Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#গল্প  : পরিপূরক##কলমে : মেহেলি ঘোষ#
" দিদি বাইরে থেকে এসে রান্নাঘরে রাখা ডেটল সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে তারপর কাজ শুরু করেন তো ? " উদ্বেগের সহিত জিজ্ঞেস করে প্রফুল্ল ।
আজ সকাল থেকেই প্রফুল্ল সারা বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছ…

 


#গল্প  : পরিপূরক#

#কলমে : মেহেলি ঘোষ#


" দিদি বাইরে থেকে এসে রান্নাঘরে রাখা ডেটল সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে তারপর কাজ শুরু করেন তো ? " উদ্বেগের সহিত জিজ্ঞেস করে প্রফুল্ল ।


আজ সকাল থেকেই প্রফুল্ল সারা বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছে । একটা দিন ছুটি পেয়ে কি করবে কি না করবে দীসা পাচ্ছেনা । সকলের উপর চিল্লে চলেছে । বাচ্চাদেরকে পরিষ্কার কাপড়ে প্রায় পুরো মুরিয়ে দিয়ে বিছানায় বসিয়ে সারা ঘর ডেটল জল দিয়ে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করছে । সকালে মিনতি দি ঘর মুছে গেছে তবুও ওর মনের শান্তি হয়নি । কিছু বলাও যাচ্ছেনা কারণ যা করছে সবার ভালোর জন্যই করছে। বেচারা নিজেও দুশ্চিন্তায় রয়েছে । কি করবে ওর তো আর ঘরে বসে থাকার উপায় নেই এমন চাকরি যেতেই হবে । তবু শান্তি বিদিসার এখন না বেরোলেও চলবে । ও বাড়িতে থাকতে পারবে । বিদিসা প্রফুল্লর স্ত্রী, পেশায় স্কুল টিচার এবং প্রফুল্ল পেশায় পুলিশ । ভবানীভবন কন্ট্রোলরুমের এমার্জেন্সি শাখায় পোস্টেড । এমন সময় লক্ষ্মী দি এসে পরেছে প্রশ্নের মুখে । লক্ষ্মীদি হোলো ওদের রান্নার দিদি। 


লকডাউনে বেশ কিছুদিন দিদি কাজে আসেননি । প্রফুল্লই আসতে দেয়নি কিন্তু বিদিসা দুটো বাচ্চা সামলে,অনলাইন ক্লাস সামলে আর একা হাতে সবটা পেরে উঠছিলো না । প্রফুল্লকে তো রোজ বেরাতে হচ্ছে কাজে আর এখন করোনার কল্যাণে কিছু বাড়তি কাজও বেড়েছে । তবে বিদিসা নিজের অসুবিধার কথা কিছুই জানায়নি প্রফুল্লকে । হাপিয়ে গেলেও নিস্তব্ধে সে সবটা সামলে চলেছিল । হয়ত আজও প্রফুল্লর উপর সেই অর্থে তার অধিকারবোধ জন্মায়নি । 


আসলে তথাকথিত ঘটক দিয়ে সম্বন্ধ করে তাদের বিয়ে । বিদিসা বরাবরই শান্ত, বেশ শিক্ষিত এবং সুন্দরী ফলে প্রফুল্ল তথা তার বাড়ির সকলেরই তাকে দেখে পছন্দ হয়ে যায় । স্কুলের চাকরিটা সে বিয়ের পরেই পায় । পরীক্ষা আগেই দিয়েছিল তবে ফল বের হয় বিয়ের পর । স্কুল শিক্ষিকার চাকরি বলে কেউ আপত্তি করেনি তবে প্রফুল্ল যে মন থেকে চায়নি তার স্ত্রী চাকরি করুক তা সে একবার প্রকাশ করে ফেলেছিল তাদের প্রথম সন্তান হওয়ার সময় । হয়ত তখনই বিদিসার নরম মনে মানুষটির কঠোর ছবি ফুটে ওঠে । 


বিদিসা কোনদিনই সংসারের প্রতি তার কর্তব্য বিমুখ হয়নি তাই প্রফুল্লও কোনদিন আর তার চাকরি নিয়ে কথা তোলেনি । তবুও হয়ত আজও বিদিসার মনে সেই দিনের সেই প্রফুল্লই রয়েছে যাকে তার কঠোর, আত্মকেন্দ্রীক বলে মনে হয়েছিল এক সময়, তাই আজও সে ভালোবেসে তার কাছে তার অধিকারের আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি । বিদিসা বরাবরই শান্ত ও চাপা স্বভাবের ফলে আর পাঁচটা মেয়ের মত প্রতিবাদী কন্ঠে নিজের অধিকার বুঝে নিতে সে পারেনা । যেখানে আঘাত পায় সেখান থেকে মনে মনে নিজেকে নিস্তব্ধে গুটিয়ে নেয় । 


