Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#মোমবাতি আর মাংসভাত#সুস্মিতা#সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
(ঘটনাটা ঘটেছিল এক ডিসেম্বর মাসেই।দিল্লীর নির্ভয়াকান্ডের পরে লিখেছিলাম "মোমবাতি আর মাংসভাত"। 
পূর্ব প্রকাশিত গল্পটি আজ আবার পোস্ট করছি।)
"মোমবাতি আর মাংসভাত"
 তা সে …

 


#মোমবাতি আর মাংসভাত

#সুস্মিতা

#সৃষ্টি সাহিত্য যাপন


(ঘটনাটা ঘটেছিল এক ডিসেম্বর মাসেই।

দিল্লীর নির্ভয়াকান্ডের পরে লিখেছিলাম "মোমবাতি আর মাংসভাত"। 


পূর্ব প্রকাশিত গল্পটি আজ আবার পোস্ট করছি।)


"মোমবাতি আর মাংসভাত"


 তা সে কথাতেই তো আছে- "কারুর সর্বনাশ তো কারুর পৌষমাস।" কথাটা মনে পড়লেই অবশ্য প্রতিবারই মনেমনে জিভ কাটে পটলা। কিন্তু ও আর কি করবে...ঘটনাটা যে এইরকমই ঘটে চলেছে। 


তবে মা কালীর দিব্যি কেটে পটলা বলতে পারে- নিজের পৌষমাস দেখার জন্য ও কিন্তু কখনোই কারুর সর্বনাশ কামনা করে না। ঘটনাচক্রে এরকম ঘটে চলেছে...তাতে ওর আর কি দোষ।


 জন্ম ইস্তক এই গরীবের জীবনে ঘেন্না ধরে যাচ্ছিল পটলার। পেট ভরে একথালা ভাত খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা যে কাকে বলে ভুলে যেতে বসেছিল। ছেলেমেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকানো যেত না...সব যেন শালা ভিখারীর বাচ্চা আর হাড়-জিরজিরে বৌটা তো যেন জনমদুঃখিনী সীতা সবসময়। 


তবু পরিবারকে কিছু কম ভালবাসেনা পটল। ওদের জন্যই তো সব কিছু...এতগুলো বছর ধরে কামধান্দার কম চেষ্টা করেছে ও? শালা বিধাতাপুরুষ যেন পাথরচাপা কপাল সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়েছিল এই পৃথিবীতে। কলকারখানা, দোকান, মুটেগিরি, অর্ডার-সাপ্লাই সব...সবরকম চেষ্টা করে দেখেছে ও। সব যায়গাতেই শুধু চলবে না আর চলবে না...চাকা বন্ধ। বাপ মাও ছিল হদ্দ গরীব, তারাও জন্ম দিয়েই খালাস। ভাগ্য ছাড়া আর কাকেই বা দোষ দেবে পটলা...।


 শেষে সেই কপাল ফিরতে শুরু করল আরেকজনের সর্বনাশের দৌলতে। কথাটা মনে আসলেই অবশ্য মা কালীর নাম করে দশবার জিভ কেটে নেয় পটলা ....


         তা ঘটনাটা শুরু হয়েছিল সেই 'রিজওয়ানুরের কেস'টার সময় থেকে। সে এক মুসলমান দেবদাস এক বড়লোক হিন্দুর মেয়ের প্রেমে পাগল হয়ে রেললাইনের ধারে মরে টরে পড়ে রইল। সেই তখন থেকে শুরু হল মোমবাতি জ্বেলে রাস্তায় রাস্তায় মিটিং মিছিল প্রতিবাদ শোকসভা। আর সেই মোমবাতি দিয়েই কপাল ফিরতে শুরু করল পটলার।


 ছোটবেলা থেকেই এই বস্তির পাশের ঘরের হাবুলের মাথাটা হেব্বি টনটনে। ঠিক সময়মত ওর বুদ্ধিটা খেলে যায়। মিটিং মিছিলে মোমবাতির চাহিদা দেখে হাবুল পটলাকে দলে টেনে নেয়। বস্তির শেষপ্রান্তে নিমাইদার ফাঁকা ঘরটা হয়ে যায় ওদের কারখানা। 

