# হৈমন্তী রূপকথা# কলমে -মনীষা পলমল26/10/21 আশ্বিনের রুপা ঝুরি জোৎস্না যখন কাঁসাই ,শিলাই, কেলেঘাই সুবর্ণরেখা চরায় মন খারাপি বিষাদ ছড়ায় তখন এই মহুয়া পলাশের দেশে কিন্তু উল্টো ছবি। নেই পূজাবসানের হা-হুতাশ, আছে উৎসব আবাহন…
# হৈমন্তী রূপকথা
# কলমে -মনীষা পলমল
26/10/21
আশ্বিনের রুপা ঝুরি জোৎস্না যখন কাঁসাই ,শিলাই, কেলেঘাই সুবর্ণরেখা চরায় মন খারাপি বিষাদ ছড়ায় তখন এই মহুয়া পলাশের দেশে কিন্তু উল্টো ছবি। নেই পূজাবসানের হা-হুতাশ, আছে উৎসব আবাহনের উচ্ছ্বাস। জীবনানন্দের ভরপুর প্রান্তিক মানুষজনের উৎসবের মরসুমের প্রারম্ভ এই হেমন্ত ঋতুতে। এই ঋতু উৎসবের, ভালোবাসার ,সমৃদ্ধির ঋতু! তাইতো হেমন্তিকা র হিমেল বাতাসে ভালোবাসার উষ্ণতা খুঁজে পায় এরা। আমার কাঁসাই কুল থেকে কেলেঘাই সুবর্ণরেখা র চরের যাপন চিত্রেএই অভিজ্ঞতারই চিত্রলিপি ।
কৃষিজীবী প্রান্তিক মানুষজন আশ্বিন সংক্রান্তি বা নল সংক্রান্তি বা ডাক সংক্রান্তি তে পালন করে কৃষিক্ষেত্রের সাধ ভক্ষণ অনুষ্ঠান। বড় মন ছোঁয়া এ রীতি। কৃষি ক্ষেত্রকে এক নারী রূপে কল্পনা করার মরমী যাপন চিত্র। ফুলন্ত নল গাছের পাতায় বেশ কয়েক রকম মশলা গুঁড়ো করে বেঁধে দেওয়া হয়। আগে ঢেঁকিতে করে এই মসলা কুটতে হতো । অঞ্চল ভেদে মসলা র তারতম্য হলেও রাই সরষে পুরনোখুদ পুরনো খাড়া নোটে খাডা ,কাঁচা তেঁতুল ,কাঁচা হলুদ, ওল, কেঁউ,আরন্দি ইত্যাদি নিশ্চয়ই থাকে। এই মশলা গুঁড়ো নল গাছের পাতাতে পোটলা করে মন্ত্রোচ্চারণের সাথে বাঁধতে হয়--- বিভিন্ন মন্ত্রের মধ্যে একটি সংগৃহীত মন্ত্র---
রাই সরিষা পাকুড খাডি
কেটেপাট কাঁকুর লারি।
এক আছে শুক্তা ধান হবে গজমুক্তা
এক আছে আরন্দি ধান হবে গুয়ারঙ্গী।
এর আছে কেঁউ ধান হবে সাত বেঁউ।
এর আছেপুন্না খড মাজা করে কড কড।
এর আছে পুন্না খুদ সব শনির মুখে মুত।
আশ্বিন গেল কার্তিক এলো সব ধানের গর্ভ হল
ছোট-বড় ধান এক থোড ফুলে ফুলে
ফুলে -------ফুলে
ফুলে ----------------ফুলে! শেষের চার লাইন ধ্রুবপদ! প্রতিটি নলগাছ জমিতে ফেলার সময় সবাই সমস্বরে এই মন্ত্রোচ্চারণ করে। দূর থেকে দূরে কার্তিকের হিমেল বাতাসে ভেসে চলে এই ফুলে ফুলে ধ্বনি। মাঠ ফসলে উথলে উঠবে এই কামনা করে এই প্রথার চল। বড় মন ছোঁয়া । বড় মরমি ।
হৈমন্তী ফসলের হাতছানিতে আঘুনের যামিনী যখন শিশির ধোয়া স্বচ্ছতা এঁকে দিচ্ছে নবদুর্বা দলে তখন এই জঙ্গলমহল শিখরভূমের ভূমিপুত্রদের ঘরেও স্বচ্ছতার অভিযান। খামার বাঁধার প্রচেষ্টায় ব্রতী সকলে। পোষা মাটির , ছঁচ মাটির প্রলেপে মসৃণ ও চকচকে হয়ে ওঠে খামার প্রাঙ্গণ! মা লক্ষ্মী যে এসে উঠবেন এই অঙ্গনে!
