর জমজমাট। জঙ্গলমহলের প্রান্তিক মানুষজনের দৈনন্দিনতার সাথে মা সনকার আত্মিক যোগ তাই ভক্তজন আপন জনের মতই মাকে দেখে। অন্তরের ভক্তি কুসুমে নিজের আরাধনা সম্পূর্ণ করে লৌকিক রীতিতে। এইখানে লালমাটির মানুষদের সাথে মা সনকার যোগ। এই লোকদেবী মানুষের দিনযাপনের মাঝে মিশে গেছেন। জঙ্গলমহলের লালমাটিয়া অঞ্চলের বিশাল জনজীবনের সাথে মিশেআছে লোক দেবদেবীদের কাহিনী। এই জঙ্গলঘেরা অহল্যা ভূমির প্রান্তরে সরল প্রান্তিক মানুষদের বিশ্বাসেই পাথর জাগ্রত হয় প্রচলিত কাহিনী আর সিঁদুরের মহিমায়। আর এই লৌকিক দেবতাদের চরণে নিবেদিত হয় তাদের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের নৈবেদ্য।
🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺
# কাজ ভোলানো দিনের পাঁচালী
# কলমে- মনীষা পলমল( সুকান্তনগর তালবাগিচা পশ্চিম মেদিনীপুর)
17/5/21
এক বছরের গৃহবন্দীদশা শেষে তেসরা জানুয়ারি বেরিয়ে পড়লাম সবার রঙে রঙ মেশাতে! গন্তব্য কোন নির্দিষ্ট নেই! আমার প্রিয় জঙ্গলমহলের রাঙ্গা পথের বাঁকে হারিয়ে যেতে মন উদ্বেল! একে জানুয়ারি তাতে রবিবার ঘরবন্দি বাঙালিরা যেন পাগল হয়ে গেছে। ভোরবেলা বেরিয়েছি। সুবর্ণরেখার ঘাট ছুঁয়ে উধাও ধু ধু চরে হারিয়ে যাবার ইচ্ছায় এসে পৌছালাম জঙ্গল কন্যা সেতু পেরিয়ে ডাহিতে। সেতুর পাশের ছত্রিশ একর জোড়া বিনোদন পার্কে মানুষের মহাসমুদ্র--- পিকনিক পার্টির ভীড। পুরো জায়গাটা বাস গাড়ী বাইকের মেলা। আমি দু'চোখ ভরে দেখছি গণদেবতার উচ্ছ্বাসকে। আসতে আসতে ভিড় এড়িয়ে সাঁতাই বুড়ি র থান কে ডাইনে রেখে নদীর ধার ঘেষেএগিয়ে গেলাম। এখানে যেন মেলা বসেছে---- মাটিতে কাপড় বিছিয়ে সবজি আলু পিয়াজ থেকে মনিহারি জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছে প্রান্তিক মানুষ জন! ঘর সাজানোর ফুল তালপাতার পাখার পসরা সাজিয়ে বসেছে এক তরুণ দম্পতি! নবীন ও ইতু । সঙ্গে বৃদ্ধ বাবা-মাও আছে। রাস্তার পাশে পসরা সাজিয়ে বিকিকিনির সাথে সাথে পিকনিকের আনন্দ ও নিচ্ছে। একটু দূরে পেছনে গাছের ছায়ায় রান্নাবান্নার ব্যবস্থা। পিকনিকের মত। বেশ লাগছে দেখতে। ধীরে ধীরে গিয়ে ভাব জমালাম। স্থানীয় ডাহি গ্রামের বাসিন্দা ওরা। পিকনিকের দিনগুলোতে এইভাবে ব্যবসাও করে আর পিকনিকের আনন্দ ও নেয়। আমি একা জেনে আমাকে ওদের সাথে খাবার নিমন্ত্রণ জানালো। মজা করে বললাম--- সুবর্ণরেখার মাছ খাওয়াতে পারবে? হেসে বললো-- পারব!