বিদিসার শাশুড়ীমা তাকে খুব স্নেহ করেন । ফলে তার চোখ এরায়নি বিদিসার প্রতিদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম ও শারীরিক কষ্ট । তাই তার শাশুড়ীই দায়িত্ব নিয়ে প্রফুল্লকে বলে পুনরায় কাজের দিদির আসার ব্যবস্থা করেন । প্রফুল্লও মায়ের কথা ফেলতে পারেনা । 


প্রফুল্ল এমনিতে মানুষটি নিজের কাজের প্রতি যথেষ্ট দায়িত্বশীল এবং নিজের পরিবারের প্রতিও বেশ কর্তব্যপরায়ণ । তবে এটুকুই যথেষ্ট নয় । এর বাইরেও প্রতিটি মেয়েই তার স্বামীর মধ্যে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে খুঁজে পেতে চায় যার কাছে নির্দিধায় নিজের মনের কথা বলা যায়, তার স্বপ্নের প্রেমিককে খুঁজে পেতে চায় যার বুকে মাথা রেখে নিজেকে নিশ্চিন্তে হারিয়ে ফেলা যায় । যা বিদিসা পায়নি কারণ প্রফুল্ল বেশ রাশভারী মানুষ । হয়ত এর জন্য অনেকাংশে তার পুলিশের চাকরি দায়ী ।


দুদিন আগে পর্যন্তও মানুষটিকে বিদিসার বড় বেমানান লাগত নিজের সাথে কিন্তু তা সে কোনদিনই তার ব্যবহারে প্রকাশ করেনি । দুজনের চিন্তাধারায় বিস্তর ফারাক তাই দশ বছরের বিবাহিত জীবনে সেই অর্থে প্রেমের উপলব্ধি তার হয়নি । বিয়ে করলে সংসার করতে হয় তাই সে করে চলেছে নিস্তব্ধে । সংসারের দায় দায়িত্ব অস্বীকার করার শিক্ষা যে সে পায়নি ! তবে কোনদিন সেই অর্থে ভালো না বাসলেও দুজনের মধ্যে অদ্ভুত এক বোঝাপড়া তৈরী হয়ে গেছে নিজের অজান্তেই মনের গভীরে । সেই বোঝাপড়ার ফল স্বরূপ তাদের দুই সন্তান সহ দশ বছরের ভরা সংসার  ! 


সকাল থেকে বাড়ির সকলেই ভয়ে গুটিসুটি হয়ে রয়েছে । বাড়ির সকলেই কমবেশি প্রফুল্লকে ভয় পায় তার রাশভারী স্বভাবের জন্য । কিন্তু বিদিসার কেন জানিনা আজ এই রাশভারী মানুষটিকে দেখে বড় অসহায় লাগছে । মানুষটিকে মানসিক ভাবে বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে । আজকাল আর বিদিসার মানুষটিকে ভয় করে না । বরং মানুষটির উপর করুণা হয় । গত তিন চার মাসে এটুকু তো সে বুঝেছে যে মানুষটি আতঙ্কিত তার পরিবারের সুরক্ষা নিয়ে  । 


যবে থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে বাড়ির কাউকে সে বাইরে বেরোতে দেয়না । বাজার হাট, ওষুধ পত্র আনা থেকে শুরু করে বাইরের যাবতীয় কাজ সে করে । তাকে কর্মসূত্রে বাইরে বেরোতে হয় বলে সে নিজেকে পরিবারের সকলের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে নিয়েছে । এমনকি খাবারটা পর্যন্ত সে খাবার টেবিলে বসে খায়না সকলের সাথে একসঙ্গে । নিজের ঘরে একা একা বসে খায় । আজ দীর্ঘ চার মাস ধরে পরিবারের সুরক্ষার কথা ভেবে এইভাবেই সরিয়ে রেখেছে নিজেকে । তবে আজ যেন একটু বেশিই ক্ষেপে উঠেছে । টানা দুঘন্টা ধরে পুরো বাড়ি স্যানিটাইজ করে স্নান সেরে অবশেষে সে নিজের ঘরে গিয়ে বসে । বিদিসা এক কাপ চা নিয়ে প্রফুল্লর কাছে যায় ।


 "চা !"


