Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন বিষয়_গল্পশিরোনাম_কারিগরকলমে_রিমলী
কমলা রঙের ডিউজ বলটা চোখের সামনে,নিজের পরিচয় বদলে,দুরন্ত এক আগুনের গোলায় রূপান্তরিত হয়ে,গলির একেবারে শেষ বাড়িটার, ছাদের লাগোয়া ঘরের ভাঙা কাঁচের জানলা ভেদ করে ঢুকে গেল।
উত্…

 


#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন 

বিষয়_গল্প

শিরোনাম_কারিগর

কলমে_রিমলী


কমলা রঙের ডিউজ বলটা চোখের সামনে,নিজের পরিচয় বদলে,দুরন্ত এক আগুনের গোলায় রূপান্তরিত হয়ে,গলির একেবারে শেষ বাড়িটার, ছাদের লাগোয়া ঘরের ভাঙা কাঁচের জানলা ভেদ করে ঢুকে গেল।


উত্থিত ব্যাট আর হাতটাকে সাঁই সাঁই করে মাথার ওপরে দুবার ঘুরিয়ে, নিজের কৃতিত্বের প্রশংসা পাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে,বাকি সকলের এমন রাগের মুখে পড়তে হবে, স্বপ্নেও কল্পনা করেনি বুকাই।


উইকেট কিপার পাপ্পু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল

__"নতুন বলটা আমার।"


__"হোয়াটস রং উইথ ইউ অল?ইটস্ জাস্ট অ্যা বল..."

__"ভেবেছিলাম পাড়ায় নতুন। কিছু বলব না। খেলার নিয়মগুলো তো বলে দিয়েছিলাম।এত বড় ভুল করলি কি করে?"

টিম ক্যাপ্টেন রোহিতের কথার উত্তরে বুকাই বলল___

__"খেলছিস ক্রিকেট,তাও নিউজ বলে, অথচ ছয় মারা যাবে না? কোথাকার নিয়ম রে?"

__"তুই তোর এই পকেটভর্তি ট্যালেন্ট, তোর অ্যাকাডেমিতে গিয়ে দেখা। এখানে আমাদের নিয়ম মানতেই হবে।"

__"বেশ মানলাম আমি নিয়ম ভেঙেছি। কিন্তু তাতে 'ভয়ংকর ভুল' এর কি আছে?"

__"তোর অতিরিক্ত সাহস তো? যা, তুই গিয়ে নিয়ে আয় বলটা...দাদুর বাড়ি থেকে"


পাপ্পু এগিয়ে এসে বলল,

__"রোহিতদা ছেড়ে দাও‌।আমরা ম্যানেজ করে নেব আর একটা।নতুন এসেছে, কিছু হলে সবাই আমাদেরকেই ধরবে।"


বুকাই হাত ঝাঁকিয়ে সামনে এগিয়ে এসে বলল__"এক মিনিট... তোরা কেন ওই বাড়িতে যেতে চাইছিস না?কি আছে ওখানে?"

__"বললাম তো,নিজে গিয়ে দেখ। আমরাও দেখি হাওড়ার ছেলেদের কতটা সাহস..."

পাপ্পুর হাত ধরে পেছনে সরিয়ে বলল রোহিত।


রোহিতের এই শেষ কথাটা ভীষণভাবে গায়ে মেখে নিল বুকাই। পাড়ার ছেলেদের কাছে নিজের সম্মান সে কিছুতেই খোয়াতে চায়না। হাত থেকে ব্যাটটা ফেলে দিয়ে, পায়ে পায়ে এগিয়ে এল বাড়িটার সামনে।


 উত্তর কলকাতার স্ট্যাম্প লাগানো দোতলা বাড়িটার জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে, সেখানে যে কোন মানুষ থাকতে পারে কল্পনাই করা যায় না। ভেতর থেকে বন্ধ দরজাটা,অল্প ঠেলতেই,হাতের চাপে খুলে গেল।একবার পেছন ফিরে পাড়ার ছেলেদের দেখে, একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ভেতরে ঢুকে এল বুকাই।


 পচা গন্ধে টেকা দায়। তেমনই অন্ধকার। বুকাই হাতরে হাতরে সুইচবোর্ডটা খুঁজে পেতে, আলো জ্বালানোর চেষ্টা করে,ব্যর্থ হয়ে,সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।


এখনও পর্যন্ত বাড়ির মালিকের দেখা মেলেনি। বলটা উদ্ধার করতে গেলে ছাদে যেতেই হবে। সাহস করে ছাদে উঠে এসে দাঁড়িয়ে বেশ অবাক হল। গোটা বাড়ির তুলনায়, গোটা ছাদে আসবাবপত্রের সংখ্যা বেশি। একটা ভাঙ্গা চেয়ার, কোণের দিকে দু'তিনটে ফাঁকা টব, একটা বালতি মগ, বিছিয়ে রাখা মাদুর,তার ওপরে একটা ভাঙা ক্যারাম বোর্ড, একটা ছেঁড়া ঠাকুরমার ঝুলি... 