এবার শুরু হয় ফসল কাটার মহোৎসব! সাজো সাজো রবে কাটুনিরা নেমে পডে খেতে। চাষির নির্দেশে সব ক্ষেতের ধান কাটা হয়ে গেলে একগোছা ধান গাছ আ-কাটা রেখে দেয়! তার উপর এক বিঁডা কাটা ধান চাপা দিয়ে লুকিয়ে রাখা হয় আকাটা ধানগাছ তথা ঠাকুরকে।
চাষির সব ক্ষেতের ফসল কাটা হবার পর আসে সেই মহেন্দ্রক্ষণ---" ক্ষেত উঠাই"বা" ঠাকুর আনার"!
মাঠে-ঘাটে ধান প্রায় সবই কাটা হয়ে গেছে, খালি সেই যে ক্ষেতের কোনে আকাটা ধান গাছগুলো বিঁডাচাপা আছে--- না-- না ধানগাছ না---" ঠাকুর"--- মা লক্ষ্মীর প্রতিরূপ একেই তো বরণ করে আনতে হবে চাষির খামারে! মুহুর্তের মধ্যে সাজ সাজ রব হইচই পড়ে যায়! পূজার থালায় সাজানো হয় ধূপধুনা সিঁদুর মেথি কষা ফল কাঁচা শালপাতার দোনা। দোনায় গাঁদাফুল ফুলমালা চালের গুঁড়ি বাতাসা ও কাস্তে রাখা হয়। এবার চলল শোভাযাত্রা "ঠাকুর "আনার! কচিকাঁচারা শাঁখ কাঁসর নিয়ে বাজাতে-বাজাতে মাঠের দিকে রওনা হয়। যিনি "ঠাকুর" নিয়ে আসবেন তাকে ধুতি পরতে হবে! এবার ক্ষেতের সেই আকাটা ধানগাছ গুলিকে বেণীর মত পাকিয়ে তুলতে হবে । ধান বেণীর প্রতি পাকে গাঁদা ফুলের সাজ। এবার ওই ফুল সাজে সজ্জিত ধানগাছ কে ধুপ ধুনা জ্বেলে ও পিটুলি জল ও মেথিছিটিয়ে দিয়ে পুজো করা হবে। বাতাসার ভোগ দেওয়া হবে। এবার কাস্তের ডগা দিয়ে মাটি শুদ্ধ ধান গাছগুলোকে উপডে নিয়ে শালপাতার দোনা য় রাখা হবে। এবার ধানের বিঁডা সহ দোনা মাথায় করে নিয়ে আসা হবে খামারে। আগে শাঁখ কাঁসর বাজিয়ে জলের ধারা দিয়ে খেতে ঠাকুরকে ঘরে বরণ করা হবে।
ঠাকুর মাথায় তোলার পর পেছনে তাকাতে নেই কথাও বলতে নেই। ঠাকুর খামারে পৌঁছালে বিঁডা গাদার সামনে আলপনা আঁকা পিঁডিতে মাথার ঠাকুরকে নামিয়ে রাখা হয়। এবার কৃষি লক্ষ্মীব্রত কথা শুনে খাপরা পিঠা খাওয়ার ধুম। দুধে আতপ চাল গুড়ি, গুড় গুলে ঘিয়ে ভেজে তৈরি হয় পিঠা।
এর তিন পাঁচ বা সাত দিন পর থেকে শুরু হয় ধান ঝাড়া। খড পাকানো" বরহই দড়ি" বা" বড" দিয়ে বাঁধা হয় "পুডা"! এতে ধান রাখা হবে! বাঁশের চাঁচরাবাঁধা "ডোল" এ ও রাখা হয় ধান। অবস্থাপন্ন কৃষিজীবীর ঘরে মরাই এ মা লক্ষ্মীর অবস্থান ।