মোমবাতি বানাতে বিশেষ ঝামেলা নেই। শুরুর দিকের কাঁচামালের খরচাপাতি হ্যাবলাই সামলাতে পেরেছিল। তা সেই মিছিল প্রতিবাদের ঘটা চলেও ছিল টানা অনেকদিন। মোমবাতির সাপ্লাই দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠত পটলারা। ওইসব মোমবাতির কোয়ালিটি ফোয়ালিটি নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার হয়না। শহুরে প্রতিবাদী দাদা দিদিদের হাতে ওগুলো আধঘন্টা একঘন্টা শোভা পায়। তবে হ্যাঁ...টেলিভিশনের লোকরা যখন ছবি তুলতে আসে সেই সময় মোমবাতি নিবে গেলে কিন্তু চলবে না ।


 এইভাবেই শুরু। দিনের শেষে কাঁচা পয়সা গুনতে গুনতে লাভের মুখই দেখতে পেত পটলা হাবুলরা। পার্টির দাদাদের দিয়েথুয়েও।


        হাবুলের মনটা সত্যিই খুব বড়। বস্তির সকলের কথা ভাবে ও। রিজওয়ানুর পরে যতগুলো 'কেস'এ মোমবাতি হাতে মিটিং মিছিল হয়েছে, সবগুলোতেই বস্তির হারাণ, ন্যাড়াদেরও কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে ও। 


প্রতিবাদ জানাতে জানাতে দাদা দিদিদের চা জলের তেষ্টা পেয়ে যায়, একটু ঝালমুড়ি চিনেবাদাম খেতে ইচ্ছে করে...সে তো করবেই। তা ন্যাড়া, হারাণরা সেসব সাপ্লাই দিয়েছে। সে যেন প্রতিবাদের মেলা বসেছে। তবে হ্যাঁ, পার্টি আর টেলিভিশনের দাদারা একটা কথা সোজাসাপটা বলে দিয়েছে- "বেলুন, নাগরদোলা, খেলনা"...এইসব জিনিষ এই মেলার ধারেকাছে রাখা চলবে না।


যাক গে যাক, অতশত ভাবলে পটলার চলে না। ও শুধু জানে- একটা করে নতুন 'কেস', আবার শিক্ষিত দাদা দিদিদের রাগ-প্রতিবাদ, আবার বানাও মোমবাতি। উফ্ খেলা হেব্বি জমে উঠেছে। ভগবান এবার সত্যিই মুখ তুলে চেয়েছেন। পটলার গোটা পরিবার একটু ভালো খেয়েপরে বাঁচছে আজকাল।


 কিন্তু হলে কি হবে? সুখের মুখ দেখলেই মানুষকে ভূতে কিলায়। গত কয়েকদিন ধরে পটলার মনমেজাজটা ঠিক সুবিধের যাচ্ছে না। অথচ ওর তো এখন একটু বেশি খুশি হওয়ারই কথা। 


          বাজারে পরপর বেশ কয়েকটা 'রেপ কেস'চলছে। এক একটা 'কেস'এর প্রতিবাদও চলছে বেশ অনেকদিন ধরে। মোমবাতির ডিমান্ডও বেড়েই চলেছে...ঘরে পয়সাও আসছ ভালো। আজকাল মাসে প্রায় দশদিন পটলার পরিবার মাছভাত খেতে পায়। তবুও যে কেন মেজাজটা ঠিকমতো ফুরফুরে হচ্ছে না...পটলা বোঝে না।


 কারখানার কাজ সেরে, বিক্রিবাটার পয়সা গুণেটুনে রোজ রাতেই হাবুল আর পটলা দাওয়ায় বসে একটু সুখদুঃখের গল্প করে।


     হাবুলটা সুখের মুখ দেখেছে...ঘরে একটা ছোট দেওয়াল-টিভি কিনেছে, এখন ভাবছে চোরবাজার থেকে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ইস্কুটারের কথা। 


    আজ পটলা যেন কোনো কথাতেই মন দিতে পারছেনা। ইদানিং আর কোনো 'কেস'এরই আলাদা করে খবর রাখে না ও, কিন্তু দিল্লীর ওই কলেজে পড়া মেয়েটার ঘটনাটা পটলার কানেও পৌঁছেছে। সারাদিন মোমবাতি বানাতে বানাতে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে...বারবার অন্যমনষ্ক হয়ে যায় পটলা....


 হাবুলের টেলিভিশন প্রতিরাতেই দিল্লীর মেয়েটার খবর পৌঁছে দেয়...


মেয়েটা হাসপাতালে...লড়াই করছে...বাঁচার জন্য...বেশ অনেকদিন পেরিয়ে গেল...


