বিষয় -- গল্প.
"কুমারী মায়ের কপালে সিঁদুর"
নবজীবন ছত্রধর০৩/০৪/22---------------------------------------------------------এক বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে আজকের গল্প.আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।
°°°°°°°°°°°°°```````````````…
বিষয় -- গল্প.
"কুমারী মায়ের কপালে সিঁদুর"
নবজীবন ছত্রধর
০৩/০৪/22
---------------------------------------------------------
এক বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে আজকের গল্প.
আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।
°°°°°°°°°°°°°````````````````````````°°°°°°°°°°°°°°°
ঠিক সন্ধ্যার দিকে পশ্চিম আকাশের কালো মেঘটা হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার সৃষ্টি করে বজ্র বিদ্যুৎসহ প্রবল বর্ষণের সূচনা করলো। প্রচন্ড জোরে দমকা হাওয়ার কারনে গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ছে, ঘন ঘন বজ্র নিনাদে প্রকম্পিত হচ্ছে মেদিনী।
ঠিক এই বর্ষণমুখর পরিমন্ডলকে উপেক্ষা করে ঘনান্ধকার ভেদ করে মানসী গ্রামের মেঠো পথ ধরে ছুটে চলেছে ভরা কটালযুক্ত গঙ্গার দিকে।
আজ সে মনস্থির করেছে....
নিজের এই কলঙ্কিত দেহটাকে গঙ্গার জলে বিসর্জন দেবে। আজ তার কাছে এই সমাজে বেঁচে থাকাটাই যেন বড় অস্বস্তির কারণ।
আজ থেকে মাত্র ছ-মাস আগে মামার বাড়িতে গিয়ে মানসীর সাথে পরিচয় হয় সঞ্জয় নামে এক সুন্দর যুবকের সাথে। তারপর থেকে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত সঞ্জয় মানসীর সাথে চলতে থাকে সুন্দর আবেগঘন প্রেমের এক স্পর্শকাতর পরিস্থিতির পরিমন্ডল।
--সঞ্জয় দা আমি যে আমার মন প্রাণ দিয়ে তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিগো। কখনো ভুলে....
কথাটা শেষ করতে দিল না সঞ্জয়,ডান হাত দিয়ে মানসীর মুখটা আলতো চেপে আদর করে তাকে কোলের মধ্যে আপন করে নিয়ে বলল...
---ছি: মানসী ওকথা বলতে নেই, আমি তোমাকে কোনদিন ভুলে যাব না গো। তুমি যে আমার হৃদয়ের ময়ূরাক্ষী।
এই কথা বলতে বলতে সঞ্জয় মানসীকে আরো আপন করে কাছে টেনে নিয়ে তার দুটো কম্পিত ওষ্ঠে নিজের দুটো ওষ্ঠ আলতো করে স্পর্শ করতেই মানসীর সর্ব শরীরে সৃষ্টি হলো এক অজানা আকুতি। শিরা উপশিরা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক অভূতপূর্ব আনন্দানুভূতির শিহরণ।
এমন তো কোনদিন হয়নি। আজ সঞ্জয়ের পরশের এক গভীর অনুভূতি মানসীকে পাগল করে দিল। সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না, সঞ্জয়ের কাছে আজ উজাড় করে উন্মুক্ত করে দিল সবকিছু। সঞ্জয় এমনি এক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল।
আলো আঁধারির এক সুন্দর নির্জন সন্ধ্যায় খেলার মাঠের পুকুরপাড়ে এক আবেগঘন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের
সাক্ষী থাকলো পশ্চিম আকাশে জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকা সন্ধ্যা তারা।
এক মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল নারীর জীবনের সব থেকে শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মানসী ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে, আবেগ বশত: সে কি করে বসলো।
--কষ্ট পেয়ো না মানসী সারাজীবন আমি তোমাকে আমার করে কাছে রাখবো। তোমাকে দেব আমার সব ভালবাসা।
মানসীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সঞ্জয় কথাগুলো বললো।
আর মানসী,সঞ্জয়ের বুকে মাথা রেখে বললো...
-- কোনদিন আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিও না সঞ্জয় দা।
---আরে না না একি কথা তা কোনদিন হয় নাকি পাগলী। আমি যে তোমার প্রেমে পাগল।
সেদিনের কথা শুনে মানসী মনে মনে সঞ্জয়কে তার মনের মানুষ হিসেবে পেয়ে খুব খুশী ও গর্বিত হলো। কিন্তু বিয়ের আগে ওদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্ক কাল রাহুর মতো মানসীকে গ্রাস করলো।
দুই মাস পরে মানসী বুঝতে পারলো তার গর্ভ সঞ্চার হয়েছে। সে মা হতে চলেছে। আনন্দের শিহরণে ভাসতে লাগলো সে। মহানন্দে ছুটে গেলো সঞ্জয়ের কাছে আনন্দের খবরটা দিতে।
সঞ্জয় প্রথম কথাটা শুনে চমকে উঠলো, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো...
