Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

সৃষ্টি সাহিত্য যাপন :-
দোকান ফিরতি পথে দিদিকে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলাম- 'হ্যাঁরে দিদি, আমরা কি সেই গরীব মানুষ? ওই যে রে! যাদের পয়সা থাকেনা।'দিদি বলল -'না আমরা ঠিক তা নয়, ওই মধ্যবিত্ত বলে না! সেরাকম।'-মানে?..-মানে ঐ …

 


সৃষ্টি সাহিত্য যাপন :-


দোকান ফিরতি পথে দিদিকে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলাম- 'হ্যাঁরে দিদি, আমরা কি সেই গরীব মানুষ? ওই যে রে! যাদের পয়সা থাকেনা।'

দিদি বলল -'না আমরা ঠিক তা নয়, ওই মধ্যবিত্ত বলে না! সেরাকম।'

-মানে?..

-মানে ঐ তো! গরীব না বড়োলোক ও না, হয় না!

-ও আমরা গরীব না, পয়সা আছে । কিন্তু তু্ই যে সব পয়সা না দিয়ে দিয়ে কিনলি? 

-ওই তো! মধ্যবিত্ত বলেই ধার দিলো। জানে পয়সা দিয়ে দেবো। 

-ও গরীব হলে দিতোনা, না!

-হ্যাঁ দেয়। গরিবদের দান দেয়। সে ফেরত দিতে হয় না। 

-বাহ্! তাহলে তো গরীব হলেই ভালো!

-না, গরীব ইচ্ছে করে হতে নেই। 

কেমন জটিল লাগলো। জটিলতা আরও বাড়লো। 

মুদির দোকানে দিদি আমি দাঁড়িয়ে। আরো কিছু লোক ছিলো। দোকানদার দিদি'কে বার বার বলছিলো- 'কি নেবে খুকু বলো ?'

দিদি বলল- 'তুমি ওদের দিয়ে সেরে নাও, তারপর নিচ্ছি।' সবাই চলে গেলে দিদি জিনিস নিলো। ফেরার পথে বললাম- 'দিদি প্রথমে নিচ্ছিলিস না কেনো রে?' দিদি বলল- ধারে নেবো না! লজ্জা লাগছিলো। ওরা সব দাঁড়িয়ে ছিলো'।

-কেনো রে লজ্জা লাগছিলো। ওরা বড়োলোক? 

-না ওরা আমাদের মতোই।  

-তাহলে লজ্জা লাগছিল কেনো রে?

-ওফ! তোর এতো প্রশ্ন না! ওরা আমাদের মতো হলেও ভাববে আমাদের বাবার রোজগার কম। আমরা ঠিক মতো খেতে পাইনা, ধার করে চলে...বুঝলি!! শোন! এ নিয়ে আর একটাও প্রশ্ন করবি না। চুপ করে বাড়ি চল। 

কিন্তু জটিলতা বেড়েই যাচ্ছিলো। 

বাবা অনেক দূরে কাজ করে, সেখানে ই থাকে। 

একদিন টেলিগ্রাম এলো বাবা খুব অসুস্থ। মা তড়িঘড়ি করে চলে গেলো। আমাদের মন খারাপ। 

দিদি রাতে চমকে বলল- 'যাহ! মা আমাদের চলার পয়সা দিয়ে যায়নি। ইস! আমিও ভুলে গেলাম চাইতে।'

আমি বললাম-' ভয় কি ধার করে আনবো।' 

দিদি বলল-'না আগের ধার না মিটিয়ে আবার চাওয়া যায় নাকি!'

চাল ছাড়া দু-দিনেই সব শেষ হলো। শুরু হলো দিদির এক্সপেরিমেন্ট। শুধু চাল দিয়েই কতো রকম। এক সকালে হটাৎ একটা কথা মনে পড়াতে দিদিকে বললাম- 'জানিস কাল স্কুল থেকে ফেরার সময় ওই হেম জেঠিমা জিজ্ঞেস করছিলো বাবার কথা। তার পর জিজ্ঞেস করলো 'আজ কি খেলে তোমরা?' শুনে দিদি একটু যেনো চমকেই জিজ্ঞেস করলো- 'তু্ই কি বললি?'

-আমি কিছু না বলেই দৌড়ে চলে এসেছি। 

দিদি কি একটু ভেবে বলল- 'শোন, এর পর যদি কেউ জিগ্গেস করেনা! বলবি ভাত,ডাল,তরকারি আর কাটা-পোনা মাছের ঝোল..কেমন!'