 চোখ বন্ধ করতেই স্মৃতির পাতাগুলো দমকা হাওয়ায় খুলে যেতে লাগল...হাওড়ার বাড়ির ছাদটা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠার আগেই বুকাই চমকে উঠল...


__"ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন বাবা? ভিতরে আয়..."

এক নিমিষে সব সাহস গলে জল হয়ে, বুকাইয়ের সারা কপালে ফুটে উঠল, ছাদের অন্য কোণের ঘর থেকে আসা একটা খ্যানখ্যানে গলার স্বরে। আধখোলা দরজাটাও খুলে গেল বীভৎস শব্দ করে।


আবছা আলোয় দূর থেকে বুকাই দেখল, সারা ঘর জুড়ে ছোট বড় বিভিন্ন সাইজের মাটির পুতুলে ভর্তি।একটু খুঁজতেই চোখে পড়ল বলটা।দরজার এক কোণে।


তাড়াতাড়ি বলটা নিতে ঘরে ঢুকতেই, আবারও সেই গলার স্বর।বুকাই লক্ষ্য করল,ঘরের কোণের ভাঙা জানালাটার তলায় বসে থাকা বৃদ্ধকে।বুকাইয়ের দিকে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।


__"এতদিন আসিস নি কেন বাবা?দাদুর কথা মনে পড়েনি?এত ব্যস্ত তোরা?"


ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে বুকাইয়ের মুখ।মাটিমাখা হাতটা পাশে রাখা বালতির জলে ধুয়ে, ছেঁড়া ফতুয়াটায় মুছে,কোনোরকমে উঠে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ।

টলোমলো পায়ে এগিয়ে এলেন বুকাইয়ের কাছে।

ঝুলে পড়া গাল বেয়ে,কোটরে ঢোকা চোখ থেকে বেরিয়ে এল আনন্দাশ্রু।


__"আমার দাদুভাই…আমার দাদুসোনা..."

এবার বুকাইয়ের গলার কাছটাও পাক খেতে  শুরু করেছে।কতদিন পড় 'দাদুসোনা' ডাকটায় কেউ ডাকল আবার।হাওড়ার বৃদ্ধাশ্রমে দাদুভাইকে ছেড়ে আসার সময় ঠিক এমন কাতর কন্ঠের ডাক শুনেছিল ও।

বৃদ্ধ তখন বুকাইয়ের সারা মাথায়,গায়ে হাত বোলাতে শুরু করেছেন।বুকাই দু পা পিছিয়ে যেতেই, কাঁপা কাঁপা হাতে  ওর হাতটা চেপে ধরে টেনে নিয়ে গেলেন ওই ফাঁকা টবগুলোর সামনে।


__"দাদুভাই,এই দেখ,অপরাজিতার চারাটা কেমন শুকিয়ে গেছে...ওই দেখ তোর ব্যাট বল,লুকিয়ে রেখেছিলাম।আয় দাদু মাদুরে বস।ডালিমকুমারের গল্পটা বাকি আছে যে..."


আবার টানতে টানতে ভাঙা চেয়ারটার সামনে নিয়ে গেলেন।বুকাই যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত অনুসরণ করতে লাগল।


__"...তোর জন্য কত পুতুল বানিয়েছি।সব রাখা আছে।"

কিছুক্ষণ থেমে থেকে আবার বললেন..." হ্যাঁ রে তোর বাবা এলো না?"


হাত ছাড়িয়ে পেছনে সরে এলো বুকাই।

__"দা..দাদু,আপনি যেমন ভাবছেন, আমি সে না।এ পাড়ায় নতুন এসেছি আমরা।আমিতো শুধু বলটা..."

__"মিথ্যে কথা।আমার রক্ত,আমি চিনব না? ছোট থেকে হাতে করে মানুষ করেছি তোকে।"


বৃদ্ধ আরও পেঁচিয়ে ধরলেন বুকাইয়ের হাত। বাড়ির নিচ থেকে তখন বেশ কিছু মানুষের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বুকাই কান পেতে শুনল, ওর বাবাও চিৎকার করে ডাকছে নিচ থেকে।


