Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

প্রথম-খেয়া-সেরা-সাহিত্য-সম্মাননা

শিরোনাম: #শূন্যকলমে: #অমৃতা_ব্যানার্জী 
সাল ১৯৯৮। এপ্রিল মাস। সময় রাত ন'টা।প্রায় দু'ঘন্টা ধরে কালবৈশাখী ও ভারী বৃষ্টির দাপটে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে মেদিনীপুর শহর। এখন প্রকৃতি শান্ত, তবে বিদ্যুৎ পরিষেবা বিচ্ছিন্ন। চারিদিকে কে…

 


শিরোনাম: #শূন্য

কলমে: #অমৃতা_ব্যানার্জী 


সাল ১৯৯৮। এপ্রিল মাস। সময় রাত ন'টা।

প্রায় দু'ঘন্টা ধরে কালবৈশাখী ও ভারী বৃষ্টির দাপটে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে মেদিনীপুর শহর। এখন প্রকৃতি শান্ত, তবে বিদ্যুৎ পরিষেবা বিচ্ছিন্ন। চারিদিকে কেমন থমথমে ভাব। 


গাড়িঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে স্কুটিতে স্টার্ট দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করছে প্রাঞ্জল। কিন্তু স্কুটি কোনমতেই স্টার্ট নিচ্ছে না। বিরক্তি মাখা স্বরে প্রাঞ্জল বলে 'গাড়িটাও আজকেই খারাপ হল! কখন পৌঁছব, কে জানে? রোজই কিছু না কিছু ঝামেলা। ভালো লাগে না।' 


স্কুটি গাড়িঘরে তুলে রেখে হেঁটে রওনা হওয়ার কথা ভাবে প্রাঞ্জল। তখনই বাড়িওয়ালা দোতলার বারান্দা থেকে ডাক দিয়ে জানান ডাঃ রঞ্জন ফোন করেছেন। টেলিফোন লাইন অক্ষত আছে ভেবে অবাক হয় প্রাঞ্জল। এই মুহূর্তে অন্য কারোর ফোন এলে সে এড়িয়ে যেত। কিন্তু ডাঃ রঞ্জনকে অবজ্ঞা করার কথা প্রাঞ্জল কল্পনাও করতে পারে না। অগত্যা ফোন ধরার জন্য বাড়ির ভিতর ঢুকতে বাধ্য হয় সে।


ডাঃ রঞ্জন জানান, আগামীকাল সকালে তিনি সস্ত্রীক মেদিনীপুর শহরে আসছেন। আনন্দ এবং চিন্তা - উভয়ই জন্ম নেয় প্রাঞ্জলের মনে। প্রিয়জনেদের সঙ্গ কে না চায়? কিন্তু তাদের আপ্যায়নে যদি কোন ত্রুটি থেকে যায়, তাহলে আফসোসের সীমা থাকে না। এমন জায়গায় কি আদৌ ডাঃ রঞ্জনের মতো মানুষের সঠিক যত্ন সম্ভব, ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়ে প্রাঞ্জল।


যানবাহনের আশা ছেড়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হয় প্রাঞ্জল। পৌঁছতে আধ ঘন্টা মতো সময় লাগবে।


চারিদিক নিঝুম। হঠাৎ যেন নিশুতি রাত নেমেছে মেদিনীপুরের বুকে। দু-একটা দোকানে টিমটিম করে জ্বলা মোমবাতি অথবা হ্যারিকেনের আলো জানান দিচ্ছে, এই শহরে এখনও প্রাণ অবশিষ্ট। রাস্তায় সেইভাবে জল জমেনি। তবে সেইরকম মানুষজন চোখে পড়ছে না। মাঝেমধ্যে একটা বাইক কিংবা একটা রিকশার হর্নের আওয়াজ নিস্তব্ধতার চাদরকে কিছুক্ষণের জন্য খানখান করে দিয়ে যাচ্ছে।