হেমন্তের উৎসবের আমেজ শীতের আমেজের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। শিখরভূমের প্রান্তিক মানুষ জন অপেক্ষা করে পৌষ সংক্রান্তি বা মকর পরবের। ঐ লক্ষ্মীর প্রতিরূপ "ঠাকুরকে" খামারে সযত্নে বিঁডাচাপা দিয়ে রাখা হয় মকর সংক্রান্তির খামার পূজার জন্য। ওই ধানগাছ কে কৃষি লক্ষ্মী রূপে পূজা করা হয় পৌষ সংক্রান্তিতে। জঙ্গলমহলের সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎসব এই পৌষ পার্বণ। হেমন্ত থেকে শীতে গড়িয়ে চলে পরবের ধারা। ওই ধান গাছ টির বেণী বদ্ধ রূপকে" ধানের লতি" বলে। পূজার শেষে ওইধানের লতি ঠাকুর ঘরের লক্ষীর আসনে সাজিয়ে রাখা হয়। পরের বছর নতুন এলে পুরনো লতি কে জলে বিসর্জন দেওয়া হয় অঞ্চলভেদে গবাদিপশুকে খাইয়ে দেওয়া হয়। জঙ্গলমহল শিখরভূমের প্রান্তিক মানুষজনের
মনের আনন্দ উৎসব প্রকাশ পায় ঝুমুর বাউল লোকসংগীত এর সুরের মায়ায়!, আঘুন হিমের আমেজ ,সোনালী ধানের শোভায় , নলেন গুড় পিঠের সুগন্ধে উৎসবের আমেজ মম করতে থাকে।
লক্ষ্মীইতুর ব্রত কথায় হারিয়ে যায় দুঃখ কষ্টের রেশ। বাতাসে ভাসতে থাকে---
" এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে ,
আমার এ ঘরে থাকো আলো করে।।"
🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️
# নদী কথায় কংসাবতী
# কলমে- মনীষাপলমল
আমাদের জঙ্গলমহলের আদরের মেয়ে কাঁসাইয়ের পরান কথা শোনাবো আজ। পুরুলিয়ার ঝালদার পাহাড় ঝাবরবন এখানেই কাঁসাই নালা রূপে এর উৎপত্তি। শাল মহুয়া পলাশ শিমুলের সোহাগী সবুজে ঢাকা টাঁড চাট্টানের উঁচু-নিচু ডুঙ্গরি টিলায় ছোট্ট কিশোরীর মতো নেচে চলেছে কাঁসাই---- পাশের অযোধ্যা পাহাড় থেকে নামা সাহারঝোরা এসে মিলেছে এর সাথে। কিশোরী-তরুণী হয়-- কংসাবতী নামে তার চলন। ভারী সুন্দরতার পরান কথা। কালিদাসের মেঘদূত' ও অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্যে একে "কপিশা "নামে উল্লেখ করা হয়েছে! কথিত যে কংসাবতীর রূপে মুগ্ধ সাগর---- তাই সমুদ্রের বাগদত্তা ছিল কাঁসাই--- নদী কংসাবতী! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দামোদর নদের রূপে তাকে আলিঙ্গন করতে ছুটে এলে কংসাবতী দ্রুত ধাবমান হয়ে সমুদ্রে মিলিত হন! তাইতো তার প্রবাহ পথের দূরত্ব এত কম!
