Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

প্রথম-খেয়া-সেরা-সাহিত্য-সম্মাননা

'শিরোনাম--রামধনুর খোঁজে'কলমে--রিমলী রায়
কুয়াশায় ঢাকা উপকূলের আকাশ জুড়ে লাল সূর্যটা, একটু একটু করে নিজের উপস্থিতি প্রমাণ করতে ব্যস্ত। ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙছে শহরের। শুধু দিগন্তবিস্তৃত নীল-সাদা জলরাশি, গর্বের সঙ্গে অবিরাম, ত…

 


'শিরোনাম--রামধনুর খোঁজে'

কলমে--রিমলী রায়


কুয়াশায় ঢাকা উপকূলের আকাশ জুড়ে লাল সূর্যটা, একটু একটু করে নিজের উপস্থিতি প্রমাণ করতে ব্যস্ত। ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙছে শহরের। শুধু দিগন্তবিস্তৃত নীল-সাদা জলরাশি, গর্বের সঙ্গে অবিরাম, তার তরঙ্গমালায় নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার মুক্তো গেঁথে চলেছে।

হোটেল সানসাইনের রুম নাম্বার ১০২ এর বন্ধ দরজার আড়ালে,দুটো অনাবৃত,ক্লান্ত শরীর,আদরের উষ্ণতায় খুঁজে নিচ্ছে পরম সুখ।


ডোরবেল বেজে ওঠে।


নরম শরীরটাকে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে, ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেন তুষারবাবু।


__"উমমম। দেখ কে এসেছে। মনে হয় চা দিতে। জামাটা পরে নাও।"

আদর মাখা সুরে বললেন বন্হিদেবী। নিজেরও একেবারে ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছে নেই তুষারবাবুকে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও, মাটিতে পড়ে থাকা জামাটা টেনে নিয়ে এগিয়ে দেন তুষারবাবুর দিকে।


__"গুড মর্নিং স্যার। আপনারা আজ চেক আউট করবেন তো?"

__"হ্যাঁ। এটা বলতে এলেন?"

__"না না আসলে..."

__"বুঝেছি। একটু দাঁড়ান।"

একটা পাঁচশো টাকার নোট, ছেলেটির হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন__

__"থ্যাংক ইউ ফর এভরিথিং"

__"থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে ইনফর্ম করে দেবেন। আমরা নিয়ে যাব। ম্যাডাম কি উঠে পড়েছেন?"

তুষার বাবু ভুরু কোঁচকালেন। বন্হিদেবী, নিজের গায়ে বেডশীটটা ভালো করে জড়িয়ে, মুখ লুকালেন বালিশে।

__"কোন দরকার আছে?"দৃঢ় কণ্ঠে বললেন তুষার বাবু।

__"না...ওই আর কি। গুড মর্নিং বলতাম। এই দুদিনেতো ম্যাডামই দরজাটা খুলেছিলেন, তাই..."

__"উনি ঘুমাচ্ছেন।"

__"আচ্ছা স্যার। হ্যাভ আ গ্রেট ডে।"


ছেলেটি চলে যেতেই, সজোরে দরজা বন্ধ করে, নিজের কপট রাগ প্রকাশ করলেন তুষার বাবু। বন্হিদেবী বালিশ থেকে মুখ তুলে হেসে উঠলেন খিলখিল করে।


__"একদম হাসবে না। কতবার বলেছি, যার তার সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে যেও না।"

__"আমি মোটেও গায়ে পড়িনা।"

__"তা নয় তো কি?"

বারান্দার দরজা খুলে, একটা সিগারেট ধরিয়ে, চাপা অভিমান ধোঁয়ায় উড়িয়ে বললেন__

__"যাই বল আর তাই বল, আমার খারাপ লাগে।"


নাইটিটা গায়ে জড়িয়ে উঠে আসতে গিয়ে, বেড সাইড টেবিলে পড়ে থাকা ফোনটা বেজে উঠল। এক প্রকার ভয় পেয়ে যান বন্হিদেবী।