মাস দুয়েক হল মেদিনীপুর হাসপাতালে পোস্টিং পেয়েছে প্রাঞ্জল। তার মেডিকেল পাসের সমস্ত উৎসাহ উদ্দীপনা মেদিনীপুরে আসার কথা শুনেই নিভে গিয়েছিল। যে জায়গার কথা সে কেবল পাঠ্য বইয়ের পাতায় কিংবা খবরের কাগজের পাতায় পড়েছে, এইবার সেই অজপাড়াগাঁয়েই উপস্থিত হতে হবে! তবুও নতুন অনুসন্ধানের আশা বুকে ভরে প্রাঞ্জল এসেছিল মেদিনীপুরে। কিন্তু আসার পরে সে প্রতি মুহূর্তে বুঝছে কলকাতার অনেক মানুষজন মেদিনীপুরকে গ্রাম কেন বলে। এখানে জীবন বড্ড ধীর, শপিং মল নেই, স্ট্যান্ডার্ড রেস্টুরেন্টে নেই, নাইট লাইফ শূন্য। সবাই যেন দশটা-পাঁচটা চাকরি করেই সন্তুষ্ট। উপরন্তু মেদিনীপুরে প্রাঞ্জলের কোন বন্ধুও নেই। এই নির্বান্ধব পুরীতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। তবুও পেশার টানে এখানে থাকতে বাধ্য সে। তাছাড়া নতুন চাকরি, এখনই ট্রান্সফারের কথা বলা সম্ভব নয়। 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রাঞ্জল ভাবে, এ কোন ঘাটে এসে তার তরী ভিড়ল!


প্রাঞ্জলের নাইট ডিউটি চলছে। বৃষ্টির জন্য আজ পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে গেল। ওয়ার্ডে ঢুকে একবার সব পেশেন্টদের ওপর চোখ বুলিয়ে নার্সের কাছে সবার রিপোর্ট নিল সে। নাহ্, একটাও সিরিয়াস কেস নেই। 'ধুর, আবার সেই সারা রাত বসে মশা মার।' বিড়বিড় করে বলে বিরক্তি প্রকাশ করে প্রাঞ্জল। অবশ্য পর মুহূর্তে নিজেকেই ভর্ৎসনা করে সে। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য সে মানুষের কঠিন রোগ চাইছে! তার মানবিকতাবোধ বিবেকের ওপর আঘাত হানে। আসলে স্বল্প দিনের পেশায় এখনও মেধা প্রকাশের মতো চ্যালেঞ্জিং কেস একটাও পায়নি প্রাঞ্জল। 


নিজের চেয়ারে বসে প্রাঞ্জল। ডাঃ রঞ্জন বললেন ম্যাডামকে নিয়ে আগামীকাল আসছেন। ওনাদের মেদিনীপুরের প্রতি হঠাৎ এতো আগ্রহ কেন, তা ঠিক বুঝতে পারে না প্রাঞ্জল।


ঠিক এক সপ্তাহ আগে দুদিনের জন্য বাড়িতে গিয়েছিল প্রাঞ্জল। ডাঃ রঞ্জন তাকে নিজের বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছিলেন। মেডিকেল পড়ার সময় থেকে ডাঃ রঞ্জনের সঙ্গে প্রাঞ্জলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। রঞ্জনবাবু যেমন স্বনামধন্য ডাক্তার, তেমনই চমৎকার মানুষ। তাঁর স্ত্রী অরুন্ধতীও ভীষণ আন্তরিক এবং ফিজিক্সের গবেষক। নিঃসন্তান দম্পতি বিজ্ঞানের সাধনা এবং মানুষের সাহচর্যে আনন্দে জীবন কাটাচ্ছেন। 


কফি মগে চুমুক দিয়ে ডাঃ রঞ্জন বলেন 'মেদিনীপুর কেমন লাগছে প্রাঞ্জল?'