শিখর ভূমের রুখু পাথুরে মালভূমির মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদীর তীর কখনো পান্নাসবুজ কখনো ধূসর। ডুঙ্গরি টিলা চাট্টানের ভূমিরূপ প্রকৃতির সাথে সাথে রং বদলায়। বসন্তের ফুলের আগুনে সারা জঙ্গল পাহাড় ভেসে যায়। শাল মহুয়ার সুবাসে মাতোয়ারা হয় প্রকৃতি। আদিবাসী মাদলের দ্রিম দ্রিম বোল আদিবাসী সারিন্দার মধুর ধ্বনিতে মুখরিত হয় কাঁসাই তীর। জঙ্গলমহলের বড় আদরের দুলালী সে--- যেখান দিয়ে সে বয়ে চলেছে দু'তীরে সোহাগী সবুজে তীরভূমি কে করেছে লাবণ্যময়ী। রুখু প্রকৃতিতে শান্তির প্রলেপ লাগিয়েছে সে। শাল মহুয়া পলাশের বনে তার কি অপরূপ বিস্তার। তবে সে যেন এই জঙ্গল ভূমির মাটির মেয়ে ,বড় খেয়ালি, বড় অভিমানী! বর্ষায় হঠাৎ বানে ভাসিয়ে নিয়ে যায়
দুই তীর আবার জল কমলে চলে যায় নিজের আপন খাতে। কাহার কন্যার মত উদ্দাম তার ভালোবাসা--- এই ভাঙছে এক কূল তো গডছে অন্য কূল । প্রবাহ পথের পরিবর্তনে ভূমিরূপকে করছে নবরূপে অলংকৃত। নদী যেখানে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলেছে কি তার রুপ। পাখির কলতানে মুখরিত জীবন্ত বনভূমি। নদী চরে পানকৌরি বালিহাঁসের আড্ডা। দলমার দামাল হাতির পাল করে জলকেলি। সন্ধ্যা নামলে চখাচখি চলে যায় দুকুলে। রাক্ষসী বেলার রক্তরাগ ডানায় মেখে পশ্চিমে উড়ে চলে বকের ঝাঁক। সন্ধ্যাতারার উদয়ের নিশি টহলে বেরোয় পেঁচা দম্পতি । এই নদী যে জঙ্গলমহলের প্রাণ ভোমরা। লোধা শবর সাঁওতাল কুড়মিদের বড় আদরের ধন। নদী তাদের মাতৃরূপা ,নদীর মীন ফসল তাদের জীবন ধারণের হাতিয়ার। মাছের শেষ নেই--- পাবদা, পুঁটি, চেলা কালবোস ,চিংড়া---- মন ভরে যায় ,ভরে যায় খালুই ও।
নদীর ঘাটে ঘাটে ঋতুবদলে চলে লোক উৎসবের ধুম। হৈমন্তী ফসলের ডালা উপচানো দুই তীরে বসে মেলা ---নবান্ন ,টুসু কিংবা মকরসংক্রান্তির ধূম লাগে ।
টুসু গানে মুখরিত হয়ে ওঠে কংসাবতী নদীর ঘাট।
চৌদলের রংয়ের মেলায়, টুসু গানের সুরে নদীতীর ভেসে যায়। উত্সব ছাড়াও নদীতীরের সাপ্তাহিক হাটে চলে মোরগ লড়াইয়ের উদ্দীপনা। ভূমিপুত্র দের আমোদের এক প্রধান উপকরণ এই মোরগ লড়াই।
নদীতীরের বড়াম থানের হাতি ঘোড়ার ছলনে খেলা করে রৌদ্রছায়ার মীনাকারি। মানতের ছলনের স্তুপ জমা হয় আটনে। নদীর চর জাগা বুকে শিউলির অস্থায়ী ছাউনিতে নলেন গুড়ের সুবাস-- মিষ্টি সুবাস মাখা হিমেল বাতাসে ম ম করতে থাকে সারা চরাচর । কার্তিকে বাঁদনা পরব এর উচ্ছলতা আহিরার গানের সুরে ঝুমুরের বোলে, ভেসে যায় কংসাবতীর তীর। মনসা থানের বিষম ঢাকির ধুমূলে জেগে ওঠে নদীর চর।
তুমডি বাঁশির সুরে, বেদেনীর গানে ,ভাসান মেলা জমে ওঠে! বামুনডিহা নদীর বাঁকে যেখানে কাদা কাল বালিখাল মিলেছে সেখানে "সাতবউনির থান।" পৌষসংক্রান্তিতে মেলা বসে।
মকর সংক্রান্তিতে নদীর ঘাটে ঘাটে উৎসবের ধুম। দামোদরের আলিঙ্গনের ভয় ভীতা কাঁসাই ছুটে চলে সাগর পানে। দু শাখায় ভাগ হয়ে এক শাখা পালার পাই নামে রূপনারানের দিকে গেছে অন্য শাখা কেলেঘাইএর সাথে মিশে হলদি নামে সাগরে মিশেছে।