" একি তুমি ঘরে ঢুকে এলে কেন  ? দরজায় নক করে ঘরের বাইরে রেখে দিলেই তো আমি নিয়ে নিতাম !..." কথাটা বলতে বলতে চায়ের কাপটা নিতে হাতটা বারিয়ে বিদিসার দিকে তাকিয়েই আতকে ওঠে প্রফুল্ল..." এমা তুমি মাস্কও পড়নি ! তোমার কি বুদ্ধি লোপ পেয়েছে  ? জানো আমাকে বেরোতে হয় মাস্ক ছাড়া আমার সামনে  এলে ? আবার বাচ্চাদের কাছে যাবে !".....


প্রফুল্লকে অবাক করে থামিয়ে দেয় বিদিসা । হঠাৎ দুঃসাহসী হয়ে উঠে চায়ের কাপটা খাটের পাসের কর্ণার টেবিলে রেখে প্রফুল্লর মুখটা চেপে ধরে বিদিসা । এই প্রথম বিদিসা প্রফুল্লর চোখে চোখ রেখে অধিকারের সাথে বলে ওঠে ..." চুপ ! একদম চুপ ! কারুর কিচ্ছু হবেনা । অযথা ভয় পাচ্ছো তুমি । চুপচাপ চা টা খেয়ে মাথা ঠান্ডা করো । আমার উপর ভরসা নেই  ? "


প্রফুল্ল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বিদিসার দিকে । এইরূপ ঔধ্যত্ব বিদিসার স্বভাব বিরুদ্ধ । মুখ থেকে হাত নামিয়ে বিদিসা আসতে করে প্রফুল্লর পাশে বসে জিজ্ঞেস করে...." কি হয়েছে  ? তোমাকে এতো টেনশড লাগছে কেন  ? "


" নির্মলের করোনা হয়েছিল । আজ ভোরে এক্সপায়ার করেছে । "


কথাটা শুনে বিদিসার গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে ।  নির্মল প্রফুল্লর সহকর্মী ছিলেন । বিদিসা চুপ করে বসে থাকে । প্রফুল্ল উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটি মেরুন রঙের ফাইল বার করে এনে বিদিসার হাতে দিয়ে বলে..." এই ফাইলটা নিজের কাছে রাখো । আমার কিছু হয়ে গেলে একদম ঘাবড়াবে না । যা কিছু আমি রাখতে পেরেছি তোমাকে নমিনি করে দিয়েছি । এতে সবকিছু আছে । তোমার কোনো অসুবিধা হবেনা । এবার যাও । আমার থেকে দূরে থাকাই ভালো । নিজেও সাবধানে থাকো বাকিদেরও সাবধানে রাখো । যাও !!"


বিদিসা প্রফুল্লকে জড়িয়ে ধরে । " কিচ্ছু হবেনা তোমার । "


প্রফুল্লর সারা শরীরে কাটা দিয়ে ওঠে । আজ প্রথম সে বিদিসার শরীরের স্পর্শে কেপে ওঠে । এতো বছরের সংসারজীবনে এই প্রথম বিদিসা তাকে এইভাবে আলিঙ্গন করে । প্রফুল্ল কাছে এলে সে কোনদিন ফিরিয়ে দেয়নি ঠিকই তবে এভাবে আঁকড়েও ধরেনি । প্রফুল্লর শরীর মন জুড়ে পূর্ণতার তৃপ্তি বয়ে চলে । এদিকে বিদিসার সুরক্ষার ভয়ে তার হাত দুটো ছাড়িয়ে দূরে ঠেলে দিতে ইচ্ছে করলেও সে তাকে ছাড়াতে পারল না । তাকে আরও শক্ত করে নিজের বুকে জাপটে ধরলো । আজ তারা পূর্ণ । আজ বিদিসাও বুঝতে পারে যে তাদের মধ্যে রাবীন্দ্রিক প্রেম না থাকলেও তারা একে অপরের পরিপূরক । মানুষটি নিজের পরিবারের জন্যই বাঁচেন । সেদিনও তিনি পরিবারের কথা ভেবেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন । বিদিসাকে চাকরি না করতে দিয়ে তার ব্যাক্তি স্বাধীনতাকে খর্ব করা তার উদ্দেশ্য ছিলনা ।


                               (সমাপ্ত)