গরম কফি গিলে মেদিনীপুর সম্পর্কে নিজের সমস্ত বিতৃষ্ণা উগরে দেয় প্রাঞ্জল।


—- 'সব বিষয়ে এতো অধৈর্য হলে চলে না প্রাঞ্জল। প্রতিটি জায়গারই বিশেষত্ব আছে। সেখানকার পরিবেশ, মানুষজন সব কিছুর মধ্যে সন্ধান কর। দেখবে ঠিক নতুন উপাদান খুঁজে পাবে।'


কথার মাঝে এক কাপ কফি নিয়ে ডাঃ রঞ্জনের পাশে এসে বসেন অরুন্ধতী। প্রাঞ্জলের উদ্দেশে বলেন 'তাছাড়া মেদিনীপুর অগ্নিযুগের ইতিহাস বহন করে। স্বয়ং বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে কত মহান বিপ্লবী মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং নিজেদের মহান কর্মকাণ্ড দিয়ে বাংলাকে ধন্য করেছেন।'


মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে প্রাঞ্জল বলে 'কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম। আমি জানতাম আপনার সাবজেক্ট ফিজিক্স। আপনি হঠাৎ ইতিহাস নিয়ে এতো ইন্টারেস্টেড কেন?'


—- 'প্রতিটি বিষয় পরস্পরের সঙ্গে জড়িত প্রাঞ্জল। ইতিহাসের পর্যালোচনা ছাড়া বিজ্ঞানের উন্নতি সম্ভব নয়। আমাদের রিসেন্ট রিসার্চ অনুযায়ী, মেদিনীপুরের এমন অনেক ইতিহাস আছে, যা আজও অজানা। জানতে পারলে অনেক নতুন সৃষ্টি সম্ভব বলে আমার ধারণা।'


'তোমার ম্যাডামের সঙ্গে আমিও ভাবছি মেদিনীপুর যাব। ম্যাডামের রিসেন্ট রিসার্চ আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগে।' কফি শেষ করে বলেন ডাঃ রঞ্জন।


—- 'মোস্ট ওয়েলকাম স্যার।'


হাসপাতালের চেয়ারে বসে প্রাঞ্জল ভাবে, কী এমন অদ্ভুত বিষয়ের সন্ধান পেয়েছেন অরুন্ধতী ম্যাডাম এখানে?

**************************************************

এলোমেলো চিন্তার ফাঁকে কখন যে বাইরে আলো ফুটুছে খেয়াল হয়নি। হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো প্রাঞ্জল। একজনকে স্ট্রেচারে করে আনা হচ্ছে। ওয়ার্ড বয়ের মতে অবস্থা নাকি ভালো নয়। কৌতূহলবশত এগিয়ে যায় প্রাঞ্জল।


লোকটি অজ্ঞান। পোশাক ভিজে সপসপ করছে। তার উপর বালি মাখামাখি। মুখের চামড়ায় কুঁচকানো ভাব। তবে লোকটির বয়স বোধহয় বেশি নয়।


জিজ্ঞাসা করে প্রাঞ্জল জানতে পারে, যে জায়গায় কাঁসাই নদী থেকে বালি তোলা হচ্ছে, সেইখানেই লোকটিকে জ্ঞানশূন্য অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় প্রথম। জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় স্থানীয় মানুষ তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।


প্রাঞ্জল পরীক্ষা করে দেখে, লোকটির নাড়ী ধীরে চলছে। শ্বাসও দুর্বল। তবে ভয়ের বোধহয় কিছু নেই। লোকটি ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেনি বোধহয় বহুদিন। কিছু ওষুধ ও স্যালাইন লিখে দেয় প্রাঞ্জল। 


তবে প্রাঞ্জলের মনে একটা খটকা রয়ে যায়। স্টেথোস্কোপ দিয়ে লোকটিকে পরীক্ষা করার সময় তার পকেটে ওটা কি দেখল প্রাঞ্জল? পকেট ঘড়ি! কিন্তু এ'যুগে পকেট ঘড়ি… 


বেলা এগারোটা নাগাদ ডাঃ রঞ্জন ও অরুন্ধতী ম্যাডাম পৌঁছে যান। রান্নার মাসি মুরগির ঝোল, ভাত আর চাটনি রেঁধেছিলেন। মাসির রান্নার হাত অপূর্ব। তিন জনে জমিয়ে খেয়ে গল্পগুজব করছেন।