এই কাসাই কুলের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে রয়েছে আনন্দ যাপন। হাতের অঞ্জলিতে তাকে কুড়িয়ে নিয়েছি বেঁধে রেখেছি কালি কলমের বন্ধনে।
লোক কবিদের আহিরার সুরে ভেসে চলে সরল মানব জীবন দর্শন----
ভালা আহিরে --- মানবজীবন ভালা
ঝিঙা ফুলের কলিরে---বাহ হো
সাঁঝে ফুটে বিহানে মলিনঅ রে।
শীতের নিলুয়া বাতাসে ভেসে বেড়ায় লোক সুর
কাঁসাইচরের বেনা ঘাসের জঙ্গলে, সর্ষের হলুদ ফুলে, পাকা ধানের সোনার অঙ্গে কাঁপন ধরায়---- নটরাজের জপমালার কাল চক্র ঘুরে চলে আপন খেয়ালে।
🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺
#কালিন্দী -কেলেঘাই
# কলমে- মনীষা পলমল( সুকান্ত নগর ,তালবাগিচা ,পশ্চিম মেদিনীপুর)
রাত গভীর! মধ্য নিশির গভীর নীরবতায় আবিল চরাচর। হৈমন্তী মায়াবী রাত পরান কথায় বোনা। প্রকৃতির নিশিযাপন কাব্যের নীরব দর্শক আমি। দৃষ্টি এখন শ্রবণ। চরাচরের প্রাণচাঞ্চল্য এখন দেখা যায় না অনুভব করা যায় শ্রবণে। দূরে -----অনেক দূরে ঝিলের পারে রাতজাগা মানুষের আবছা স্বর ভেসে আসছে। মাঠ পাহারার দল--- ফসল পাহারা দিচ্ছে। হিজলি ফরেস্টের দিক থেকে ভেসে আসছে প্যাঁচাদের রাতজাগানি মজলিসের শব্দ। এই রাতের প্রকৃতি আমায় নিয়ে চলে সেই ফেলে আসা সময়ে---- মনে পড়ে কেলেঘাই নদীর তীরে সেই প্রান্তিক গ্রামে কাটানো রোমাঞ্চকর দিনগুলোর কথা।
" কলসি ভাঙ্গা"--- এক শাল ম হুয়ার সোহাগী সবুজে ঢাকা ছোট্ট গ্রাম । জঙ্গলমহলের ভূমিপুত্রদের আবাসস্থল। এই গ্রামে টাঁড চট্টা নের মাঝ থেকে ঝোরা রূপে এর জন্ম। এ যেন এক আদিবাসী কন্যা। স্বাধীন সুখী উদ্দাম উচ্ছল। সারাবছর ক্ষীণতোয়া- তির তিরে জল বয়ে চলেছে পায়ের পাতা ডোবা ছোট্ট মেয়ের মত।" আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে""! বর্ষায় হড়পা বানে দুকুল ছাপিয়ে সে হয় ভয়ংকরী। জল কমলে আবার স্বখাতে বয়ে চলে । এই নদীর চলন বড় মন ছোঁয়া বড় আবেগী। কংসাবতীর সাথে মিলে হলদি নামে সমুদ্রে মিশেছেএ। কংসাবতীর ডান তীরের উপনদী কেলেঘাই বা কালিয়াঘাই। এর দুকূলে শাল মহুয়া বাঁশ পলাশের হরজাই জঙ্গল। আড়বাঁশি সারিন্দা র সুরে মাদলে র দ্রিম দ্রিম বোলে মুখরিত সারা প্রবাহপথ। মাটির মানুষদের বড়ো আপনজন এ নদী। জীবনের প্রতিটি চরণে এই নদীর সাথে যোগে শিখর ভূমির মানুষদের।
নদী খাতে বোল্ডার চাট্টানের ভাস্কর্য দেখলে অবাক হতে হয়। পাথরের পাশ কাটিয়ে বিলাসী নটিনীর মত এঁকেবেঁকে চলেছে কেলেঘাই--- যেন এক লাস্যময়ী ঝুমুর শিল্পী। নদী খাতের ওপরে জঙ্গলে তোলপাড় করে মহাকাল -----দলমার হাতির দল! নদী কুলের চাষ জমি তাদের লীলাক্ষেত্র! ধান সবজি আখ সবক্ষেত তছনছ করে আবার ঢুকে যায় জঙ্গলের গভীরে।
আহিরার উদাসী সুর ঝুমুরের বোলে ভেসে বেড়ায় এই কাহিনী।