__"বিতান কলিং"

তুষার বাবু ইশারা করে ফোনটা ধরতে বললেন__

__"হ্যালো?"

__"কখন উঠছো বাসে?"

__"এইতো বেরোবো এবার।"

__"নন্দিতা মাসি ছাড়তে আসছে তো?"

__" নন্দিতা মাসিকেই ফোন করতে পারতিস?"

__"তোমায় ফোন করা যাবে না এটা কি বলে গিয়েছিলে?"

বন্হিদেবী বেশি কথা না বাড়িয়ে ফোনটা কেটে দিলেন।


তুষার বাবু নিজের লাল ট্রলি ব্যাগে জামা কাপড়গুলো গোছাতে গোছাতে বললেন__

__"কি বলল?"

__"খোঁজ নিচ্ছিল..."

বহ্নি দেবী বিছানা ছেড়ে উঠে এসে তুষার বাবুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন___

__"ছুটি শেষ।"


******************


___"ঠাম্মি, তোমার এত দেরি হল?"

__"রাস্তায় খুব জ্যাম রে বাবু। ধর্মতলায় পা রাখার জায়গা নেই।"

__"এসে গেছ মা? কেমন কাটালে দুটো দিন?"


লাল মাফলার খুলে রেখে, সোফায় গা এলিয়ে দিলেন বন্হিদেবী।


___"তোদের বাবা ফিরল?"

___"নাহ্"

__"বিনয় কোথায়?"

__"ও বাড়িতে নেই মা। বাজারে গেছে একটু।"

টেবিলে কফির কাপটা, আওয়াজ করে রেখে গেল, সুনন্দা।


একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফির কাপ চায়ে চুমুক দিতে দিতে, ছোট ছেলে বিতানকে বললেন___


__"আমি না থাকলে, তোদের বুঝি খুব অসুবিধা হয়?"

__"বৌদির তো একটু হয়ই মা"

__"আমিতো থাকলে সে রকম কোনো কাজ করিনা?"

__"রিন্টুকে তো একটু সামলাতে পারো। হঠাৎ করে তোমার বেড়াতে যাবার কিই যে শখ জাগে, বছরে একবার ফ্যামিলি ট্যুরে তো যাচ্ছি মা। তার পরেও তোমায় ঘুরে বেড়াতে হবে? বাবাও থাকেনা। সংসারের দিকে তো একটু মন দিতে হবে?"


বেশ কিছুক্ষন শুধু তাকিয়েই থাকলেন বন্হিদেবী। তারপর মৃদু হেসে বললেন__

__"সেইতো..."


একতলায় সিঁড়ির কাছে, রিন্টুর __"দাদুভাই দাদুভাই" চিৎকার শুনে, উঠে গেল বিতান।


___"উফ! কি জ্যাম রাস্তায়।"

__"ঠাম্মাও একই কথা বলছিল।"

আদরে নাতির গালদুটো ভরিয়ে দেওয়ার আগেই বিতান বলে ওঠে...

__"তুমিও বুঝি ধর্মতলা হয়ে এলে বাবা?"


বিতানের এই কথায় বিষম খেলেন বহ্নিদেবী। দৌড়ে এলেন তুষারবাবু। পিঠে হাত ঘষতে ঘষতে বহ্নিকে সোফার উপরে বসালেন।


__"ঠান্ডা লাগিয়েছো?"

বহ্নিদেবী মাথা নাড়লেন।


__"একটু কালো লাগছে কেন? রোদে পুড়েছ?"

__"সেতো তোমাকেও লাগছে দেখছি..."


তুষারবাবুর নাকটা টিপে খিলখিল করে হেসে ওঠেন বহ্নিদেবী। সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রিন্টু হাততালি দিয়ে ওঠে... 

__"দাদুভাইয়ের নাক টিপছে।নাক টিপছে।"


__"রিন্টু তুমি ঘরে যাও।"

সুনন্দা রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে উঠলো। রিন্টু মাথা নিচু করে ঘরে চলে যেতে, তুষারবাবু বন্হিদেবীকে বললেন,


__"একবার ঘরে এসো। কিছু জিনিস তোমায় দেখানোর আছে।"

নিজের লাগেজটা নিয়ে উপরে চলে গেলেন তুষারবাবু। কফির কাপটা হাতে নিয়ে পেছন পেছন গেলেন বন্হিদেবীও।


রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে সুনন্দা। বিতানকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে ওঠে আবারও,


___"তোমাদের হয়তো কিছু নাও মনে হতে পারে, আমার কাছে ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর। যখন তখন এভাবে সবার সামনে ওনারা... বারবার এক ঘটনা কেন ঘটবে বলতো? বিয়ে হয়ে আসা থেকে দেখছি, ইদানিং যেন বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করছে না? স্পষ্ট বুঝতে পারছি, দুজনে মিলে একসাথে গেছে বেড়াতে। বাড়িতে না বলে যাবার কি হয়েছে? কোন বিপদ-আপদ হলে তখন কে দেখবে? বুড়ো বয়সে ভীমরতি?"