সবে মুখস্ত শরু করছি দেখি হেম জেঠিমা আমাদের বাড়ি এসে হাজির। দিদি কে জিজ্ঞেস করলো- 'বাবার কোনো খবর পেলে ?' দিদি বলল- 'না জেঠিমা, মা না আসা পর্যন্ত তো কিছুই জানতে পারছি না।' জেঠিমা এদিক ওদিক একটু চেয়ে বলল বলল-'রান্না বান্না শেষ হলো ?' দিদি বলল- 'হ্যাঁ কিছুটা হয়েছে।' আমি বিনা প্ররোচনায় গড়গড় বলে ফেললাম- 'কাটা-পোনা মাছের ডাল, ভাত আর...আর কি যেনো বললি দিদি ?' উত্তর না দিয়ে দিদি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জেঠিমা বেশ কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে দিদি কে বলল- 'তোমাদের তো স্কুল যাওয়া আছে।' দিদি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। 

জেঠিমা বলল- 'শোনো না এই উনোন ধরিয়ে রান্না-বান্না সেরে স্কুল যাওয়া খুবই কঠিন। পড়াশোনার ও ক্ষতি। তাই বলছিলাম যতো দিন না তোমার মা আসছে আমার বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করো। আজ রাত থেকেই কেমন।' দিদি চোখ নামিয়ে চুপ করে ছিল। জেঠিমা যেতে যেতে হটাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বলল- 'ও শোনো, আমার রান্না সব হয়ে গেছে। তোমরা বরং আমার ওখানে খেয়েই আজ স্কুলে যাও। ঘরে যা রান্না রয়েছে ও থাক। পরে খেয়ে নিও।' দিদি কেনো যে চুপ করে আছে কে জানে। তবে হেম জেঠিমা খুব গম্ভীর মতো, সে ভয়েই নাকি!

দিদি আয়নার সামনে বেনুনিতে ফিতে বাঁধছিলো। আমি বললাম- 'হ্যাঁরে দিদি, এটা কি দান না ধার রে?.. ওই যে খেতে বলল জেঠিমা'। দিদি উত্তর দিলো না। কেমন অন্যমনস্ক মতো মুখ। বেশ খানিক পরে বলল- 'মনে রাখতে হয়'। বললাম- 'কি মনে রাখতে হয় রে'। বেনুনি বাঁধা শেষ করে বলল- 'কৃতজ্ঞতা'। 

বললাম- 'কৃতজ্ঞতা মানে কি রে?' দিদি এর উত্তর না দিয়ে বলল- 'এই তু্ই বই-বাক্স যা নেবার এখুনি নে। তোকে স্কুলে দিয়ে আমাকে স্কুলে যেতে হবে। ওবাড়ি খাওয়া আছে, তাড়াতাড়ি কর।' 


মা বাবা এক সাথেই এলো। বাবা ভালো হয়ে গেছে। ওফ! কতো বাজার হাতে। 

দিদি দৌড়ে গিয়ে বাবার হাত থেকে থলি গুলো নিলো। আমি মা'এর হাত থেকে। বাজার দেখে এতো খুশি কোনো দিন হয়নি। আম'এর বেশ কটা টুকরিও ছিলো। বিকেলে মা আর দিদি দেখি আমের এক বড়ো টুকরি আরো কি কি সব জিনিস নিয়ে হেম জেঠিমা কে দিয়ে এলো। দিদিকে বললাম- 'ভালো ভালো আম গুলো ওদের দিয়ে এলি কেনো রে! ধার শোধ?' দিদি হেসে আমার থুতনি নেড়ে বলল- 'কৃতজ্ঞতা। একে দান বলে না ধার ও বলতে নেই। তবে শোধ দিতে হয়। উপকারের ঋণ-শোধ বলে একে'।

'ঋণ' মানে জানিনা। তবে বুঝলাম ফেরত সেই দিতেই হয়। দেয়া উচিত। 

আমার মুখটা বোধহয় আফসোস মতো দেখাচ্ছিল। দিদি আবার হেসে বলল- 'আরও তো কতো আম আছে খা না!' 

হ্যাঁ তা আছে। 

না আমরা গরীব নই। বাড়ির কাজের মাসি আর তার ছেলেটাকে দেখলে বুঝি। মাসির শাড়ি থেকে আমার মা'য়ের শাড়ি অনেক ভালো। ওর ছেলেটার প্যান্ট-জামা থেকে আমার গুলো অনেক পোক্ত। সিঁড়ির রেলিংয়ে হাজার স্লিপ খেলেও প্যান্টের পিছন ভোগলা হয় না। বছর বছর চলে। বর্মের মতো। ভেজালেও নরম হয় না। দাঁড়িয়ে শুকায়। মাসির ছেলের কাকের বাসার মতো আমার চুল না। গুড়িগুড়ি করে ছেঁটে দেয়া হয়। বহু দিন কাটতে হয়না। বড়ো হলে শাঁখের মুখের মতন দারুন একটা টেরি বানাই। কাটা পরে যখন কান্না পায়। দিদি হাসে। 