__"ছেড়ে দিন দাদু। আমি আপনার নাতি নই।"


কোনরকমে হাত ছাড়িয়ে, ছুটে পালালো বুকাই।

সদর দরজা খুলে বাইরে এসে ভিড় ঠেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। ততক্ষনে পাড়ার অন্য কাকুরা ভীষণ বকাবকি শুরু করেছেন বুকাইকে।


__"কি দরকার ছিল এ বাড়িতে ঢোকার?"

বুকাই আড়চোখে একবার রোহিতের দিকে তাকিয়ে দেখতেই,রোহিত ছুটে পালাল।বুকাই ও ফিরে এল ঘরে।


ঘরে ঢুকে দাদুর ছবিটা বুকে জড়িয়ে, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।কানে এল ক্লাবের সেক্রেটারির কথা।


__"ও বাড়িতে আমরা কেউ যাইনা।ওনার ছেলে বৌমা,আদরের নাতিকে নিয়ে হঠাৎ করেই একদিন চলে যাওয়ায়, ওনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।আর ফিরে আসেনি।আমরা বহুবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছি,পারিনি।কি বেয়াদব ছেলে বলুন তো...

আমরা মাঝে পাহারা দিতাম,খেয়াল রাখতাম পালা করে। তারপর ছেড়ে দিয়েছি।ওনার নিজের কোনো হুঁশই নেই‌।বাড়ি ছেড়ে উনি কোথাও যাবেন না।জোর করে ধরে আশ্রমে রেখে এসেছিলাম সবাই মিলে। ভীষণ অশান্তি করে চলে এসেছেন।


একসময় নামকরা মৃৎশিল্পী ছিলেন।এখনও শুধু মাটির পুতুল বানিয়ে যান।দোতলা বাড়ির সব ঘর ছেড়ে ওই ছাদের ঘর আগলে পড়ে থাকেন।নাতির আশায়‌।পাড়ার সবাই মিলে প্রতি সপ্তাহে শুকনো কিছু খাবার দিয়ে আসি।পাড়ার ছেলেরা বল চাইতে গেলে এমনভাবেই আটকে রাখতেন,নাতি ভেবে। বোসবাবুর ছেলেকে একটা গোটা দিন আটকে রেখেছিলেন।ওখানে তাই কেউ যায়না। খুবই আনফরচুনেট ব্যাপারটা। কিন্তু নিজের সেফটিতো সবার আগে দরকার বলুন।"


চোখ বন্ধ করল বুকাই। কানে ভেসে আসছে এখনও বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর।

__"গল্প শুনবি?..."


বুকাইয়ের দাদু শিক্ষক ছিলেন।এই বৃদ্ধ মৃৎশিল্পী।

দুজনেই কারিগর। একজন মানুষ গড়েন, একজন পুতুল।দুজনেই দুজনের পেশায় চরম ব্যর্থ।


বিকেলে ছাদে উঠে, দাদুর বাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ বুকাই। মা বাবার উপরে জমে থাকা অভিমান, আজ সকালের ওই ছাদের পাঁচিলের কোনায় কোনায় লুকিয়ে থাকতে দেখেছে বুকাই।বাবা মাকে বহুবার বলার পরেও দাদুভাইকে নিয়ে আসার অনুমতি পায়নি।কেমন আছে দাদুভাই? সারা সপ্তাহের একটা ফোনে, ফেলে আসা রবিবারগুলোয়, হাওড়া বাড়ির ছাদের ওপরে কাটানো দুপুরবেলাগুলো কি সত্যি ফেরানো যায়?


রাতে খেতে বসে বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন__

__"বাবাকে নিয়ে আসি এবার সুমিতা।"

মায়ের গম্ভীর মুখটা আরেকটু শক্ত হয়ে যায়।উঠে চলে যায় টেবিল থেকে। বুকাই স্পষ্ট দেখল, চোখের জল আড়াল করছেন ওর বাবা।


__"প্লিজ বাবা। দাদুভাইকে আর একলা ফেলে রেখোনা।মাকে ঠিক ম্যানেজ করে নেব আমরা..."


ওর বাবা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।


__"বাবা,ও বাড়ির ওই দাদুটার জন্য যদি কিছু করা যেতে পারে... ওনার পুতুলগুলো যদি..."


বুকাইকে মাঝখানে থামিয়ে,ওর বাবা বললেন

__"আজ সন্ধ্যেবেলায় উনি মারা গেছেন বুকাই। শান্তি পেয়েছেন।কাল সকালে..."


ওর বাবা আরও কিছু বলে যাচ্ছিলেন, কথাগুলো বুকাইয়ের কানে ঢুকছিল না। সবকিছু ছাপিয়ে শুধু একটাই আওয়াজ এখনও তার কানে বেজে চলেছে...


__"যাসনে দাদু...যাসনে..."