-- কি দারুণ খবর নিয়ে এসেছো মানসী প্রিয়া মোর। উফ আজ কি আনন্দ হচ্ছে আমার, আমাদের দুজনের ভালোবাসার ফসল আজ তোমার গর্ভে।
মানসীকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ভালোবাসার আদরে ভরিয়ে দিতে লাগলো এক কপট মায়াজালে। মানসী তখনো পর্যন্ত বুঝতে পারেনি তার ভাগ্যকাশে নেমে আসছে অমানিশার অন্ধকার।
-- আমি আর তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না সঞ্জয়দা।
-- আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি সামনের বৈশাখে তোমাকে বিয়ে করে আমার ঘরে নিয়ে যাবো প্রিয়া।
সেদিন আনন্দ মনে মানসী ফিরে আসে তার ঘরে।
কিন্তু তারপর কেটে গেলো কয়েকটা মাস,সঞ্জয়ের কোনো খবর নেই, ফোনটা সবসময় বিজি। মানসী ভেঙ্গে পড়ছে, এদিকে তার শারীরিক পরিবর্তন দেখলো পরিবারের সবাই, সৎ মায়ের সংসারে মানসীর উপর শুরু হলো অকথ্য অত্যাচার।
পরিবারের থেকে যখন এমনি ঘৃণা অবজ্ঞা অত্যাচার চলছে ঠিক সেই মুহূর্তে মানসীর ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো....
--আমি বর্তমান উড়িষ্যায় চলে এসেছি, এখানে একটা কোম্পানির চাকরিও করছি, আর সবথেকে বড় কথা হলো আমি এখানে রূপসী নামের একটা মেয়েকে বিয়ে করেছি। তোমার থেকে রূপে ও ব্যাবহারে বহুগুনে ভালো। আমি আর দেশে ফিরবো না, সুতরাং আমার জন্য তুমি অপেক্ষা করো না। পারলে ক্ষমা করে দিও।
সঞ্জয়ের দেওয়া ম্যাসেজ টা পড়ে মানসী বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো, তার মাথায় যেন আকাশটা ভেঙ্গে পড়লো। সে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করলো, সমাজের চোখে আজ সে ব্যাভিচারিনী কলঙ্কিনী।
না এ জীবন সে আজ আর রাখবে না।
তাই এই কালবৈশাখীর ঝড় বৃষ্টির রাতে মানসী ছুটে চলেছে খরস্রোতা গঙ্গার দিকে। আর সে এই পৃথিবীতে কাউকে মুখ দেখাবে না।
প্রবল স্রোত বহে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে জল পাক খেতে খেতে গভীরে চলে যাচ্ছে।
হাত জড়ো অবস্থায় চোখ বন্ধ করে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে প্রণাম সুসমাপন করে যেই জলে ঝাঁপ দিতে যাবে এমনি সময়ে পেছন থেকে মানসীর কাপড়ের আঁচল ধরে কেউ সজোরে টেনে ধরলো।
মানসী আচমকা বাধা পেয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো "কালো ভল্লুক" কে!
না না এ কোনো জন্তু জানোয়ার নয়,এ হচ্ছে মানুষ,
নামটা তার 'সংকটমোচন'।
যে ছেলেটাকে পুরো স্কুল জীবনে মানসী ঘৃণার থুৎকারে বারে বারে লাঞ্চিত অপমানিত করেছে, এমন কি ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিলো বলে মানসী তার গালে মেরেছিলো সপাটে এক চড়,আর বন্ধুদের জড় করে মাথার মাঝখানে চুল কেটে চুন লেপন করে কালো পোশাক পরিয়ে কোমরে দড়ি দিয়ে স্কুলের খেলার মাঠের চারিদিকে ঘোরানো হয়েছিল। কালো ভল্লুক, কালো ভল্লুক বলে সবাই চিৎকার করছিলো। তখন হাত জড়ো করে কাঁদতে কাঁদতে ও সবাইকে বলেছিলো....
---আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও, আর কখনো কোনো মেয়েকে প্রেমের কথা বলবো না।
না কেউ তাকে ছাড়ে নি, সবাই তাকে অপমান করতে করতে নানা কটু কথাও বলেছে। সেদিন থেকে সংকটমোচন আর স্কুলের দোয়ার মুখ দেখে নি। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগের ঘটনা। কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিলো সে কেউ তার খোঁজ রাখেনি।
সেদিন সংকটমোচনকে কি ভাবে অকথ্য অত্যাচার করা হয়েছিল তা মৃত্যু পথযাত্রী মানসী আজ নিজেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মনে মনে আজ সে নিজেকে অপরাধী ভাবছে, সেদিন ও যদি এমন না করতো আজ সংকটমোচানের এমন হাল হতো না।
যাইহোক ত্রাতার ভূমিকায় সংকটমোচানকে দেখে মানসী বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো, কি করবে সে, কি তার করা উচিৎ।
মানসীকে কিছুই বলতে হোলো না, সংকটমোচন বললো....