প্রাঞ্জল হঠাৎ হাসপাতালে দেখা লোকটির কথা ডাঃ রঞ্জন ও অরুন্ধতী ম্যাডামকে জানায়। অরুন্ধতী ম্যাডাম বলেন 'আমার কিন্তু বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে। যদি কোন সমস্যা না থাকে, তাহলে আমরা কি একবার ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারি? হয়তো আমার রিসার্চের জন্য কোন ক্লু পেয়ে যাব।'


—- 'সে আপনি যেতেই পারেন ম্যাডাম। তবে বিশেষ কোন লাভ হবে কিনা বলতে পারছি না। আমার মনে হয়, লোকটি হয়তো কোন‌ চোরাচালান গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। বালির‌ স্মাগলিং করে হয়তো। ঘড়িটাও কোনভাবে হাতিয়েছে।'


বিকেলবেলা ভিজিটিং আওয়ার্সে ডাঃ রঞ্জন ও অরুন্ধতী ম্যাডামকে নিয়ে হাসপাতালে যায় প্রাঞ্জল। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে, লোকাল থানায় লোকটির কথা জানানো হয়েছিল। কিন্তু এখনও কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে লোকটির জ্ঞান ফিরেছে। নার্স স্যুপ খাইয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লোকটি এমন সব কথা বলেছে যার অর্থ নার্স বুঝতে পারেনি।


ওয়ার্ডে গিয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে প্রাঞ্জল জিজ্ঞাসা করে 'কেমন বোধ করছেন?'


উত্তরে লোকটি বলে 'আমার দেশের লোকের কোন ক্ষতি করতে পারবে না তোমরা।' তার চোখ-মুখ দিয়ে ভয় ঝরে পড়ে।


শান্ত স্বরে অরুন্ধতী ম্যাডাম বলেন 'কে করবে আপনার দেশের লোকের ক্ষতি?'


ভয়ার্ত স্বরে লোকটি বলে 'এই যে তোমরা। আমি জানতে পেরেছি তোমাদের মতলব। গোপন কাগজে লেখা আছে, ১৯৪৪ সালের ৪ঠা মার্চ রাতে তোমরা বাংলার জনসাধারণের ওপর গোপনে আঘাত হানবে। কোন উপায়ে করবে তা অবশ্য জানি না। কিন্তু আর কত অত্যাচার করবে? খুব দ্রুত শেষ হবে তোমরা।' কথা শেষ করে লোকটি জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।


প্রাঞ্জল বলে '১৯৪৪ সাল! আপনার নিশ্চয়ই কোন ভুল হচ্ছে। এখন তো ১৯৯৮ সাল চলছে। তাছাড়া আমরা তো সাধারণ ভারতীয়। কার ক্ষতি করব!' গলার স্বর রুক্ষ করে প্রাঞ্জল আবার বলে 'আপনার আসল মতলব কী বলুন তো? কে আপনি? এইসব উল্টোপাল্টা কথা বলে কী আড়াল করতে চাইছেন?'


লোকটা উদ্ভ্রান্তের মতো বলে '১৯৯৮! কেমন করে সম্ভব? তবে আমার বয়স এখন চুরাশি! এই তো গত রাতে আমি…'


প্রাঞ্জলের মনে হয় লোকটি ভাঁওতাবাজি করছে। কারণ তাকে দেখলে চুরাশি বছর বয়স কখনোই মনে হয় না। শরীরে ধকল স্পষ্ট অবশ্যই। তবে বয়স আটত্রিশ-ঊনচল্লিশের বেশি হওয়া অসম্ভব। কড়া স্বরে প্রাঞ্জল বলে 'কী ভুলভাল বলছেন?'


'শান্ত হও প্রাঞ্জল। ওনাকে কথা সম্পূর্ণ করতে দেওয়া উচিত।' বলেন অরুন্ধতী।


ততক্ষণে লোকটির বেড ঘিরে জটলা জমতে শুরু করেছে।


'আপনি আমাদের সব কথা খুলে বলুন।' বললেন অরুন্ধতী।


সাল ১৯৪৪। বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে দিকে দিকে। অক্ষ শক্তি ও মিত্র শক্তি র পক্ষ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত বিশ্ব কলঙ্কিত করছে মানব সভ্যতাকে। এমন ধ্বংসলীলার মাঝে মেদিনীপুর শহরের একটি ছোট বাড়ির শোয়ার ঘরে বসে আছেন প্রফেসর অভয়চন্দ্র মজুমদার। তাঁকে দেখে শান্ত মনে হলেও ভিতরে ভিতরে তিনি অত্যন্ত অস্থির। সন্ধে নামছে। বাড়ছে প্রফেসরের উদ্বেগ। টেবিলে রাখা এক গ্লাস জল ঢকঢক করে খেয়ে তিনি আরেকবার কাগজগুলোর উপর নজর বুলিয়ে নিচ্ছেন।