__"আজকে দাদা ফিরুক। কথা বলা যাবে।"

****************


___"তোমার কোনদিনও কোনো আক্কেল হবে না, না?"

__"আমি কি করলাম?"

সদ্য জামা কাপড় ছেড়ে, একটা টাওয়েল জড়িয়ে, ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে, বন্হিদেবীকে দেখে থেমে গেলেন তুষারবাবু।

বাঁকা হেসে বন্হিদেবীর কোমর জড়িয়ে ধরলেন।


__"তোমার কি মনে হয়, ওরা কিছু বোঝেনা?"

__"এতে বোঝা না বোঝার কি আছে? কোন জিনিসটা অন্যায় করেছি?"বন্হিদেবীর নরম ঠোঁটে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বললেন তুষারবাবু।

__"ছাড়ো তো। সব সময় ভালো লাগে না।"

__"সত্যি ভালো লাগে না?"

আরেকটু কাছে নিয়ে এলেন বন্হিদেবীকে।

__"বাড়িতে বলে গেলে তোমার কি হয় জানি না বাবা।"

___"তোমার মনে আছে? যেদিন কলেজ পালিয়ে প্রথম দেখা করেছিলাম? তারপর যেদিন কলেজের এক্সকার্শনের নাম করে প্রথম দিঘায় গিয়েছিলাম? পালিয়ে বিয়ে করার দিনটা মনে আছে? সবসময় একটা ভয় ছিল বটে। কিন্তু সেদিনের সেই আনন্দটা.. লুকিয়ে থাকার আনন্দটা... সেটা কিন্তু প্রাইসলেস ছিল। লুকিয়ে প্রেম করার মজাটাই আলাদা।"


___"ওরে আমার বুড়ো রে... নাতি বাবুর বয়স পাঁচ বছর হতে চলল। এবার বুঝে শুনে চলতে হবে তো?"

__"তুমি সত্যিই চাও? আমরা হিসেবি হয়ে যাই? এই প্রেম কমে যাক? আর পাঁচটা সাধারণ দম্পতিদের মত, শুধুই সংসারধর্মে মনোনিবেশ করে,নিজেদের ভুলে যাই? ছেলে মেয়ে, সংসারের সুখের মধ্যেই আমাদের সুখ খুঁজে নিই?"

__"সেটাই তো স্বাভাবিক গো।সবাই এরকম করে ভাববে না।"

__"তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসেনা।"

বন্হিদেবী হেসে মাথা রাখলেন তুষার বাবুর বুকে।এ তর্কে কোনোদিনই তুষার বাবুর কাছে জেতা যায় না।

___"আমাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। নিজে কেন এখনও এত সুন্দরী বল?"


বন্হি দেবী খিলখিল করে হেসে ওঠেন।

***********************


__"কিরে দাদা? এত দেরি হল? সিনেমায় যাওয়ার প্ল্যান আছে, ভুলে গেছিস? এমনিতেই কালকে থার্টিফার্স্ট। টিকিট পাওয়া যাবে তো দেরি করে গেলে?"

___"রাখ তোর সিনেমা। যা নাটক শুরু হয়েছে, সিনেমা হলে যেতে হবে না আর।"


বাজারের ব্যাগটা রান্নাঘরে ছুঁড়ে দিয়ে, টেবিলের উপরের জলের বোতলটা থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে হাঁফাতে থাকে বিনয়।


__"কি হয়েছে বলতো?"সুনন্দা এগিয়ে আসে।

__"বাজার যাওয়ার সময়, রমেন কাকুর সাথে দেখা। অভিষেক ক্লাবে আসছেনা কেন, জিজ্ঞেস করতে জানতে পারলাম, গতকাল ওনারা ফিরেছেন দীঘা থেকে। সপরিবারে ঘুরতে গিয়েছিলেন।"

__"এইটা রাগের কারণ?"

__"সব কথা না জেনে মাঝখানে কেন কথা বল?"

সুনন্দার ওপর ঝাঁঝিয়ে উঠল বিনয়।


___"রমেন কাকুরা ওখানেই বাবা-মা কে দেখেছে। সী-বীচে দাঁড়িয়ে... আমি বলতে পারছিনা। অভিষেক হোয়াটসঅ্যাপে ছবিটা সেন্ড করেছে। দেখে নে তোরা।"

___"কি অবস্থা! বাড়িতে তাহলে মিথ্যে কথা বলে..."

__"কি দরকার মিথ্যা বলার? আমরা কি আটকে দেব? ওনারা নিজেরা কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন না বলে? এই ছেলেমানুষীগুলোর কি খুব প্রয়োজন আছে?"