--মা হয়ে তুমি ছেলের মৃত্যু কামনা করো কি করে, তোমার গর্ভের সন্তানের কি দোষ? অকালে ওর প্রাণ নাশ করা দণ্ডনীয় অপরাধ।
---আসলে আমার গর্ভের সন্তানটি..!
--জানি, আমি সব জানি,ওটা সঞ্জয় আর তোমার সন্তান।
--কিন্তু!
--সে তোমাকে ফেলে বিদেশে পালিয়েছে।
মানসী ওর কথা গুলো শুনে অবাক হচ্ছিলো, যাকে সেদিন সে এত অপমান করলো, লাঞ্ছনা গঞ্জনা দিলো তারপরেও সে তার খবর রেখেছে, কিন্তু কেন?
--কেন মৃত্যুর হাত থেকে আমাকে বাঁচালে তুমি.?
কিন্তু সংকট মোচন তাকে বুঝিয়ে দিলো সে মানসীকে বাঁচাতে আসে নি, সে বাঁচাতে এসেছিলো তার গর্ভের সন্তানটিকে।
--সে তো ভালো কথা কিন্তু এই সন্তানটি কার পরিচয়ে সমাজে বসবাস করবে, কে দেবে তার বাবার পরিচয়?
সহাস্য বদনে শান্ত নম্রভাবে সংকটমোচন গর্ভজাত সন্তানটির বাবার পরিচয় দিতে রাজি হোলো।
কিন্তু এ যে বড় কঠিন কাজ, কি করে এই সমাজে মানসী সন্তান জন্ম দেওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকবে, কি পরিচয়ে?
সংকটমোচন নিঃসঙ্কোচে বললো...
-- যদি তোমার কোনো অসুবিধা না হয় তবে শুধু তোমার সাথে আমি স্বামীর অভিনয়টা করে যেতে পারি হয়তো কিন্তু কারুর প্রকৃত স্বামী হতে পারি না।
--কেন পারো না সংকট?
--আমি যে কালো কুৎসিত,আমার না আছে চেহারা না আছে রূপ, তাই তো কেউ আমাকে পছন্দ করে না আর করবেও না।
---যদি আমি তোমাকে পছন্দ করি।
--কি বলছো তুমি মানসী! আবার তুমি আমাকে...
--না সেদিনের তোমার মতো হৃদয়বান মানুষকে চিনতে না পেরে আমি ঠকে গেছি, আর দ্বিতীয়বার আমি আর ঠকতে চাই না গো সংকটমোচন।
মানসীর চোখের জল ঝর ঝর করে ঝরতে রইলো।
সংকট মোচন মানসীর কাছে গিয়ে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললো...
---ভয় নেই সারাজীবন আমি তোমার পাশে থাকবো মানসী,স্ত্রীর মর্যাদায় না হোক বন্ধুর মর্যাদা দিয়ে তোমাকে আমি আগলে রাখবো।
---আমাকে তুমি স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবে না?! ও বুঝেছি আমার গর্ভে অপরের সন্তান। সন্তানের বাবা হওয়া যায় কিন্তু সন্তানের মাকে বৌ বানানো যায় না।
-- মানসী তোমাকে ভালোবাসি বলে আজও পর্যন্ত তোমার সব খোঁজ খবর আমি রেখেছি, তোমাকে ভালোবাসি বলে তোমাকে অনুসরণ করে ছুটে এসেছি এই নদী বক্ষে,আসলে কেন জানি না তোমাকে আমি আমার জীবন দিয়ে ভালোবাসি।
--ওগো দেবতা আমার, আমি যে তোমাকে চিনতে ভুল করেছি গো, ক্ষমা করো তুমি ক্ষমা করো প্রভু।
মানসী কাঁদতে কাঁদতে সংকটের পায়ে আছড়ে পড়লো।
সংকট দুহাত দিয়ে মানসীকে মাটি থেকে তুলে নিজের বক্ষে স্থান দিলো, আর মানসীর সব চিন্তার অবসান ঘটাতে গঙ্গা বক্ষের পবিত্র মাটি নিয়ে শ্রী শ্রী মাতা গঙ্গা দেবী ও আকাশের চন্দ্রকে সাক্ষী রেখে বলে উঠলো...
-- নেই কোনো শঙ্খধ্বনি, নেই কোনো উলুধ্বনি,নেই বিবাহ বাসর, এই নির্জন নদী বক্ষে মা গঙ্গা ও আকাশের চন্দ্রকে সাক্ষী রেখে কুমারী মায়ের সাদা সিঁথিতে পবিত্র গঙ্গা মাটির সিঁদুর রাঙিয়ে দিয়ে তোমাকে আমি আমার স্ত্রী রূপে বরণ করে নিলাম মানসী।
মানসী অবাক দৃষ্টিতে ঝড় বৃষ্টি থেমে যাওয়া আকাশের চাঁদের হালকা আলোতে সংকটের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকে, আর পরম স্নেহে মানসীর ভিজে যাওয়া কেশ রাশিতে হাত বুলিয়ে দিয়ে গেয়ে উঠলো...
"আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী
তুমি থাকো গঙ্গা (সিন্ধু)পারে ওগো বিদেশিনী"......
সমাপ্ত