রসায়নের মেধাবী ছাত্র অভয়চন্দ্র বিদেশে লেখাপড়া শেষ করার পর কেবল দেশমাতার টানে মোটা অংকের চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখান করে দেশে ফিরে এসেছেন। বর্তমানে তিনি মেদিনীপুরে অধ্যাপনা করেন এবং গোপনে চালান নিজের গবেষণা। বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে তিনি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।


অভয়চন্দ্র বেশ কিছু সময় ধরে গবেষণা করে একটি ওষুধ আবিষ্কার করেছেন, যা অপটিক নার্ভ ক্ষীণ হয়ে আসা রোগীদের চোখের দৃষ্টি পূর্ণ রূপে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম। তবে বাজারে এই ওষুধ ছাড়ার আগে প্রয়োজন আরো কিছু পরীক্ষা। ব্রিটিশের অত্যাচারে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা বিপ্লবীদের চোখে নতুন করে আগুন জ্বালার স্বপ্ন দেখেন অভয়চন্দ্র। তবে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন। এই ওষুধের অতিরিক্ত প্রয়োগ সুস্থ মানুষের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নিতে পারে। 


অধ্যক্ষ উইলিয়াম অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং ভারতীয়দের ঘৃণা করেন। অভয়চন্দ্রের ভয় উইলিয়াম বোধহয় তাঁর গোপন গবেষণা সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনে ফেলেছেন। হয়তো চরও লাগিয়েছেন তাঁর পেছনে। উইলিয়ামের হাতে এই ওষুধের ফর্মুলা পড়লে সর্বনাশ হয়ে যাবে। পৈশাচিক আনন্দ উপভোগের জন্য তিনি নিরপরাধ ভারতীয়দের ওপর ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ করবেন।


গবেষণার কাগজপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অভয়চন্দ্র। যেভাবেই হোক আগামীকাল সকালের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছতেই হবে। কলকাতার একটি ল্যাবরেটরিতে অভয়চন্দ্রের বিশিষ্ট বন্ধু কাজ করে। তার কাছে সমস্ত নথি পৌঁছে না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই। তাছাড়া ভাগ্যক্রমে উইলিয়ামের ফাইলে অভয়চন্দ্রর চোখ পড়েছিল। ৪ঠা মার্চ কোন বড় ধরণের ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা করছে ব্রিটিশ সরকার তলে তলে। যেভাবেই হোক বিপ্লবী ভাইদের কাছে খবরটা পৌঁছে দিতে হবে। 


রাত ন'টার পর গলিপথ ধরে রওনা হন অভয়চন্দ্র। আজ রাতে মেদিনীপুর থেকে কলকাতা যাওয়ার ট্রেন নেই। যেভাবে হোক জলপথে কোলাঘাট পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে রহমানের গাড়ি নিয়ে কলকাতা যাওয়া যাবে। রহমান ধনীর সন্তান এবং অভয়চন্দ্রদের সংগঠনের সদস্য। 


কংসাবতীর তীরে পৌঁছে অভয়চন্দ্র দেখেন দাশরথি নৌকা নিয়ে হাজির। সমস্ত প্রয়োজনে এইভাবেই দাশরথিকে সঙ্গী রূপে পান অভয়চন্দ্র। দাশরথির মতো সুনিপুণ হাতে দাঁড় বাইতে খুব কম মাঝিই পারে।


ফাল্গুন মাস চলছে। সদ্য শীত পেরিয়েছে। নদীতে জলের পরিমাণ কম। পাড়ের চড়া ধরে নৌকার দিকে এগোন অভয়চন্দ্র। হঠাৎ তাঁর পা একটা গর্তে পড়ে। অস্বাভাবিক শক্তি দিয়ে কেউ যেন অভয়চন্দ্রকে ক্রমশ নীচের দিকে টানতে থাকে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। দাশরথি ছুটে আসার আগেই অতল গহ্বরে তলিয়ে যান অভয়চন্দ্র।


অরুন্ধতী বলেন 'তারপর?'