" কলসি ভাঙ্গা"--- নামটা তেই কেমন পরান কথায় মাখা। কার কলসি? কে ভাঙলো? কেন ভাঙলো? বড্ড কৌতুহল! কেউই কোনো উত্তর দিতে পারে না- মন বাউল উত্তর খুঁজে বেড়ায় খেজরা কেলেঘাই এর ঘাটে! ছকামারা বাগডুবির জঙ্গলে , কলসি ভাঙ্গার মাঠে চট্টানে। শেষে বাগডুবি রএক দেহুরি র অশতিপর বৃদ্ধা মা বলল এর কাহিনী------ সেই আদিম কালে কেলেঘাই ছিল এক
রূপসী আদিবাসী কন্যা কালিন্দী। নাচে-গানে রঙ্গে রসে ভরপুর সবার নয়ন মনি। খরা প্রবণ এ অঞ্চলে পানীয় জলের বড় কষ্ট ছিল তখন। কয়েক ক্রোশ দূর থেকে জল আনতে হতো এদের। তেমনই এক দিনে জল আনার সময় এক সাধুর সাথে মেয়েদের দেখা। তিনি বলেন এই উষর ভূমিতে কেউ আত্ম বলিদান দেয় তাহলে ঝরণা ঝরবে।
ভূমিপুত্রী কালিন্দীর অন্তর ছুঁয়ে যায় সে আবেদন।
এই টাঁড চাট্টানে সে প্রাণ ত্যাগ করে। তার কাঁখের কলসি ভেঙ্গে পড়ে যেখানে সেখান থেকেই উৎপত্তি হয় কেলেঘাই নদীর। আর তখন থেকেই জায়গাটির নাম হয় কলসি ভাঙ্গা।
আমার বাউল মন তূপ্ত হয় কলসি ভাঙ্গার পরান কথায়। কেলেঘাই তীরে টুসুর গানে যেন সেই আদিবাসী কন্যা কালিন্দীর সুর ভেসে বেড়ায়----" একে তো মা বিয়ে দিছো কাঁসাই নদীর ওপারে
বিষাদে তাই নয়ন ঝরে""----!
🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷
॥নদী কথায় সুবর্ণরেখা॥
কলমে-মনীষা পলমল( সুকান্ত নগর ,তালবাগিচা, পশ্চিম মেদিনীপুর)
সুবর্ণরেখা,,,,, নদী তো নয় , যেন এক কাহার কন্যার মহাকাব্য,,,,এই ভালোবাসায় ডগোমগো তো এই রাগে চন্ডালিনী,,,,,দুকূল প্লাবী বন্যায় ভাসিয়ে দেয় !,,,,তারপর আবার শান্ত হয়ে গুন গুন করে কাঁদতে থাকে,,,তখন তার মূর্তি দেখে কে বলবে সে এত ভয়ংকরী।
এই নদীর বাঁকে বাঁকে রয়েছে পরানকথার আকর ,,,,,,কত না কাহিনী ,,,,পুরাণ থেকে আধুনিক যুগ ,,,,সে বয়ে চলেছে একই গতিতে,,,,, মাঝে মাঝে গতিপথ বদলালেও আসল চরিত্র একই আছে।
এই নদীর ঘাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘুরে বেড়া ই আমি,,,,, কখনও দলমা ,,দোমোহানী,,,,কখনও কুঠীঘাট,,,, ক খনও রামেশ্বর ॥''সুবর্ণরেখা'',,,,,,, এর বালিতে নাকি সোনার কণা পাওয়া যায় !এই নদী সত্যিই স্বর্ণপ্রসবিনী,,,,,মীন ফসলে সমৃদ্ধ! চিংড়ি ,পাবদা,খলসে, ট্যাংরা,পুঁটি ছাড়া ও বড় চিংড়ি , , , চিংড়া ও কালবোশ এর প্রধান ফসল॥নদীর বালি ও নুড়ি , , , , তাও সংগ্রহ করে জীবিকা চলে অনেক মানুষের॥
নদী যখন ছোটনাগপুর মালভূমি ও ঝাড়খণ্ড দিয়ে বয়ে চলে তখন এক রূপআবার পলল সমতল পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা তে আর একরকম ॥
ঝাড়খন্ডের ডুঙ্গরি টিলা ,টাড় চাট্টানে,জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা নদী যেন আদিবাসীকন্যা ,,,কোন ভয় ডর নেই॥ স্বাধীন ,,,,,,,!নদীর দু কূলে জঙ্গল আর তার বাসিন্দা দের পরানকথা! মাদলের দ্রিম দ্রিম আর আড় বাঁশি সারিন্দার মধুর সুরে ভেসে যায় সারা জঙ্গল পাহাড়!খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার এই অঞ্চল !মানভূম,সিংভূম ,ধলভূম গড়ে র ভাঙ্গা প্রাকার ,মিনার ছুঁয়ে বয়ে চলা নদী শোনায় অতীত কাহিনী!