          প্রতিবাদ এখনও লাগাতার চলছে...চলছে সারা দেশ জুড়ে।মোমবাতির বিক্রি একেবারে তুঙ্গে...একটা ছোট টিভি পটলাও এবার কিনে ফেলতে পারবে।


       খবর পাওয়া গিয়েছে মেয়েটাকে নাকি সিঙ্গাপুরের এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সারা দেশ মেয়েটার জন্য প্রার্থনা করছে মোমবাতি জ্বালিয়ে...


      পটলার বৌ ছেলেমেয়েও প্রার্থনা করছে- "মেয়েটা যেন আরও অনেকদিন বাঁচে হে ভগবান, মোমবাতি জ্বেলে প্রার্থনা আর প্রতিবাদ যেন আরও অনেকদিন চলে ঠাকুর" -ওদের দুচোখ জুড়ে একটা নতুন টেলিভিশনের স্বপ্ন...।


আজ সারাদিনে মোমবাতির বিক্রি প্রায় সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। হাবুল আর পটলার পকেট আজ সুপার হট্। আজ তাই পার্টি জমে গেল চম্পার ঠেকে। প্রাণভরে নীট বাংলা আর মাংসভাত খাওয়া দাওয়া হল সারা সন্ধে। 


        বাড়ি ফিরেও পটলার চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই। নেশাটা কিছুতেই জমছেই না। 


রাত প্রায় দুটো...হাবুলটা মাল খেয়ে বেহুঁশ।


       ঘরের বাইরের দাওয়ায় ভূতে পাওয়া মানুষের মত একলা বসে আছে পটলা...কিছুক্ষণ আগে হাবুলের ঘরের টেলিভিশনে খবর শুনেছে ও...


"দিল্লীর মেয়েটা সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে মারা গিয়েছে...একটু আগে"


         তাতে পটলার কি? কি এসে যায় ওর মেয়েটার বাঁচা মরায়? সে তো কেউ হয় না পটলার...।


         তবুও খবরটা জানার পর থেকে পটলের মাথাটা ঝিম মেরে আছে। ও কিছু ভাবতে পারছে না, কিছু শুনতে পাচ্ছে না। অস্পষ্ট ছবির মতো ওর চোখের সামনে ভেসে আসছে কতগুলো দৃশ্য। ছবি নাকি দুঃস্বপ্ন?


            তখন পটলের সাত আট বছর বয়স। সব থেকে বড় দিদিটার বোধ হয় ষোলো সতেরো। বছরবিয়ানো, হেঁপো রুগী মা'টা কোনোদিনই পটলকে কোলে নিতেই পারত না। দিদিটার কোলেপিঠেই পটলা বড় হচ্ছিল...।


তারপর একদিন কি যে হয়েছিল...বাপ, মা আর বুড়ো ঠাকুরদা মিলে রাতভোরে দিদিটাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলো। বাপটা সারাদিন মাথা নীচু করে বসে থাকতে আর বলত- "কি সর্বনাশ...কি লজ্জা...সমাজে আর মুখ দেখাতে পারব না।" পটলা কিছুই বুঝতে পারত না, শুধু সারাদিন শুকনো মুখে দিদিটাকে খুঁজত। 


       শেষে একদিন মা কপাল চাপড়ে বললো- "তোর দিদি মরেছে...মরে আমাদের লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়েছে।"


    রাতে দিদিকে ছাড়া ঘুমোতে পারত না পটলা ....


 আজও কিছুতেই ঘুম আসছেনা পটলার। এতগুলো বছর পেরিয়ে দিদিটার মুখটাও ভালো করে মনে পড়েনা...মাথার ভেতরটা যেন কেমন করছে।


       হঠাৎ টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল পটল...ঘর থেকে নিয়ে আসলো নিজেরই বানানো একটা মোমবাতি। দাওয়ার এক কোণে জ্বালিয়ে দিলো মোমবাতিটা। 


মোমবাতির আগুনে ভেসে উঠল কার মুখ? পটলের দিদি নাকি এই দেশের কোটি কোটি নির্যাতিতা মা বোনদের মুখ? তারা পটলের কে?


দুহাতে নিজের মাথাটাকে চেপে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল পটল...ওর গলা দিয়ে বেরিয়ে আসলো রাতে খাওয়া গড়গড়ে মাংসভাত।


************