__"সুনন্দা, যেভাবে আমাকে বললেন রমেন কাকু, আমার নিজের খুব লজ্জা করেছে। জানিনা তোমাদের সামনে থাকলে ঠিক কেমন রিঅ্যাকশন হত। কিন্তু আমি খুব লজ্জিত।"

__"দেখ দাদা, আমরা কিন্তু সেই অর্থে বাবা-মাকে কিছু বলতে পারিনা। ওনারা ওনাদের মতন সময় কাটাতেই পারেন।"


__"বিতান,তোমার বাবার আর মায়ের বয়সটা খেয়াল আছে?এ বয়সটা সংসারে মনোনিবেশ করার জন্য।কচিদের মত প্রেম করার নয়।"

মাথা নিচু করে নিল বিতান...

___"তুমি যদি কিছু কথা না বলতে পারো তাহলে এবার আমি বলবো।বাড়িতে এমন অসভ্যতা চলবে না। ওইটুকু বাচ্চা কি শিখবে? রিন্টুর সামনেই ওনারা... ভালোয় ভালোয় বলছি ব্যবস্থা করো।"

__"চিৎকার করো না। বলেছি তো কথা বলবো।"

__"কসবার ফ্ল্যাটটা তো ফাঁকা পড়ে আছে? ওখানে চলে যেতে বল না। আমরাও একা থাকি। ওনারাও শান্তিতে থাক।"

__"সব সময়, সব কথার শেষে, নিজের মনের কথা জুড়ে দিও না সুনন্দা। বলেছি তো কথা বলবো।"

*********


ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, নিজের বলিরেখায় ভরা মুখটা দেখছিলেন বন্হিদেবী। কি এমন আছে এই চেহারায়? বয়সের ভারে শরীরটাও ভেঙে গেছে। আগাগোড়াই নিজেকে সুন্দর রাখার প্রচেষ্টা করে চলেছেন বন্হিদেবী। তবে বয়সের একটা ছাপ তো পড়বেই। কি করে যে এখনো এক মুখের প্রেমে পড়েন তুষার বাবু... হাতে পায়ে উইন্টার ক্রিম ঘষতে ঘষতে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন নিজের দিকে। সকালে বিতানের কথাগুলো বড় কানে বাজছে। বত্রিশটা বছর শুধু সংসার ধর্ম পালন করতেই, জীবনের অতি মূল্যবান যৌবন,অতিবাহিত হয়ে গেছে। তুষারবাবু ছুটে বেড়িয়েছেন ভবিষ্যৎ সামলাতে। বর্তমানকে জলাঞ্জলি দিয়ে।

সব দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি হয়তো পাওয়া যায় না। কিন্তু এই শেষ সময়ে এসে, দুজনে দুজনকে নতুন করে চিনতে চাওয়ার আকুতি তাঁরা প্রকাশ করেন, সেখানে কি সত্যিই কোন ভুল আছে?