দিদি পড়াশোনায় ভালো...খুব ভালো। ওর ক্লাসের কতো মেয়ে ওর কাছে পড়া বুঝতে আসে। 

এ নিয়ে সাংঘাতিক কান্ডও আছে একটা। সে কে এক ক্লাস-মেট আসবে, সঙ্গে তার মা ও আসবে, থাকবে সারাদিন। তারা নাকি ভীষণ বড়োলোক। এমন গেস্ট অসার আগে বাড়িতে কি কি হয় আমার জানা। প্রথমেই আমাকে ধরা হয়। চটি জুতো থাকলেও পরিনা। পায়ে ধুলো মাটির ছ্যেতলা থাকে। ও ঘষে তুলতে হয়। নখ কাটতে হয়। লাট্টু-লেত্তি কেরে নেয়া হয়। এর পরেই মা কে..সে খুব কঠিন লড়াই মা'য়ে দিদিতে।

-কী!! এটা খারাপ শাড়ি?.. তোর বাবা নিজে হাতে শ্যামবাজার থেকে কিনে এনে দিয়েছিলো। কি নরম! পরে কি আরাম!

-ওফ! খারাপ শাড়ি কে বলল। বললাম খারাপ হয়ে গেছে..ন্যাতা হয়ে গেছে মা!

-কী... ন্যাতা! এটা ন্যাতা? শোন! মায়েদের ওতো সাজার কি দরকার রে!..তোরা সাজগে যা না। সকালে উঠে কোন মানুষ সাজে রে?

প্রতিবারই লড়াই শেষে মা অপরূপ সেজে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। শাড়িতে ন্যাপথলিনের গন্ধ..মুখে ক্রিম। এবারও তাই হলো। 

ও হ্যাঁ একটা জাদু বাক্স আছে আমাদের বাড়িতে। সেটা নামানো হয়। সে এক বাদশাহী জিনিস নাকি। আশ্চর্য এক ডিনার সেট। আমার এক মামা উপহার দিয়ে ছিলো মা কে । আরব থেকে আনা। সে সেখানেই থাকে। তার যে কতো রকমের অদ্ভুত আকারের বাটি থালা গামলা। কি দারুণ সব নকশা তাতে। খেতে বসে প্রতিবার আমাদের মধ্যে তর্ক হতো কোনটায় কি রাখে তা নিয়ে। এ তর্কে মা বাবাও ছিলো। ওটায় জাদু ছিলো নিশ্চই। কোনো দিন বাবা খুব রেগে থাকলে মা ও জিনিস নামিয়ে বাবাকে খেতে দিতো। বাবা জল হয়ে যেতো। আমার জ্বরে ওরই এক অদ্ভুত বাটিতে বাৰ্লি দিত মা, আমি ঢক ঢক খেয়ে নিতাম। জ্বরেও কেমন রূপকথার রাজ পুত্তুর মনে মতো নিজেকে। ওটা বেরোলেই বাড়িটা রাজার ঝলমলে মহল হয়ে উঠত। 


চুরমার হয়ে ভেঙে গেলো সেদিন দিদির হাত থেকে পরে। মাজতে নিয়ে ছিলো ওর গেস্ট আসবে বলে। 

হাঁ হয়ে চেয়ে রইলাম সবাই টুকরো গুলুর দিকে। আমাদের কি একটা রাজ পরিচয় হারিয়ে গেলো যেনো। দিদি পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। 


কাঁসার বাসন গুলো কে দিদি ঝন ঝন করে বেছে রাখছিলো। আমি পিছনে দাঁড়িয়েও বুঝতে পারছিলাম ও কাঁদছে..চোখ মুচ্ছে বার বার। 

বললাম-কাঁদছিস দিদি?

উত্তর দিলো না। আরো ক'বার জিগ্গেস করতেই ও

তেড়ে আমার দিকে ঘুরে বলল-হ্যাঁ আমরা গরীব.. আমরা গরীব...আমরা গরীব...আমরা গরীব... হয়েছে তোর শান্তি!!!! আর একটাও কথা বললে মেরে পাট-পাট করে দেবো তোকে আমি !

দিদি কখনো আমাকে মারেনা..ওই মুখে ই বলে। 

তাই সাহস নিয়ে বললাম- ভালোই তো হলো রে দিদি..তোকে আর ধার করতে হবে না। আমাদের মানুষ এমনই দান করবে...ফেরত দিতে হবে না ধার..ওই ঋণ না কি বললি ওটাও না..

দিদি এবার সত্যিই আমায় মারলো। গুম গুম করে পিঠে ক ঘা দিলো। আরে বাহ্!! একটুও ব্যথা লাগলো নাতো! গরীব হলে বেশ মজা তো। 

                                            

                           -- অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়