Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

সৃষ্টি সাহিত্য যাপন :-
অপেক্ষা..
হরিদাসী অপেক্ষা করতে খুব ভালোবাসে। অপেক্ষা মিটে গেলে তার দুঃখ হয়। আবার সেই তাকে খোঁজো। অতো কি পাওয়া যায়! এই যে মাধব চা-মুড়ি দিতে আজ দেরী করছে, নাকি ভুলেই গেলো। তার খুব নিশ্চিন্তি লাগছে।যেই মাধবের খে…

 


সৃষ্টি সাহিত্য যাপন :-


অপেক্ষা..


হরিদাসী অপেক্ষা করতে খুব ভালোবাসে। অপেক্ষা মিটে গেলে তার দুঃখ হয়। আবার সেই তাকে খোঁজো। অতো কি পাওয়া যায়! 

এই যে মাধব চা-মুড়ি দিতে আজ দেরী করছে, নাকি ভুলেই গেলো। তার খুব নিশ্চিন্তি লাগছে।

যেই মাধবের খেয়াল হলো, "ওহো! হরি মাসি, এই দেখো, বড্ডো বসিয়ে রাখলাম গো! এদিকে অফিস বাবুদের আগে ভাগে একটু বাড়িয়ে দিতে গিয়ে বেখেয়াল হয়ে গেল।"

হরিদাসী এক গাল হেসে বলে, "আরে তুই চা দিবি তবে আমি খাবো! আমি তো সেই কখন থেকেই খাচ্ছি রে!..খেয়েই তো যাচ্ছি। ওই যে চা বানাচ্ছিস, ঢেলে ঢেলে সবাইকে দিচ্ছিস। আমি বসে বসে সব গিলছি। যেই দিবি অমনি তো সব শেষ হয়ে গেলো।" মাধব হেসে চা মুড়ি এগিয়ে দিয়ে বলে, "নাও নাও তবু শেষ ই করো। তোমার তো আবার ধান-গোলা যাওয়া আছে"।


হরি দাসী ভোর বেলায় এসে এ চা-দোকানে ঝাঁটপাট দেয়। উনুন পরিষ্কার করে ঘুঁটে গুল সাজিয়ে দেয়। জল ছিটিয়ে সামনের রাস্তা ঝেটিয়ে দেয়। বিনিময়ে মাধব তাকে চা মুড়ি দেয়।

এরপর সে আগুরি'দের গোলায় গিয়ে ধান পাহারা দেবে। পাখি তাড়ায় ধান উঠোন থেকে। ওখানেই তার সারা দিনের খাওয়া হয়ে যায়। বড়ো এনামেল থালায় এই এতো পান্তা দেয়। তবে হরেন আগুরি কদিন আগে খুব কথা শুনিয়েছে, "হ্যাঁগো পিসি! পাখ-পক্ষী তো দেখি তোমায় আর ভয় ই পায়না। গায়ে এসেই তো বসে পরে দেখি! তোমায় রেখে কি লাভটা হলো?'" সেই থেকে হরিদাসী একটা লাঠি নিয়ে বসে। তাও কি তারা শোনে। হরিদাসীর মুখে যে খুব মায়া। পাখিরা সব বোঝে। 


এখানে রোদ শেষ হলে হাটঁতে হাটঁতে সেই শ্মশান চাতালে গিয়ে বসে। আগে অবশ্য এখানে কাজ সেরে বট-কাছারি তে যেতো। ওখানে কতো দিকের বাস লরি আসে। নাতিটার ফেরার কথা।

সেই অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করতো সেখানে। --"হ্যাঁ গো! যুদ্ধের চাকরি করে তো নাতি! কি একটা যুদ্ধে সে গেছে। আহা! মা বাপ মরা ছেলে! আমি বেঁচে আছি কি সাধে! তবে এক খানা নাত-বৌ সে দেখেও রেখেছি। পাকা কথাই হয়ে আছে ধরো। সে মেয়ে কে সব শিখিয়ে পরিয়েও রাখছি। একবার শুধু আসুক সে। নাতি পুতি ছাড়া এ বয়সে থাকা যায় বলো!"

..এ গল্প ও কাছারিতে সবাই জানে.. রোজ শোনে।  


একদিন সে গ্রামে তার মৃত্যু খবর এলো। সে খবর  গাঁয়ের মাতব্বররা চেপে রাখতেই বল্ল সবাইকে। এই শেষ বয়েসে হরিদাসীকে দুঃখ দিয়ে কি হবে আর। তবে গাঁয়ে দুস্টু ছেলের তো অভাব নেই। একদিন বলেই ফেলল, "ও দাসী বুড়ি তোমার নাতি মরেছে গো!"

-কী!..কি বললি?

হরিদাসী তাদের পিছন পিছন দৌড়ায়।

-এই! এই! বল..কি বললি?..মরে গেছে?..বল. ওই পলাস কেনো?..

শেষে হরেন আগুরির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে।

--'ও হরেন, ওরা কি বলাবলি করছে! নাতিটা নাকি আমার মরে গেছে?'

হরেন মাথা নিচু করে কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,

"হ্যাঁ পিসি, থানা থেকে তেমন খবরই দিয়ে গেছে। তবে তার দেহ তো পাওয়া যায়নি। কোন পাহাড় খাঁজে নাকি পরেছে। পিসি সে না পাওয়া গেলে মরেছে বলি কি করে বলো!.."