অভয়চন্দ্র বলেন 'আমি নদীর গভীরে তলিয়ে যাই। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আমার শ্বাসকষ্ট হয় না। একটি নির্দিষ্ট গভীরতায় পৌঁছনোর পর আমার দেহ সমান্তরাল ভাবে বইতে শুরু করে। শুধু হাত-পা নাড়ানোর ক্ষমতা লোপ পায়। আরেকটি বিষয়, আমি অতল জলে থেকেও কোন জলজ জীবের দেখা পাইনি। চারদিকে শুধু অথৈ জল। তারপর হঠাৎ একসময় আমার শরীরের সঙ্গে কিছুর ধাক্কা লাগে। জ্ঞান হারাই আমি। চোখ খুলে দেখি আপনাদের এই হাসপাতালে শুয়ে আছি।'


হাসপাতালের ওয়ার্ড জুড়ে পিন পতনের নিস্তব্ধতা। সকলে একাগ্র চিত্তে শুনছেন রোমহর্ষক কাহিনী। কিছুক্ষণ পরে অভয়চন্দ্রর কথার সত্যতা নিয়ে শুরু হয় জল্পনা। অরুন্ধতী ম্যাডাম সবাইকে শান্ত করিয়ে দৃঢ় স্বরে বলেন 'আমার মতে ওনার কথা সত্য।'


ডাঃ রঞ্জন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন 'প্লিজ এক্সপ্লেন কর।'


—- 'আমার মতে, প্রফেসর অভয়চন্দ্র ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে সময়ের ফাঁকে পড়ে গিয়েছিলেন।'


'ম্যাডাম ওয়ার্মহোল, সময়ের ফাঁক - এইসব তো সাধারণত সায়েন্স ফিকশন মুভিতে দেখা যায়। বাস্তবে… আমার তো মনে হল উনি চোরাবালিতে পড়েছিলেন।' বলে প্রাঞ্জল।


—- 'এই জগতে কিছুই অসম্ভব নয় প্রাঞ্জল। স্বয়ং আইনস্টাইন ওয়ার্মহোলের প্রবক্তা। আমার রিসেন্ট রিসার্চও ওয়ার্মহোল এবং টাইম ক্র্যাকের ওপর। আমাদের টিমের ধারণা, মেদিনীপুরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা কাঁসাইয়ে যে বহুল পরিমাণ চোরাবালি আছে, তাদের মধ্যে কিছু চোরাবালি ওয়ার্মহোলের একটি প্রান্ত। এতে একবার পা পড়লে মানুষ সময়ের ফাঁকে পড়ে যায়। প্রফেসর অভয়চন্দ্রর সঙ্গেও তাই ঘটেছে। হঠাৎ আবার তিনি ওয়ার্মহোলের অপর প্রান্তে পৌঁছে বর্তমান সময়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। সময়ের ফাঁকে ছিলেন বলেই উনি কোন জলজ জীবের দেখা পাননি।'


—- 'কিন্তু ওনাকে দেখে চুরাশি বছরের বৃদ্ধ কেন মনে হচ্ছে না?'


—- 'সময়ের ফাঁকে পড়লে আর সময়ের হিসেব সম্ভব নয়। দেহের জৈবিক চাহিদা এবং গতি স্তব্ধ হয়ে যায়। তাই বয়সের বৃদ্ধি হয় না।'


ক্লান্ত স্বরে অভয়চন্দ্র জিজ্ঞাসা করেন 'ভারতবর্ষের এখন কী অবস্থা?'