__"কি ভাবছো অমন করে?"

চমক ভেঙে ফিরে তাকালেন বন্হি দেবী।

__"কিছু না।"

__"দাও, আমি মাখিয়ে দিচ্ছি।"

বন্হি দেবী মৃদু হেসে, উইন্টার ক্রিমের শিশিটা ধরিয়ে দেন তুষার বাবুর হাতে।

__"যে প্রেমের বন্হি জ্বালিয়েছো, তাতে তো কবেই এই তুষার মন গলে জল হয়ে বয়ে চলেছে। লোকের কথায় কান দিয়ে আর কি লাভ?"

তুষার বাবুর হাতের স্পর্শে শিঁউরে উঠলেন বন্হি দেবী। চোখ বন্ধ করে বললেন___

__"আমরা কি সত্যিই বাড়াবাড়ি করি?"

__"হয়তো করি।"

__আজও কি রিন্টু আমাদের সাথে শোবে?"

__"সুনন্দাদের একটু প্রাইভেসি দরকার। আর তাছাড়া রিন্টুবাবু আমাদের কাছে থাকলে ভালই তো লাগে তাইনা?"

তুষার বাবু,বন্হিদেবীর চিবুক ধরে মুখের কাছে নিয়ে এসে বললেন__

__"রিন্টু ঘুমিয়ে পড়লে, বছরের শেষ রাতটা আমরা জেগে কাটাব। কেমন? ওই বারান্দায়?বছরের নতুন সূর্যটা একসাথে দেখব।"


তুষার বাবুর ঠোঁটের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল বন্হিদেবীর অধর। আবেশে মিশে যাওয়ার আগে,হঠাৎ নিচে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজে দুজনেই ছুটে আসেন।


সুনন্দা রিন্টুকে ভীষণ বকছে। রিন্টুও কান্না জুড়েছে। বিতান আর বিনয় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। কিছু বুঝতে না পেরে, সুনন্দার হাত থেকে রিন্টুকে সরিয়ে নিয়ে নিজের কাছে আনলেন বন্হিদেবী।


__"কি হচ্ছে কি? এভাবে মারছো কেন?"

__"একদম একটাও কথা বলবেনা। ছেড়ে দাও ওকে।"

হ্যাঁচকা টানে রিন্টুকে কাছে টেনে, এক মারে সুনন্দা।

__"বারবার বারণ করেছি ওপরে যেতে। বারবার বারণ করেছি দাদু ঠাকুমার ঘরে ঢুকতে। কথা কানে ঢোকে না?"

__"কি হয়েছে কি?"ধমক দিয়ে উঠলেন তুষার বাবু।

কাঁদতে কাঁদতে বলল রিন্টু___

___"তুমি যে ঠাম্মিকে কিসি দিচ্ছিলে আমি তো সেটাই মামমামকে এসে বললাম।"


বন্হিদেবীর চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করলেন। তুষার বাবুও। পাথরের মতো দাড়িয়ে রইলেন দুজনে।


___"ভুলে যেওনা মা, আমরা একসাথে থাকি। একটু লাজলজ্জ্বার খেয়াল রাখতে হবে।"

রিন্টুকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে চলে গেল সুনন্দা।


__"তোমাদের সাথে এ বিষয়ে যে কথা বলতে হবে,ভাবতে পারিনি।"বিনয় বলে ওঠে___"আমরা তোমাদের এই আদিখ্যেতা দেখে মানুষ হতেই পারি। কোনদিনোই তোমরা লোকজন জ্ঞান করনি। এর জন্য আত্মীয়-স্বজন বহু মানুষই তোমাদের কথা শুনিয়েছে। তোমরা কোনদিনও কাউকে পাত্তা দাওনি। তা বলে একটা ছোট বাচ্চাকেও এভাবে নষ্ট করবে, এটাতো হতে দিতে পারিনা।"

__"বাড়িতে কিছু না বলে লুকিয়ে একসাথে বেড়াতে যাচ্ছ। যখন তখন রিন্টুর সামনে... আমার বলতে লজ্জা করছে। পাড়ার লোকেরা কত ব্যঙ্গ করে জানো?"বিতান চিৎকার করে বলে উঠলো।


তুষার বাবু নিরুত্তর। বহ্নি দেবী ঘরে চলে যেতে গেলে, বিতান বলে ওঠে___

__"দাঁড়াও মা। আমরা ঠিক করেছি, আমরা কসবার ফ্ল্যাটে চলে যাব। এমনিতেই আমাদের আরেকটু জায়গার দরকার। কসবার ফ্ল্যাটটা অনেকটা বড়। তাছাড়া নিচের গ্যারেজটায় একটা দোকান বানিয়ে নেওয়া যাবে। বহুদিন থেকেই তোমাদের বলছি। কোন ব্যবস্থা করছো না দেখে, আমাদেরই সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছে।"


বন্হিদেবী মাথা নিচু করে ওপরে চলে এলেন।

********************


__"তোমার মা বাবাকে ডাকো। আমি পারবো না রোজ রোজ ডেকে ডেকে খেতে দিতে। ডাকতে গেলেও আবার কি দৃশ্য দেখব তার নেই ঠিক।"


বিতান চেয়ার ছেড়ে উঠে সিঁড়ির কাছে যাওয়ার আগেই, বন্হিদেবী ও তুষার বাবু ট্রলিব্যাগ হাতে নিচে নেমে আসেন।