তবে হরিদাসী কান্নাকাটি কিছু করেনি। বাড়ি এসে কুমড়ো মাচার দিকে তাকিয়ে খুব রাস করলো। "হ্যাঁরে! এই সেদিন তোদের মাটিতে বুনে দিলুম, এর মধ্যেই এ কচিতে পোয়াতি হয়ে গেলি?... ছি ছি ছি...এত কুঁড়ি কে পাহারা দেবে বলতো?"..


মাধব চা মুড়ি দিতে গিয়ে থমকালো, "ও মাসি তোমাকে দেখে আজ কেমন ভালো লাগছে না। বুকে খুব কফ জমেছে নাকি গো! ওঃ গা তো পুড়ে যাচ্ছে তোমার। শুনলাম সারারাত উঠনে শুয়ে থাকো, কুমড়ো পাহারা দাও?"

--"ওরে না রে! সে তারা এখনো কচি। দিনে কাপড় কানি জড়িয়ে রেখে কাজে আসি। রাতে হিম কুয়াশা লাগাতে আবার ওদের খুলে দেই। তা সে করেও স্বস্তি আছে! ইঁদুর পোকা কতো সব আছে না! যদি আঁচড়ে কামড়ে দেয়! দেখিসনিতো! মাচা আলো করে কেমন ফুল ফুটে ছিলো"।


আলোর কথা হরিদাসী গগন ডোম কেও বলে। --''আহা কতো পুণ্যির কাজ, কী উপকারের কাজ করিস গগন । রোজ কতো মানুষের গায়ে আলো জড়িয়ে দিস। তারা কেমন আলো হয়ে হয়ে স্বগ্গে চলে যায়। আমাকেও অমন করে দে না রে ভাই!"

গগন বলে,"সে সময় তোমার হয়নি গো দিদি ঠাকরুন। তোমার ভিতর অপেক্ষা কঠিন বাসা বেঁধে আছে! ও না খুলে পড়লে কি করে যাবে?"

হরিদাসী বলে," কই! আর তো বাঁধন কিছু নেই। মাচার কুঁড়ি ধর সে কুমড়ো হয়েই এলো। আর ক'রাত গেলেই সব লায়েক হয়ে যাবে"।...


তা সে মাধব রাতে অষুধ দিয়ে গেছে, কোবরেজ কে বলে এই এতো। বড়ো দয়ালু সে। হরিদাসীর চোখে জল আসে কেউ ভালোবাসলে।

সে সব অষুধ মুঠো করে শুয়ে রইল হরিদাসী। আহা! খেয়ে ফেললেই তো শেষ হয়ে যাবে। এ ভালোবাসা যে আর ছোঁয়ায় রইবে না।

হরিদাসী সত্যিই অপেক্ষা করতে জানে। কতো কণা জুড়ে রাতটা ভোর হয়ে যায়, হরিদাসী এই আঙ্গুলে গুনতে পারে। তবে আজ গুনতে গুনতে ঘুমিয়েই পড়েছিল নাকি! হঠাৎ কোন অতল থেকে ঘুম ভেঙে সে অবাক! এ কেমন আলো তার উঠোনে! কোন দূর জগতের মায়া মতো.. "ও বাবা! "হ্যাঁরে! মোটে একটু শুয়েছিলাম এর মধ্যেই লতা পাতা কুঁড়ি তে উঠোন ভর্তি করে দিলি তোরা! পা ফেলার জায়গা রাখিসনি। এত নাতি পুতি কে চেয়েছে রে?.. তোদের পিরিতের আদিখ্যেতা দেখলে গা জ্বলে যায়।..ওই!! সদর দরজায় আবার কে এলো! ওরে ওতো জোরে ধাক্কা দিস না! ও দরজা  কি আর সে পোক্ত আছে!...যাহ! ভেঙেই ফেললি!.. ও বাবা! তোমরা সব আমার বাড়ি এলে? মাধব হরেন গাঁয়ের আরো কতো মানুষ গো!"

সব হই হই করে হরিদাসী কে বললো, "আনন্দ খবর নিয়ে এলাম গো! তোমার নাতি ফিরে এসছে। গাঁয়ের নাট মন্দিরে প্রণাম সেরে সে আসছে। আগেভাগে খবর দিতে এলাম সব।"

--"হ্যাঁরে! মাধব ঠিক বলছিস?.. ও হরেন ঠিক বলছিস? ওহ! আজ কী আনন্দ এলো গো"। ভিড়ের মধ্যে হরিদাসী গগন-ডোম কে দেখে  অবাক। কি সুন্দর পোশাক পরে সে সবার মাঝে  দাঁড়িয়ে। রাজার মতো মাথায় সোনার মুকুট,গায়ে সোনা জরি দেয়া ঝলমলে কাপড়। সে হেসে বলল, "কি দিদি ঠাকরুন বলেছিলাম না! তোমার মধ্যে অপেক্ষা ছিলো?"

হরি দাসী বলল-"হ্যাঁগো, সে নাতি না ফিরলে কি আর বুঝতাম! আজ ভরাট হলো সব। হ্যারে গগন!সেই যে বলে ছিলিস, এদিকে সব মিটে গেলে আমার গায়ে আলো মাখিয়ে দিবি.. দিবি তো?..ও গগন দিবি তো?"

গগন বলল-"হ্যাঁ গো! সেই জন্যই তো এলাম। সেখানে নিয়ে যেতেই তো সবাই এলো! এসো আমার হাত ধরো। নাতিকে সে পথেই পাবে.. চলো দিদি...."

         

                        -- অমিত বন্দোপাধ্যায়