'ভারত এখন স্বাধীন দেশ মিঃ অভয়চন্দ্র। গত বছর আমরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উদযাপন করেছি। ওয়েলকাম টু ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইন্ডিয়া প্রফেসর।' করমর্দনের জন্য অভয়চন্দ্র দিকে হাত এগিয়ে দেন ডাঃ রঞ্জন।


সাল ২০০০। এপ্রিল মাস। 

বিকেলবেলা ডাঃ রঞ্জনের বাড়ির ব্যালকনিতে মুখোমুখি বসে আছেন অরুন্ধতী ম্যাডাম ও প্রফেসর অভয়চন্দ্র। অরুন্ধতী ম্যাডাম একটা জার্নাল নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন 'সরণ শূন্য।'


অভয়চন্দ্র বলেন 'কিছু বলছেন ম্যাডাম?'


—- 'ফিজিক্সের ভাষায়, কোন ব্যক্তি বা বস্তু যদি যাত্রা শুরুর স্থানে ফিরে আসে, তাহলে তার সরণ শূন্য হয়। আপনি ভারতবর্ষ থেকে সময়ের ফাঁকে পড়ে আবার ভারতবর্ষেই ফিরে এলেন। আপনার সরণ তো শূন্য হল।'


—- 'কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয় ম্যাডাম। আমি পরাধীন ভারতবর্ষ থেকে যাত্রা শুরু করে স্বাধীন ভারতে এসে পৌঁছেছি। তবে আমার প্রাপ্তির ঝুলি শূন্য।'


—- 'কেন বলুন তো?'


—- 'আপনিও উত্তরটা জানেন ম্যাডাম।'


সুস্থ হওয়ার পরে অভয়চন্দ্রকে নিজেদের সঙ্গে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন ডাঃ রঞ্জন ও অরুন্ধতী ম্যাডাম। বিভিন্ন ভাবে যাচাই করার পর ওনারা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে অভয়চন্দ্র সত্যি কথা বলছেন। তারপর ওনারা সরকার এবং সংবাদমাধ্যমকে সমস্ত ঘটনা জানান। অত্যাশ্চর্য খবর পেয়ে ডাঃ রঞ্জনের বাড়িতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ঢল নামে। নানান পত্রপত্রিকায় তাঁকে নিয়ে লেখা হয়। অনেকেই অভয়চন্দ্রকে মিথ্যাবাদী প্রমাণের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। অরুন্ধতী ম্যাডামের গবেষণার ওপর প্রশ্ন তোলে সমাজ। প্রতারণার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোক এসে অভয়চন্দ্রকে তাদের দলে যোগদানের প্রস্তাব দেয়। সঙ্গে এও বলা হয় যে, অভয়চন্দ্র তাদের দলে যোগদান করলে অরুন্ধতী ম্যাডামের ওপর থেকে সমস্ত অভিযোগ তুলে নেওয়া হবে। প্রফেসর অভয়চন্দ্র নিজের সত্যতা প্রমাণের জন্য যুগান্তকারী ওষুধের ফর্মুলা লিখে অ্যাপ্রুভালের জন্য জমা করেন। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে হারিয়ে যায় তাঁর জমা করা সমস্ত নথি। 


স্তম্ভিত হন অভয়চন্দ্র। ১৯৪৪ সালে এমন স্বাধীন দেশের কল্পনা কি তিনি করেছিলেন!


অস্তমিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে অভয়চন্দ্র বলেন 'আমি সময়ের ফাঁকেই বেশ ছিলাম ম্যাডাম। এই আঘাটায় আমার তরী ভিড়ল কেন?'


(কংসাবতী নদীর যে অংশ মেদিনীপুর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে, তার তলায় প্রচুর চোরাবালি আছে। নয়ের দশকের শেষের দিকে কাঁসাই নদীতে একটি কাঠের নৌকা ভেসে উঠেছিল। পরীক্ষা করে জানা গিয়েছিল নৌকাটি স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ের। কিন্তু এতো বছর জলের মধ্যে থেকেও কাঠের বিন্দুমাত্র ক্ষতিও হয়নি। এই দুই বিষয়কে মাথায় রেখে একটি কল্পনাপ্রসূত কাহিনী লেখার চেষ্টা করেছি।)