রাত নামে ক্লান্ত বকের পাখায় ভর করে!শুরু হয় নিশিজাগর কাব্য!রাতচরা পাখিদের ডাকে বুক হিম হয়ে আসে।পরিযায়ী পাখির ডানায় লাগে উড়ান কাঁপন॥ উস খুশ করে উঠে ,,,,',,,।
রাত কাটে পাখির কলকাকলি তে,,,,রবিবন্দনায়, দিনমণিকে আহ্বান জানিয়ে। দলমা র দামাল হাতির দল জল কেলি করে॥জঙ্গলে নদীর ঘাটে সে এক উৎসব! শুঁড়ে র ফোয়ারার জল ছুঁড়ে নদী তোলপাড় । তার পর এক সময় একে একে সবাই চলে যায় জঙ্গলের গভীরে! নদী ঘাট আবার নিঃ শব্দ হয়ে যায় ॥
নদী যখন পলল সমতল পশ্চিমবাংলায় তখন তার কি অপরূপ রূপ॥দিগন্ত ছোঁয়া বিশাল বিস্তার!প্রায় দেড় কিমি! মাঝে মাঝে চর জেগেছে! সেখানে কাশ ,বেনা ঘাসের বন!গাঙ শালিখ ও তেলি মুনিয়ার ঝাঁক সেখানে শোরগোল তুলেছে॥ ছোট্ট জেলে ডিঙ্গি বেয়ে মাছ ধরছে দন্ডছত্রী মাঝি॥ দূরে বড় নৌকা মাল বোঝাই ভেসে চলেছে উজানে॥
দূরে,,,,,অনেক দূরে ,,,,,নদীখাত থেকে ওপরে রামেশ্বরের দেব দেউল ॥ আউল বাতাসে ভেসে আসে তার আরতির ঘণ্টা ধ্বনি॥ নদীচরার বাউল বাতাস ঘাটের পাকুড় গাছ ছুঁয়ে বয়ে চলে জঙ্গলের দিকে॥ একা বক এক পা এক পা করে তির তিরে বালি ছোঁয়া জলে হেঁটে চলে ,,,,,, বড় গ্রামভারী চেহারা তার । জল ফড়িং জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে চলে॥ দূর থেকে ভেসে আসে গাং চিলের তীক্ষ্ণ স্বর! দূরে দিকচক্রবালে আবছাসবুজের আভাস,,,,,, ওই দিক থেকে আসে দলমার দামাল দল ॥ সূর্য ডোবার রাক্ষসীবেলা আসলেই শোনা যায় তাদের পদ ধ্বনি॥নদীকুলের আখের খেত,সবজি,ধান,,,সব তছনছ করে,,,,,।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে,,,,,
নামে সন্ধ্যা তন্দ্রালসা,
সোনার আঁচল খসা,
হাতে দীপশিখা॥
এক অপার্থিব মায়ায় জড়িয়ে যায় জল জঙ্গল॥ ধীরে ধীরে আকাশে ফুটে ওঠেসন্ধ্যাতারা! যেন তামসী তপ স্বিনীর একাগ্রতা,,,,,,।দূরে গ্রাম থেকে ভেসে আসে শঙ্খ ধ্বনি! সেই স্বর ভেসে চলে বাউলবাতাসে ভর করে,,,নদীচরায়, জলজঙ্গল, দেবদেউলের ধ্বজা ছুঁয়ে সেই অনন্তের পানে,,,,,,॥
॥মনীষা॥