জঙ্গলকন্যা সেতুর নিচে চরে রঙের মেলা। দূরে নদীর বুকে চর বেনা কাশের জঙ্গল। তেলে মুনিয়া গাঙশালিকের ঝাঁক সেখানে মজলিস জমায়। চরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে গভীর জলধারা ।ডিঙি বেয়ে বালি বইছে দন্ড ছত্রী মাঝি। মাঝে মাঝে মাছ ধরা ডিঙি। খালুই কোমরে একা দন্ডছত্রী নৌকা বেয়ে চলেছে দূর থেকে দূরে। ঐ ডিঙি গুলোকে লক্ষ্য করে হেঁটে গেলাম। চরের বুক থেকে সেতুও পার্ক দুটিকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। পিকনিকের লোকজন নৌকা চড়ে নদীতে ঘুরবে নদী ঘাটে এসে ভিড় জমিয়েছে। আমি নদীর ঘাট ছেড়ে আঘাটায় যাত্রা করলাম। সেতুর পিলারের ছায়ায় বসে বসে দেখছি কিভাবে উজ্জ্বল সোনালী সকাল ধীরে ধীরে জ্বলন্ত দুপুরে ঢলে পডলো।
মাথার উপর জলন্ত সূর্য দূরে নদীর চরে যেন রংবে রঙ্গের মেলা ।নদীর জমা জলে নাল ফুল দোলে। ছোট্ট ছোট্ট মাছ তির তিরে জলে খেলা করে। আঘাটা তে একটা বক একপা একপা করে মাছের আশায় ঘুরছে। দূরে সাঁতাইবুড়ির আটনের মহীরুহের মাথায় বসা চিল তীক্ষ্ণ স্বরে দুপুরের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। দেখছি পিকনিক পার্টিরা আস্তে আস্তে ফিরতে শুরু করেছে। নদী ঘাটে স্নানার্থীর ভিড় । স্নান সেরে গল্পগাছা সেরে ভিজে কাপড়ের বোঝাও ভিজে গামছা মাথায় ফিরে চলেছে নিজের ঘরের পানে।
নবীনের ডাক ভেসে এলো ---মাসি মাছ ধরা দেখতে আসুন! ছুটলাম চরের ডিঙির কাছে। নদী থেকে জাল তুলছে দন্ডছত্রী--জালে- চকচক করছে রূপালি মীনফসল--- চ্যালা ট্যাংরা পুঁটি চিংড়ি বেলে মৌরলা। কি সুন্দর খালুই ভরা মাছ! নবীন মাছ নিয়ে ইতুকে দিল! ইতু নদী ঘাটে মাছ বেছে পরিষ্কার করে নিয়ে চলল রান্না করতে। সুবর্ণরেখার মাছ খাওয়াবে বলেছিল নবীন কথা রাখতে পেরে আনন্দে উচ্ছল ছেলেটা--- কি সরল আন্তরিক এদের ব্যবহার! গাছ তলায় শালপাতার থালায় ভাত ডাল আলু ভাজা মাছের চচ্চড়ি দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারলাম। বসে বসে ওদের সংসারযাত্রা দেখছি।
সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিম দিগন্ত সীমায় পৌঁছালো। নদী চর জনশূন্য---- এক এক করে সবাই চলে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যে! জন কোলাহলমুখর পার্কও নদীচর নিস্তব্ধতার চাদরে মুখ ঢাকতে চলেছে। মেলার বেসাতি সেরে ব্যাপারীরা ফিরে গেছে। সারা নদীচর কেমন যেন বিষাদ ব্যথাতুর মনে হচ্ছে। গোধুলির রাঙ্গা কনে দেখা আলোতে অপার্থিব সুন্দর লাগছে জঙ্গল কন্যা সেতু, সুবর্ণরেখার চর, সাঁতাইবুডীর থান।
ধীরে ধীরে নেমে আসছে সন্ধ্যার মায়াবী আঁচল---
"নামে সন্ধ্যা তন্দ্রালসা সোনারআঁচল খসা
হাতে দীপশিখা।"
আকাশে একটি দুটি তারা ফুটে উঠছে যেন তামসী তপস্বিনী জপমালার মোতির মত। নদীকূলে পাকুড বটের ডালে এসে বসে নিশিটহলে বেরোনো পেঁচা দম্পতি।
নদীর বুকে ছোঁয়া ঠান্ডা বাতাসে ভেসে আসছে গ্রামের সন্ধ্যাপূজার শঙ্খ ধ্বনি।
আমিও ফিরে চললাম আপন গন্তব্যে।