__"আবার কোথায় চললে?"

তুষার বাবু এগিয়ে এসে বিতানের হাতে একটা কোর্ট পেপার ধরিয়ে বললেন__

__"বহুদিন ধরেই ভাবছিলাম, সুযোগটা আজকে তোমরা করে দিলে। আমরা ভেবেছিলাম আমরা চলে গেলে হয়তো তোমরা কষ্ট পাবে। এই বাড়িটা আমি তোমাদের নামে লিখে দিলাম। সমান ভাগে ভাগ করা আছে। কসবার ফ্ল্যাটটা, আমি তোমার মাকে অ্যানিভার্সারি তে গিফট করেছিলাম। ওটা একান্তই তোমার মায়ের। ওখানে তোমাদের কোন অধিকার নেই।"


__"কি বলছো এসব?"

__"আমরা চলে যাচ্ছি।"

__"কোথায় যাচ্ছ?"

__"কসবার ফ্ল্যাটে।"

__"বাবা, তুমি নিজেদের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে, কি করছো এসব? আমরা তো সকালবেলা কথার কথা বললাম। ভেবেছিলাম নিজেদের ভুলটা তোমরা বুঝতে পারবে। তা না করে, তোমরা কী শুরু করলে?"

__"হ্যাঁ ঠিক বলছো। আমরা অন্যায় করেছি। তোমার মাকে ভালোবাসার আগে,আমাদের ব্যক্তিগত মূহুর্তে প্রবেশের আগে, আমার ঘরের দরজাটা বন্ধ করতে হতো। আমাদের একান্ত মুহূর্তটা আমাদের একান্তই রাখতে হত। তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।

রিন্টুর এতে কোন দোষ নেই।

কিন্তু,তোমার মায়ের কাছে আমার ভালোবাসা প্রকাশ করতে, না আমাকে বয়স বাধা দিতে পারে, না সমাজ, না আইন, না তোমরা..."


__"তারমানে তোমরা এই বয়সে এসে যা করছ, বেশ করছো?"সুনন্দা বলল।


__"কি করেছি আমরা? কি এমন করেছি?"বন্হিদেবী গলা তুললেন। তোমরা রিন্টুকে প্রায়ই আমাদের ঘরে পাঠিয়ে দাও। রাতে শোয়ার জন্য। সত্যি কথা বলতে, তাতে আমাদের কোন অসুবিধা নেই। তুমি কথা তুললে তাই বলছি, আমরা জানি তুমি কেন রিন্টুকে আমাদের ঘরে পাঠিয়ে দাও। আমরা তোমার সেই ভাবনার সম্মান করতে জানি। ভালোবাসার প্রকাশ করতে, বয়স, সমাজ, ছেলে মেয়ে, সংসার, এইসব দেখতে হয় বুঝি? তোমরা তো আজকালকার জেনারেশনের ছেলে মেয়ে। তোমাদের তো আরো আধুনিক হওয়ার কথা। ঠাকুমা দাদুকে প্রেম করতে দেখলে বুঝি গায়ে জ্বালা ধরে?"


সুনন্দা মাথা নিচু করে নেয়। বিনয় এগিয়ে এসে তুষার বাবুর হাত ধরে বলে__

__"বাবা এভাবে আমাদের ছেড়ে যেওনা, এটা কিন্তু..."


তুষার বাবু হাত তুলে থামান।


___"আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে, নিজের ভালোবাসার আগে পরে কিছু না দেখে, পরিবার ছেড়েছিলাম। আজও তাই করলাম। তবে হ্যাঁ,আমরা তো মা বাবা... তোমাদের সাথে যোগাযোগটা বন্ধ করতে পারবোনা। ভালোবাসাটাও কমাতে পারবোনা। শুধু সবারই একটু প্রাইভেসি দরকার। একটু স্পেস দরকার। ভালো থেকো..."


আবারও একটা কুয়াশাঘেরা রাত। নতুন বছরকে বরণ করে নিতে ব্যস্ত শহরের মাঝে, হারিয়ে গেল দুজোড়া চোখ। সাদাকালো জীবনটাকে একটু রঙ খুঁজে নিতে।

একটু নির্লজ্জ হতে।

রামধনুর খোঁজে...।।